একজন নন্দিত ইউএনও: ভুলিতে দেব না তোমারে

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

মে ২৭ ২০১৯, ০৯:১৩

পংকজ কান্তি গোপ : হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ জসীম উদ্দিন মহোদয় বদলী হয়েছেন; এটি এখন স্থানীয় বাহুবলের প্রধান খবর। সর্বত্রই এই নিয়ে আলোচনা। ফেইসবুক সয়লাব। অনেকেই নতুন ইউএনও মহোদয়কে স্বাগত জানিয়ে পোস্টও দিচ্ছেন।

নতুনকে আবাহন জানিয়ে, স্মৃতিময় অতীতে কিছুটা সময় অবগাহন করতেই এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। একজন সরকারি কর্মকর্তা বদলী হবেন,এটি একটি স্বাভাবিক ও চলমান প্রক্রিয়া। কেউ একই জায়গায় দীর্ঘদিন থাকতে পারেন না;এটিই নিয়ম,এটিই বাস্তবতা।

কিন্তু,বর্তমান উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ জসীম উদ্দিন বাহুবলবাসীর হৃদয়ের মনিকোঠায় দীর্ঘদিন বাস করবেন; উনারই কৃতকর্মের কারণে। উনার উদ্যোগগুলোই উনাকে বাঁচিয়ে রাখবে অনেকদিন। কেন? কী এমন উদ্যোগ? হ্যা,এ ব্যাপারে পরে আসছি। তবে আমি বলব না যে, তিনি সকল কাজেই শতভাগ সফল হয়েছেন। কিছু কাজে তিনি যেমন বিব্রত হয়েছেন তেমনি বিতর্কিত হয়েছেন। বেশ প্রতিবন্ধকতার পরও গত দু’বছরে বাহুবলে যে আলোর মিঝিল হয়ে গেল, তা সত্যি অকল্পনীয়। নতুন যে পথ তিনি তৈরি করে গেলেন, সেই পথ যদি গতিময়তা পায়, তবে এর ফল হবে ইতিবাচক। উপকৃত হবেন বাহুবলবাসী।

আমরা অবশ্যই জানি একজন উপজেলা নির্বাহী অফিসার কিন্তু মন্ত্রী কিংবা এমপি’র মতো ক্ষমতাবান নয়। তবু জনাব মোঃ জসীম উদ্দিন মন ও মননে ছিলেন একজন শক্তিশালী মানুষ। একজন স্বপ্নবান আর কাজ পাগল মানুষ। ১১মে’১৭ সালে তিনি বাহুবলের উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। প্রায় ২বছর সময়কালে তিনি পেশাগত কাজের বাইরে বেশকিছু কাজে সফলতা দেখিয়েছেন। যা উনাকে অত্র উপজেলায় গ্রহনযোগ্যতা এনে দিয়েছে। সর্বসাধারণের কাছে হয়ে উঠেছেন নন্দিত। এক নজরে দৃশ্যমান এই উদ্যোগগুলো দেখে নেয়া যাক।

শিক্ষা: বাহুবলে এসেই যে কাজটিকে তিনি অগ্রাধিকার দিয়েছেন সেটি হলো ‘শিক্ষা’। শিক্ষার মান ও হার বৃদ্ধির লক্ষ্যে “বাহুবল উপজেলা সার্বিক শিক্ষা আন্দোলন” নামে এক ব্যাপক কর্মযজ্ঞ হাতে নেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে বেশ কয়েকটি সেমিনার করেন। উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো মনিটরিং এর জন্য নিয়োগ করেন ট্যাগ অফিসার। প্রাথমিক শিক্ষায় অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি সিলেট বিভাগের শ্রেষ্ঠ ইউএনও নির্বাচিত হয়েছেন ২০১৮সালে। জাতীয় পর্যায়েও সফল অংশগ্রহণ করেন।

যানজট: বাহুবল বাজারের প্রধান সমস্যা ছিল যানজট। উনার উদ্ভাবনী উদ্যোগ সকলের দৃষ্টি কেড়েছে। প্রায় ৬টি জায়গায় সিএনজি অটোরিকশায় স্ট্যাণ্ড স্থাপন করে দিয়ে বাহুবল বাজারকে যানজন মুক্ত করেন। শুধু বাহুবল নয় মিরপুর বাজারও এখন যানজটমুক্ত।

আমরা সবুজ সংঘ: শুধু বাহুবল নয়, শরীরচর্চা সংগঠন ‘আমরা সবুজ’-এর পরিচিতি এখন দেশব্যাপী। প্রথম আলোসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকে একাধিকবার আমরা সবুজ নিয়ে প্রতিবেদন হয়েছে। শুধু শরীরচর্চা নয়, কল্যাণকর কাজ, পরিচ্ছন্নতা অভিযান, সচেতনামূলক কার্যক্রম, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বৃক্ষরোপণসহ বেশকিছু কল্যাণমূলক কাজ করে আলোচনায় এসেছে ‘আমরা সবুজ’ সংঘটি। হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক জনাব মোঃ মাহমুদুল কবীর মুরাদ প্রায় ৬মাস আগে শতাধিক গাছ রোপনের মধ্য দিয়ে সংঘটির উদ্বোধন করেন। ‘আমরা সবুজ’-এর দুটি শাখা মিলিয়ে প্রায় ২’শ সদস্য এর সাথে যুক্ত। সম্প্রতি শেষ হলো ‘আমরা সবুজ গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট’।

বাহুবল পাবলিক লাইব্রেরী: জরাজীর্ণ বাহুবল পাবলিক লাইব্রেরিটি সংস্কারের ফলে আজ অত্যাধুনিক একটি লাইব্রেরিতে রূপান্তরিত হয়েছে। নির্বাচিত কমিটির মাধ্যমে লাইব্রেরির সামনে নির্মাণ করা হয়েছে সেড। লাইব্রেরিয়ান নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ওই কাজে প্রায় ৯লক্ষ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। লাইব্রেরির উদ্যোগে একটি ‘প্রকাশনা’ বের করারও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

নজরুল একাডেমি: নজরুল একাডেমির নতুন কমিটি গঠনের পর একে গতিশীল করা হয়েছে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। নিয়মিত সাহিত্য আড্ডা, বিশেষ দিবস উদযাপন করছে সংগঠনটি। গোলাপ, প্রেমের বাঁশি, অরন্য বিলাস বিভিন্ন নামে এই আড্ডাগুলো অনুষ্ঠিত হচ্ছে বাহুবলের দর্শনীয় স্থান সমূহে।

পুওর কেয়ার কুইক রেসপন্স টিমঃ— এই সংগঠনটি অসহায়, দরিদ্র মানুষের পাশে থাকে সবসময়। ইতিমধ্যেই কেন্সার আক্রান্ত পপি আক্তার (পপি গতকাল ২৫মে মারা গেছে), অগ্নিদগ্ধ সাদিয়া আক্তার ও রুবিনা আক্তার এবং স্বামীহারা জয়তুনের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে।

বাহুবল উপজেলা ডিবেটিং ক্লাব: হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলা সবসময় সনাতনী বিতর্কই হয়ে এসেছে। তিনিই প্রথম বাহুবল একুশে বইমেলায় ‘পার্লামেন্টারী ডিবেট’ শুরু করেন। বাহুবলে গঠন করা হয় “বাহুবল উপজেলা ডিবেটিং ক্লাব”। বাহুবলে সবকটি স্কুল-কলেজে বিতর্ক চর্চা ও ভালো তার্কিক তৈরি করার পরিকল্পনা আছে সংগঠনটির।
‘পঞ্চ ইন্দ্রিয় সজাগ রাখি ; যুক্ত- তর্কে সমৃদ্ধ থাকি’ এই শ্লোগানকে সামনে রেখে এগিয়ে চলছে বাহুবল উপজেলা ডিবেটিং ক্লাব।

বইমেলা: বাহুবল একুশে বইমেলা গৌরবের অষ্টাদশ বছর পার করল গত বছর। গত দু’ বছর রূপ-রস-গন্ধে বিমোহিত ছিল বইমেলা। সেমিনার, বিভিন্ন রকমের অনুষ্ঠান, প্রতিযোগিতায় আলোড়িত ছিল বইমেলা প্রাঙ্গন।

একজন উপজেলা নির্বাহী অফিসার উপজেলার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। ভরসার জায়গা। উঁচু-নিচু, ধর্ম-বর্ণ, গরীব-ধনী সবাইকে গুরুত্ব দিতে হয়। সবার কথাই শুনতে হয়। ওই আস্থার জায়গাটুকু তিনি বিগত দুই বছরে অর্জন করতে অনেকাংশে সক্ষম হয়েছেন।

হ্যা, একেবারে শেষদিকে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটনা উনার স্বপ্নযাত্রায় কিছুটা হলেও ছন্দপতন ঘটিয়েছে। তবুও বলব, বাহুবলের উন্নয়নে তিনি যতটুকু চেষ্টা করেছেন, তা অনেক কর্মকর্তার কাছেই আমরা পাইনি। আবার অনেকের কাছে পেয়েছিও।

যারা বাহুবলের মঙ্গলার্থে কাজ করেছেন, উনাদের নাম কিন্তু এখনও বাহুবলবাসী শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। যেমন- আজো আমরা তৎকালীন ইউএনও নাসিরুজ্জামান মহোদয়ের (বর্তমানে সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়) নাম স্মরণ করি উনার কৃতকর্মের কারণেই। এভাবে হয়ত একদিন মোঃ জসীম উদ্দিন মহোদয়ের নামটি যুক্ত হবে ওই তালিকায়।

জনাব মোঃ জসীম উদ্দিন প্রায়ই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতেন, “মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক”। হ্যা, আমরাও বলি, ‘তোমারে দেব না ভুলিতে’।

পংকজ কান্তি গোপ, সংস্কৃতি কর্মী, শিক্ষক।