খেলাফত মজলিস: রাজনৈতিক দর্শন। – মুফতি ওযায়ের অামীন

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জুন ১৮ ২০১৮, ১৮:৪৩

একুশে জার্নাল: রাষ্ট্রচিন্তা ও রাজনীতি মানবজীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। মনুষ্যসমাজের সুশৃঙ্খল রূপায়ন রাজনীতি ছাড়া কল্পনাও করা যায় না। ব্যাক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রের সুরক্ষা, বিভিন্ন শ্রেণী জাতি ও গুষ্ঠির টিকে থাকা, মানবিকতার বিকাশ ও মানবাধীকার প্রতিষ্ঠা রাজনীতি ছাড়া একেবারেই অসম্ভব।

রাজনীতিতে সুনীতি ও দুর্নীতি:
রাজনীতিতে সুনীতির প্রতিফলন হলে সুন্দর শান্তিময় সমাজ কায়েম হবে। রাজনীতি থেকে সুনীতির তিরোধান হলে পশুবাদ কায়েম হবে। ‘দুর্বল মেরে সবল বাঁচো’ নীতি প্রতিষ্ঠা পাবে। সে যাই হোক রাজনীতি অপরিহার্য। রাজনীতি ছাড়া মানবজীবন ও মনুষ্যসমাজ কল্পনাতীত।
সুনীতি ও সুবিচার হবে কল্যাণমূখী রাজনীতির যথাযথ প্রয়োগের ফলে। দুর্নীতি ও অবিচার হবে তাও এ রাজনীতির অপপ্রয়োগের ফলে।

প্রকৃত রাজনীতি:
প্রকৃত রাজনীতি যা মানুষের কল্যাণে হয়। এটা একটা মহৎ বিষয়। কিন্তু অপরাজনীতির বিজয়োল্লাসের কারনে অনেকে রাজনীতি পছন্দ করেন না। তারা মনে করেন রাজনীতি করা ভাল মানুষের কাজ নয়। বিশেষত: ধার্মিক শ্রেণীর মানুষ রাজনীতির প্রতি বিতশ্রদ্ধ। তাদের কাছে রাজনীতি একেবারেই অপছন্দ। বরং রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িতদের প্রতি খারাপ ধারণাও পোষণ করেন।

ইসলামে রাজনীতি:
ইসলাম এ ধারণাকে মোটেও সমর্থন করে না। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তা ইসলাম ধর্মের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রয়োগ ছাড়া ইসলাম পূর্ণাঙ্গতা পায় না। কোন মুসলমানের অপরাজনীতির কারণে ইসলামী রাজনীতিকে অপছন্দ করা বা অস্বীকার করা ইসলাম ধর্মকে অপূর্ণাঙ্গ ধারণা করার শামিল। আর কোন মুসলমান ইসলামকে অপূর্ণাঙ্গ ধারণা করতে পারে না।

রাসূলুল্লাহ সা. -এর রাজনীতি:
ইসলামী রাজনীতির ধরন নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু ইসলামে রাজনীতি নেই, একথা শুধু মূর্খ এবং জ্ঞান-পাপীরাই বলতে পারে। ইসলাম ধর্মের নবী বিশ্বনবী মুহাম্মদ সা. নিজে একজন রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। মহানবী সা.-এর একান্ত চার সহচর, ইসলামের প্রধান চার খলিফা আবু বকর রা. ওমর রা. উসমান রা. এবং আলী রা. সবাই রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। তাদের শাসন ব্যবস্থা ইতিহাসে সোনালি যুগ হিসেবে খ্যাতিলাভ করেছিল।

মুসলমানদের রাজনৈতিক পতন:
পরবর্তীতে কিছুটা ত্রুটিপূর্ণ হলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বে ইসলামী খেলাফত ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মুসলিম দুনিয়া তাদের গৌরবের খেলাফত ব্যবস্থা হারিয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি হারিয়েছে। বেশির ভাগ মুসলিম দেশকে ঔপনিবেশিক আগ্রাসী শক্তি গ্রাস করে নিয়েছিল।

মুসলিম উম্মাহ: রাজনৈতিক দৈন্যদশা-
বর্তমানে বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে বিভিন্ন ধরনের শাসন ব্যবস্থা চলছে। কোথাও রাজতন্ত্র, কোথাও সামরিক একনায়কতন্ত্র, কোথাও ঔপনিবেশিক শাসন, আবার কোথাও পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক শাসন চালু রয়েছে। একমাত্র ইরান ইসলামী শাসনব্যবস্থার দাবী করলেও বাকী মুসলিম বিশ্ব সেটাকে শিয়া শাসন হিসেবেই আখ্যায়িত করে থাকে।

আজ গোটা দুনিয়ায় মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর রাজনীতি প্রকৃত মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে নেই। প্রায় সব মুসলিম শাসকই সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তির তাবেদার ও ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করছে। অথচ যখন প্রকৃত মুসলমানের হাতে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ ছিল; খোলাফায়ে রাশেদার সেই যুগে বিশ্বের তৎকালীন দুই মহাশক্তি রোম ও পারস্য মুসলিম শক্তিকে সমীহ করতো।

ইসলামের রাজনীতি শুধু মুসলমানের স্বার্থ এবং কল্যাণচিন্তা নয়, বরং গোটা সৃষ্টি জগতের কল্যাণ সাধনই হলো ইসলামী রাজনীতির দর্শন। যে রাজনীতির শিক্ষা দিয়ে সয়ং আল্লাহ পাক মহানবী সা.কে এ পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। ইসলামের রাজনীতি কোন রকম সাম্প্রদায়িকতা এবং সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করে না। বরং ইসলামের রাজনীতি সার্বজনীন ও বিশ্বজনীন।

ধর্মভিত্তিক রাজনীতি কেন চলবে না?
দেশের ধর্মবিদ্বেষী একশ্রেণির মানুষের বক্তব্য হলো, ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি তথা ইসলামী রাজনীতি এদেশে চলবে না। কার্ল মার্কস-মাও সেতুং-এর রাজনীতি চলবে, লেনিন-স্ট্যালিন-এর রাজনীতি চলবে, গান্ধী-আব্রাহাম লিঙ্কনের রাজনীতি চলবে। আর মানবতার মুক্তিদূত বিশ্বনবী মুহাম্মদ সা.- এর রাজনীতি চলবে না। মুহাম্মদ সা. -এর উম্মত দাবীদার তা কীভাবে মেনে নিতে পারে? এ দাবী মেনে নিলে মুহাম্মদী উম্মত হয় কী করে?

যারা মুহাম্মদ সা. ও খোলাফায়ে রাশেদীনের সুমহান আদর্শের আলোকে গণ-মানুষের হৃদয় জয় করে খেলাফত রাষ্ট্র ব্যবস্থা তথা একটি কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চায়, তাদের অন্যায়টা কোথায়? ইসলামী রাজনীতি প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানী ফরিজা। এর সঙ্গে প্রচলিত সংঘাতমুখর, সহিংসতা ও প্রতিহিংসার রাজনীতির বিস্তর ফারাক।

তওবার রাজনীতি: ইবাদতের রাজনীতি-
আশির দশকে আলোড়ন সৃষ্টিকারী আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক নেতা যুগশ্রেষ্ঠ বুজুর্গ মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ. তওবার রাজনীতির ডাক দিয়েছিলেন। রাজনীতি না করা গুনাহ। তওবার রাজনীতি মানে গুনাহমোচনের রাজনীতি। তওবার রাজনীতি হলো প্রকৃতপক্ষে এবাদতের রাজনীতি। তওবার রাজনীতির ডাকে সাড়া দিয়ে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মাওলানা আবদুল গাফফার রহ. শায়খুল হাদীস রহ. মুফতী আমিনী রাহ. মাওলানা ইসহাক, ড. আহমদ আবদুল কাদের সহ অসংখ্য আলেম ওলামা ও দীনদার বুদ্ধিজীবি।

প্রচলিত ধারার ক্ষমতার রাজনীতিতে উপমহাদেশের পীর আউলিয়াগণ কখনোই খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। তবে গণ-মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তাঁরা যুগে যুগে নেতৃত্ব দিয়েছেন, অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। উপমহাদেশের আজাদী আন্দোলনে পীর-আউলিয়া এবং উলামা মাশায়েখের ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল অত্যন্ত জোড়ালো। ইংরেজ খেদাও আন্দোলনে ফকির মজনু শাহ, মাওলানা শাহ আবদুল আজিজ, সৈয়দ আহমদ বেরলবী, মাওলানা শাহ ইসমাঈল শহীদ, হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী, মাওলানা কাসেম নানুতবী, মাওলানা রশিদ আহমদ গাংগুহী, শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দী, শায়খুল ইসলাম মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী, হাজী শরীয়তুল্লাহ, মাওলানা কেরামত আলী জৈনপুরী-এর মতো পীর আউলিয়াদের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁরা তাদের ভক্ত, মুরিদ ও শোষিত মজলুম মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে জালিম আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। উপমহাদেশের ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে প্রথাগত রাজনৈতিক নেতৃত্ব সম্পৃক্ত হয়েছে অনেক পরে, একেবারে শেষের দিকে। প্রথম দিকে সব আন্দোলন সংগ্রাম এবং বিদ্রোহ বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পীর আউলিয়া এবং ওলামা শ্রেণী যারা প্রথাগত রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না।

উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে সর্বাগ্রে পীর মাশায়েখগণ ঝাঁপিয়ে পড়ার কারণ ছিল ব্যাপক জনসম্পৃক্ততা এবং সামাজিক নেতৃত্ব। উপমহাদেশের মুসলিম সমাজে পীর আউলিয়াদের প্রভাব ছিল ব্যাপক। কারণ, পীর আউলিয়াদের দাওয়াত ও প্রচেষ্টার ফলেই উপমহাদেশে মুসলিম সমাজ বিকাশ লাভ করেছে। খাজা মুঈন উদ্দীন চিশতি, খাজা নিজামুদ্দীন, খাজা খান জাহান আলী, শাহজালাল ইয়ামেনী, শাহ পরান, শাহ মাখদুম, শাহ আমানত, শাহ আলী, শাহ নেয়ামতুল্লাহসহ বিখ্যাত পীর আউলিয়াগণের চেষ্টা সাধনায় ভারত উপমহাদেশে ইসলাম ধর্ম বিস্তার লাভ করেছে। যে কারণে এখানকার মুসলিম সমাজে পীর আউলিয়াদের প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধা পৃথিবীর অন্যান্য এলাকার চেয়ে বেশি। ব্যক্তিগত ও কিছুটা সামাজিকভাবেও এ অঞ্চলের মুসলিম সমাজ ধর্মের প্রতি অনুরক্ত। কিন্তু ইসলামকে রাজনৈতিকভাবে বা রাষ্ট্রজীবনে গ্রহণ করতে অধিকাংশ মুসলমানই এখনো প্রস্তুত নয়।

ইসলামী রাষ্ট্র ও রাজনীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে- মানবজীবনের সকল পর্যায়ে ইসলামের সুমহান বিধি বিধানের চর্চা ও বাস্তব প্রয়োগ। অধিকাংশ মুসলমানই ইসলামের প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করতে পারেনি। দীন ইসলামের খন্ডিতরূপে আমলে আনতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। অরাজনৈতিক সুবিধাবাদী দর্শন লালন শুরু করেছে। যেখানে ইসলামী দন্ডবিধি প্রয়োগের চিন্তাটুকুনো তিরোহিত হয়ে গেছে।

খেলাফত মজলিস মুসলমানদেরকে পুরোপুরি ইসলামে প্রবেশের দাওয়াত দেয়। গণমানুষের সামনে দীনের পূর্ণাঙ্গ ধারণা প্রকাশ করে। পূর্ণাঙ্গ দীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শরিক হতে উদাত্ব আহবান জানাচ্ছে। দীন ও দুনিয়াকে আলাদা করার সামাজিক প্রবনতা থেকে মুসলিম উম্মাহকে মুক্ত করার জোড় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

দীন এবং দুনিয়াকে আলাদা করার প্রবণতা থেকেই আজ ইসলামকে রাষ্ট্র থেকে, সমাজ থেকে, অর্থনীতি থেকে, সংস্কৃতি থেকে বিদায় করার চেষ্টা চলছে। অথচ এসব কিছুই দীন তথা ইসলামের বিষয়বস্তু। খেলাফত মজলিস সকল পর্যায়ে এ সংগ্রামকে উত্তম এবাদত মনে করে।

খেলাফত মজলিস এ বিশ্বাস লালন করে যে- আসমান-জমিন, জীবন-মৃত্যু, রাজত্ব-ক্ষমতা, শান্তি অশান্তির একমাত্র মালিক আল্লাহ। অতএব শান্তি পেতে হলে মানবরচিত মতবাদ ছুড়ে ফেলে দিয়ে আল্লাহর রচিত রাসূলুল্লাহ সা. প্রবর্তিত ইনসাফপূর্ণ খেলফত রাষ্ট্রনীতি অনুযায়ী দেশ চালাতে হবে।