কওমী মাদরাসা আমার ভালোবাসা

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

অক্টোবর ০৪ ২০১৮, ১৪:৫৭

লাবীব আব্দুল্লাহ: আমি কওমী মাদরাসার ছাত্র৷ 1992 সালে দাওরায়ে হাদীস পড়েছি৷ কওমী মাদরাসায় নাহবেমীর, শরহে বেকায়া, ফযীলত ও তাকমীল স্তরে কেন্দ্রীয় পরীক্ষাও দিয়েছি৷ আমি যখন শরহে বেকায়া জামাতে পড়ি তখন আমার এক একান্ত বন্ধু গোপনে আলিয়া মাদরাসায় দাখিল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে৷ সে ক্লাসে মেধাবী তালেবে ইলম ছিলো৷ রোল নং ছিলো এক৷ আমার দুই৷ কোনো কোনো পরীক্ষায় আমার এক রোল তার দুই৷ সে লুকিয়ে পরীক্ষা দিলেও তা ধরা পড়ে নাযেমে তালীমাতের কাছে৷ মাদরাসার নিয়ম অনুযায়ী তাকে বিদায় করে দেওয়া হয়৷ আমার এই জিগরি দোস্তের ভাই অনেক চেষ্টা করেন মাদরাসায় যেনো থাকতে পারে কিন্তু কোনো কাজ হয় নাই৷ সে চলে যায় ঢাকায়৷ আমি থাকি ময়মনসিংহেই৷

কওমী মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি নেই আলিয়ার আছে এটি আমি জানি আরও আগ থেকে৷ নাহবেমীর পরীক্ষা দিয়ে আমি পড়ালেখা বাদ দিয়ে ছিলাম৷ বোহেমিয়ান জিন্দেগি কেটেছে এক বছর৷ স্কুল বা আলিয়ায় ভর্তির জন্য আমি ঢাকায় যাই৷ মামার কুপরামর্শে আমি জামেয়া কাসেমিয়া নরসিংদী যাই ভর্তি হতে৷ মামার দৃষ্টিতে কওমী মাদরাসার কোনো স্বীকৃতি নাই৷ আমি কী করে খাইমু? মামা আমাকে বাসায় জায়গা দিয়ে ব্রেনওয়াশ করে আলিয়ায় পাঠালেন৷ তখন আমার কোমল ব্রেন৷ ওয়াশড হয়েছে ব্রেন৷ গেলাম আলিয়ায়৷ ইন্টারভিউ দিলাম এবং ভর্তির অনুমতি পাইলাম৷ কিন্তু আমি ভর্তি না হয়ে মামাকে বললাম- স্কুলে পড়বো৷ মামা আমাকে পেন্ট ও শার্ট বানিয়ে দিলেন৷ ছবি উঠাতে বললেন এবং এসএসসি পরীক্ষার আয়োজন করলেন৷ আমি কওমী মাদরাসার ঐতিহ্যের পোষাক টুপি পায়জামা পাঞ্জাবি ছেড়ে পেন্ট ও শার্ট পড়ে স্কুলে গেলাম৷ স্যাররা আমার আব্বুকে চিনতেন৷ চিনতেন আমার নানাকেও৷ হাইস্কুলটি আমার বাড়ীর কাছেই৷ দুই ক্ষেত পর আমাদের বাড়ির আঙ্গিনা থেকে৷ স্যার বললেন,
তোমার নানা মৌলভী৷ আমাদের মসজিদ ও মাঠের ইমাম৷ তোমার বাপ মুত্তাকি মানুষ৷ তোমাকে মাদরাসায় ভর্তি করেছে৷ তুমি তা ছেড়ে স্কুলে কেন?
আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না৷ নীরবে স্কুল থেকে ফিরে এলাম৷ পেন্ট শার্ট বাদ দিয়ে আবার টুপি পাঞ্জাবি গায়ে দিলাম৷ আম্মা বাড়িতে কেঁদে কেঁদে বললেন,
তোমার বাপ দুনিয়াতে নাই৷ স্কুল থেকে নিয়ে ভর্তি করেছে মাদরাসায়৷ তোমার বাপ বলেছে জমি বিক্রি করে হলেও পোলাডারে মাদরাসায় পড়াইও৷ লালবাগ পরে দেওবন্দ৷ তোমার বাপ দুনিয়াতে নাই৷ তুমি আমার সামনে পেন্ট শার্ট পড়ে স্কুলে যাচ্ছো? আমি তোমার মাদরাসায় আবার পড়ার জন্য চোখের পানি ফেলেছি কয়েক কলসি৷ যাও বাবা মাদরাসায়৷

আমি সিদ্ধান্ত নিলাম পড়বো এবং মাদরাসায় পড়বো৷ পড়বো এবং কওমী মাদরাসায় পড়বো৷ সেই মামার ব্রেনওয়াশ ফেল৷ আমি জামালপুরের ইসলামপুর থানার বেনুয়ারচর থেকে নদী পথে পনের মাইলে প্রথমে, জামালপুর, পরে ময়মনসিংহে এলাম৷ ভর্তি হলাম দেশের শীর্ষ কওমী মাদরাসা জামিয়া আরাবিয়া মাখযানুল উলূমে৷ তালতলা মাদরাসায়৷ ভর্তি হলাম হেদায়েতুন্নাহুতে৷ পড়লাম দাওরা পর্যন্ত এই মাদরাসায়৷ একাধিক জায়গীর থাকলাম৷ বর্ণনাতীত কষ্ট করেছি আর্থিক৷ আমি জানতাম আমাকে আরও কষ্ট করতে হবে৷ আমি জানতাম এবং ভালো করেই জানতাম সনদের কী ফায়দা৷

আমি মাদরাসায় দেয়াল পত্রিকার সম্পাদক ছিলাম৷ কখনও সহকারী সম্পাদক৷ দেয়ালিকায় হস্তলিপি থাকতো আমার৷ আমি সেই দোস্তের উৎসাহে এবং তার নেতৃত্বে মাদরাসায় পাঠাগার প্রতিষ্ঠায় শরীক হলাম৷ আমি জানতাম আমার কোনো সনদ নেই৷ সনদ থাকলেও সেটির কোনো সরকারি স্বীকৃতি নাই৷ আমি সরকারি কোনো চাকুরি করতে পরবো না৷ দেশের সবাই তো আর চাকুরি করেন না৷

1992 সালের শিক্ষাবর্ষের শুরু দিন থেকে বেফাকের দাওরা পরীক্ষার ফলাফল বের হওয়ার আগের দিন থেকে আমি মাখযানের শিক্ষক নিয়োগ হলাম৷ আমার উস্তাযদের সুনজর ও দুআ৷ আমি আজও শিক্ষক৷ আমি সেই 1992 সাল থেকে মসজিদের খতীব৷ টুকটাক লেখালেখি করেছি তা উল্লেখ করার মতো নয়৷ যেহেতু স্কুলে ক্লাস ওয়ানে পড়েছিলাম, তাই লেখালেখির এই অবদান স্কুলের নয় কওমী মাদরাসার৷ আমার লেখা চারটি বই বাজারে চলে৷ মান নিম্ন হলেও৷ আমার একবারও ইচ্ছে হয়নি আমি আলিয়া বা স্কুলের একটি সনদ সংগ্রহ করি৷ আমি অসচেতন কোনো ছাত্র ছিলাম না৷

আমি আমার সমাজ ও দেশ সম্পর্কেও গাফেল নই৷ আমি সেই ছাত্র জীবন থেকেই পত্রপত্রিকা পড়ি৷ দৈনিক সাপ্তাহিক ও মাসিক৷ আমার মনে হয় না আমি ব্যর্থ সনদের স্বীকৃতি না থাকার কারণে৷ আমি আমাকে সফল মনে করি৷ আমি আমাকে সুখী মনে করি৷

আমি শিক্ষকতার জীবনে শিক্ষাবিভাগের প্রধান, সহকারী প্রধান হিসেবে কর্মরত আজও এবং আল্লাহর রহমতে তিন-চারটি মাদরসার প্রতিষ্ঠাতাও৷ অন্যদিকে শিশুদের একটি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য৷
এই দেশের জেনারেল শিক্ষা, আলিয়া শিক্ষা নিয়ে আমি কিছুটা পড়ালেখা করি৷ বৃটিশ আমল থেকে যতগুলো শিক্ষা কমিশন হয়েছে সবগুলো সংগ্রহে আছে আমার৷ কওমী মাদরাসার একটি বিষয় তাহরিকে দারুল উলুম দেওবন্দের পরীক্ষায় ৯৪ মার্ক পেয়েছিলাম বেফাকে৷ দেওবন্দের ওপর একাধিক প্রবন্ধ লিখেছি৷ সবকিছু সবদিক জেনেই আমি সনদের সরকারি স্বীকৃতি নেই এমন একটি শিক্ষাধারায় পড়ালেখা করেছি এবং দুই যুগ থেকে শিক্ষকতা করছি৷ আমি আমাকে নিষ্ফলা মাঠের কৃষক মনে করি না৷

লাখ লাখ অভিভাবক জানেন, কওমী মাদরাসার কোনো সরকারি স্বীকৃতি নাই৷ তবুও তারা তাদের নয়নমনিকে কওমী মাদরাসায় ভর্তি করাচ্ছেন৷ সনদের স্বীকৃতি হওয়ার পর কওমী হবে আলিয়ার ফটোকপি৷ আমার আব্বা যদি বেঁচে থাকতেন এবং দেখতেন কওমীর পরিবেশ আলিয়া বা স্কুলের মতো তাহলে তিনি আমাকে কওমীতে ভর্তি করতেন না৷ আগামীতে কওমী যদি কওমী না থাকে হাজার হাজার অভিভাবক তাদের সন্তানকে মাদরাসায় আর পড়াবেন না৷
সনদের সরকারি স্বীকৃতির পর সেই সনদ থেকে স্কুলের ও আলিয়ার সনদের মূল্যটা বেশী হবে তাই সেখানে পড়াই ভালো৷ এক দেশে তিনধারার স্বীকৃত শিক্ষা৷ উন্নত স্কুলেরটা৷ দ্বিতীয় পর্যায়ে আলিয়াটা৷ তৃতীয় পর্যায়ে হবে কওমীরটা৷ তাহলে অভিভাবক প্রথমটাতে থাকবেন৷ আলিয়ায় অনেক অভিভাবক ভর্তি করান না৷ সচেতন যারা৷

সনদের স্বীকৃতির পর কওমীর পরিবেশ, শিক্ষার মান ও পরীক্ষা পদ্ধতি আলিয়ার মতো হবে না এই নিশ্চয়তা কেউ কি দিতে পারবেন দয়া করে? দিন তাহলে৷ আমিও বলে রাখলাম কওমীর গন্তব্য ও পরিণাম হবে আলিয়ার৷ আলিয়া হবে স্কুল৷
আমি আবার বলছি আমি সচেতনভাবেই সরকারি স্বীকৃতিহীন কওমী মাদরাসায় পড়েছি৷
আমি হতাশ নই৷
আমি বিফল নই৷
আমি অসুখী নই৷
আমার কোন আফসোস নেই কেন আমাকে সরকার সনদের স্বীকৃতি দেয় নি৷
আমার আব্বুকে ধন্যবাদ আমাকে তিনি কওমী মাদরাসায় ভর্তি করেছিলেন৷ আমি আব্বুর কথা রেখেছি৷ বেঁচে থাকলে তিনি খুশী হতেন আমি দেশের একজন সুখী ও সুনাগরিক৷ আমার পরিচয়পত্রে সরকারের কাছে জাহেল হলেও আমার সমাজ আমাকে মাওলানার স্বীকৃতি দিয়েছে৷ আমার পেছনে তারা বিশ বছর ধরে নামায পড়ে৷ আমার কাছে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী পড়ালেখা করে৷ হাজার হাজার স্বীকৃত সনদধারীরা বলেন,
হুজুর,
“ছেলেটারে মানুষ করে দেবেন৷”
কওমীর সনদের স্বীকৃতি নেই কিন্তু মানুষ বানায় এবং ভালো মানুষ৷