কুফা অভিমুখে র‌ওয়ানা: যুক্তিসংগত ছিল কিনা?

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

সেপ্টেম্বর ১৩ ২০১৯, ০০:১৪

হুসাইন আহমদ বাহুবলী

বিজ্ঞ সাহাবীদের মতে কুফার উদ্দেশ্যে হযরত হুসাইন রা. বের হওয়াতে কল্যাণের কোন লক্ষণ পরিলক্ষিত হয় নি। এ জন্যই অনেক সাহাবী তাঁকে বের হতে নিষেধ করেছেন এবং তাঁকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছেন।

কিন্তু তিনি বিরত হন নি। কুফায় যাওয়ার কারণেই ঐ সমস্ত জালেম ও স্বৈরাচারেরা রাসূলের দৌহিত্রকে শহীদ করতে সক্ষম হয়েছিল। তাঁর বের হওয়া এবং নিহত হওয়াতে যে পরিমাণ ফিতনা ও ফসাদ সৃষ্টি হয়েছিল, মদীনায় অবস্থান করলে তা হওয়ার ছিল না।

যে সকল সাহাবী তাঁকে বের হতে নিষেধ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর, আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর, আব্দুল্লাহ বিন আমর এবং তাঁর ভাই মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফীয়ার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ইবনে উমার রা. হুসাইনকে লক্ষ্য করে বলেন, হুসাইন! আমি তোমাকে একটি হাদীস শুনাবো। জিবরীল আ. আগমন করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দুনিয়া এবং আখিরাত- এ দুটি থেকে যে কোন একটি গ্রহণ করার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন।

তিনি দুনিয়া বাদ দিয়ে আখিরাতকে বেছে নিয়েছেন। আর তুমি তাঁর অংশ। আল্লাহর শপথ! তোমাদের কেউ কখনই দুনিয়ার সম্পদ লাভে সক্ষম হবেন না। তোমাদের ভালর জন্যই আল্লাহ তোমাদেরকে দুনিয়ার ভোগ-বিলাস থেকে ফিরিয়ে রেখেছেন।

হযরত হুসাইন রা. তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন এবং যাত্রা বিরতি করতে অস্বীকার করলেন। অতঃপর ইবনে উমর রা. হুসাইন রা.’র সাথে আলিঙ্গন করে বিদায় দিলেন এবং ক্রন্দন করলেন।

সুফীয়ান সওরী ইবনে আব্বাস রা. থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণনা করেন যে, ইবনে আব্বাস রা. হযরত হুসাইন রা.কে বলেছেন, মানুষের দোষারোপের ভয় না থাকলে আমি তোমার ঘাড়ে ধরে বিরত রাখতাম।

বের হওয়ার সময় আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর রা. হুসাইনকে বলেছেন: হোসাইন! কোথায় যাও? এমন লোকদের কাছে, যারা তোমার পিতাকে হত্যা করেছে এবং তোমার ভাইকে আঘাত করেছে?

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. বলেছেন: হুসাইন তাঁর জন্য নির্ধারিত ফয়সালার দিকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছেন। আল্লাহর শপথ! তাঁর বের হওয়ার সময় আমি যদি উপস্থিত থাকতাম, তাহলে কখনই তাকে যেতে দিতাম না। তবে বল প্রয়োগ করে আমাকে পরাজিত করলে সে কথা ভিন্ন।

(ইয়াহ্-ইয়া ইবনে মাঈন সহীস সূত্রে বর্ণনা করেছেন)

এই সকল রিওয়ায়াত কার‌ও হৃদয়ে সন্দেহের বীজ ঢালতে পারে। বিশেষ করে আশুরার মৌসুমে যে সকল লেখকদের লেখায় এমন বর্ণনার পর কোনো সামঞ্জস্য উল্লেখ করা হয় না, পাঠক এতে বিভ্রান্ত হন অনায়াসে।

প্রথমত: মানতে হবে, মানুষের অনিচ্ছা সত্ত্বেও আল্লাহর নির্ধারিত ফয়সালা ও তকদীরের লিখন বাস্তবে পরিণত হওয়া ছাড়া ভিন্ন কোন উপায় ছিল না। হযরত হুসাইন রা. হত্যায় বিরাট বড় অন্যায় সংঘটিত হয়েছে, কিন্তু তা নবীদের হত্যার চেয়ে অধিক ভয়াবহ ছিল না।

আল্লাহর নবী ইয়াহ-ইয়া আ.কে পাপিষ্ঠরা হত্যা করেছে। জাকারিয়া আ.কেও তাঁর জাতির লোকেরা নির্মমভাবে শহীদ করেছে। এমনি আরও অনেক নবীকে বনী ইসরাইলরা কতল করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন:

ﻗﻞ ﻗﺪ ﺟﺎﺀﻛﻢ ﺭﺳﻞ ﻣﻦ ﻗﺒﻠﻲ ﺑﺎﻟﺒﻴﻨﺎﺕ ﻭﺑﺎﻟﺬﻱ ﻗﻠﺘﻢ ﻓﻠﻢ ﻗﺘﻠﺘﻤﻮﻫﻢ ﺇﻥ ﻛﻨﺘﻢ ﺻﺎﺩﻗﻴﻦ

“তুমি তাদের বলে দাও, তোমাদের মাঝে আমার পূর্বে বহু রসূল নিদর্শনসমূহ এবং তোমরা যা আবদার করেছ তা নিয়ে এসেছিলেন, তখন তোমরা কেন তাদেরকে হত্যা করলে যদি তোমরা সত্য হয়ে থাক।” (সূরা আল-ইমরান: ১৮৩)

এমনভাবে হযরত উমর রা., উসমান রা. ও আলী রা.কেও হত্যা করা হয়েছে। সুতরাং তাঁর হত্যা কাণ্ড নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করার কোন যুক্তি নেই।

দ্বিতীয়ত: খেলাফতের বাইয়াত গ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়ে কুফাবাসীদের পক্ষ থেকে দেড়শত থেকে পাঁশত চিঠি হযরত হুসাইন রাযিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর হস্তগত হওয়ার বিভিন্ন রিওয়ায়াত পাওয়া যায়।

এইএই চিঠিগুলো তাঁকে খিলাফত আলা মিনহাজিন নুবুওওয়াহ এর স্বপ্ন দেখতে বাধ্য করেছিল। চিঠির আহবানে তিনি সাড়া না দিলে হয়তো ইতিহাস অন্যভাবে রচিত হতো। তাঁকে ভীরু-কাপুরুষ, ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠায় অনিচ্ছুক বলে উপস্থাপন করা হত।

এমনকি বিশ্বের সরলপ্রান মুসলিমরাও হয়তো আক্ষেপের সুরে বলতো হায়! তিনি কেন এগিয়ে গেলেন না! তাহলে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা হত!

তৃতীয়ত: তিনি শুধু চিঠিতেই ভরসা করেন নি। আপন চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকিলকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠিয়ে ছিলেন। তিনি কুফা পৌঁছার পর ১৮০০০ ইরাকী তার হাতে হযরত হুসাইন রাজিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর পক্ষে খেলাফতের বায়াত গ্রহণ করেন। পরিবেশ অনুকূলে দেখে তিনিহযরত হুসাইন রাজিয়াল্লাহু আনহুকে কুফা অভিমুখে রওয়ানা হওয়ার পরামর্শ দিয়ে চিঠি লিখেন। এই চিঠি তাঁর হস্তগত হয়ে গিয়েছিল। ইসলামী খেলাফতের এক স্বপ্নদ্রষ্টার কাছে এই সকল উপাদান উপস্থিত থাকতে খেলাফতের বাইয়াত গ্রহণে কালক্ষেপণ করা কোনক্রমেই বৈধ হতো না।

চতুর্থত: মুসলিম বিন আকীলের হাতে হুসাইন রা.’র পক্ষে ১৮০০০ ইরাকীর বাইয়াত গ্রহণের খবর তৎকালীন গভর্নর উবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদের কর্ণগোচর হল। সাথে সাথে সমবেত বাইআত গ্রহণকারীদের সামনে চরম বৃত্তিমূলক মূলক বক্তব্য দিল। এতে সে এজিদের দুর্দান্ত ক্ষমতা ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের কারণে কঠোর শাস্তি উচ্চারণ করল।

এতেই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে১৮০০০ অনুগামী থেকে কমতে কমতে মাত্র তিনজন অবশিষ্ট রইল। সংক্ষিপ্ত এক লড়াইয়ের পর মুসলিম বিন আকিল বন্দী হলেন ওবায়দুল্লাহ যাদের হাতে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবার আগে শেষ ইচ্ছা হিসেবে তিনি হাসান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বরাবরে একটি চিঠি পাঠাবার আবদার করলেন। তার আবদার মঞ্জুর হল। তিনি চিঠি লিখলেন

চিঠির সংক্ষিপ্ত বক্তব্য ছিল এ রকম: 

“হুসাইন! পরিবার-পরিজন নিয়ে ফেরত যাও। কুফা বাসীদের ধোঁকায় পড়ো না। কেননা তারা তোমার সাথে মিথ্যা বলেছে। আমার সাথেও তারা সত্য বলেনি। আমার দেয়া এই তথ্য মিথ্যা নয়।”

যাত্রা পথে হুসাইনের কাছে মুসলিমের সেই চিঠি এসে পৌঁছল। চিঠির বিষয় অবগত হয়ে তিনি কুফার পথ পরিহার করে ইয়াজিদের কাছে যাওয়ার জন্য সিরিয়ার পথে অগ্রসর হতে থাকলেন।

পথিমধ্যে ইয়াজিদের সৈন্যরা আমর বিন সাদ, সীমার বিন যুল জাওশান এবং হুসাইন বিন তামীমের নেতৃত্বে কারবালার প্রান্তরে হুসাইনের গতিরোধ করল।

হুসাইন রা. সেখানে অবতরণ করে আল্লাহর দোহাই দিয়ে এবং ইসলামের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনটি প্রস্তাবের যে কোন একটি প্রস্তাব মেনে নেওয়ার আহবান জানালেন।

(১) হুসাইন বিন আলী রা.কে ইয়াযীদের দরবারে যেতে দেয়া হোক। কেননা তিনি জানতেন যে, ইয়াজিদ তাঁকে হত্যা করতে চান না।

(২) অথবা তাঁকে মদিনায় ফেরত যেতে দেয়া হোক।

(৩) অথবা তাঁকে কোন ইসলামী অঞ্চলের সীমান্তের দিকে চলে যেতে দেয়া হোক। সেখানে তিনি মৃত্যু পর্যন্ত বসবাস করবেন এবং রাজ্যের সীমানা পাহারা দেয়ার কাজে আত্ম নিয়োগ করবেন। (ইবনে জারীর হাসান সনদে বর্ণনা করেছেন)

ইয়াজিদের সৈন্যরা কোন প্রস্তাবই মানতে রাজী হল না। তারা বলল: উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদ যেই ফয়সালা দিবেন আমরা তা ব্যতীত অন্য কোন প্রস্তাব মানতে রাজী নই।

এই কথা শুনে উবাইদুল্লাহর এক সেনাপতি, হুর বিন ইয়াজিদ বললেন: এরা তোমাদের কাছে যেই প্রস্তাব পেশ করছে তা কি তোমরা মানবে না?

আল্লাহর কসম! তুর্কী এবং দায়লামের লোকেরাও যদি তোমাদের কাছে এই প্রার্থনাটি করত, তাহলে তা ফেরত দেয়া তোমাদের জন্য বৈধ হত না।

এই তিনটি প্রস্তাব প্রমাণ করে তিনি যখন নিশ্চিত হলেন খিলাফত আলা মিনহাজিন নুবুওওয়াহর পথ কঠিনভাবে রুদ্ধ হয়ে আছে। এখন সম্ভাবনা টুকু আর বাকি নেই। তখন তিনি নিজেকে নিবৃত্ত করার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন।

প্রশাসনের সুনজর কাঁড়ার জন্য ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে তাকে যখন আত্মসমর্পণের প্রস্তাব করলো। এহেন পরিস্থিতিতে এক হাশেমী, কোরাইশী, খেলাফতের উপযুক্ত ব্যক্তিত্বের আত্মসমর্পণ করা, বন্দী হয়ে যাওয়া ওয়াজিব ছিলনা। ঐচ্ছিক এই সুযোগটাকে তিনি বীরত্বের জন্য বেছে নিলেন এবং বীরের বেশে শহীদ হলেন।

হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর পদক্ষেপ তার অবস্থান থেকে সঠিক ছিল। ছিল সকল প্রশ্নের উর্দ্ধে। আজ যারা অভিযোগের আঙুল তুলতে চায়, তারা তো গবেষক সেজেছে কারবালার অকল্পনীয় দুর্ঘটনা ঘটার পর। নতুবা হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু যে সকল তথ্যের ভিত্তিতে কুফা গমনে উদগ্রীব ছিলেন ওই সময় আজকের এই গবেষকরা থাকলে তারাও হয়তো এই সিদ্ধান্ত‌ই নিতেন।