উত্তর-খিলাফত কালে ইসলামীকরণের বিভিন্ন ধারা প্রসঙ্গে

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

আগস্ট ২৮ ২০১৯, ২১:০১

মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত

উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহ একটি বড় বিপর্যয় কাল অতিক্রম করেছে। এই আধুনিক কালেই মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশে পাশ্চাত্য উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল। এর চূড়ান্ত পরিণতি হিশেবে দেখা যেতে পারে ১৯২৪ সালে তুর্কী উসমানি খিলাফতের সার্বিক পতন ও বিলুপ্তিকে। এরপর থেকে মুসলিম বিশ্ব এখন পর্যন্ত খিলাফতহীন পর্যায় অতিক্রম করছে। কাজেই ১৯২৪ পরবর্তী এই কালপর্বকে উত্তর-খিলাফত কাল বলে অভিহিত করা যেতে পারে।

আধুনিক ঔপনিবেশিক ও উত্তর-খিলাফত কালে মুসলিম বিশ্বে যে সার্বিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষাগত, জ্ঞানতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে তার মোকাবেলায় বিভিন্ন সংস্কার, পুনরুজ্জীবন, নবজীবন উদ্যোগ ও আন্দোলন দেখা গেছে। এক্ষেত্রে আরব উপদ্বীপে শায়খ মুহাম্মাদ আবদুল ওয়াহাব এবং দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশে শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলবির চিন্তা ও কর্মকে সর্বপ্রথম অনুপ্রেরণা হিশেবে উল্লেখ করা যায়।

এই চিন্তা ও কর্মের বিভিন্ন রকম ভাষ্যকে নির্ভর করে একদিকে আরব বিশ্বে মুয়াহহিদীন আন্দোলন (অরিয়েন্টালিস্ট ভাষ্যে যাকে ওয়াহাবী অভিধা দেয়া হয়েছে) দেখা দিয়েছিল। ভারতবর্ষে শাহ আবদুল আযীয ও সৈয়দ আহমদ বেরেলবির নেতৃত্বে জিহাদি আন্দোলন দেখা দিয়েছিল। এই জিহাদী আন্দোলন এবং ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের বিপর্যয়ের পরে ভারতবর্ষের উলামাদের একাংশ দেওবন্দ মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে একটি ঐতিহ্যবাদী দারুল উলুম বা একাডেমিক ইসলামের অনুশীলনে মনোনিবেশ করেন।

আবার অন্য আরেক রকমের ভাষ্যের উপরে ভিত্তি করে সৈয়দ জামালউদ্দীন আফগানী ও তাঁর আরব অনুসারী মুফতী মুহম্মদ আবদুহু ও রশীদ রিদার নেতৃত্বে একটি আধুনিক প্যান-ইসলামি চিন্তা ও কর্মের ধারা শুরু হয়েছিল। অন্যদিকে ভারতবর্ষে স্যার সৈয়দ আহমদ খান, সৈয়দ আমীর আলী এবং মওলানা আকরম খাঁ প্রমুখের প্রেরণায় একটি আধুনিকতাবাদী সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল। আধুনিক তুরস্কে এই ধারাকে চরম পর্যায়ে নিয়ে যান জিয়া গোকাল্প ও মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক। আধুনিক শিয়া ইরানে এই ধারাকে নিজেদের মত করে অনুসরণ করেছে ইরানী আধুনিকতাবাদীরা; পাহলবী শাহ রাজবংশ এর পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিশেবে ১৯৭৯ সালে ইরানে সংঘটিত হয় আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনীর নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লব। এই বিপ্লবে আদর্শিক অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন ড. আলী শরীয়তী, আয়াতুল্লাহ মুর্তাজা মুতাহারি প্রমুখ।

বিশ শতকের সূচনায় ভারতবর্ষে আল্লামা মুহম্মদ ইকবালের অনুপ্রেরণায় এই সংস্কার ও ইসলামীকরণের আন্দোলন একটি নতুন পর্যায়ে উপনীত হয়। তিনি ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বকে পুনরায় তুলে ধরেন পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানকে উপেক্ষা না করেই। এই ধারাটি আরো শক্তিমত্তার সাথে আবির্ভূত হয় আরব বিশ্বে শায়খ হাসান আল বান্নার নেতৃত্বে ইখুয়ানুল মুসলিমিন এবং ভারতবর্ষে মওলানা আবুল আলা মওদূদীর নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী সংগঠনের মাধ্যমে। এই ধারাটি ক্রমাগত সংহত ও বিস্তৃত হয়ে বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এসে ইসলামিজম হিশেবে পরিচিতি পেয়েছে। অরিয়েন্টালিস্টরা অবশ্য একে কখনো ডেকেছে মৌলবাদ, কখনো রাজনৈতিক ইসলাম অথবা ইসলামো-ফ্যাসিজম ইত্যাদি নামে।

সোভিয়েত আগ্রাসন বিরোধী আফগান জিহাদের সময় থেকে এই রাজনৈতিক ইসলাম ক্রমাগত একটি সংগঠিত সামরিক প্রতিরোধ বা জিহাদী ইসলামের রূপ নিতে থাকে যেখানে আরব ও অনারব মুজাহিদরা অংশ নিতে থাকেন। এক্ষেত্রে মিশরের সাইয়িদ কুতুব এবং ফিলিস্তিনী শায়খ আবদুল্লাহ আজ্জামের আদর্শিক প্রভাব বড় ভূমিকা রেখেছে নিঃসন্দেহে। কিন্তু শায়খ উসামা বিন লাদেন আল কায়েদা গঠন করে এই আফগান আঞ্চলিক জিহাদের অভিজ্ঞতাকে একুশ শতকে সাধারণীকরণ/বিশ্বায়িত করতে গেলে বিপুল বিতর্কের অবতারণা হয়। “সন্ত্রাসবাদ” ও “জঙ্গিবাদে”র তকমা লাগতে থাকে তাদের চিন্তা ও কর্মকান্ডের উপরে। পরবর্তীকালে আইসিস, বোকো হারাম ইত্যাদির উত্থান এই বিতর্ককে আরো উসকে দেয়। যে ইসলামীকরণের উদ্দেশ্যে এইসব সংস্কার আন্দোলনের উৎপত্তি হয়েছিল তা অনেকটাই ধাক্কা খেল। দেখা গেল এইসব সামরিক ইসলামপন্থীদের দমনের নামে মুসলিম দেশগুলোতে পাশ্চাত্য আধিপত্য আরো প্রবলভাবে হাজির হতে পারল। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন ইত্যাদি মুসলিম দেশগুলোতে একধরণের আত্মঘাতী গৃহযুদ্ধ ও নৈরাজ্য কায়েম হয়ে গেল। অর্থাৎ ফলাফল উলটো হল যাকে কাউন্টার প্রোডাক্টিভও বলা যায়।

এই পরিস্থিতিতে সংস্কারমূলক ইসলামীকরণের ভবিষ্যত রূপরেখা কি হতে পারে? একবিংশ শতকের তৃতীয় দশকের সূচনালগ্নে মুসলিম বিশ্বে কি নতুন চিন্তা ও কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করার সময় এসেছে? যদি এসে থাকে তাহলে তার প্রকৃতি ও আকৃতি কি হবে? পোস্ট-ইসলামিজম, পোস্ট-“টেরোরিজম” ও পোস্ট-“মিলিট্যান্টিজম” সংস্কার ও ইসলামীকরণের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক কাঠামো কেমন হওয়া উচিত? আমাদের এই বিষয়ে পুনর্চিন্তা ও পুনর্গঠনের দিকে যেতে হবে। আমাদের খুব সম্ভবত রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিরোধকে পরবর্তীকালে আরো শক্তিশালী করার জন্যই এখন শিক্ষাগত, জ্ঞানতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক লড়াইকে জোরদার করতে হবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও জ্ঞান কাঠামোকে আগে ইসলামীকরণ করতে হবে। বিপুল মানুষের কাছে ইসলামী জ্ঞান ও শিক্ষাকে নানাভাবে উপস্থাপন ও পৌঁছে দিতে হবে তাদের মানস গঠন পরিবর্তন করার জন্য। এক্ষেত্রে একধরণের এপিস্টেমলজিকাল ও পেডাগজিকাল বিপ্লব সাধন করতে হবে। আনুষ্ঠানিক, উপানুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বিভিন্ন শিক্ষা ও জ্ঞান কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এই কাজটি আগে সম্পন্ন করে নিলে যে সামাজিক ইসলামীকরণ ঘটবে তা পরবর্তীকালে রাজনৈতিক ও সামরিক ইসলামীকরণের পথ সহজ করে দেবে।

এই পুনর্চিন্তা থেকে বিশ শতকের আশির দশক থেকে সৈয়দ আলি আশরাফ, সৈয়দ নাকিব আল আত্তাস, ইসমাইল রাজি আল ফারুকী, সাইয়েদ হোসেইন নসর, জিয়াউদ্দীন সরদার প্রমুখ মুসলিম মনীষীরা জ্ঞান ও শিক্ষার ইসলামীকরণের যে ধারণা ও কর্মকান্ডের সূচনা করেছিলেন সেটিকেই আমি এইমুহূর্তে পরিপুষ্ট করে তোলাকে সবচাইতে জরুরী ও কার্যকর পথ ও পন্থা বলে প্রস্তাব করছি। এর মধ্য দিয়ে আসলে এক ধরণের নতুন শিক্ষা ও জ্ঞান ভিত্তিক দাওয়াতি ও তাবলিগী ইসলামীকরণ প্রক্রিয়া চালু করা যেতে পারে। এর একটি সমান্তরাল ধারা বেশ কিছু আগে থেকেই অনুশীলন করে আসছিলেন মওলানা আবুল হাসান আলি নাদভী তার লেখালেখি ও কাজের মধ্য দিয়ে। উত্তরাধুনিক মিডিয়া ও ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহার করে সম্প্রতি ডা. জাকির নায়েক, নুমান আলী খান প্রমুখ দাঈ ও উস্তাদ এই নব উত্তর-ইসলামপন্থার (পোস্ট-ইসলামিজম) অগ্রপথিক হয়ে উঠেছেন। অনেকেই এই এপিস্টেমলজিকাল এন্ড পেডাগজিকাল ইসলামের ধারায় যুক্ত হবেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।