কারাগারে যেমন আছেন আফিয়া সিদ্দিকি (১ম পর্ব)

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুন ০৫ ২০২৩, ২৩:০৮

নোমান বিন আরমান: বিশ বছর! অপহরণ, আটক ও বন্দিজীবনের টানা ২০ বছর পর স্বজনদের দেখা পেলেন নি-পী-ড়িত, নি-র্যাতিত স্নায়ুবিজ্ঞানী ড. আফিয়া সিদ্দিকী। পাকিস্তানি এই বিজ্ঞানী মাথায় ৮৬ বছরের সাজা নিয়ে আমেরিকায় বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন। ২০০৩ সালের মার্চে তিন সন্তানসহ করাচি থেকে তাকে অ-পহরণ করা হয়। নিয়ে যাওয়া হয় কুখ্যাত বাগ-রাম কারাগারে। অ-পহরণের সময় ৬ মাস বয়েসী এক বাচ্চাও সাথে ছিলো। ছেলেটি কোথায় আছে, সেই হদিস এখনও মিলেনি! অনেকে ধারণা করছেন, তাকে হ-ত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। ২০ বছরের মধ্যে একটিবারের জন্য আফিয়াকে তাঁর কোনো স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হয়নি।

২০ বছর পর বুধ ও বৃহস্পতিবার ড. আফিয়ার সঙ্গে দেখা করেছেন তাঁর বড় বোন ড. ফৌজিয়া সিদ্দিকী। সঙ্গে ছিলেন পাকিস্তানের সংসদ সদস্য মুশতাক আহমদ খান ও মার্কিন মানবাধিকারকর্মী ক্লাইভ স্ট্যাফোর্ড-স্মিথ। প্রথম দফায় আড়াই ঘণ্টা ও দ্বিতীয় দফায় তিন ঘণ্টার সাক্ষাৎ হয়েছে তাদের। সাক্ষাৎকারের পুরো কথোপকথন রেকর্ড করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন মুশতাক আহমদ খান। সাক্ষাৎ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমকে ব্রিফিং ও টুইটারে ফলোআপ দিচ্ছেন তিনি।

মানবাধিকারকর্মী ক্লাইভ ইতোমধ্যে গো-য়ান্তা-নামো কারা-গার থেকে দু’বন্দির মুক্তিতে সহয়াতা করে প্রসংশিত হচ্ছেন। এরমধ্যে একজন ২০ বছর অন্যজন ২১ বছর থেকে বন্দি ছিলেন। তার এই সফলতার পরই আফিয়ার মুক্তির ব্যাপারে নতুন করে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। ২০ বছর পর আফিয়ার সঙ্গে তাঁর বোনকে সাক্ষাৎ করতে দেওয়ায়, নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে।

সিনেটর মুশতাক আহমদ খান টুইটারে ও গণ্যমামকে জানিয়েছেন, আফিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় মধ্যখানে গ্লাসের দেয়াল ছিলো। গ্লাসের দুই পাশ থেকে দু’বোন কথা বলেন। দীর্ঘ বন্দিত্ব, নির্যা-তন ও একাকিত্বে বিধ্বস্ত আফিয়াকে শেকল পরিয়ে কয়েদির পোশাকে তাঁদের সামনে আনা হয়। তখন সেখানে এক ভাবাবেগের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। দু’বোনের চোখ অশ্রুতে ভেসে যায়।

২০ বছর থেকে শেকলবন্দি করে রাখা আফিয়াকে দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে আমেরিকা। কিন্তু ইসলামের সঙ্গে তার সংযোগে ছেদ বসাতে পারেনি। কয়েদি অবস্থায়ও তিনি পরিপূর্ণভাবে স্কার্ফ ব্যবহার করছেন। প্রথম দিনের সাক্ষাতে তিনি অফ হোয়াইট স্কার্ফ পরা ছিলেন।

কান্নায়-আলাপে কেটে যায় আড়াই ঘণ্টা। বিশ বছর পর স্বজনের আড়াই ঘণ্টার সান্নিধ্যে স্নাত হন আফিয়া। তবে কেউ কাউকে ছুঁতে না পারার হাহাকার নিয়ে বুধবারের সাক্ষাৎ শেষ হয় তাদের।আজকের সাক্ষাৎ নিয়ে বিস্তারিত কিছু এখনও জানা যায়নি।

মুশতাক আহমদ খান জানিয়েছেন, আফিয়ার সামনের চারটি দাঁত পড়ে গিয়েছে। কারা-গারে হা-মলা ও নির্যা-তনে দাঁত পড়ে গিয়েছে বলে আফিয়া জানিয়েছেন। সাক্ষাতের সময় বারবার তিনি বলছিলেন, ‘আমাকে এই জাহান্নাম থেকে বের করো।’

আফিয়া এখনও জানেন না, তার সন্তানদের ভাগ্যে কী ঘটেছে। জানেন না, তাঁর ছয় মাস বয়েসী সুলাইমান কোথায় আছে। বড় দুই সন্তান মুহাম্মাদ ও মাইয়ামের ছবি ফৌজিয়া সঙ্গে নিয়ে গেলেও, আফিয়াকে তা দেখতে দেয়নি কারা কর্তৃপক্ষ। তার মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে মায়ের মৃত্যুর খবরও ছোট বোনকে জানাননি ফৌজিয়া।

আফিয়া একবার তাঁর মাকে চিঠিতে বলেছিলেন, ‘মা! আমি যদি কারা-গারে মারা যাই, আমার জন্য দুঃখ করো না। কিয়ামতের দিন আমি রাসূলের পায়ের কাছে বসে তাদের নামে বিচার দেবো, এক মুসলিম বোন শত্রুদের কারাগারে বন্দি থাকার পরও যারা নিজেদের আত্মমর্যাদা ও আত্মপরিচয় ভুলে গিয়েছে, বিকিয়ে দিয়েছে।

সংসদ সদস্য মুশতাক আহমদ খান ও ড. ফৌজিয়া বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন। মুশতাক জানিয়েছেন, ‘আফিয়ার মুক্তির চাবিকাঠি ওয়াশিংটন নয়, রয়েছে পাকিস্তানের কাছে। পাকিস্তানকেই রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁর মুক্তির উদ্যোগ নিতে হবে।’

আফিয়ার মুক্তির ব্যাপারটি আমেরিকা-আফগানের কাতার চুক্তিতেও ছিলো। ওই সময় ধারণা করা হচ্ছিলো দু’য়েক মাসের মধ্যেই তিনি মুক্তি পেতে যাচ্ছেন। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, পাকিস্তান সরকারের ‘বিরোধিতার’ ফলেই তার মুক্তি আটকে যায়।

আফিয়ার মা ইসমত সিদ্দিকী ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে হৃদয়স্পর্শী একটি চিঠি লিখেছিলেন। এতে তিনি বলেছিলেন, ‘অ-পহরণের পর আমার মেয়েকে এই কয়েক বছর ধরে জোর করে তার সন্তানদের কাছ থেকে আলাদা করে রাখা, তার ওপর নির্যাতন চালানো, গুলি চালানো, মারধর করা, শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা এবং বিবস্ত্র করার ভাবনায় আমার হৃদয় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। এমনকি, এখনো তার ডিটেনশন ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে সাধারণ সৌজন্যবোধও মানা হচ্ছে না। বুলেটের ক্ষতস্থান থেকে চুঁইয়ে পড়া রক্ত নিয়ে নিউ ইয়র্কে পৌঁছার পর এক মাস তাকে কোনো চিকিৎসা দেয়া হয়নি।’

তিনি চিঠিতে আরও লিখেন, ‘সতের বছর বয়সে আমার মেয়েকে আপনার দেশে পাঠিয়েছিলাম, যাতে এমন শিক্ষা গ্রহণ করে যা বিশ্বের আর কোথাও সম্ভব হতো না। তাকে সেই মূল্যবোধ শিখিয়েছিলাম- দয়ালু হতে ও সত্য-ন্যায়ের পক্ষে কাজ করতে; প্রয়োজনে মানুষের পাশে দাঁড়াতে এবং অসহায় মানুষকে সহায়তা দিতে। আমার মেয়েকে সেটাই শিখিয়েছিলাম, যা আমেরিকার অবস্থান। কিন্তু আমি অবাক হই, আপনারা যখন সে মূল্যবোধ ভুলে যান। যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেয়া তার সন্তানেরা প্রশ্ন করে- কেন তাদের অপহরণ ও নির্যাতন করা হয়েছিল? কেন এদের দেশ এদের ওপর এমন আচরণ করল? আপনি কি এর জবাব দিতে পারেন, মি. প্রেসিডেন্ট?’

ড. আফিয়া যদি কিয়ামতের দিন রাসূলের কাছে বিচার দেন, আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করেন- কী অবস্থা হবে তখন!

চলবে…