করোনাভাইরাস; বৈশ্বিক বিশ্লেষণ এবং বাঁচার জন্য করণীয় কিছু আমল 

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মার্চ ২৭ ২০২০, ১৮:০৪

•আহমদ কবীর খলীল•

বর্তমান পৃথিবীকে থমকে দেয়া এক ভয়াবহ মহামারীর নাম করোনা ভাইরাস। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য অনুযায়ী করোনা ভাইরাস মূলত ‘অনেকগুলো ভাইরাস এর সমন্বয়ে গঠিত ভাইরাসের বড় একটি গ্রুপ বা ফ্যামিলি’। যা সাধারণত ঠাণ্ডা লাগা থেকে শুরু হয়ে অনেক গুলো জটিল রোগের উৎপত্তিস্হল বা কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এটিকে অনেকে মার্স এবং সার্স এর সঙ্গে তুলনীয় বলেছেন। ২০১৯ সালে পরিচিতি লাভ করা এই ভাইরাসটি একটি নতুন ধরণের ভয়াবহ ভাইরাস।

বলা হয় থাকে এটা একটা জোনোটিক ভাইরাস, অর্থাৎ যা পশু এবং মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়। যেমনটি সার্স সংক্রমিত হয়েছিল বিড়াল জাতীয় প্রাণী থেকে মানুষের মাঝে এবং মার্সের বিস্তার ঘটেছিল উট থেকে মানুষের মধ্যে।

করোনা ভাইরাস এর সাধারণ উপসর্গ- জ্বর, কফ, শ্বাসকষ্ট। যার ফলে নিউমোনিয়া, জটিল শ্বাসকষ্ট, কিডনি জটিলতা এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।

নিম্মবর্ণিত সাবধানতা নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত করা জরুরি। যেমন: নিয়মিত হাত ধৌতকরণ, কাঁশি ও হাঁচির সময় নাক মুখ ঢেকে রাখা, সর্দি, কাঁশি, হাঁচিতে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে না যাওয়া, খাদ্য উচ্চ তাপমাত্রায় রান্না করা ইত্যাদি।

বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্থার (WHO) চীন শাখা ২০১৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর প্রথম কোরোনার ঘোষণা দেয় চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে I নিউমোনিয়া আক্রান্ত কিছু রোগীর এই ভাইরাস প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। উহান শহরের সীফুড ও পোলট্রি মার্কেটকে এর উৎপত্তিস্থল বলে সংসহাটি মনে করে  প্রথম ব্যাচে ৫৯ জনকে শনাক্ত করা হয় যাদেরকে জানুয়ারী মাসে ‘জিনটান’ হাসপাতালে ভর্তি করে বিচ্ছিন্ন পরিবেশে রাখা হয়।

এরপর হুবেই প্রদেশের ১৭১৬ জন স্বাস্থ্য কর্মী এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। আর এভাবেই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

বর্তমানে ইউরোপে করোনা মহামারী ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে ইটালি, স্পেন, জার্মান, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, গ্রেট ব্রিটেন, নেদারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, নরওয়ে, সুইডেনসহ আরও অনেক দেশ  এর মধ্যে নতুন মৃত্যু সংখ্যা এবং আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যার দিক দিয়ে ইতালি, স্পেন, জার্মানী, ফ্রান্স মারাত্মক অবস্থায় আছে।

মধ্যপ্রাচের দেশগুলোর মধ্যে ইরানের অবস্থাও খুবই নাজুক পর্যায়ে রয়েছে। এছাড়া কাতার, ইরাক, সৌদি আরব সহ অন্যান্য দেশ গুলোতেও প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলছে।

এশিয়াতে সাউথ কোরিয়ার অবস্থা বেশি নাজুক। এছাড়া জাপান, ইন্দোনেশীয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডে, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান এবং কানাডায়ও আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের বাংলাদেশও মারাত্মক ঝুঁকির মাঝে আছে।

 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বর্তমান পরিসংখ্যান অনুযায়ী আক্রান্ত মানুষের মধ্যে যারা ৬০+ বয়সের রয়েছেন এবং বিভিন্ন ধরণের হেলথ ইস্যুতে আছেন, যেমন ডায়বেটিস, উচ্চ রক্তচাপ সহ আরো অনেক কিছু’ তারাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণতায় অবস্থান করছেন। এছাড়া কোনো হেলথ ইস্যু ছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাধারণত ১৪-৩০ দিনের মধ্যে ভাইরাস মুক্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। এটা আবার ‘করোনা ভাইরাস পরিবারের’ নিম্ন পর্যায়ের কোনোটা দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার উপর নির্ভর করে। যদিও অধিকাংশ চিকিৎসকরা বলছেন, করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের প্রাথমিক অবস্থায় সনাক্ত করা অনেক কঠিন, আর যখন সনাক্ত করা হয় তখন তা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চলে যায়।

ভয়াবহ ও চিন্তার বিষয় হলো, করোনা ভাইরাসটি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া করোনা ভাইরাসের যথার্থ এ্যান্টিভাইরাস এখনও পুরোপুরি আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। চিকিৎসা বিঙানিরা যা বলছেন তা কেবল প্রচেষ্টার অংশ বিশেষ হিসেবেই দেখা যেতে পারে। অতএব, এমন একটা ভয়াবহ মহামারী থেকে বাঁচার জন্য মহান স্রষ্টার স্মরণাপন্ন হওয়ার বিকল্প নেই। তাছাড়া বিশ্বের অধিকাংশ ইসলামী বিশেষঙদের বক্তব্য অনুযায়ী এটা সীমাহীন জুলুম ও পাপাচারের কারণে আল্লাহর গজব! এত্থেকে বাঁচতে হলে তাওবা ছাড়া উপায় নেই।

 

উল্লেখ্য যে, মুমিন- মুসলমানরা কখনও রোগসংক্রমণে বিশ্বাসী নয়। তবে দুনিয়ার প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী রোগ জীবাণু একের কাছ থেকে অন্যের কাছে স্হানান্তরিত হতে পারে এবং আল্লাহর হুকুমে অন্যও সেই জীবাণুর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর একারণেই হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো মহামারী আক্রান্ত স্থানে বহিরাগমন থেকে বারণ করেছেন।

★ যুগে যুগে নাজিল হওয়া আযাব গজবের ঐতিহাসিক বর্ণনাদৃষ্টে পরিলক্ষিত হয় যে, যে যুগে যেই পাপের আধিক্যতা সীমালঙ্গন করেছিল সেই যুগে সেই পাপের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই গজব নাজিল হয়েছিল। এখন আমাদের লক্ষণীয় বিষয় হলো করোনা ভাইরাস! যা সারা পৃথিবীবাসীকে অচল করে দিয়েছে। বিশ্বের সমস্ত শক্তিধরদের শক্তির দাম্ভিকতা চুরমার করে দিয়েছে। সমস্ত অহংকারী জালিমদেরকে গৃহবন্দী করে দিয়েছে। ইসলামের বিধানকে নিয়ে তামাশাকারীদেরকে তাদের অনিচ্ছায় হলেও ইসলামের বিধান মানতে বাধ্য করে দিয়েছে। এমন একটা গজব বা মহামারী বর্তমান সময়ে কেনো আসলো? চিন্তা করলে দেখা যায়, বর্তমানে জালিমদের জুলুম সীমাতিরিক্ত হয়ে গেছে। তারা প্রকৃত ইমানদারদেরকে আল্লাহর যমীনে চলার ক্ষেত্রে পদে পদে বাধা দিচ্ছে, এমনকি প্রকৃত মুমিনদেরকে একধরনের গৃহবন্দী ও জনবিচ্ছিন্ন করে রাখার চেষ্টায় মেতে ওঠেছে। তাছাড়া আল্লাহর বিধান নিয়ে তামাশার মাত্রা বেড়েই চলেছে। অহংকারী জালিমদের শক্তির মহড়া প্রদর্শনও এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, মনে হচ্ছে যেন তারাই এই পৃথিবীর আদেশ নিষেধের ক্ষেত্রে সর্বেসর্বা! অথচ করোনা ভাইরাস এসে প্রমাণ করে দিলো মানুষ কত অসহায়!

আমার মনে হয় এইসব অপরাধের কারণেই মূলত এই মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। অতপর দুনিয়ার চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী অন্যরাও তার প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করতে হচ্ছে। কারণ ব্যাপকভাবে কোনো গজব নাজিল হলে নিরপরাধ মানুষদেরকেও তা ভোগ করতে হয়। যদিও পরকালে সে আল্লাহর কাছে আজর প্রাপ্ত হবে। যেমন, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ; কোনো মহামারীতে আমার কোনো মুমিন উম্মত মারা গেলে সে আল্লাহর কাছে শহীদের মর্যাদা লাভ করবে।

★ আযাব, গজব ও করোনা ভাইরাস থেকে বাচার জন্য করণীয় কিছু আমল ও দোয়া:

এক. গুনাহ বর্জন করে দিল থেকে তাওবা ও ইস্তেগফার করা। কারণ, যুগে যুগে আযাব, গজব মানুষের পাপের পরিনামেই এসেছে এবং তাওবার পরে অনেক সময় আসন্ন গজব উঠিয়ে নেয়াও হয়েছে। কুরআনে কারীমে বর্ণিত অনেক ঘটনায় যার প্রমাণ পাওয়া যায়।

দুই. ছোট বড় সমস্ত জুলুম ও অন্যায় আচরণ থেকে বিরত থাকা। কারণ, মজলুমের আর্তনাদ আল্লাহর কাছে দ্রুত পৌঁছে যায় ফলে জালিমের শাস্তি তিনি অবধারিত করে দেন। অতপর বিভিন্ন আযাব গজব রুপে সেই শাস্তি জালিমকে পাকড়াও করে থাকে।

তিন. সমস্ত ফরজ নামাজ যথাসময়ে আদায় করা। সাথে সাথে নফল নামাজ পড়েও আল্লাহর কাছে নিজের জন্য, আত্মীয় স্বজনের জন্য ও সকল মানুষের জন্য দোয়া করতে থাকা। কারণ, নামাজের পরে দোয়া কবুল হয় এবং অন্যের জন্যে দোয়া করলে নিজের হকেও তা কবুল হয়ে থাকে। যা বিভিন্ন হাদীস থেকে সুপ্রমাণিত।

চার. সবধরনের হারাম খাবার, সন্দেহযুক্ত খাবার এবং সতর্কতার জন্য বিদেশী খাবার বর্জন করা। কারণ, হারাম খাবার মানুষের জন্য ধ্বংসাত্মক এবং এই হারাম খাদ্য অনেক রোগ জীবাণুর উৎপত্তিস্থল।

পাঁচ. প্রতিদিন ফজরের নামাজ আদায় করে ভোরের নিরিবিলি বাতাস গ্রহণ করা এবং পবিত্র কুরআনুল কারীমের কিছু অংশ তেলাওয়াত করা, বিশেষ করে সূরা ফাতেহা তেলাওয়াত করে পানিতে ফু দিয়ে পানি পান করা। এটাও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।

ছয়. প্রতি ফরজ নামাজের পর আয়াতুল কুরসী একবার পাঠ করা এবং পাঠ করে শরীরেও ফু দেয়া যেতে পারে।

সাত. প্রতি দিন ফজর ও মাগরিবের নামাজের পর সূরা এখলাস, সূরা ফালাক এবং সূরা নাস তিন তিন বার পাঠ করে উভয় হাতে ফু দিয়ে সমগ্র শরীরে হাত বুলানো। রোগমুক্তির লক্ষ্যে এটা স্বয়ং নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরও আমল ছিলো।

আট. নিম্নের দোয়া গুলো বেশি বেশি পড়া। বিশেষ করে ফজর ও মাগরিবের নামাজের পর তিন তিন বার করে পড়া।

 

* اللّٰهُمَّ انِّي اَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللّٰهِ التَّامَّةِ مِن شَرِّ مَا خَلَقَ

. *اللّٰهُمَّ اِنِّي اَعُوذُبِكَ مِنَ البَرَصِ وَالجُنُونِ والجُذَامِ وسَيِّءِالاَسقَامِ

* بِسمِ اللّٰهِ الَّذِى لَايَضُرُّ مَعَ اسمِهٰ شَيءُٗ في الاَرضِ وَلَا في السَّمَاءِ وَهُوَالسَّمِيعُ العَلِيمُ

*اللّٰهمَّ صَلِّ علٰی مُحِمَّدِِبِعَدَدِ کُلِّ دَاءِِ وَدَوَاءِِ وبِعَدَدِ کُلِّ عِلَّةِِ و شِفَاءِِ

 

নয়. ُحَسبُنَا اللّٰهُ وَنِعمَ الوَکِیل দোয়াটি তিনশ তেরো বার পড়ে আল্লাহর কাছে মুসীবত থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা এবং

لَاحَولَ ولَا قُوَّةَ اِلَّا بِاللّٰه

বেশি বেশি পড়া।

 

দশ. বেশি বেশি করে নফল সদকা করা। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে ; সদকা মানুষের জীবনের বিভিন্ন মুসীবত দূর করে।

 

তাছাড়া নবীজির নির্দেশ হিসেবে পবিত্রতার সাথে থাকা এবং কাপড় চোপর ও পরিবেশকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করতে হবে, এবং সুন্নত তরীকার অনুসরণ করে যোগ্য চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলাও দরকার। তবে ইবাদত বন্দেগী ছেড়ে দিয়ে শুধু চিকিৎসার উপর ভরসা করে বসে থাকা মোটেও মুমিনের কাজ হতে পারেনা। কারণ, আল্লাহপাক যেই রোগ অবধারিত করে দেন তা সরিয়ে দেয়ার শক্তি পৃথিবীর কারো কাছে থাকতে পারে না। অতএব, আল্লাহর উপর ভরসা রেখে তাঁর কাছে কান্নাকাটি করা একান্ত প্রয়োজন । কারণ, তিনিই আমাদের আশ্রয় দাতা এবং তিনিই সমস্ত কল্যাণ ও অকল্যাণের স্রষ্টা। তাঁর আদেশ নিষেধেই সব হয়। আল্লাহ পাক আমাদেরকে তাঁর আযাব, গযব থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

শিক্ষক, জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গা, সিলেট।