করোনা ও প্রবাসী সমাচার

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

মার্চ ২৮ ২০২০, ১৭:০৩

মাওলানা ইমরান আহমেদ

সরকারি পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের বর্তমান প্রবাসীর সংখ্যা—সোয়া কোটির মতো। কেবল সৌদি আরবেই প্রায় ২২ লাখের ওপরে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী সর্বশেষ অর্থবছর, অর্থাৎ ২০১৯ সালে দেশের মোট র‌েমিট্যান্স আয় ছিল ১৮.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ১৫০০ বিলিয়ন, মানে দেড় লাখ কোটি টাকারও বেশি। যা বাংলাদেশের মোট জিডিপিরই ১২ শতাংশ! চোখ কপালে তোলা আরেকটা তথ্য হলো—গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মোট রিজার্ভ ছিল কমবেশি ৩২ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে প্রবাসীদের অবদানই অর্ধেকের ওপরে!

বাংলাদেশের অর্থনীতি কতোটা রেমিট্যান্স নির্ভর, সেটা বোঝা যায় জিডিপি বা রিজার্ভে রেমিট্যান্সের সরাসরি প্রভাব বিবেচনায়। এ ক্ষেত্রে নেপালের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা সহজেই বুঝে আসবে। বিশ্বে রেমিট্যান্স আয়ের দিক থেকে নাম্বার ওয়ান পজিশনে আছে ১৩৫ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারত। তাদের বার্ষিক রেমিট্যান্স আয় কমবেশি ৮০ বিলিয়ন ইউএস ডলার। অথচ ইন্ডিয়ার জিডিপি’তে রেমিট্যান্সের অবদান মাত্রই ২.৮ শতাংশ। যেটা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ১২ শতাংশ, ভাবা যায়! সীমাহীন দুর্নীতি আর লাগামহীন রাষ্ট্রীয় অপচয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি এমনিতেই চিরকালীন ছন্নছাড়া। একমাত্র রেমিট্যান্স ছাড়া অর্থনীতির অন্য সব সূচকের অবস্থা শোচনীয়। রপ্তানি বাণিজ্যে ধস। রাজস্ব আদায় প্রতিনিয়ত কমছে। মূল্যস্ফীতি উর্ধ্বমুখি। আমদানিও নিম্নমুখি। বিনিয়োগে খরা কাটছে না। ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পাহাড়। শেয়ারবাজারে তো শনিই লেগে আছে। সে কারণে বলা যায়, একমাত্র প্রবাসীদের পাঠানো পিওর রেমিট্যান্সই এখন পর্যন্ত সচল রেখেছে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা। এটা শুধু শুধু আমার দাবি নয়—দেশের অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণও এটাই।

হঠাৎ অর্থনীতির জটিল এই পরিসংখ্যান নিয়ে ঘাটাঘাটি কেন? কেন এই পাঁচালি? হ্যাঁ, প্রবাসীরা যে অচ্ছুৎ নয়—বরং সত্যিকার অর্থেই ‘নবাবজাদা’ মূখ্যত আজ সেটাই প্রমাণ করা। কেননা যাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পুঁজির ওপর দাঁড়িয়ে আছে ‘সোনার বাংলার’ অর্থনীতি, যাদের রক্ত-ঘামের রেমিট্যান্সের বদলৌতেই আমরা আজ প্রবৃদ্ধির দিক দিয়ে কানাডা, রিজার্ভ ও জিডিপি বিবেচনায় হংকং, সিঙ্গাপুরকে পেছনে ফেলার কৃতিত্ব দাবি করি—আজ তাদেরকে নিয়েই খোদ রাষ্ট্রীয়ভাবে টিটকারি করা হচ্ছে! ডাক্তারের চেম্বার, সুপার শপ, শপিং মল, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শোরুম, এমনকি মুদি দোকানে পর্যন্ত সাইনবোর্ড টানানো ‘‘প্রবাসীদের প্রবেশ নিষেধ!’’ সবচে’ হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে বাংলাদেশের বর্তমান বেকুব প্রজন্ম যে স্মার্টফোন দিয়ে ইন্টারনেট মারাচ্ছে, বাঁকা মন্তব্যে প্রবাসীদের কলজেকে ফালাফালা করছে, খোঁজ নিয়ে দেখেন—সেসব ফোনের ২৫ শতাংশই সরাসরি প্রবাস থেকে ইম্পোর্টেড! আর ৫০ শতাংশে হয় প্রত্যক্ষ না হয় পরোক্ষ—নিশ্চিত প্রবাসী অর্থায়ন রয়েছে!

যাক, কথা সেটা না। কথা হলো, দেশ সবার। সবাই যার যার অবস্থান থেকে দেশ গড়ায় অংশ নিচ্ছেন। কেউ দেশে থেকে, কেউ বিদেশে এসে। প্রবাসীরা যেহেতু প্রতিকূল পরিবেশে এসে, নিজের মা, মাটি, স্বজন ছেড়ে দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতিতে নিরন্তর অক্সিজেন সাপ্লাই দিয়ে চলছেন, তাই তাদের ব্যাপারে সরকারের যতটুকু মনোযোগ থাকা দরকার ছিল, আদতে তার ছিটেফোঁটাও নেই। না দেশে, না প্রবাসে। তারা বরং হয়রানি এবং অার্থিক ক্ষতিরই শিকার হচ্ছেন সর্বত্র। নতুন একজন বিদেশযাত্রীর জন্য যেসব ফরমালিটির প্রয়োজন—বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় সেসব ফিলআপ করতে গিয়েই একজন বিদেশযাত্রী সর্বশান্ত ও হীনবল হতে বাধ্য। পাসপোর্ট থেকে শুরু, মেডিকেল চেকআপ, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ট্রেনিং, ম্যানপাওয়ার—এক কথায় পুরো প্রক্রিয়াটাই আকণ্ঠ দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় ঠাসা। এতো কিছুর পর এয়ারপোর্টে এসেও কিন্তু তাদের নিস্তার নেই। নানাবিধ হয়রানিরও অন্ত নেই। সত্যি বলতে বিদেশের এয়ারপোর্টগুলোয় প্রবাসীরা যতোটা কমফোর্টেবল ফিল করেন, ততোটাই নার্ভাস হয়ে যান নিজেদের আঙ্গিনায় এসে।

বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই একটা সুর ওঠে গেছে, দেশে করোনা বিস্তারের জন্য নাকি একমাত্র প্রবাসীরাই দায়ী। কেবল প্রবাসীরাই দেশে করোনা ছড়াচ্ছেন। অথচ করোনার আঁতুরঘর চীন থেকে যখন কোনোরকম বাছ-বিচার ছাড়াই বিমান বোঝাই করে যাত্রী-শিক্ষার্থী নিয়ে আসা হলো, তখন কেউ রা’ও করলো না। কারণ, সরকার তখন আবাল ম্যাঙ্গোপিপলদেরকে মুজিববর্ষের সুরের মুর্ছনায় ঘুম পারিয়ে রেখেছিল। অবশেষে যখন শত শত কোটি টাকার পরিকল্পিত আতশবাজি শেষ হলো, তখনই ফোকাস ফেলা হলো করোনায়। আর তখন থেকেই করোনা ঠেকাতে অন্য কোনো কার্যকর উদ্যোগ না নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে কেবল প্রবাসীদেরকে দেশে ফিরতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। তথাপি মাটির টানে যারা ফিরছেন, তাদেরকে চরমভাবে লাঞ্ছিত করা হচ্ছে। সামাজিকভাবে অচ্ছুৎজ্ঞান করা হচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সর্বত্র বয়কটের ডাক দেয়া হচ্ছে। দুনিয়ার আর কোনো দেশে এরকমটা হচ্ছে কী না, আমার অন্তত জানা নেই।

যেহেতু বাংলাদেশের বিশাল সংখ্যক মানুষ প্রবাসী। স্বজন ছেড়ে বিদেশ বিঁভুইয়ে। তাও শখের বশে নয়। পেটের দায়ে, দেশের তরে; তারা করোনা আতঙ্কের মধ্যেও প্রতিনিয়ত আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকবেন—এটাই স্বাভাবিক। তাই তাদের নিরাপত্তার জন্য, দেশের সুরক্ষার জন্য আগ থেকেই সরকারের একটা গ্রহণযোগ্য গাইডলাইন, সুন্দর ও মানসম্পন্ন ব্যবস্থাপনা থাকা দরকার ছিল। কিন্তু এতে তারা চরমভাবে ব্যর্থ হয়ে উল্টো দায় চাপাচ্ছে ক্লান্ত-শ্রান্ত প্রবাসীদের কাঁধে। আর নির্বোধ আমজনতা কেউ মায়ের কোলে বসে, কেউবা বউয়ের আঁচলে দাঁড়িয়ে দোষ দিচ্ছে কেবলই প্রবাসীদেরকে। সরকারের দায় নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যাথা নেই। অথচ সরকারে হাতে প্রটেক্টের জন্য আড়াই মাসের মতো যথেষ্ট সময়ও ছিল।

করোনার উৎপত্তি চীনের উহানে। তাহলে ইতালি, ইরান, স্পেন, ইংল্যান্ড আর আমেরিকায় এতোটা ছড়ালো কী করে? অবশ্যই স্ব স্ব দেশের বিদেশযাত্রীদের মধ্য দিয়ে। খোঁজ নিয়ে দেখুন, এসব দেশের বিদেশযাত্রীরা রেমিট্যান্সের জন্য নয়, বরং অধিকাংশই প্রমোদভ্রমণ সেরে দেশের অর্থ বিদেশে উড়িয়ে দেশে ফিরেছেন। সঙ্গে বোনাস হিসেবে নিয়ে গেছেন করোনার বিষবাষ্প। তবুও তাদেরকে নিয়ে সেসব দেশে এ ধরণের নির্মম ট্রল অন্তত হচ্ছে না। দেশে ফিরতে বাধাও দেয়া হচ্ছে না। উল্টো সরকারগুলো তাদেরকে দেশে ফিরে যেতে জোর তাগিদ দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ ফ্লাইট দিয়ে উড়িয়েও নিচ্ছে। কারণ, সেসব দেশের সরকার ও জনগণ তাদের একটা নাগরিককেও উৎকট ঝামেলা মনে করে না। বরং সম্পদ হিসেবেই গণ্য করে। সৌদি আরবে ইরান ফেরতদের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম করোনার বিস্তার ঘটে। এরপরেও রাজতান্ত্রিক সৌদি সরকার জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই অান্তর্জাতিক সব ফ্লাইট বাতিল করার আগে ৭২ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছিল নাগরিকদের দেশে ফেরার জন্য। এমনকি নিজ নাগরিকদের বিশেষ ফ্লাইট পাঠিয়ে দেশে ফিরিয়েও নিয়ে এসেছে।

আসলে আমরা এমনই এক কমেডিয়ান জাতি, যার মন্ত্রীরা হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতিকেও ব্যাপার না বলে প্রকাশ্যে দাঁত কেলিয়ে হাসে! জনগণও তালি দিয়ে বাহবা দেয়। বাংলাদেশ দুর্নীতির এমনই এক অভয়ারণ্য, যেখানে হলমার্ক, সোনালি, ডেসটিনি, শেয়ার মার্কেটের মতো মেগা করাপশনকেও নাথিং মনে করা হয়! পদ্মা, রূপপুর, কর্ণফুলি, এক্সপ্রেসওয়ে, ফ্লাইওভারের তিনগুণ খরচাকেও কৃতিত্ব হিসেবে জাহির করা হয়! বালিশকাণ্ড, পর্দা কেলেঙ্কারি, পাপিয়া স্ক্যান্ডালকেও হেসেখেলে দিব্যি হজম করা হয়! সে দেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখাও তো বোকামি। যে দেশে ক’টা নারকেল গাছের দাম ধরা হয় ১৩ কোটি টাকা, একটা কলাগাছ হয়ে যায় ৬ লাখ টাকা, দু’টো টিনের ছাপড়ার ব্যয় ধরা হয় ৬ কোটি টাকা! তাও আবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পে—সে দেশের কর্ণধাররা অসৎ হারামজাদা নয় তো কী? আর প্রবাসী, যারা প্রতিনিয়ত কোমায় থাকা দেশের হরিলুটের অর্থনীতিকে অমূল্য অক্সিজেনে জিন্দা রাখেন—আখেরে তারাই তো নবাবজাদা! সবশেষে অলস ম্যাঙ্গোপিপল, যাদের অধিকাংশই সরাসরি প্রবাসী অর্থে প্রতিপালিত হয়েও স্বয়ং প্রবাসীদের নিয়েই মশকারি করে, যারা রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির প্রত্যক্ষদর্শী ও নীরব অংশীদার—তাদেরকে আর কী বলবো? মোক্ষম শব্দ যোগাতে এবার অভিধানই হাতড়াতে হবে…..