খুব কাছে থেকে দেখে এলাম মৃত্যুকে— মোহাম্মদ আজমল খাঁন

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

মে ১০ ২০২০, ২১:৩০

একুশে জার্নাল ডেস্ক: ব্রিটেনে যখন লকডাউন ঘোষণা দেওয়া হলো,তার পরের দিন কাজের জায়গা থেকে self isolation এর জন্য বিদায় নিয়ে আসলাম।আসার পথে বোনের ঘরে উঠলাম।ভাবলাম,আর কতদিন বেরোতে পারবো না ,তাই দেখা করে আসি।চা-নাস্তা খেয়ে একটু শপিং করে রাত ৭/৮টার দিকে ঘরে আসলাম।আসার সময় বাস জার্নি করতে হয়েছে।বাসে social distance বজায় রাখা সম্ভব হয় না।যাক,ঘরে আসার পরদিন থেকেই যেন শরীরটা একটু একটু খারাপ লাগতে লাগলো।২/৩ দিন পর যেন মাত্রাটা বেড়ে যাচ্ছে।গলায় ব্যথা,ভয়েজ রাতেরবেলা ডাউন হয়ে যায়,এবং জ্বর জ্বর ভাব আসে।তাই পরের দিন সকাল থেকেই যার যার সাথে সম্ভব ফোনে বলতে থাকি,আমাকে মনেহয় করোনা ভাইরাসে আক্রমন করেছে।তাই যদি মরে যাই, মাফ করে দিও….ইত্যাদি।সকলেই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে।যাক,এর ২/৩ দিন পর বিকেল বেলা শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসে।তারপর রাতেরবেলা high temperature শুরু হয়।সেই সাথে শ্বাসকষ্ট। এই অবস্থা যখন,আমার wife সবাইকে জানিয়ে দেন সবদিকে তখন খুবই হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি।
আর আমি ভাবতে লাগলাম আমার সময় তো শেষ হয়ে আসছে।আমার এখন করণীয় কী?ঐ দিকে ফোনে অনেকের কান্নাকাটি আমার কানে আসছে।আমার মনে হলো,আমি তো চলেই যাচ্ছি দুনিয়া ছেড়ে।দুনিয়া তো আমার শেষ।আমি চলে যাবার পর আমার কী হবে?আমার সামান কী আছে,আল্লাহর কাছে নিয়ে যাবার?
তখন থেকেই দুনিয়ার সকল মায়া আমার ভেতর থেকে চলে গেলো।আর আল্লাহর নিকট বলতে থাকলাম,আল্লাহ তুমি আমায় মাফ করে দাও!
এরপর থেকে কিছু সময় আমার হুঁশ থাকতো,তারপর বেহুঁশ থাকতাম।এভাবে মনেহয় ২/৩ দিন কেটে যায়।আমার এক বন্ধDr Khairul Islam Helal ,A&E তে কাজ করে।তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ হতো।
এরমধ্যে করোনার সকল লক্ষণ চলে আসে।মুখের স্বাদ চলে যায়,শুকনো কাশি,মুখ দিয়ে রক্ত আসা,বমি,runny nose,ডায়রিয়া প্রচন্ড টান্ডা ।
যেখানে কাঁচুমাচু হয়ে শুয়ে থাকতাম দেয়াল ঘেঁষে, শুধু মনে হতো,এই দেয়ালটা পেরিয়ে গেলেই আমি হয়ে যাবো লাশ।আর চোখে শুধু ভাসতো,ক্রেন দিয়ে লাশটা কবরে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে।প্রায়ই এই দৃশ্য ভেসে উঠতো চোখে।দুনিয়ার মায়া-দয়া মনেই পড়তো না।শুধু মনে হতো,আমি তো আল্লাহর হাওলা হয়ে গিয়েছি।
এই সময় মাঝেমধ্যে ঘাম দিয়ে জ্বর একটু কমলে মোবাইলটা হাতে নিতাম আর পরিচিতজনের মৃত্যুর খবর দেখতাম।আর চিন্তা করতাম,কখন আমার শ্বাসকষ্টটা শুরু হয়েই আমার দুনিয়াটা শেষ হয়ে যাবে।
দেয়ালটা সরে যাবে আর নিউজে শুধু একটা সংখ্যা বেড়ে যাবে।প্রথম যখন ambulance এলো,সকল check up করলো, swab নিয়ে check করলো এবং জানালো,করোনা positive but oxygen level ঠিক ক থাকায় stay at home।আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানালাম।আমি hospital এ যেতে চাইছিলাম না।এদিকে জিপি (আমার রেজিস্টার ডক্টর )থেকে রেগুলার ফোন করতো।একদিন সকালে ভিডিও কল দিয়ে আমার অবস্থা দেখে সে নিজেই আবার ambulance পাঠিয়ে দেয়।তারা আমাকে hospital নিয়ে যেতে চায়।আমার গড়িমসি দেখে তারা বাইরে গিয়ে control room এর সাথে যোগাযোগ করে specialist সমৃদ্ধ আরও একটি ambulance নিয়ে আসে।সেখানে একজন বয়স্ক ডাক্তার ছিলেন।আমার মনে হলো,সরকার শুনেছি কিছু retired doctor কে ফিরিয়ে এনেছে,উনি তাদের একজন হবেন।দুই ambulance এর লোকজন মিলে অনেকক্ষণ check up এর পর বয়স্ক ডাক্তার বললেন,তুমি খুবই ভাগ্যবান যে এই ভাইরাসের এ্যাতো আক্রমণের পরেও তোমার oxygen level ok আছে।stay at home।বিভিন্ন গবেষনায় পড়েছি ১২ দিনের পর এই ভাইরাসটি disable হবার আগে একটা মরণকামড় দেয় আর আমিও পৃথিবী থেকে বিদায়ের জন্য রেডি আর আল্লাহর কাছে শুধু ক্ষমা চাচ্ছি ।
এভাবে ২/১ দিন যাওয়ার পরে আমার অসুস্থতার তেরো কিংবা চৌদ্দ দিন চলে গেলো।জ্বরের মাত্রা কমে আসতে লাগলো,মুখের স্বাদও ফিরে পেলাম।তখন থেকে আবার ভেতরে ভেতরে বুঝলাম,মহান আল্লাহ মনেহয় এই যাত্রায় বাঁচিয়ে দেবেন।
এর আগে একদিন একবার আমার একমাত্র সবেধন নীলমণি, কলিজার টুকরা,বারো বছরের ছেলের জন্য খুবই খারাপ লাগছিলো।সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ছেলেকে রুমে ডেকে বললাম,তোকে শাসন করতে গিয়ে কত কষ্ট দিয়েছি,কত আবদার পূরণ করতে পারি নি,আমাকে মাফ করে দিস।
বলে কান্না ধরে রাখতে পারি নি।এই একটিবার দুনিয়ার জন্য মায়া হয়েছিলো।সে এসব শুনে ঠিক থাকতে পারে নি।আমার ছেলে ও কান্নায় ভেঙে পড়ে।তখন তার মা এসে বলেন,”দেখো ছেলেটা এ্যাজমা রোগী।শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যাবে।”
বলে তাকে নিয়ে গেলেন রুম থেকে।যারা জানেন তাদের সবারই জানা আছে,আমার ছেলে আমাকে যেমন ভয় পায়,তেমনই miss ও করে।আমরা বাপ-পুত এখনও হাত ধরেই রাস্তায় হাঁটি।আমি কখনও বাইরে গেলে কিংবা extra time কাজে গেলে তার মাকে বলবে,কেন আব্বু বাইরে গেলো? আমি না আসা পর্যন্ত ঘুমাতে চায় না।
যাক…..এভাবে দুই সপ্তাহ পেরোনোর পরে সবাই আবার আশাবাদী হওয়া শুরু করে দিলেন।আমিও আর খাওয়া-দাওয়া করতে অসুবিধা মনে করলাম না।কিন্তু শরীর খুবই দূর্বল এবং কথাবার্তা বলার শক্তিও হারিয়ে ফেললাম। আমি বেঁচে আছি তবে আমার শরীরটা একেবারে নষ্ট , নিস্তেজ করে দিয়েছে ।জিপি ডাক্তারের সাথে প্রতিদিন কথা হতো।সে বললো,এই ভাইরাসের ন্যাচার একেক জনের সাথে একেক রকম।কেউ কেউ সুস্থ হতে লম্বা সময় লেগে যায়,আবার কেউ কেউ তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যায়।তবে ডাক্তার বাসায় একটা oxymeter নিজে দিয়ে যায় আর বলে,কখনও যদি oxygen level 92 এর নীচে নেমে যায়,তবে 999 এ কল দিও।
তিন সপ্তাহ যাবার পরে দূর্বলতা এবং গলা ব্যথা ছাড়া মোটামুটি সুস্থ আলহামদুলিল্লাহ। ডাক্তার যখন বললো,তখন ছেলেকে অনেকদিন পর অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকলাম,কাঁদলাম।আর ভাবতে লাগলাম,আমি কই ছিলাম,কোথায় থাকার কথা, আর এখন কোথায় আছি!
যদি শ্বাসকষ্ট কখনও বাকী সব উপসর্গের সাথে শুরু হতো,তখনই হয়তো জীবনটার অবসান হয়ে যেতো।

আমি যা উপলব্ধি করেছি-

একমাত্র আমার ভাইবোনদের আহাজারি, ক্রন্দন, বিলাপ,মামা-মামী ওরফে শ্বশুর-শাশুড়ি,আত্মীয়-স্বজন,পাড়া-প্রতিবেশী,বন্ধু-বান্ধবের দোয়ায় আল্লাহ আমার হায়াতকে বৃদ্ধি করেছেন।আমি শুনেছি ৪/৫ টা কুরআন খতম হয়েছে,খতমে ইউনুস সহ দান-খয়রাতের উছিলায় আল্লাহ রক্ষা করেছেন।
এই সময়ের মধ্যে মাঝেমাঝে যখন একটু ভালো লাগতো,মোবাইলটা হাতে নিতাম আর দেখতাম-বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব,আলেম-ওলামার ফোন।হয়তো তারা ভাবতেন, মরে যাওয়ার আগে শেষ একটু কথা বলে নিই।আমি সবার কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাচ্ছি,ফোন ধরতে পারি নি বলে।অনেক সময় আমার wife ফোনের answer করে দিতেন।কিন্তু সমস্যা হলো যখন আমার wife করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গেলেন।
এই রোগের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসা নাই।
তবে গরম পানি,লেবুর রস,আদা চা,এগুলো খুব উপকারী।এই সার্ভিসগুলো যদি আমার wife না দিতেন,তবে এ্যাতো তাড়াতাড়ি হয়তো সুস্থ হতে পারতাম না।উনি অসুস্থ হবার পরেও এই সেবা দিয়ে গেছেন।সামাজিক দুরত্ব দুরের কথা , কোন দুরত্ব কিংবা ভয় তার মাঝে ছিল না ।গা মুছে দেয়া , বুকে vicks মালিশ করা সহ সবকিছু আমার wife করেছেন ।বর্তমানে উনি সুস্থ হবার পথে আলহামদুলিল্লাহ।
লন্ডনে যতোগুলো ঘটনা শুনেছি,যেখানেই স্বামী-স্ত্রী দুজনের এই রোগ হয়েছে,এর মধ্যে একজন দুনিয়া থেকে চলে গেছে।মহান আল্লাহর নিকট অসংখ্য,অগণিত শুকরিয়া আদায় করে শেষ করা যাবে না,আমরা দুজনই বেঁচে আছি আলহামদুলিল্লাহ।
আশেপাশে যেসব বন্ধু-বান্ধব,পাড়া-প্রতিবেশী ঔষধ,খাবার-দাবার, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে সহযোগিতা করেছেন(সঙ্গত কারণেই সবার নাম নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না ),তাদের ঋণ ক্ষুদ্র এই জীবনে কিভাবে যে শোধ করবো,জানি না।শুধু আল্লাহর দরবারে বলছি,আল্লাহ তাদের দুনিয়া-আখিরাতের সুখ-সমৃদ্ধি দান করো। মৃত্যুর কাছাকাছি না গেলে বুঝতাম না – দুনিয়ার এত মানুষ আমাকে ভালবাসে , তাদের এই ভালবাসা মায়ার প্রতিদান আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়, আল্লাহ তুমি তাদের দুনিয়া আখেরাতের সুখ সমৃদ্ধি দান করেন ।

পরিশেষে বলবো,শুধুমাত্র আল্লাহর দয়া এবং সকাল-সন্ধ্যার নিয়মিত দোয়াই এই রোগের ঔষধ।যা বিজ্ঞ আলেম-ওলামাগণ বলে থাকেন।

হে আল্লাহ! এই যাত্রা যখন বাঁচিয়ে দিয়েছো,বাকী জিন্দেগী তোমার ফরমার্বদার,শুকরিয়া জ্ঞাপনকারী, হালাল রোজগারী হিসেবে কবুল করিও।আল্লাহ তুমি আমাকে মিথ্যাচারী,গীবতকারী,চোগলখোরদের দলভুক্ত করো না।সিরাতুম মুস্তাক্বীমের পথে অটল থাকার তৌফিক দান করিও।