ইসলামে শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মে ০১ ২০২০, ০০:৪০

•মুফতি সৈয়দ নাছির উদ্দীন আহমদ•

পহেলা মে,আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিশেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালন করা হয় । আমাদের বাংলাদেশেও সে দিবসটির গুরুত্ব অনেক রয়েছে।

সরকারি ছুটি হিশেবে সেদিন সমস্ত অফিস আদালত কল কারখানা ইত্যাদি বন্ধ রাখা হয় । বিশ্বের কোটি কোটি শ্রমজীবি মানুষের অধিকার ও দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সেদিনকে মহান ‘মে দিবস হিসেবে পালন করা হয় ।

১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা উপযুক্ত মজুরি আর দৈনিক আট ঘন্টা কাজের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন । কল-কারখানা তখন গিলে খাচ্ছিল শ্রমিকের গোটা জীবন । অসহনীয় পরিবেশে প্রতিদিন ১৬ ঘন্টা কাজ করতে হতো । সপ্তাহজুড়ে কাজ করে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে যাচ্ছিল ।

শ্রমজীবি শিশুরা হয়ে পড়েছিল কঙ্কালসার । তখন দাবি উঠেছিল,কল-কারখানায় শ্রমিকের গোটা জীবন কিনে নেয়া যাবে না । ৮ ঘন্টা শ্রম দিনের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলনের সময় ওই বছরের ১লা মে শ্রমিকরা ধর্মঘট আহবান করে । সেদিন লাখ মেহনতি মানুষ ওই সমাবেশে অংশ নেয়।

আন্দোলনরত ক্ষুদ্ধ শ্রমিকদের রুখতে গিয়ে একসময় পুলিশ বাহিনী শ্রমিকদের মিছিলে এলোপাতাড়ি গুলি চালায় । এতে পুলিশের গুলিতে প্রায় দশের অধিক নিরস্ত্র শ্রমিক নিহত হন,আহত ও গ্রেফতার হন আরো অনেক শ্রমিক।

সম্মানিত পাঠক,

ইসলাম ধর্মে মানব রচিত দিবস পালনের গুরুত্ব ও ফজিলত তো দুরের কথা এর বৈধতাটুকুও নেই । সে হিশেবে শ্রমিক দিবস উদযাপন যদিও ইসলাম ধর্মে নেই,কিন্তু ইসলামে রয়েছে শ্রম ও শ্রমিকের অপরিসীম গুরুত্ব ও ফজিলত ।

♢ শ্রম ও শ্রমিকের পরিচয়:

মানুষ জীবন ধারণের জন্য যেসব কাজ করে,তাকে শ্রম বলে। মানুষ তার নিজের বেঁচে থাকার,পরিবারকে ভরণ-পোষণের, অপরের কল্যাণে এবং সৃষ্টি জীবির উপকারে যে কাজ করে, তা-ই শ্রম।

ধনি-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, নর-নারী নির্বিশেষে সব মানুষই কোনো না কোনো কাজ করে। আর যে কোনো কাজ করতে গেলেই প্রয়োজন হয় শ্রমের। এ হিসেবে পৃথিবীর সব মানুষকেই শ্রমিক হিসেবে অভিহিত করা যায় ।

ইসলামে শ্রমিকের মর্যাদা :

ইসলামে শ্রমিকের মর্যাদা ও গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে অনেক। কেননা শ্রমিকই হলো সকল উন্নয়ন এবং উৎপাদনের চাবিকাঠি । যে জাতি যত বেশি পরিশ্রমী, সে জাতি তত বেশি উন্নত। শ্রম আল্লাহ্ প্রদত্ত মানব জাতির জন্যে এক অমূল্য শক্তি ও সম্পদ । এ সম্পর্কে আল-কোরআনে বর্ণিত আছে, “নিশ্চয়ই আমি মানুষকে শ্রমনির্ভর করে সৃষ্টি করেছি। (সূরা বালাদ : ৩)

“তিনি তোমাদের জন্য ভূমি সুগম করে দিয়েছেন। কাজেই তোমরা এর দিক-দিগন্তে বিচরণ কর এবং তার দেয়া রিযিক থেকে আহার কর।” (সূরা: মুলক, আয়াত-১৫)

আল্লাহ পাক অন্যত্রে নির্দেশ দিয়েছেন,“অতঃপর যখন নামায শেষ হবে, তখন তোমরা জমিনের বুকে ছড়িয়ে পড় এবং রিযিক অন্বেষণ কর।” (সূরা: জুমা, আয়াত-১০)

●হযরত মিকদাম ইবনে মাদীকারিব (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, নিজ হাতে পরিশ্রম করে খাওয়ার চেয়ে উত্তম খাবার কেউ কখনো খায়নি ।আল্লাহর নবী দাউদ (আ:) নিজ হাতে কাজ করে খেতেন । (সহীহ বুখারী হাদীস নম্বর ২০৭২)

♢ ইসলাম ভিক্ষাবৃত্তির চেয়ে শ্রমিকদের মর্যাদা অধিক হিসেবে বর্ণনা করেছে 

●রাসূলুল্লাহ্(সা.)বলেন,তোমাদের কেউ তার এক গাছা রশি নিয়ে বের হওয়া এবং জঙ্গল থেকে পিঠে করে লাকড়ি বোঝা আনা,তারপর তা বিক্রি করা এবং ফলে এর মাধ্যমে আল্লাহ পাক তাকে ভিক্ষাবৃত্তি থেকে রক্ষা করা এটি তার পক্ষে উত্তম ও শ্রেয় মানুষের কাছে এমন ভিক্ষা করে ফেরার চেয়ে যে,তারা চাইলে তাকে কিছু দিবে অথবা বঞ্চিত করবে । (সহীহুল বুখারী হাদীস নম্বর ১৪৭১)

● হযরত আয়েশা সিদ্দিকা(রা:) বর্ণিত,রাসুলুল্লাহ (সা:) যে ব্যক্তি হাতে খেটে কাজ করে ক্লান্ত শ্রান্ত অবস্থায় সন্ধ্যা করে,তার সগীরাগুনাহ সমুহ ক্ষমা করে দেওয়া হয় । (তাবরানী তারগীব খন্ড ২ পৃ:৪)

♢ ইসলামে শ্রমিকের পারিশ্রমিকের গুরুত্ব :

●হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর(রা:)থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,রাসুলল্লাহ(সা:)বলেছেন, শ্রমিকদের পারিশ্রমিক দিয়ে দাও তার ঘাম শুকানোর আগেই ।(সুনানে ইবনে মাজাহ হাদীস নম্বর ২৪৪৩)

কিন্তু দুঃখ হলেও সত্য বর্তমান সময়ে বিশেষ করে সাধারণ শ্রমিকের পারিশ্রমিক যথাযথ সময়ে পাবে তো দুরের কথা অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় তার ন্যায্য পাওনাটুকু দেয়া হয়না । বরং উলটো করা হয় অনেক সময় শ্রমিকের উপর অন্যায় অত্যাচার।

অনেক সময় দেখা যায়,চাকরি সুরক্ষার জন্য শ্রমিকরা বিনা পারিশ্রমিক নিয়েও মালিকের চাপের মুখে পড়ে নির্দিষ্ট কাজ থেকে অতিরিক্ত কাজ করেন ।

বিভিন্ন কল কারখানা অফিস আদালত ইত্যাদিতে এর প্রবনতা বর্তমান সময়ে অনেকটাই বেশি দেখা যায়।

অথচ শ্রমিকদের সঙ্গে এরূপ ব্যবহার করার ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে হযরত আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত হাদীস ,রাসুলুুুল্লাহ (সা:) বলেন,আল্লাহ পাক বলেছেন, কেয়ামতের দিন আমি নিজে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে দাড়াবো । আর আমি যার বিরুদ্ধে দাঁড়াবো তাকে পরাস্ত করেই ছাড়বো ।

এক. ঐব্যক্তি যে আমার নামে অঙ্গীকার করে তা ভঙ্গ করেছে ।

দুই. ঐ ব্যক্তি যে কোনো স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রি করে সেই মূল্য ভক্ষণ করেছে ।

তিন. ঐ ব্যক্তি যে কোনো শ্রমিককে পারিশ্রমিকের ভিত্তিতে নিয়োগ দিলো, এবং তার থেকে পুরোপুরি পরিশ্রম নিল,কিন্তু তার পারিশ্রমিক দিলনা । (সহীহ বুখারী হাদীস নম্বর ২২৭০)

ইসলাম ধর্ম যেখানে একজন শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার সবক্ষেত্রেই পূর্ণাঙ্গভাবে দেয়,সেখানে ইসলাম বিবর্জিত বিভিন্ন সমাজে শ্রমের বিভিন্নতাকে বিভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা হয়ে থাকে। তাদের দৃষ্টিতে কোনো শ্রম অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ আবার কোনো কোনো শ্রম অত্যন্ত অমর্যাদাকর। সেখানে অর্থের মানদন্ডের উপর ভিত্তি করে সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। যে যত অর্থশালী সামাজিকভাবে তিনিই তত সম্মানী ।

মুলত প্রকৃত সম্মান আর মর্যাদা যে,অর্থের উপর ভিত্তি করে নয়,বরং ইসলামী মূলনীতি পালনের উপর নির্ভর সে বিষয়টি কিন্ত ওরা ভলে যায়।

দুঃখ হলেও সত্য যে,এরকম মনমানসিকতা আমাদের অনেক মুসলমান ভাই বোনদেরও মধ্যে পাওয়া যায় । যা খুবই দুঃখজনক ও আপত্তিকর, মুসলিমদের জন্য এটা কখনো কাম্য হতে পারেনা।

এমন মনমানসিকতা থেকে অবশ্যই প্রতিটি মুসলমান নারী ও পুরুষকে বের হয়ে আসতে হবে।

তাই পরিশেষে বলতে চাই,ইসলাম শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার যেভাবে দিয়েছে এর বাস্তবায়ন যেন আমরা বাস্তব জীবনে প্রতিষ্ঠা করি ।

এবং শ্রমিকের শ্রমের ন্যায্য অধিকার ও পাওনা নিয়ে যেন কোনো প্রকার দূর্নীতি ও অনৈতিক আচরণ না করি । আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে সঠিকভাবে ইসলাম ধর্ম পালনের তাওফিক দান করেন । আমীন