কুড়িগ্রামে এক টাকায় খাতা-কলম, ১০ টাকায় শাড়ি-লুঙ্গি দিচ্ছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মার্চ ০১ ২০২২, ১৪:৩১

রোকন সরকার, কুড়িগ্রাম: অভাবী শিক্ষার্থী এক টাকায় খাতা-কলম এবং অভাবী মানুষকে ১০ টাকার বিনিময়ে শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণ করছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। পাশাপাশি চরাঞ্চলসহ প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করছে সংগঠনটি। সংগঠনের এমন কার্যক্রমে খুশি সুবিধাভোগীরা।

ত্রাণ না নেবার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসা এবং চরসহ গ্রামের প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষদের স্বাস্থ্য সচেতনতার লক্ষ্যে প্রায় দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে কাজ করছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ফাইট আনটিল লাইট (ফুল) যুব সংস্থা।

বিনামূল্যে জ্বর পরিমাপ, ব্লাড প্রেসার, ওজন পরিমাপ, পালস ও অক্সিজেন পরিমাপ, ডায়াবেটিস পরীক্ষা করাসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্য সেবা, মানবতার বাজার, ২৫০টি ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প এবং দশ টাকায় অসহায় বাবা-মায়ের শাড়ি-লুঙ্গি, দুই টাকায় গৃহিনীর ব্লাউজ পিচ, ব্লেড, সাবান, মাস্ক ও এক টাকায় দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মাঝে দুটি খাতা-কলম বিতরণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে আসছে।

করোনার দুর্যোগে ২০২০ সালের ১ মে থেকে ২০২১ সালের ৩০ডিসেম্বর পর্যন্ত কুড়িগ্রাম সদর ও ফুলবাড়ী উপজেলার গর্ভবতী মাসহ প্রায় সাড়ে ৪০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্য সেবা প্রদান এবং দুই হাজার রোগীদের বিনা মূল্যে প্রয়োজনীয় ঔষধ দেওয়া হয়। জটিল রোগীদেরকে সরকারিভাবে সঠিক চিকিৎসা নিতেও দেওয়া হয় সু-পরামর্শ। নিয়মিতভাবে করোনাসহ স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করতে প্রতি সপ্তাহে বাড়ি বাড়ি উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। আর এসব মানবিক কাজ করছে জেলার দুটি উপজেলায় ৫১জন ভলান্টিয়ারসহ বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ, ঢাকার রেজিস্টার্ডকৃত তিনজন ডিএমএফ ডাক্তার। অরাজনৈতিক এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে করোনার দুর্যোগে প্রায় ১৯ হাজার সার্জিক্যাল মাস্ক, তিন হাজার সাবান, ৫১জন অসহায় মা-বাবাকে শাড়ি-লুঙ্গি, দেড় শতাধিক গৃহবধুকে ব্লাউজের কাপড়সহ প্রায় ১২০০ শিক্ষার্থীর মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ ফুল যুব সংস্থার এমন কার্যক্রমে অভিভূত।

উপজেলার কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নের রায়পুর গ্রামের বিধবা হামিদা বেগম বলেন, ‘তালাক প্রাপ্ত মেয়ে মিনু খাতুনকে নিয়ে সংসার। বাড়িতে আর কেউ নেই। হঠাৎ একদিন গভীর রাতে মিনু খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ে। কোথায় কোন যানবাহন নেই, একলা মানুষ কি করব ভেবে পাইচ্ছি না? এসময় ফুল অফিসের ভাইদেরকে ফোন দেই। ফোন দেওয়ার পর রাতেই ডাক্তার আসে বাড়িতে। চিকিৎসা দেই সঙ্গে ওষুধের ব্যবস্থা করেন তারা। ওমরা গুলা কোন ভিজিট নেয়নি। এমন সেবা পামো চিন্তায় আসেনি।’

খবির মণ্ডল বলেন, ‘আমি মেলা রোগে আক্রান্ত। হাসপালেও ভর্তি ছিলাম। পরে ফুল সংস্থার লোকজন আমাকে নিয়মিত ডায়াবেটিস, প্রেসার মাপে। সময় মতো তারা আমার খোঁজ-খবর রাখেন। ওদের সেবা যত্নে আমি এখন সুস্থ, চলতে পারি। তারা পরিবারের সদস্যদের মতই আমার নিয়মিত খোঁজ রাখেন। তাদের কাজে আমিসহ এলাকার মানুষ বেশ খুশি।’

হরিশ্বর গ্রামের বাসিন্দা গর্ভবতী হাওয়া বেগম বলেন, ‘ফুল থেকে আমার শারীরিক অবস্থা চেকআপ করেন। ক্যালসিয়াম বা আয়রন বড়ি লাগবে তারা নিজেরাই দেয় বিনামূল্যে। এই অসুস্থ শরীর নিয়ে হাসপাতালে যেতে হয় না। বাড়িতে এসে এমন সেবা পাওয়া আমি খুশি।’

রিনা বেগম বলেন, ‘ফুলের কাদের ভাই মাসে মাসে এসে এলাকায় বাচ্চাদেরকে এক টাকায় দুটি খাতা-কলম এবং অসহায় বাবা-মায়ের জন্য দশ টাকায় শাড়ি-লুঙ্গি দেন। তাদের এই কাজ ১৫-১৬বছর থেকে দেখছি। এছাড়া বাড়ি-বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্য সেবা দেন বিনামূল্যে।’

শাহি ইসলাম ইমন বলেন, ‘আমার যখন তিন দিন বয়স তখন আমার মা মারা যায়। এরপর বাবা চলে যায়। বর্তমানে আমার নানির বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করছি। খলিলগঞ্জ স্কুল অ্যান্ড কলেজে দশম শ্রেণির ছাত্র। ফুল সংস্থা আমার খাতা-কলম দিয়ে সহযোগিতা করে।’

ভলান্টিয়ার ডা. তৌহিদুর রহমান বলেন, ‘মানুষ হিসেবে নিজেদের দায়বদ্ধতা থেকে প্রান্তিক মানুষের পাশে দ্বাঁড়ানোর লক্ষে বিনামূল্যে দীর্ঘদিন থেকে স্বেচ্ছায় মানবসেবায় নিয়োজিত হয়েছি ফুল যুব সংস্থার ভলান্টিয়ারগণ। লেখাপড়ার এবং সাংসারিক কাজ মিটিয়ে এই সেবা কার্যক্রমে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন সদস্যরা। কোন ধরনের বিনিময় ছাড়াই আমরা প্রান্তিক মানুষের সেবা নিশ্চিত করে যাচ্ছি।’

ফুল যুব সংস্থা প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক আব্দুল কাদের বলেন, ‘২০০৪ সাল থেকে প্রান্তিক মানুষের সেবা নিজ উদ্যোগে শুরু করি মানবসেবা। এরপর কাজের পরিধি বাড়াতে ২০১৪ সালে যুব সংস্থা,যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধিত হয় ফুল যুব সংস্থা। কোন ধরনের সরকারী-বেসরকারী আর্থিক সহযোগিতা ছাড়াই ফুল সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।

উপজেলার যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা ফুলবাড়ি শ্যামল কুমার দাস ফুল সংস্থার নিবন্ধিত হবার কথা নিশ্চিত করে এই কর্মকর্তা বলেন, আমি নিজেও তাদের সামাজিক কার্যক্রমগুলো দেখেছি। তারা বিনামূল্যে সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন আসছে। প্রান্তিক মানুষের স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষার্থীদের কলম-খাতা এবং অসহায় বাবা-মাকে শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণ করে আসছে।