কোন কিতাব শ্রেষ্ঠ, বুখারী না মুসলিম? -আহমদ যাকারিয়া

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জানুয়ারি ৩০ ২০১৯, ১২:৪৯

মুফতি আহমদ যাকারিয়া: ইলমে হাদীসের ইতিহাসে দুটি হাদীসগ্রন্থ সর্বাধিক সমাদৃত, যার একটি হল সহীহ বুখারী এবং অপরটি হল সহীহ মুসলিম। এদেরকে একসাথে ‘সহীহাইযন’ বলা হয়। সহীহ বুখারীর লেখক হলেন মুহাম্মদ বিন ইসমাইল বুখারী(রঃ) এবং মুসলিম শরীফের লেখক হলেন ইমাম মুসলিম বিন হাজ্জাজ আন-নিশাপুরী(রঃ)। আল-কুরআনের পর এ দু’টি কিতাবের গুরুত্ব মুসলিমদের কাছে  সর্বাধিক। তবে এ দু’টি কিতাবের মধ্যে কোনটি সর্বশ্রেষ্ঠ তা নিয়ে আলেমদের ভিতর মতপার্থক্য রয়েছে।এ ব্যাপারে তিনটি মতামত পাওয়া যায়:

১. দুটি গ্রন্থ সমানভাবে সর্বশ্রেষ্ঠ।

২. মুসলিম শরীফ বুখারী শরীফের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।

৩. বুখারী শরীফ মুসলিম শরীফের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।

১. দুটি গ্রন্থ  সমানভাবে সর্বশ্রেষ্ঠ।

যারা এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, দুটি গ্রন্থ শ্রেষ্ঠ এবং মর্যাদা দিক থেকে সমান, তাদের যুক্তি হল যে, বুখারী শরীফ একদিক দিয়ে যেমন বিশুদ্বতার দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ আর মুসলিম শরীফ তেমনিভাবে বিন্যাস পদ্ধতির আলোকে শ্রেষ্ঠ। তাই কোন অংশেই একটি হতে অপরটি পৃথক নয়।

২. মুসলিম শরীফ বুখারী শরীফের উপর শ্রেষ্ঠ।

যারা মনে করেন যে, বুখারী শরীফের চেয়ে মুসলিম শরীফ শ্রেষ্ঠ হাদীসগ্রন্থ। তারা এখানে যুক্তি হিসেবে ইমাম মুসলিম(রঃ) এর দক্ষতা, নিজ শহরে বসে হাদীস লিখা, তা’লিকাতের সংখ্যা, রাবীগণের মধ্যকার পার্থক্য ইত্যাদি বিষয়াবলী নিয়ে আলোচনা করেছেন।

৩. বুখারী শরীফ মুসলিম শরীফের উপর শ্রেষ্ঠ।

অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, বুখারী শরীফ সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। তারা এর পিছনে বেশ কিছু যুক্তি পেশ করেছেন; যার কারণসমূহ নিম্নরুপঃ

১। হাদীস গ্রহণে রাবীর সাক্ষাৎ।

হাদীস গ্রহণে ইমাম বুখারী(রঃ) “রাবী ও মারবীর” মাঝে অন্তত পক্ষে একবার হলেও সাক্ষাতের শর্তারোপ করেছেন। যে সকল হাদীসে “রাবী ও মারবীর” একবার সাক্ষাৎ হয়েছে সে সকল হাদীস-ই তিনি তার গ্রন্থে সংযোজন করেছেন। অন্যদিকে ইমাম মুসলিম (রঃ) তার গ্রন্থে “রাবী ও মারাবীর” ভিতর সাক্ষাৎকে শর্তের ভিতর আওতাভূক্ত করেন নি। বরং তিনি তাদের সমসাময়িকতার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তাহলে এই বিচারে বলা যায় যে, “বুখারী শরীফ”  “মুসলিম শরীফ” অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।

২। হাদীস গ্রহণে রাবীগনের যোগ্যাতার তারতাম্য:

রাবীগণের গুণাবলীর উপর ভিত্তি করে তাদেরকে কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়-

১. যাদের স্মৃতি শক্তি অত্যাধিক এবং শায়খের সাথে ভালো সম্পর্ক।

২. যাদের স্মৃতি শক্তি অত্যাধিক কিন্তু শায়খের সাথে সম্পর্ক ভাল নয়।

৩. যাদের স্মৃতি শক্তি কম কিন্তু শায়খের সাথে ভাল সম্পর্ক আছে।

৪. যাদের স্মৃতিশক্তি কম এবং শায়খের সাথে সম্পর্ক ভাল নয়।

৫. যাদের দুই ধরনের ত্রুটি আছে এবং গুণে সামান্য ত্রুটি আছে।

ইমাম বুখারী(রঃ) এখানে কেবল প্রথম দুই শ্রেণীর রাবীর বর্ণনা গ্রহণ করেছেন কিন্তু মুসলিম(রঃ) উপরোক্ত প্রথম তিন শ্রেণীর বর্ণনার প্রতি অত্যাধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। প্রথম দুই শ্রেণীর বর্ণনাকারীদের হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে ত্রুটি না থাকলেও পরবর্তী দুই শ্রেণীর হাদীস বর্ণনায় ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়।

৩।মুসলিম (রঃ) ছিলেন ইমাম বুখারী(রঃ) এর ছাত্র।

ইমাম মুসলিম (রঃ) ছিলেন ইমাম বুখারী(রঃ) এর ছাত্র। ইমাম মুসলিম (রঃ) সর্বদা বুখারী(রঃ)কে তার উস্তাদের উস্তাদ, মুহাদ্দিসদের শ্রেষ্ঠ এবং হাদীস বিষয়ের চিকিৎসক বলে অভিহিত করেছেন। ইমাম কুরতুবী (রঃ) বলেন, ইমাম বুখারী না থাকলে ইমাম মুসলিম কখনও হাদীস বিষয়ে এত প্রসিদ্ধি লাভ করতে পারতেন না।

৪। জামে’ ও সুনান গ্রন্থ:

“বুখারী শরীফে” জামে’ গ্রন্থ। কারণ এখানে কিতাবুত তাফসীর আছে। কিন্তু “মুসলিম শরীফে” কিতাবুত তাফসীর সংক্ষিপ্তাকারে দেওয়া আছে। তাই তা জামে’ নয় বরং তা সুনান গ্রন্থ।

৫। ছুলাছিয়্যাত:

ছুলছিয়্যাত ঐ ধরনের বর্ণনাকে বলা হয়, যেখানে মুহাম্মদ(সাঃ) থেকে রাবীর সংখ্যা মাত্র তিনজন। বুখারী শরীফে এ ধরনের হাদীস সংখ্যা ২২টি কিন্তু এর বিপরীতে মুসলিম শরীফে তেমন কোন হাদীস নেই।

৬। যাচাইয়ের কষ্ঠিপাথরে বুখারী ও মুসলিম শরীফ:

বুখারী(রঃ) ৬ লাখ হাদীস থেকে যাচাইয়ের পর ৭২৭৫টি হাদীস তার গ্রন্থে সংকলন করেছেন আর মুসলিম(রঃ) তিন লাখ হাদীস থেকে মাত্র ৬০০০ হাদীস তার গ্রন্থে সংকলন করেছেন।

৭। হাদীস প্রণয়নে সাধনা

ইমাম বুখারী(রঃ) তার হাদীস গ্রন্থের সংকলন শুরু করেন মসজিদুল হারামে বসে। তিনি তার এই গ্রন্থ মসজিদে নববীতে মুহাম্মদ(সাঃ) এর মিম্বার এবং রওযার পাশে বসে লিখেছেন। তিনি হাদীস লিখার আগে গোসল এবং দুই রাকাআত নফল নামায আদায় করতেন।

৮। রাবীগণের ন্যায়নিষ্ঠা ও পূর্ণ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তারতাম্য:

বুখারী শরীফের রাবীগণের বিশ্বাসযোগ্যতা মুসলিম শরীফের রাবীগণের বিশ্বাসযোগ্যতার চেয়ে অনেক বেশি। বুখারী শরীফে ৪৫৩জন রাবীর ভিতর ৮০ জন রাবীর অন্যদিকে মুসলিম শরীফের ৬২৫ জন রাবীর ভিতর  ১৬০ জন রাবী সমালোচিত।

৯। শায ও মু’আল্লাল না হওয়ার জন্য তারতাম্য:

মুআ’ল্লাল ঐ সকল হাদীসসমূহকে বলা হয়, যার ভিতর সত্যিকারভাবে কোন ধরনের সমস্যা আছে। এক হাদীস অন্য হাদীসের ভিতর অনুপ্রবশের দরুন হাদীস উলট-পালট হয়ে যেতে পারে, যার ফলে অর্থ বের করা দুরুহ হতে পড়ে। হাদীস মু’আল্লাল দু’ভাবে হতে পারে; সনদের ভিত্তিতে এবং মতনের ভিত্তিতে। অপরদিকে “শায” হচ্ছে ঐ সকল হাদীসসমূহ যেখানে নির্ভরযোগ্য রাবী অপর একজন নির্ভরযোগ্য রাবীর বিপরীত হবেন যিনি যোগ্যতা ও ন্যায়নিষ্টার গুণে অপরের চেয়ে অধিক হবেন। এভাবে দুই নির্ভরযোগ্য রাবী পরস্পর বিপরীত অর্থবোধক হাদীস বর্ণনা করলে, কম নির্ভরযোগ্য রাবী “শায” এবং অধিক নির্ভরযোগ্য রাবী “মাহফুয” হিসেবে বিবেচিত হবেন। এই ধরনের “রুগ্ন হাদীস” বুখারীতে ৭৮টি এবং মুসলিম শরীফে ১১০টি রয়েছে।

১০। স্মরণশক্তির প্রখরতা:

ইমাম বুখারী(রঃ) এর স্মরণশক্তি অত্যন্ত প্রখর ছিল। এ ব্যাপারে স্বয়ং ইমাম বুখারী(রঃ) নিজেই বলেছেন যে, আমি প্রায় এক লক্ষ হাদীস মুখস্ত করেছি এবং দুই লক্ষ হাদীস কন্ঠস্থ করেছি। কিন্তু ইমাম মুসলিম (রঃ) এর এমন যোগ্যতার প্রমাণ পাওয়া যায় না।

১১। স্বপ্নে হাদীস সংকলনের ইঙ্গিত:

ইমাম বুখারী(রঃ) একবার স্বপ্নের মাধ্যমে দেখতে পেলেন যে, মসজিদে নববীতে মুহাম্মদ(সাঃ) বসে আছেন আর তার উপর মাছি পড়ছে আর বুখারী (রঃ) পাখা দিয়ে তা সরাচ্ছেন। এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা বুখারী (রঃ) তার উস্তাদের কাছে জানতে চাইলে তার উস্তাদ তাকে এ কথা বলেন যে, তার দ্বারা হাদীসের বিরাট খিদমাত হবে।কিন্তু ইমাম মুসলিম (রঃ) এর ব্যাপারে এমন কোন ঘটনা পাওয়া যায় না।

১২। হাদীসের শিরোনাম প্রদান:

ইমাম বুখারী (রঃ) হাদীস সংকলনের পাশাপাশি বিভিন্ন অধ্যায় ও পরিচ্ছেদ বিন্যস্ত করে শিরোনাম প্রদান করেছেন।কোন কোন শিরোনামে তিনি পবিত্র কুরআনের আয়াত উল্লেখ করেছেন। কুরআনের ব্যাপারে তিনি সুক্ষ্ণ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। তিনি আকাইদ, নীতিশাস্ত্র এবং মাসআলা নিয়েও আলোচনা করেছেন। কিন্তু ইমাম মুসলিম (রঃ) সনদ ও মতন ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে আলোচনা করেন নাই।

১৩। আলিমগণের মতামত:

এ ব্যাপারে সকলেই এক্যমত পোষণ করেছেন যে, কুরআনের পর হাদীসগ্রন্থদ্বয় সর্বশ্রেষ্ঠ। কিন্তু এখন কোন গ্রন্থটি সর্বশ্রেষ্ঠ সে ব্যাপারে সচেতন হাদীস বিশারদগন বলেন যে, বিশুদ্ধতার দিক দিয়ে “বুখারী শরীফ” অত্যন্ত মর্যাদাবান আর অভিবনত্ব, বিন্যাস বৈশিষ্ট্য ও পরিবেশনার কৌশলের বিচারে “মুসলিম শরীফ” অতুলনীয়। উপরোক্ত আলোচনা থেকে এ বিষয়টি অনুধাবন করা যায় যে, বুখারী এবং মুসলিম হাদীসের উভয় গ্রন্থই শ্রেষ্ঠ কিন্তু বুখারী শরীফ মুসলিম শরীফের তুলনায় শ্রেষ্ঠ।

১৪। খতম:

বুখারী শরীফের খতম করানো হয় আর মুসলিম শরীফের কোন খতম করানো হয় না।

১৫। ফিকহ্ ভিত্তিক হাদীস:

বুখারী শরীফে ফিকহী মাসাআলা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই সকল হাদীসের সমাধান ক্রমবিন্যাস ধারায় আলোচিত হয়েছে।

১৬।সমালোচনাভিত্তিক হাদীস:

বুখারী শরীফে সমালোচিত হাদীসের সংখ্যা ৭৮টি আর মুসলিম শরীফে সমালোচিত হাদীসের সংখ্যা ১১০টি।

১৭। সনদের ভিত্তি:

বুখারী শরীফের সনদের ভিত্তি মুসলিমে শরীফের তুলনায় অত্যন্ত মজবুত।

১৮।তা’লিকাত:

বুখারী শরীফে হাদীসের একটি বিশুদ্ধ তা’লিকাত আছে কিন্ত মুসলিম শরীফে হাদীসের তা’লিকাত নেই।

পরিশেষে বলা যায় যে, বুখারী এবং মুসলিম শরীফ নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠতর হাদীস গ্রন্থ। এই গ্রন্থদ্বয়ে কোন ধরনের “মওযূ” কিংবা “যঈফ” হাদীসের স্থান নেই। কিন্তু এর পরেও বুখারী শরীফের ভিতর এমন এমন কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়; যার ভিত্তিতে বলা যায় যে, বুখারী শরীফ মুসলিম শরীফের চেয়ে শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ।