কওমি পাঠ্যক্রম সংস্কার কেন প্রয়োজন -আবদুল হক

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জানুয়ারি ২৫ ২০১৯, ১৫:১৩

আবদুল হক:
বাংলাদেশে কওমি মাদরাসার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে—এ বড় আশার কথা। কিন্তু চিন্তার কথা হলো, মাদরাসা শিক্ষার উঁচু লক্ষ্যে উত্তরণে সার্থকতার হার সেভাবে বাড়ছে না। বাড়ার কথাও নয়। সতেরো শতকের জরাজীর্ণ পাঠক্রম দিয়ে আপনি একুশ শতকের উপযোগী আধুনিক মানুষ তৈরির আশা করতে পারেন না।

আমাদের দেশেই ১৪ হাজার কওমি মাদরাসা, ভারত-পাকিস্তানেও এর কম নয়। ছিটেফোঁটা আছে এ অঞ্চলের বাইরেও। এত প্রাচীন পাঠক্রম নিয়ে এত এত মাদরাসা চলছে কীভাবে? দুনিয়ার আদি যাত্রীবাহী বাস ছিল হ্যানকক অমনিবাস। লন্ডনের রাস্তায় নেমেছিল ১৮৩২ সালে। গরুর গাড়ির মতো বড় বড় চাকা লাগানো সেই বাস বাষ্পীয় ইঞ্জিনে চলত ঘণ্টায় ১০ মাইল। দুই ধারে সারে সারে দাঁড়াত মানুষ, অপার বিস্ময় চোখে নিয়ে। আপনি যদি আজকের অত্যাধুনিক প্লাটিনাম বাসে এনে জুড়ে দেন হ্যানককের সেই বাষ্প-ইঞ্জিন, বাসটি তাহলে কীভাবে চলবে? এভাবেই চলছে আমাদের কওমি মাদরাসাগুলো।

কওমি মাদরাসার পাঠক্রমকে বলা হয় দারস-ই নিযামী। এটি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ইতিহাসের প্রাচীনতম পাঠক্রম, যা আজও টিকে আছে। ইতিহাসে এ পাঠক্রমলগ্ন দুই নিযামের নাম পাওয়া যায়। একজন হলেন নিযামুল মুলক তুসী (১০১৮-১০৯২)। ইনি বিখ্যাত সেলজুক সুলতান আল্প আরসালানের উজির ছিলেন। ১০৬৫ সালে বাগদাদে তিনি একটি মাদরাসা স্থাপন করেন। নাম ছিল জামিয়া নিযামিয়া। একটি মাদরাসা না-বলে বরং বলা উচিত এক ধরনের মাদরাসা। কেননা এরপর ক্রমশ তিনি নিযামিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করতে থাকেন নিশাপুর, আমুল, বলখ, হেরাত, মসুল, ইসফাহান প্রভৃতি বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগজুড়ে। এসব মাদরাসা ছিল উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তখনকার দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়। নিযামুল মুলক তুসী বাগদাদের নিযামিয়ায় আচার্য নিয়োগ করেছিলেন মুসলিম ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ইমাম গাযালীকে। শেখ সাদীর সম্পূর্ণ পড়ালেখা এখানেই। ১০৯৬ সালে গাযালী যখন নিযামিয়া ছেড়ে যান, তখন এতে তিন হাজার শিক্ষার্থী ছিল। এ জামিয়া নিযামিয়ার পাঠক্রমই শাপে বর হয়ে আসে ভারতে এবং কালক্রমে দারস-ই নিযামী বা নিযামিয়া নামে খ্যাতিলাভ করে।

দ্বিতীয় নিযাম, মোল্লা নিযামুদ্দিন সাহালভী (১৬৭৭-১৭৪৮), ভারতে এ পাঠক্রমের অন্যতম পরিমার্জক ও প্রসারক হিসেবে স্মৃত।

ভারতবর্ষে কওমি মাদরাসার প্রাতিষ্ঠানিক সূচনা করেন সুলতান মুহাম্মদ ঘুরি, দ্বাদশ শতকের শেষাশেষি। পরবর্তী সুলতানদের আমলে এ ধারা আরো বিস্তার লাভ করে, দিকে দিকে গড়ে উঠতে থাকে শত শত মাদরাসা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা সত্ত্বেও চারিত্র্যে ওসব মাদরাসা ছিল একেলে কওমি মাদরাসাই। তখনো দারস-ই নিযামী হয়নি। তবু ধারণা করা যায়, ওই মাদরাসাগুলোর পাঠক্রমে মৌলিকত্ব ও ব্যাপ্তি ছিল। কারণ এসব মাদরাসার শিক্ষাক্রম পরিকল্পনায় সংশ্লিষ্ট ছিলেন তখনকার মুসলিম উম্মাহর শ্রেষ্ঠতম মুফাসসির, ধর্মতাত্ত্বিক, দার্শনিক, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ, চিকিৎসাবিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, বিশ্বকোষসহ শতাধিক গ্রন্থপ্রণেতা আল্লামা ফখরুদ্দিন রাযী। সুলতান মুহাম্মদ ঘুরি ছিলেন তার অনুরাগী। সুলতানের অনুরোধে রাযী অনেকদিন থেকে গিয়েছেন ভারতে। এর কয়েক দশক পর, ১২৫৮ সালে, মুসলিম উম্মাহর শিক্ষা ও তমদ্দুনের ওপর নেমে আসে সর্বনাশা কালরাত্রি। হালাকু খাঁর নৃশংস হামলায় ধ্বংস হয়ে যায় মুসলিম জাহানের জ্ঞানচর্চার রাজধানী বাগদাদ। নিহত হয় কমপক্ষে দুই লাখ মানুষ।

দজলা নদীর পানি কালো হয়ে যায় কিতাবের কালিতে। অগণিত আলিম তখন হিজরত করে পাড়ি জমাতে থাকেন ভারতে, উট-বোঝাই বইপত্রসমেত। তৈরি হয় বাগদাদ থেকে দিল্লিমুখী একটি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত জ্ঞানপ্রবাহ, বাহিত হয় বায়তুল হিকমার টুকরো টুকরো ধ্বংসাবশেষ, আনীত হয় জামিয়া নিযামিয়ার শিক্ষাক্রমের ধারণা কিংবা পাঠ্যতালিকা দারস-ই নিযামিয়া। কালক্রমে এ পাঠক্রম পরিচিত ও ক্রমশ প্রযুক্ত হতে থাকে ভারতের মাদরাসাগুলোতে। অবশ্য অনেকের ধারণা, দারস-ই নিযামীর প্রকৃত রূপকার ভারতের শাহ আবদুর রহিম ও মোল্লা কুতুব উদ্দিন শহীদ—দুজনই সতের শতকের মানুষ।

পরবর্তীতে এ পাঠক্রমে দেশকাল-উপযোগী ব্যাপক সংযোজন-বিয়োজন-পরিমার্জন সাধন করেন এ দুয়েরই দুই প্রতিভাবান সন্তান যথাক্রমে—শাহ ওয়ালিউল্লাহ (১৭০৩-১৭৬২) ও মোল্লা নিযাম উদ্দিন (১৬৭৭-১৭৪৮)। বিশদ প্রামাণ্য তথ্য মেলে না আজ আর, তবু এ দ্বিতীয় ধারণাকে ধরলেও দারস-ই নিযামীর বয়েস তিন শো বছরের কম নয়।

সময়ের সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করা যায় না। সবকিছুকে পুরোনো করতে করতে, বহু কিছুকে বাতিল করে দিতে দিতে বয়ে চলে সময়। নিয়ত পরিবর্তমান ও পরিবর্তক সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কেউ নিজেকে বদলে নিয়ে সমসাময়িক হয়ে উঠতে না পারলে সে আপনিই বাতিল। মানুষের চিন্তা, শিক্ষা ও রুচির সময়ানুগ পরিবর্তনের ধারা তাই স্বাভাবিক ও অনিবার্য। সময়ের দাবিতেই দুনিয়াজুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যসূচিতে ঘটে চলেছে নিরন্তর রদবদল।

অতএব কোথাও কোনো একটা পাঠক্রমকে এভাবে যদি অনেক শতাব্দ ধরে টিকে থাকতে দেখা যায়, তবে সে এক আশ্চর্য ঘটনাই বটে। এ ঘটনার পেছনে দুটি আশ্চর্য কারণের কোনো একটি কিংবা অংশত দুটিই সক্রিয় থাকতে পারে: হয়তো পাঠক্রমটি আশ্চর্য শক্তিমান, নয়তো তার অনুসারীরা আশ্চর্য অথর্ব। দারস-ই নিযামী টিকে রইল কেন, কীভাবে? সে কি কালজয়ী, না মেয়াদোত্তীর্ণ? পাঠক্রমটি কতখানি পাঠযোগ্য?

প্রথমত, মনে রাখতে হবে যে, ইসলামী শিক্ষাধারার মূল পাঠ্য পবিত্র কোরআন এবং হাদিসের কয়েকটি সংকলন। এগুলো কালোত্তীর্ণ ও অপরিবর্তনীয়। বাকি সমস্ত বিষয় ও বই এ দুটো থেকেই উৎসারিত—কিন্তু কালোত্তীর্ণ নয়, অপরিবর্তনীয় নয়।

দ্বিতীয়ত, দারস-ই নিযামীতে এমন কিছু বিশ্বমানের পাঠ্যপুস্তক রয়েছে, যেগুলোর নীতিগতভাবে পরিবর্তন সম্ভব হলেও বাস্তবিকপক্ষে তা কাম্য নয়। উদাহরণত, নিযাম উদ্দিন শাশী (মৃ. ৯৫৫ খ্রি./৩৪৪ হি.)-এর লেখা বই ‘উসূল আশ-শাশী’। এক হাজার বছর ধরে বইটি দুনিয়াজুড়ে ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যভুক্ত। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এত দীর্ঘ সময়েও ফিকহের মূলনীতি নিয়ে এর চেয়ে সংহত সুন্দর বই কেউ লিখে উঠতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। ক্বুদূরী, হিদায়া, আল-ফাউয আল-কবীর প্রভৃতি এমন গোটা দশেক বই আছে শতাব্দীপ্রাচীন, যেগুলোর সংস্কার-পরিবর্তনের দাবি কেউ তোলেননি।

তৃতীয়ত, দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে এদেশের সমস্ত কওমি মাদরাসা ঘোষিতভাবে দারস-ই নিযামীর অনুসারী। অথচ বাস্তবে এদেশে পুরোপুরি ওই পাঠক্রমে চলছে এমন একটি মাদরাসাও নেই। আদতে তা সম্ভবও নয়। আমাদের আলিমসমাজে দারস-ই নিযামীর উৎপত্তি বিষয়ে ইতোপূর্বে কথিত দ্বিতীয় মতটাই জনপ্রিয়, সেটা মেনে নিয়েই যদি বিবেচনা করি—যে-দেশে এ পাঠক্রম তৈরি তার রাষ্ট্রভাষা ছিল ফারসি, এর রচয়িতা-গ্রহীতারা ধর্মাদর্শের দিক থেকে সংখ্যালঘু আর সময়টা কয়েক শ বছর আগের; এখন এখানে তিনটি প্রেক্ষিতই গিয়েছে বদলে, কী করে তাহলে চলতে পারে সেই প্রাচীন পাঠক্রম? পারে না। যোগ-বিয়োগ তাই স্বীকার করতে হয়েছে। ফার্সি-উর্দু সরিয়ে ঢুকছে বাঙলা-ইংরেজি। পাঠ্য হচ্ছে বিজ্ঞান-গণিত। কোরআন-হাদিস বাদে, দারস-ই নিযামীর সম্ভবত দশ শতাংশ বই আছে কওমি পাঠক্রমে। বাকি কিছু এদিক-ওদিক থেকে কুড়োনো, কিছু পাঠ্য হিসেবেই লেখা বা লেখানো।

চতুর্থত, বদলে যাওয়া দেশকালের চাপে কওমি পাঠক্রমে যে-সংস্কার হয়েছে ও হচ্ছে, তাতে কোনো শৃঙ্খলা নেই; যেসব নতুন বই পাঠ্যভুক্ত হয়েছে ও হচ্ছে, সেগুলোর রচনা-সংকলনের পেছনে শিক্ষাবিদ ও বিষয়-বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত কোনো পরিষদ নিযুক্ত নেই, ফলে বইগুলো মানহীন, অসংগত, অসম্পূর্ণ, অপাঠনীয়, ভুলে ভরা।

বর্তমানে দেশে কওমি মাদরাসার নিয়ন্ত্রক ‘জাতীয়’ বোর্ড আছে কুড়িটিরও বেশি, ছোট ছোট আঞ্চলিক বোর্ড শ খানেক। এরা সবাই যার যার মতো করে পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বদলে চলেছেন। কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব, পর্যবেক্ষণ ও জবাবদিহি না-থাকায় এসব বোর্ডের করা রদবদলের কোথাও কোনো হিসাব নেই। উদাহরণ হিসেবে আমরা প্রধান কওমি বোর্ড বেফাকের পাঠ্যতালিকা ও এর যে-কোনো একটি পাঠ্যপুস্তক, ধরুন প্রথম শ্রেণির বাংলা বইটাই, দেখে নিতে পারি একনজর—যাতে ভুল, উদাসীনতা, অসংগতি ও অস্থিরতার মোটামুটি একটা ছবি পেয়ে যাই।

ক. পাঠ্যতালিকা

এক. ‘বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ’-এর ১৪৩০ হিজরিতে প্রকাশিত এবং এ অবধি সর্বশেষ হিসেবে তার সদ্যসংস্কৃত ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত পাঠ্যতালিকা অনুযায়ী, ‘শিশু শ্রেণি’ থেকে সবোর্চ্চ শ্রেণি ‘মারাহালা তাকমীল’ পর্যন্ত মোট ১৬টি শ্রেণির সর্বমোট পাঠ্যবই ১৫১টি। তন্মধ্যে ২৮টি বই এখনো রচনাই করা হয়নি।

দুই. আল-বেফাক পাবলিকেশন্স কর্তৃক প্রকাশিত ‘পাঠ্যতালিকা’ অনুযায়ী বেফাকের প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের নাম ‘বেফাক প্রাইমারি (কওমি প্রাইমারি)’। আমরা জানি, প্রত্যেকটি জাতি বা প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ আদর্শ, ঐতিহ্য ও ভাষার নিরিখে স্বকীয়তা বজায় রেখে নিজ নিজ মূর্ত বা বিমূর্ত কাঠামোসমূহের নামকরণ করে থাকে। ‘মসজিদ’-কে ‘সাষ্টাঙ্গ প্রণতির স্থান’ বললে শাব্দিক ভাষান্তর হয় বটে, কিন্তু এমন অনুবাদে মসজিদ নামের পুষ্পটি ইসলামবৃক্ষের শাখা থেকে ধুলোয় খসে পড়ে যায়। মাদরাসা, স্কুল ও পাঠশালা সমার্থক শব্দ, তাই বলে মাদরাসাকে তো স্কুল বলা চলে না; কেননা শাব্দিক অর্থের বাইরেও প্রত্যেকটি নাম স্বকীয় আদর্শ, ঐতিহ্য ও ব্যঞ্জনা ধারণ করে। এদেশে কওমি-সরকারি নির্বিশেষে যুগ যুগ ধরে মাদরাসার প্রাথমিক শিক্ষাস্তর ‘ইবতেদায়ি’ নামে প্রচলিত, ফলে পরিভাষাটি সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত। ইসলামী শিক্ষার মূল ধারা আরবিলগ্ন বলেই নামকরণে ইসলামী ও আরবি পরিভাষার বিকল্প নেই। কিন্তু বেফাক ইসলামী বা আরবি পরিভাষার তোয়াক্কা করেনি, বাংলাও বর্জন করেছে—‘ইবতেদায়ি’ বা ‘প্রাথমিক’ বাদ দিয়ে সরাসরি ইংরেজের বা ইংরেজির অনুকরণে স্তরটির নাম দিয়েছে ‘প্রাইমারি’।

তিন. ঐতিহ্যগতভাবে এদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক শিক্ষাকাল পাঁচ বছর, আস্-সাফফুল আউয়াল আল-ইবতেদায়ি থেকে আস্-সাফফুল খামিস আল-ইবতেদায়ি—১ম শ্রেণি থেকে ৫ম শ্রেণি। কিন্তু বেফাকে প্রাথমিক শিক্ষার জন্যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬ বছর, শিশু শ্রেণি থেকে ৫ম শ্রেণি।

প্রাথমিক শিক্ষার সময়সীমা কত বছর হওয়া উচিত, প্রাথমিক শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতাস্তর সামনে না-রেখে তার পর্যালোচনা সম্ভব নয়। প্রাথমিকের কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতাস্তর কী, সেটি এখনো অনিরূপিত এবং রীতিমতো গবেষণার বিষয়। তবে এটা স্পষ্ট যে, প্রাথমিক শিক্ষার সময়সীমা গোটা ছাত্রজীবনকেই প্রভাবিত করে। বর্তমানে আমাদের দেশে প্রাক-প্রাথমিক ও গবেষণামূলক শিক্ষাস্তর বাদে প্রচলিত বিভিন্ন ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত মোট শিক্ষাকাল ১৫ বছর থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত। প্রথার বাইরে গিয়ে চিন্তা করলে, এটা অনেক লম্বা সময়। এ ১৫-১৭ বছরের সঙ্গে ভর্তির আগের ছয় বছর, সেই সঙ্গে নানা কারণে কিছু সম্ভাব্য অপচয়িত সময় যোগ করলে যে-ফল দাঁড়ায়, তা আমাদের গড় আয়ুর প্রায় অর্ধেক। এভাবে কাজের নিয়ম শিখতে শিখতেই ঢের কাজের সময় নষ্ট হয়ে যায়। পূর্বসূরিদের দিকে যদি তাকাই, তারা শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের চেয়ে অনেক কম সময় ব্যয় করেও বেশি জ্ঞান অর্জন করে ইমাম ও মনীষী হয়েছিলেন। অতএব শিক্ষার সময় কমাবার কথা চিন্তা করা মনীষীর দাবি, ইতিহাসের দাবি এবং সংক্ষিপ্ত জীবনেরও দাবি।

মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে এবং ফিনল্যান্ড-জাপান-যুক্তরাজ্য প্রভৃতি শিক্ষায় সবচেয়ে অগ্রসর দেশসমূহে প্রাথমিক শিক্ষাকাল ৬ বছর থেকে ৯ বছর পর্যন্ত। কিন্তু তাদের প্রাথমিকের যোগ্যতাস্তর আমাদের প্রাথমিকের সমান নয়, অনেক ওপরে। বাংলাদেশ সরকারের সর্বশেষ শিক্ষানীতিতেও প্রচলিত ৫ বছরের বদলে ৮ বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষাক্রম প্রস্তাব করা হয়েছে, অর্থাৎ অষ্টম পর্যন্ত শ্রেণিগুলোকে প্রাথমিক বলে ধরা হবে। তা হলেও, হবে স্রেফ নামের হেরফের, মোট শিক্ষাকাল থাকবে একই। আমাদের চিন্তা করা প্রয়োজন, শিক্ষার মান ঠিক রেখে কাল কমানো যায় কি না।

বাংলাদেশের সব কওমি মাদরাসায় শুরু থেকেই সাধারণ শিক্ষাক্রম ১৫ বছরের। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বোর্ডের বাইরে গিয়ে পাঠক্রম সংক্ষেপিত করে সময় কমিয়েছে। সম্পূর্ণ নতুন স্বল্পমেয়াদি পাঠক্রম প্রণয়নের চিন্তা মাথায় নিয়েও কাজ করছেন কেউ কেউ। কোনো কোনো বোর্ড তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ একটি বা দুটি শ্রেণি বিলোপ করে কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে শিক্ষাকাল। মেয়েদের বয়স-সংকট বিবেচনা করে বালিকা মাদরাসাসমূহে চলছে দশ বছরের কোনাকুনি পাঠক্রম। এসবই বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রম, গ্রাহ্যতা পায়নি খুব একটা।

সাধারণভাবে ১৫ বছরের পাঠক্রমই বহাল রয়েছে। জ্ঞানের ঘাটতি না-মেনে সময়সীমা কমানোর বুদ্ধি এখনো কেউ বের করতে পারেননি।

বেফাকও আবহমান দারস-ই নিযামীর সময়সীমা কমানোর  উপায় নিয়ে কখনো গবেষণা বা নিরীক্ষা করেছে বলে শোনা যায়নি। উল্টো সে শিশুশ্রেণি নামে নতুন একটি শ্রেণি যোগ করেছে, যার ফলে তার শিক্ষাক্রম হয়েছে ১৬ বছরের। এটা বেফাকের একটা প্রশ্নবিদ্ধ ও হাস্যকর কাণ্ড। কাণ্ডটা তারা করেছে প্রাক-প্রাথমিক কিন্ডারগার্টেনের নার্সারি-প্লে প্রভৃতি শ্রেণির দেখাদেখি। কিন্তু খেয়াল করেনি যে, এসব শ্রেণি বাধ্যতামূলক শিক্ষাস্তর হিসেবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত নয়। প্রাক-প্রাথমিকে ওই শিশুরাই পড়ে, যাদের বিদ্যালয়ে আসার বয়স (৬ বছর) হয়নি। কিন্তু বেফাক কর্তৃপক্ষ তাদের শিশুশ্রেণিতে ভর্তির কোনো বয়স উল্লেখ করেনি, একে অতিরিক্ত বা ঐচ্ছিক শ্রেণি হিসেবে দেখায়নি, আবশ্যিক শ্রেণিগুলোর সঙ্গে মূল শিক্ষাক্রমে যুক্ত করে দিয়েছে। ওই শ্রেণিতে ভর্তির বয়স উল্লেখ না-করলেও শ্রেণিটির নাম রেখেছে অস্পষ্ট বয়সসূচক শব্দে। বয়সের স্তর অনুসারে শ্রেণির নামকরণের ঘটনা কি বাংলাদেশে এটাই প্রথম? তাহলে শিশু শ্রেণির পাশাপাশি বেফাকের কিশোর শ্রেণি, তরুণ শ্রেণি, (বালিকা শাখার) যুবতী শ্রেণি কই? এ নামের দ্বিতীয় সমস্যা, শিশু শব্দের অর্থ হলো যাদের বয়স শূন্য থেকে দশ বছর। অর্থাৎ প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়া সব ছাত্রছাত্রীই শিশু। কাজেই এই তিন-চারটি শ্রেণির আলাদা আলাদা নামের কোনো যুক্তি রইল না। বেফাকের প্রথম-দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা শিশু নয়, দুনিয়ার কোনো আইন বা অভিধান দিয়েই এটা প্রমাণ করা সম্ভব নয়।

পুনশ্চ, বেফাকের উল্লিখিত ৩০ হিজরি সনে প্রকাশিত ‘পাঠ্যতালিকা’, যা সর্বশেষ প্রকাশিত পাঠ্যতালিকা হিসেবে এখনো তাদের ওয়েবসাইটে ঝোলানো রয়েছে, তার ২য় পৃষ্ঠায় কথিত শিশুশ্রেণির জন্যে ইংরেজিসহ ৫টি পাঠ্য বিষয়ের সূচি নির্ধারিত রয়েছে—কিন্তু এরপর ৫ম পৃষ্ঠায় ওই শ্রেণিরই ‘পাঠ, ঘণ্টা ও মান বণ্টন’-এর ছকে ৪টি বই ও বিষয়ের ঘণ্টা ও মানবণ্টন করা হয়েছে, ইংরেজি বিনে ব্যাখ্যায় বাদ। গাফিলতির কি কোনো সীমা থাকতে হয় না!

চার. বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ-এর ২০০৮ সালে প্রকাশিত মাধ্যমিক ও উচ্চতর পাঠ্যতালিকা, যা এখনো বেফাকের হালনাগাদকৃত ওয়েবসাইটে কার্যকর হিসেবে প্রদর্শিত রয়েছে, তার পৃষ্ঠা ১০-এ দু’বছর মেয়াদি ‘মারহালাতুত তাকমীল’-এর বাংলা করা হয়েছে ‘স্নাতক ডিগ্রি’, অথচ এর আগের পৃষ্ঠায় দু্ই বছর মেয়াদি ‘মারহালাতুল ফযীলাত’-কেও বলা হয়েছে ‘স্নাতক ডিগ্রি’। বস্তুত ফযীলাত স্তরটি স্নাতক এবং তাকমীল শ্রেণি স্নাতকোত্তরের সমমান। অধিকন্তু তাকমীলের জন্যে দুই বছর মেয়াদ দেখানো হলেও কোথাও তা বাস্তবায়িত হয়নি, এমনকি পাঠ্যতালিকায় দ্বিতীয় বছরের পাঠ্যও প্রস্তাব করা হয়নি।

পাঁচ. বেফাকের প্রাথমিক স্তরের ৬টি শ্রেণিতে উর্দু, বাংলা, ইংরেজি, ফারসি ও আরবি—এই পাঁচটি ভাষা শেখানোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রথমোক্ত চারটি ভাষার পাঠ্যপুস্তক আছে, লিখিত পরীক্ষা নেবার ব্যবস্থা আছে, চারটি ভাষাকেই কেন্দ্রীয় পরীক্ষার বিষয়ভুক্ত রাখা হয়েছে—অবহেলা করা হয়েছে শুধু আরবিকে। বেফাকের প্রাথমিক স্তরে (শিশুশ্রেণির বর্ণমালা শিক্ষা ছাড়া) আরবি ভাষার মূল পাঠ্যবই নেই, লিখিত পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই, কেন্দ্রীয় পরীক্ষায়ও আরবি বাদ।

আরবি ভাষা ইসলামের মৌলিক জ্ঞানভাণ্ডারের চাবি। কওমি মাদরাসার মূল লক্ষ্য যেহেতু ইসলামী জ্ঞান ও আদর্শে জীবন সাজানো, তাই পাঁচটির জায়গায় পাঁচ কুড়ি ভাষা শিখিয়ে প্রত্যেকটি ছাত্রকে একেকজন শহিদুল্লাহ বানানোর উদ্যোগ নেওয়া হলেও শীর্ষ গুরুত্বে থাকা উচিত আরবি ভাষা। বেফাক এখানে ভূতগ্রস্ত বে-দিশার মতো কাজ করেছে। অপরীক্ষেয়ভাবে নামেমাত্র আরবি ভাষা সূচিতে দেখাতে যে-কটি বই তারা পাঠ্যতালিকায় রেখেছে, তার একটাও আসলে পাঠ্যবই হিসেবে প্রণীত নয় এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, আরবি ভাষা শেখানোর জন্যে এই যে বইগুলো, তার একটা বইয়েরও নামই আরবি নয়। আরবি শেখার বইগুলোর নাম বাংলা, ইংরেজি এমনকি উর্দু ভাষায়। এই ঘটনার জন্যে ‘ভৌতিক’ ছাড়া আর কোনো বিশেষণ আমি খুঁজে পাচ্ছি না। নিচে বইগুলোর তালিকা দিচ্ছি:

❏ শিশুশ্রেণি – ‘আরবি বর্ণমালা শিক্ষা’, (পরীক্ষা মৌখিক।)

❏ প্রথম শ্রেণি – ‘মৌখিকভাবে শব্দাবলি’, (মানবণ্টনের তালিকায় উল্লেখ নেই, অর্থাৎ পাঠদান ও পরীক্ষা নেই, বইয়ের নামের ছকে উল্লেখ করলেও সম্ভবত এ নামে কোনো বই-ই নেই, বইয়ের নাম তো এমন হয় না )।

❏ দ্বিতীয় শ্রেণি – ‘ওয়ার্ড বুক’, (প্রকাশনীর নাম নেই, মানবণ্টনের রুটিনে ও পরীক্ষা-পদ্ধতির ছকে বইটির উল্লেখ নেই অর্থাৎ মান নেই এবং পরীক্ষা নেই।)

❏ তৃতীয় শ্রেণী – ‘আরবি ওয়ার্ড বুক’, (প্রকাশনী উল্লিখিত নেই, পূর্ণ মান ইংরেজি ও বাংলার অর্ধেক, পরীক্ষা মৌখিক।)

❏ চতুর্থ শ্রেণি – ‘আরবী বোলচাল (মৌখিক)’, (এখানে ‘মৌখিক’ কথাটা মানবণ্টনের বা পরীক্ষাপদ্ধতির ছকে নয় বরং ৪র্থ পৃষ্ঠার সূচিতে ‘বইয়ের নাম’ কলামে লেখা; নিচের দিকের কম গুরুত্বপূর্ণ কোনো পাঠ্যপুস্তকের পরীক্ষার ধরন মৌখিক হতে পারে, কিন্তু স্বয়ং কোনো পাঠ্যপুস্তকের নামও যে ‘মৌখিক’ হতে পারে, এটা আমার ক্ষুদ্র জিন্দেগিতে এই প্রথম দেখলাম। বেফাক প্রত্যেকটি কথিত আরবি বইয়েরই প্রকাশনী অনুল্লিখিত রাখল কেন, এই প্রশ্ন সম্ভবত তাদের জন্যে বিব্রতকর হবে। যা-ই হোক, বইটির পরীক্ষা মৌখিক এবং মান উর্দু ও বাংলার অর্ধেক।)

❏ পঞ্চম শ্রেণি – পাঠ্যবইয়ের নাম ‘আরবি বোলচাল (মৌখিক)’, (প্রকাশনীর উল্লেখ নেই, লক্ষণীয় যে আরবি শেখার বইয়ের নাম উর্দু শব্দ ‘বোলচাল’, বেফাকের ছাপানো পাঠ্যতালিকার ৫নং পৃষ্ঠায় ৫ম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের তালিকার নিচে ‘বি. দ্র.’-তে লেখা: ‘আরবি পরীক্ষা নেওয়া হবে না। এটা অতিরিক্ত পাঠ্য।’ অথচ ফারসি ও ইংরেজি (বিকল্পসহ) বাধ্যতামূলক।

একই কথা পুনরায় মানবণ্টনের ছকের নিচে: ‘কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় আরবির পরীক্ষা নেওয়া হবে না।’

ওপরের তালিকা দেখার পরও কুরআন-হাদিসের ভাষা আরবির প্রতি বেফাক বোর্ডের ইচ্ছাকৃত উপেক্ষা নিয়ে যেমন কারো মনে সন্দেহ থাকার কারণ নেই, তেমনি এ উপেক্ষার কারণে বেফাক কর্তৃপক্ষকে দীর্ঘ উপদেশ-পরামর্শ দিয়ে শব্দ অপচয় করে কোনো ফল হবে বলেও মনে হয় না। একটা শিক্ষা বোর্ড কতখানি অপদার্থ হলে সামান্য একটা পাঠ্যতালিকায় এত ভুল ও বৈষম্য করতে পারে, বেফাক তার একটা ভালো দৃষ্টান্ত বটে।

খ. একটি পাঠ্যবইয়ের নমুনা: প্রথম শ্রেণির বাংলা

এক. ‘বইয়ের নাম: ‘আদর্শ বাংলা পাঠ’। প্রথম প্রকাশ: ২০০৬, সংশোধিত সংস্করণ: ২০১৬। প্রথম পাতায় লেখা—‘রচনায়: মুহাম্মাদ আবদুল জব্বার জাহানাবাদী’। অথচ এতে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আছে, নজরুলের ও জসীমউদদীনের রচিত পদ্য আছে; পদ্যাংশ আছে রামনিধি গুপ্ত, রজনীকান্ত সেন, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব ও যুল হাসনাইনের। কাজেই বইটা কারো একক রচনা নয়। লেখা উচিত ছিল ‘রচনা ও সংকলন: .. .. .. .. .. ..।’

উল্লেখ্য: বেফাকের প্রাথমিক স্তরের ছয়টি শ্রেণির মধ্যে একমাত্র এ প্রথম শ্রেণির বাংলা ছাড়া আর কোনো শ্রেণির কোনো বইয়ে রবীন্দ্রনাথের রচনা রাখা হয়নি এবং এটিতেও পদ্যাংশ রচয়িতাদের মধ্যে মুসলিম তিনজনের নাম উল্লেখ করা হলেও অমুসলিম তিনজনের একদিকে যেমন নাম নেওয়া হয়নি, তেমনি অন্যদিকে তাদের পদ্যপঙক্তিও বিকৃত করা হয়েছে।

দুই. বইটি প্রথম শ্রেণির শিশুদের জন্য লেখা। মাত্র ৩৬ পৃষ্ঠার পাতলা বই। তবু এতেই ভুলের পরিমাণ বিপুল। গুণে দেখলাম, বড়-ছোট মিলিয়ে ১৮৮টি বানান ভুল। বৈষম্যও ঢের। একই শব্দ দেখা গেছে দু-তিন রকম বানানে। আছে বেশ কিছু বাতিল শব্দ। আরবি শব্দের প্রতিবর্ণায়নে কোনো নিয়ম মানা হয়নি— ঢালাওভাবে ‘ছ’ ব্যবহার করা হয়েছে, অথচ আরবিভাষায় এ ধ্বনির নিকটতর কোনো হরফই নেই। সাধু-চলিতের মিশ্রণ আছে। শিশুদের অনুপযোগী শব্দ-বাক্যও দেখা গেছে কয়েক জায়গায়। ভুলের পূর্ণ ফিরিস্তি এখানে তুলে দেওয়া সম্ভব নয়, তার দরকারও দেখি না। কয়েকটি উদাহরণেই অবস্থা আঁচ করা যাবে।

সন্ধির নিয়ম অনুযায়ী, বিসর্গের পরে ক খ প ফ থাকলে বিসর্গের জায়গায় মূর্ধন্য ষ হয়। কাজেই চতুঃ+পার্শ্ব=চতুষ্পার্শ্ব। কিন্তু লেখা হয়েছে—আমাদের মাদরাসার ‘চতুর্পাশে’ সুন্দর পরিবেশ। অবশ্য চতুষ্পার্শ্ব শুদ্ধ হলেও শিশুদের উপযোগী হতো না। ‘চারপাশে’ শব্দটাই তো সহজ এবং সুন্দর ছিল। অনুজ্ঞাসূচক ক্রিয়ার শেষে ও-কার বিধেয়, যেমন করো পড়ো বলো শোনো— বইয়ে সেটা দেওয়া হয়নি। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের কবিতা উদ্ধৃত করতে গিয়েও বানান ভুল করা হয়েছে। বাড়ি, গাড়ি, বেশি, ভিমরুল, চৈতি, শেফালি, নেকি, বেয়াদবি, দাদি, নানি, গরিব, মুলো, সুতো প্রভৃতি শব্দে অযথা ঈ-কার ও ঊ-কার ব্যবহার করা হয়েছে। ১১ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘উম্মত’, ২৭ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘উম্মা’ ও ‘উম্মাহ’—একই শব্দ আছে তিন রকম বানানে। ১৭ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘কৃপণ’ আবার ‘কৃপন’। শিশুদের জন্যে এটা চরম বিভ্রান্তিকর। ভালো (উত্তম)-কে লেখা হয়েছে ভাল (কপাল), কালো (কৃষ্ণবর্ণ)-কে কাল (সময়), হলো (কৃত)-কে হল (দরবার), বলো (কও)-কে বল (শক্তি), কোনো (অনির্দিষ্ট ব্যক্তি বা বস্তুনির্দেশক সর্বনাম)-কে কোন (জিজ্ঞাসাসূচক সর্বনাম), মতো (সদৃশ)-কে মত (মনের ভাব), জানো (জ্ঞাত হও)-কে জান (প্রাণ)। অবশ্য কয়েকটি ক্রিয়ায় ও-কার দেওয়া হয়েছে ঠিকমতো, যেমন ২৩ পৃষ্ঠায় ‘আঁধারে পথ চলো না।’  কিন্তু কোথাও তা বসেছে অপ্রয়োজনে: যেমন ‘চলবো’, ‘তুলবো’ প্রভৃতি। এ ছাড়া রয়েছে বেশ কিছু প্রাচীন ও অচল শব্দ, যেমন: করহ, পড়হ, মোরা, মোদের, নাহি, কভু প্রভৃতি। একবার ‘দু’আ’, আবার ‘দোয়া’। ‘সুন্নাত’ ও ‘সুন্নাহ’। ১৬ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘দরূদ’ ও ‘দুরূদ’ একদম কাছাকাছি। এভাবে বৈষম্য করা হয়েছে একই আকারের কিছু আরবি শব্দের ভিন্ন ভিন্ন বানান দেখিয়ে, যেমন: ‘ইলম’, কিন্তু ‘যিকির’; ‘সুন্নাত’ অথচ ‘রসূল’; ‘ইবাদাত’ কিন্তু ‘কলেমা’। প্রত্যেক পাঠের শেষে দু’ পঙক্তি পদ্য রচনা করতে গিয়েও ভুল করা হয়েছে ছন্দ ও মাত্রায়। এই হলো বেফাকের কথিত ‘আদর্শ’ বাংলা। প্রকৃতপক্ষে বইটা ভুল, অজ্ঞতা, ঔদাসীন্য, অনিয়ম ও শিক্ষার নামে স্বেচ্ছাচারের খুব ভালো একটা দৃষ্টান্ত।

তিন. শিশুদের জন্যে লিখতে হলে বিশুদ্ধ বিষয়জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে শিশু মনস্তত্ত্ব সম্পর্কেও ধারণা থাকতে হয়। এ বইতে তার কোনো ছাপ নেই। প্রাসঙ্গিক ছবির জন্যে কোনো আঁকিয়ে ঠিক করা হয়নি। রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ কবিতা প্রথম শ্রেণির জন্য কঠিন হয়ে গেছে। গদ্যের ভাষায়ও এ উপযোগিতার দিকটা খেয়াল করা হয়নি। প্রায় প্রতিটি পাঠই এমন। ৪০ পৃষ্ঠায় যেমন বলা হচ্ছে: ‘গাছ আমাদের জীবন রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে।’ এই যে ‘সহায়ক ভূমিকা পালন’, এটা কি চার বছরের শিশুদের ভাষা? পুরো বই আদেশ-নিষেধ আর উপদেশে ঠাসা। ইসলাম সম্পর্কে শেখাতে গিয়ে মৌলিকত্ব রাখা হয়নি। যেমন, (বানান যেভাবে আছে তেমনি উদ্ধৃত করছি): ‘ওলীর বাড়ী যাব। চল্লিশ দিনে এক চিল্লা হয়। টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমা হয়।’ ভুল এবং আপেক্ষিক কথাবার্তাও আছে, যেমন: ‘কৌতুক করা ভাল নয়। সত্য কথা তিক্ত হয়।’ আছে গোঁড়ামিও, কোলের শিশুকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে: ‘পর্দার হুকুম মেনে চল।’ কোনো মানে হয়!

শিক্ষাক্রম পরিগঠন ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং খুবই কঠিন কাজ। দূরদর্শী চিন্তা ও সংগঠিত উদ্যোগ ছাড়া কারো একার পক্ষে এ কাজে হাত দেওয়া সহজ তো নয়ই, সমীচীনও নয়। মানসম্মত শিক্ষাক্রম ও লক্ষ্যোপযোগী পাঠ্যপুস্তক ছাড়া উন্নত জাতি গঠন সম্ভব নয়। বিশেষত শিশুপাঠ্য রচনায় সবোর্চ্চ সতর্কতা দরকার। এ কাজ করতে নেমে ভুল করার মানে হলো একটি জাতির ভবিষ্যতকে ভুল পথে ঠেলে দেবার চেষ্টা করা। তবু সময়ের প্রয়োজনে সাড়া দিতে গিয়ে যোগ্য লোকের অভাবে যাঁরা কওমি মাদরাসার পাঠ্যপুস্তক রচনায় হাত দিয়েছেন, আমরা তাদের মহৎ ইচ্ছাকে সম্মান করি এবং যে যতটুকু কাজ প্রমিত মান ঠিক রেখে করতে পেরেছেন, আমরা তাদের ধন্যবাদ জানাই। সবার উদ্দেশে বিনীত নিবেদন এই যে, এ রচনা স্রেফ সমালোচনার জন্যে সমালোচনা নয়। আমরা আসলে কেমন আছি, এ তারই সামান্য বিশ্লেষণ। আশা করি এর দ্বারা আমরা কওমি শিক্ষাক্রমের বিশৃঙ্খলা এবং পাঠ্যপুস্তকের দুর্বলতা সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা দিতে পেরেছি, ফলে শিক্ষাক্রম পুনর্গঠন ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন-পরিমার্জনে অবিলম্বে সংগঠিত পদক্ষেপ গ্রহণের গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।