কৃতঘ্ন— মুহাম্মদ শাহরিয়ার হোসাইন শিহাব

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুন ২০ ২০২০, ১১:৪২

আরবের হুদ সম্প্রদায়ের মাজহার ইবনে লোকমান আলহুদ নামের এক বিচক্ষণ ব্যক্তি ভূধরন অঞ্চলের অধিত্যকা ছিলেন । তিনি তার সম্প্রদায়ের সম্মুখ্যে অসহায়, নিশ্চল, এক দুঃখিনী মা “বুড়ির” জীবন, কর্ম, আবদান সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে বলেন ।

বয়োবৃদ্ধিতে গৃহবধূ হয়ে অঙ্গসজ্জা করে অচপল অবরুদ্ধগৃহে মৌনাবলম্বনকরাকে কিঞ্চিতমাত্র মূল্যায়ন করতেন না বুড়িটি।অভিরুচি হলেই পাহাড়ের চূড়ায় মৃত্তিকার সামান্য স্তূপে অকুতোভয়ে রোষারক্ত নয়নে নির্মল, শুভ্রনীলাম্বরের দিকে থাকিয়ে থাকতেন ঘন্টাকয়েক। শৈবলিনির ধারে বসে প্রস্তরখণ্ড দিয়ে আমুত-পুর্তি করতেন, কখনো সমুদ্র-সৈকতে পানির কল্লুল উপভুক করতেন। অদূরবর্তী গ্রাম গঞ্জের কুসুমিত কাননে গিয়ে গ্রামীণ বাংলার স্বাদ আস্বাদন করতো। কিন্তু তৎক্ষণাৎ সময় বয়োবৃদ্ধা ; প্রায় অশীতিপরায়ণা, অগস্ত্যযাত্রারন্যায় কোথাও গমনের সেই সক্য আর নেই। কখনো বা খাটে; কখনো বারান্দায় ; আবার কখনো অবলীলা নেন উঠানে।পরিচ্ছদগুলো আঁস্তাকুড়, রোগাচ্ছান্ন হয়ে আছে , স্কান্ধ আর জানুর বিষণ ব্যাথায় দিনগুজরছেন।

বুড়িটি প্রাণী পোষার প্রতি অতিব আসক্ত ছিলেন। সেই কুড়ি বৎসর যাবৎ ছাগলের দুধ দিয়ে রোজগার করে প্রবাহিত জীবন অতিবাহিত করতেন। ভিক্ষা চাওয়াটা আত্মারকাছে ন্যাক্কারজনক মনে হতো, ছেলে-পুলেগুলো অর্থ দেইনা, টাকা চাইলে ধমকি দিয়ে আকড়ে ধরে। তাই চিকিৎসা-হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে না, এমন আপৎকালে কেউ দারস্থাও নেই। কঠুর শ্রম ও ভজকটে অসস্তিকর দিনগুলো অতিবাহিত হচ্ছে। পাশের বাড়ির ভদ্রপরিবারের মরহুম নূরুল আলীর বড় ছেলে

রহমত আলি খুবই নিষ্টবান ও অতিশয়ভদ্র ব্যক্তিছিলেন। সে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র থাকতেও পিতার পদছায়া হারিয়েপেলে। পরিবারের ব্যয়বৃদ্ধির কারণে বিদ্যাপাঠ তৃতীয় শ্রেণীতে সমাপক হয়। তাই তাকে পাড়া-মহল্লায় গিয়ে দিনমজুরীর কাজ করতে হতো ; যে যত দিতো তাতেই সন্তুষ্ট ও কৃতজ্ঞ থাকতো । সে পারিবারিক জীবিকানির্বাহ করার প্রসঙ্গে দৈন্যদের পরহিতব্রতীতে সর্বক্ষণিক উদ্যত থাকতো। সে বয়োবৃদ্ধা বুড়িটিকে প্রতিপত্তি করতো।

এমনকি বুড়ির দুধ দোহনের কাজে সহযোগীতা করতো, এবং তা পাড়া-মহল্লাই, পাহাড়ের চূড়ায়, বাসিন্দাদের নিকট বিক্রিকরে বুড়িটিকে সঠিক অর্থ প্রদান করতো। এজন্য রহমতের প্রতি বুড়ির আত্মবিশ্বাস অনুরাগ দিনদিন বৃদ্ধিপেতে লাগল। এ থেকে যত রোজগার হয় তার এক তৃতীয়াংশ তিনি রহমতকে বকশিশ হিসাবে দিয়ে দিতো। এতে করে বুড়ির এক মুকুড় অর্থ জামাট হয়েছিল।

একদা একদিন বুড়িটির মনে কোথাও ভ্রমনের কহুক জাগলো, বুড়িটি রহমতকে বলল “কুড়ি কুড়ি করে ভুড়ি ভুড়ি টাকা জমিয়ে রেখেছি।

বুড়িটি আত্মকথপোকথন করছিল সুন্দরবন দর্শন করবে। কখনো যাওয়া হয় নি। কেউ-বা নেইনি। ছেলে-মেয়ে,নাতি-পুতি সবাইকে নিয়ে ঘুরতে যাবো সুন্দরবনে।

বুড়িটি তার মেজো ছেলে মুরাদকে উদ্দেশ্য করে বললো ” আমরা সবাই সুন্দরবন যাবো”। মুরাদ বলল ” সময় তো আজ বয়োবৃদ্ধা, কিভাবে তুমি সেথায় গমন করবে মা? কিন্তু বুড়িটি নাজেহাল, উৎকট ছিল সেথায় গমন করার। অবশেষে পরিবারের সকল সদস্যরা ঐক্যমত্য হলে গমনের জন্য সবাই আপনসজ্জা ও সরোসামানের বন্দোবস্ত করল। প্রসন্নতাব্যঞ্জকভাবে সকলেই গমন করলো। সমভিব্যাহারে নূরুল আলীর বড় ছেলে রহমত আলীকেসহ গমনপথ শুরু করলো। রওনা হলো ট্রেনের দিকে, বুড়িটির মুখখানি যেন প্রীতি-প্রফুল্লোচনে হাস্যজ্জ্বল হয়ে আছে।

তারপর ট্রেনে করে সুন্দরবন গমন করলো। সবাই ট্রেন থেকে নামারপূর্বে বুড়িটি নেমে গেল। বুড়িটি সবাইকে সঙ্গেনিয়ে বনের দিকে রওনা হলো।

এদিক ওদিক প্রকৃতির (আল্লাহর সৃষ্টির) দৃশ্যসমুহ উপভুগ করছে। গাছের ডালে-ডালে যেমন সুকৌমার্য পাতা-পক্ষি, তেমন সুবাসে মুখরিত বুড়িটি। সবুজের ঘেরা লতা-পাতা সবি মিলে অনুরঁজন হল বুড়িটির। অনেক দিনের সক ছিল এমন মনোমুগ্ধকর শ্যামলা পরিবেশ দেখবার । দর্শন করলো প্রাণী-প্রজাতি, রয়েল বঙ্গল টাইগার, হরিণ, গুসাপ, বানর প্রভৃতি।

বনের চতুরপাশ গমন করতে করতে সকলে শৈথিল্য মুহি।

অবশেষে অপরাহ্নেরমূহুর্তে স্বগৃহে প্রত্যাগমনের পথে রওনা দিলো। হঠাৎ বুড়িটি দেখতে পেল বনের অবরার্ধে একটা বাঘের ছানা থরহরিকম্পে কাপছে। বুড়িটি আবলোকনমাত্র বাঘের ছানাটিকে বক্ষে জড়িয়ে নিল। বাঘের ছানাটি ছিল অতিশয় সুঠাম। আদ্যোপান্ত লালের উপরিভাগের কয়েকটি কালো রঙ এর দাগ। তিনি বাঘের ছানাটিকে আর বিলম্ব না করেই তার থলের মধ্যে আবরন করলো।

ফের প্রত্যাগমন করলো গৃহপথে। একদিকে সবাই আনন্দ প্রফুল্লচিত্যে মনোমুগ্ধকর পরিবেশ দেখে। অন্যদিকে বুড়িটি বিমুগ্ধ আত্মহারা বাঘেরছানাটিকে দারস্থা পেয়ে ।

সে তার পোষা ছাগলের মত বাঘেরছানাটিকেও আপ্যায়িত করে রাখতো।

বুড়িটি সর্বদা তার যত্ন নিতো। ছাগলের দুধ দ্বারা তাকে ক্ষুন্নিবৃত্তি করতে । সদা তাকে অঙ্গসজ্জা করতো। তাকে দুষ্প্রাপ খানা দিতো, বিশেষ করে ছাগলের দুধ ও মাছের কলিজা । তার তার করতো, এমনকি দু’জন মিলে এক খাটে নিদ্রাজাগরণ করতো।

ক্রমোৎকর্ষভাবে বাঘের ছানাটি বড় হতে লাগলো, পুষ্টিকর খাদ্য পেয়ে। বয়স বৃদ্ধির ফলে বাঘটির প্রতাপশালী ও দাম্ভিকতা প্রকাশ পেতে লাগল। তার মাতৃ শক্তি দৈনন্দিন বৃদ্ধিপেতে লাগল। তেজ-দৃপ্তি আরো উজ্জ্বল হতে লাগল।

বুড়িটি প্রতিদিনের ন্যায় পাহাড়ের চূড়ায় ঘুরতে গেল। রেখে গেলো আদরের ছাগল আর বাঘের ছানাটিকে। হঠাৎ করে খিদে লাগেছিল বাঘের ছানাটির কাছে, প্রবল খেদে। শেষমেশ ব্যার্থ হয়ে ছাগলটিকে মেরে পেললো।

বুড়ি যখন পাহাড়ের চূড়ায় থেকে প্রত্যাগমন করলো। আকস্মিতভাবে আঁতকানো হয়েগেল। আঁকিদর্শন করলোর উঠানের দিকে ছাগলটি জড়প্রাণ মূহুর্ত। ঝড়ঝড় করে কণ্ঠনালী দিয়ে রক্ত নির্গত হচ্ছে। বুড়িটি হুচুড়খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল এবং সাশ্রুসজলনয়নে আকশের দিকে থাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর পর সরোদনস্বরে চিৎকার করতে লাগল ” হায়! আমার ভালোবাসার ছাগল, হায়! আমার প্রাণের বন্ধু “।

তার এই দুঃচিৎকার শোনে আমি দ্রুতপদবিক্ষেপে গেলাম বুড়িটির দিকে। বুড়িটিকে জিজ্ঞাস করলাম “কি হয়েছে আপনার? বলবেন কি একটু”?

বুড়িটি বললো “তুমি কি দেখতেছোনা আমার ছাগলের দিকে? ”

আমি বললাম “এটি কিভাবে হলো ”

অতঃপর সে সরোদনে আমাকে কবিতস্বরে বলতে লাগল :-

দুঃখে ভরা মন যে আমার কাকে বলি বল?