ইলমে হাদিসের ক্রমবিকাশ ও শাস্ত্রীয় রূপায়ন

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুন ১৫ ২০২৩, ০০:১৪

মুহাম্মদ হাসসান আকবর: ইসলামী শরীয়তের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উৎস আহাদীসে নববীর গুরুত্ব কতটুকু তা সচেতন মুসলিম মাত্রই অবগত। কুরআনুল কারীমের ব্যাখ্যা, হযরত রাসূল সা. এর জীবনাদর্শ ও ইসলামি জীবন ব্যবস্থার আলেখ্য হিসেবে হাদীসের গুরুত্ব অপরিসীম। হাদীসের গুরুত্ব অনুভব করেই ইসলামের প্রাথমিকযুগ থেকে মুসলিম মনীষীরা হাদীস সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য যে কঠিন ত্যাগ স্বীকার করে আসছেন, বিশ্বের অমুসলিম পন্ডিতগণ পর্যন্ত এ সত্যকে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। মুসলিম মনীষীদের এই কঠোর সাধনার ফলস্বরূপ ইলমে হাদীসের বিপুলজ্ঞান ভান্ডার আজ অবিকৃতভাবে আমাদের পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে।

রাসূলে আরাবী হযরত মুহাম্মদ সা. এর সাহচর্যে ধন্য হযরত সাহাবায়ে কেরাম রা. যখন পরশ পাথরে ছোঁয়ায় নিজ জীবনকে স্বার্থক করে তুললেন;তাঁদের কামনা জাগল পরবর্তি প্রজন্মও যেন সেই আলোর দিশা পায়, সে পথেই যেন নিজেদের পরিচালিত করে। সে লক্ষেই সাহাবায়ে কেরাম রা. নববী দ্বীপাধার থেকে প্রাপ্ত মুক্তাগুলো বিলিয়ে দিতে শুরু করেন।

একদিকে নবীয়ে করীম সা. এর উৎসাহমূলক বাণী- نضر الله امرأ، سمع مقالتي فحفظها ووعاها وأداها کما سمعها

অপরদিকে ভীতিপ্রদর্শন মূলক উক্তি-من کذب علي متعمدا فليتبوأ مقعده من النار

এ কারণেই সাহাবীগণ বর্ণনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন। নবীয়ে করীম সা. এর নামে বর্ণিত কোন হাদীস সন্দেহ হলে তাঁরা যাচাই করে দেখতেন, কখনো বর্ণনাকারীর নিকট সাক্ষী তলব করতেন। হযরত আলী রা. কখনো বর্ণনাকারী থেকে কসম পর্যন্ত নিতেন।এসবের দ্বারা তাঁদের উদ্দেশ্য কখনো হাদীসের পথ সংকীর্ণ কিংবা রুদ্ধ করা ছিলনা। বরং তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল, ভুল ও মিথ্যার সুযোগ নষ্ট করে দেয়া। যেন সবাই রাসূল সা. এর সাথে কোন হাদীস সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে সতর্ক হয়।

ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সিরীন রহ. বলেন- ‘প্রাথমিকযুগে সাহাবাগণ সনদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন না। কিন্তু যখন ফেতনা তথা উসমান রা.এর শাহাদাতের ঘটনা ঘটল। তখন তারা বর্ণনাকারীদের বলতে লাগলেন-তোমরা আমাদেরকে তোমাদের বর্ণনাকারীদের নাম বলো। আহলুস সুন্নাহ হলে তাদের হাদীস গ্রহণ করা হবে আর বেদআতী হলে হাদীস ত্যাগ করা হবে।’

ইলমুল জারাহ ওয়াত তা’দীলের যুগ: সাহাবীদের যুগ থেকেই রাবীদের যাচাই-বাচাই করা আরম্ভ হয়। তাঁরা কারো হাদীস প্রত্যাখ্যান করেন,কারো বর্ণিত হাদীসের ত্রুটি বর্ণনা করেন।

ইমাম মুসলিম রহ. বর্ণনা করেন- হযরত ইবনে আব্বাস রা. এর নিকট বুশাইর আদাবী এসে বলতে লাগলেন “قال رسول الله.قال رسول الله”‘আল্লাহর রাসূল বলেছেন, আল্লাহর রাসূল বলেছেন’

ইবনে আব্বাস রা. তাঁকে হাদীস বর্ণনার অনুমতি দেননি। তার দিকে ভ্রুক্ষেপও করেন নি। বুশাইর বলেন- হে ইবনে আব্বাস! আপনি কেন মনোনিবেশ করছেন না? আমি রাসূলের হাদীস বলছি, আপনি কেন শুনছেন না? ইবনে আব্বাস রা. বললেন- আমরা এক সময় যখন কাউকে বলতে শুনতাম রাসূল সা. বলেছেন আমরা তার দিকে মনোযোগি হতাম কিন্তু লোকেরা যখন কঠিন ও নরম বাহনে (অর্থাৎ ভালো ও মন্দ পন্থা অবলম্বন করলো) আরোহণ করলো। তখন থেকে শুধু পরিচিত বন্তুই আমরা গ্রহণ করি। এভাবে সাহাবীদের যুগ শেষ না হতেই সনদ তলব করা আরম্ভ হয় এবং علم الجرح والتعدیل শাস্ত্রের সূচনা হয়। তাঁরা সহীহ হাদীস ও সিকাহ রাবী যাচাই করার কতক নীতি তৈরী করেন। যা সবার নিকট পরিচিত থাকার কারণে স্বতন্ত্র গ্রন্থে জমা করার প্রয়োজন হয়নি।‎

তাবেয়ীদের যুগে ইলমে হাদীস: হিজরী প্রথম শতাব্দীর অর্ধেক শেষ না হতেই অধিকাংশ সাহাবীয়ে রাসূল পরলোক গমন করেন। ইতিপূর্বে তাঁরা ইসলামের দাওয়াত ও আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের উদ্দেশ্যে পূর্ব-পশ্চিম বিচরণ করেন। ফলে বিভিন্ন দেশের তাবেয়ীগণ তাঁদের থেকে ইলম অর্জন করার সুযোগ লাভ করেন। নবীজির মুখ নিসৃত বাণী সরাসরি তাঁদের কাছ থেকে আহরণ করেন। তাঁরাও অন্যান্যদের কাছে হাদীস বর্ণনা করতে শুরু করেন। এক্ষেত্রে তাঁরা কতক সমস্যার সম্মুখীন হন। যেমন:

১. তাঁরা দেখতে পেলেন, নবীযুগ থেকে দূরত্বের সাথে সাথে মানুষের স্মৃতি-শক্তিও লোপ পাচ্ছে।

২. ধীরে ধীরে সনদ দীর্ঘ হচ্ছে, সাহাবী থেকে তাবেয়ী, কখনো তাবেয়ী থেকে তাবে তাবেয়ী ইলম শিখছেন।

৩. বিভিন্ন বাতিল ফেরকার আবির্ভাবের কারণে নিজস্ব মতবাদের সমর্থনে মিথ্যা হাদীস রচনার সয়লাব ঘটছে। তাবেয়ীগণ এসব সমস্যা সমাধানের জন্য নানা প্রদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তাঁরা হাদীসের সুরক্ষার স্বার্থে সাহাবীদের থেকে শেখা নীতির সাথে কিছু নতুন রীতি তৈরী করেন।

তাবেয়ীদের অনুসৃত রীতি:

১. তাঁরা রাবী ও সনদ যাচাই করতে শুরু করলেন। যেন মিথ্যাবাদীদের রচিত কোনকিছু হাদীসের স্বীকৃতি না পায়। তাঁরা রাবীদের অবস্থা,নাম,উপাধি, উপনাম,জন্ম ও সফর ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করেন। রাবীদের দেশ,সফর,অবস্থান,মৃত্যু এবং প্রত্যেকের ভালো-মন্দ সম্পর্কে জ্ঞাত হন । তাদের স্মৃতি-শক্তি ও হাদীসের উপর দক্ষতা যাচাই করেন। এভাবে তাঁরা গ্রহণযোগ্য ও প্রত্যাখাত রাবীদের পৃথক করেন। তাঁরা সনদকে দ্বীনের অংশ মনে করেন। কারণ এটি সহীহ ও জাল হাদীস চিহ্নিত করার মাধ্যম।

২. তাবেয়ীগণ রাবীদের গুনাগুণ নির্ণয়ে বিভিন্ন পরিভাষা গ্রহণ করেন। যেমন: ضابط, عادل, كذاب, ضعيف ইত্যাদি। যেন সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদী,দূর্বল ও সবল রাবীদের চিহ্নিত করা যায়।

৩. তাঁরা সরকারী ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে হাদীস লিপিবদ্ধ করা আরম্ভ করেন। যেমন: হাম্মাম ইবনে মুনাব্বিহ রহ.আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত হাদীসগুলো একত্রিত করেন।খলীফা উমর বিন আব্দুল আযীয রহ. সরকারী তত্বাবধানে ইমাম যুহরীর নেতৃত্বে হাদীস সংকলণের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।

৪. তাবেয়ীগণ বিভিন্ন দেশ থেকে হাদীসের সনদগুলো জমা করে পরখ করেন ও এক হাদীসের সাথে অপর হাদীস তুলনা করেন। এভাবে হাদীসের শুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হন।

৫. যারা পেশা হিসাবে হাদীস-শিক্ষা গ্রহণ করেনি বা হাদীস বর্ণনার নীতি সম্পর্কে জ্ঞাত নয়, তাবেয়ীগণ তাদের হাদীস ত্যাগ করেন। যেমন: উসূলে হাদীস না জানা এক ধরণের সুফিদের হাদীস। যারা তারগীব ও তারহীবের ক্ষেত্রে (অর্থাৎ উৎসাহ প্রদান ও ভীতি প্রদর্শনের ক্ষেত্রে) হাদীস রচনা বৈধ মনে করতেন।

৬. নবীন তাবেয়ীগণ প্রবীণ তাবেয়ীদের নিকট হাদীস পেশ করতেন। যেমন: স্বর্ণকারের নিকট স্বর্ণ পেশ করা হয়। তারা হাদীসের দোষ-ত্রুটি বলে দিতেন।এ যুগে হাদিসের কতক পরিভাষাও সৃষ্টি হয়। যেমন:مقطوع, موقوف, مرفوع, متصل, مرسل, مدلس, ইত্যাদি। এ যুগের হাদীস যাচাইয়ের নীতিগুলো স্বতন্ত্র কোন কিতাবে লিপিদ্ধ করা হয়নি। কারণ হাদীসের প্রত্যেক ছাত্রের নিকট তা প্রসিদ্ধ ছিলো।

ইলমে হাদীসের স্বর্ণযুগ এবং শাস্ত্রীয় রূপায়ন:

হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত সময়কে ইলমে হাদীসের স্বর্ণযুগ বলা হয়। তৃতীয় শতাব্দীতে মুহাদ্দিসগণ সংকলিত হাদীস কিতাব আকারে জমা করার প্রতি মনযোগী হন। এ সময় হাদীসের মূল কিতাবগুলো রচনা করা হয়। যেমন: ইমাম মালিক রহ.-এর আল-মুয়াত্তা, আহমদ বিন হাম্বল রহ. এর আল-মুসনাদ, ইমাম বুখারী রহ. এর আাস-সাহীহ সহ সিহাহ সিত্তার অন্যান্য কিতাবগুলো। এ সময় অনেক মুহাদ্দিসগণ علم الرجال বা রাবিদের জীবনের উপর একাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। যেমন: ইমাম বুখারী রহ. রচনা করেন كتاب الضعفاء, التاريخ الكبير, التاريخ الصغير, التاريخ الأوسط. ইয়াহয়া ইবনে মায়িন রহ. রচনা করেন التاريخ, ইবনে সাদ লিখেন الطبقة الكبرى,ইমাম নাসায়ী রহ. লিখেন كتاب الضعفاء ইত্যাদি।

মুহাদ্দিসগণ এসব কিতাবে “উসূলে হাদীসের” পরিভাষা ব্যবহার করেছেন। কিন্তু কেউ তার সংজ্ঞা দেননি। যেমন: বুখারী ও মুসলিম রহ. সহীহ হাদীসের সংজ্ঞা দেননি। ইমাম আহমদ রহ. নাসেখ-মানসূখের উপর কিতাব লিখেছেন। কিন্তু তার সংজ্ঞা দেননি। সর্বপ্রথম হাদীস শাস্ত্রের পরিভাষা সংক্রান্ত সংজ্ঞা দেন ইমাম শাফেয়ী রহ.। তিনি উসূলে ফিকহের উপর লিখিত “আর রিসালাহ” গ্রন্থে উসূলে হাদীসের কতক পরিভাষার সংজ্ঞা দেন। যেমন: দলীলযোগ্য হাদীসের শর্ত, খবরে ওয়াহিদের প্রমাণিকতা ইত্যাদি।

চতুর্থ হিজরীর মাঝামাঝি সময়ে যখন হাদীসের কিতাব লেখা প্রায় শেষ, তখন আলেমগণ হাদীসের পরিভাষাগুলো স্বতন্ত্র কিতাবে জমা করা শুরু করেন। তারা প্রথমে সনদসহ পরিভাষাগুলো জমা করেন। তার উপর টিকা সংযোজন করেন।

এভাবে তাঁরা ইলমে হাদীসকে শাস্ত্রীয় রূপ দেয়ার চেষ্টা করেন।শাস্ত্রীয় রুপদান কল্পে সর্বপ্রথম এ বিষয়ে কলম ধরেন ক্বাযী আবু মুহাম্মদ হাসান ইবনে আব্দুর রহমান আর রামাহুরমুযী(মৃত্যু: ৩৬০ হি:)।তিনি “المحدث الفاضل بين الراوى والواعى” নামক কিতাবে হাদীস বর্ণণা করা, শ্রবণ করা, শিক্ষা দেওয়া ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলোর নিয়ম-নীতি জমা করেন। কিন্তু একটি পূর্ণাঙ্গ কিতাবের ন্যায় উসূলে হাদীসের বিভিন্ন প্রকারগুলো তিনি উল্লেখ করেন নি। এরপর তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন হাকিম আব্দুল্লাহ নিশাপুরী (মৃত্যুঃ ৪০৫ হি)। তিনি “معرفة علوم الحديث” নামে একটি কিতাব লিখেন। সর্বপ্রথম উসূলে হাদীসের উপর এটা স্বতন্ত্র রচনা।

অতঃপর উসূলে হাদীসের উপর গুরুত্বপূর্ণ কিতার লিখেন আবু বকর আল বাগদাদী রহ.(মৃত্যুঃ ৫৬৩ হিঃ)। উসূলে হাদীসের উপর তিনি একাধিক কিতাব রচনা করেন-১.علم الرواية و الكفاية,২.تقييدالعلم,৩. الرحلة في طلب الحديث,৪.الجامع لإختلاف الراوي وآداب السامع,ইত্যাদি। উসূলে হাদীসের সনদ কিংবা মতনের সাথে সংশ্লিষ্ট এমন কোন ইলম নেই যার উপর তিনি কলম ধরেননি। পরবর্তী আলেমদের নিকট তাঁর কিতাবগুলো ব্যাপক সমাদৃত হয়। অতঃপর এবিষয়ে স্বতন্ত্র কিতাব লিখেন কাযী ইয়ায রহ.। তাঁর কিতাবের নাম ছিল الإلماع إلي معرفة أصول الرواية و تقييد السما,

এরপর এ বিষয়ে “ما لا يسع المحدث جهله ” নামক কিতাব লিখেন আবু হাফস মাইয়ানীযী রহঃ। এভাবে উসূলে হাদীসের উপর লিখিত কিতাবের সংখ্যা বাড়তে থাকে।

এরপর আসে প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আবু আমর উসমান ইবনুস সালাহ রহ .(মৃত্যু ৬৪৩ হি.)এর যুগ। তিনি উসূলে হাদীসের উপর “ علوم الحديث” নামক তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থটি রচনা করেন। যা “مقدمة ابن الصلاح” নামে প্রসিদ্ধ। কয়েকটি বৈশিষ্টের কারণে এ কিতাব ইলমে হাদীসশাস্ত্রে জাগরণ সৃষ্টি করে এবং সবচেয়ে বেশী সমাদৃত হয়। কতিপয় বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:—

১. এই কিতাবে হাদীসের প্রায় সকল প্রকার উল্লেখ করা হয়। যা পূর্বের কিতাব সমূহে বিক্ষিপ্ত ছিলো।

২. সহজ ও সাবলীল ভাষায় হাদীসের নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়।

৩. পূর্ববর্তী উলামাদের বাণী ও কর্ম থেকে বিভিন্ন মাসআলা উদঘাটন করা হয়।

৪. সংজ্ঞাসহ প্রত্যেক প্রকার উল্লেখ করা হয়। যার সংজ্ঞা পূর্বে ছিলনা তার সংজ্ঞা তৈরী করা হয়।

৫. পূর্ববর্তী আলেমদের নীতি ও অনুসৃত পদ্ধতির সুন্দর সমালোচনা করা হয়।

এজন্য মুহাদ্দিসগণ মনে করেন এ কিতাব দিয়ে লেখক উসূলে হাদীসের নতুন দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। পরবর্তীতে কেউ এই কিতাবকে সংক্ষিপ্ত করেন। কেউ তার ব্যাখ্যা লিখেন। কেউ কিতাবকে কবিতার রূপ দেন। কেউ আবার তার কতিপয় নীতিমালার সমালোচনা করেন। ইবনুস সালাহ’র কিতাবটি এতটাই গ্রহণযোগ্য যে, উসুলে হাদীসের মূল কিতাব বললে তাঁর কিতাব বুঝানো হয়। আর এভাবেই ইলমে হাদীস শাস্ত্র একটি পূর্ণাঙ্গরূপ লাভ করে। ইবনুস সালাহের পর এ শাস্ত্রে আরো কিতাব রচনা করা হয়। যার মাধ্যমে ইলমে হাদীস শাস্ত্র আরো সমৃদ্ধি লাভ করে। যেমন: আল্লামা শরীফ জুরজানী রহ. এ বিষয়ে “مختصر الجرجاني” নামক কিতাব লিখেন। অতঃপর হাফেজ ইবনে হাজার রহ. এ কিতাবের সার-সংক্ষেপ হিসাবে “نخبة الفكر” নামক কিতাব লিখেন । এবং নিজেই “نزهة النظر” নামে এর শরাহ রচনা করেন। যা তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের কারণে যুগ যুগ ধরে মাদ্রাসা সমূহের পাঠ্য হয়ে আসছে। এভাবেই ইলমে হাদীস একটি পূর্ণাঙ্গ শাস্ত্রীয় রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এ শাস্ত্র আবিষ্কারের পর হাদীস সংরক্ষণের পদ্ধতি সুদৃঢ় হয়ে যায়। এবং ইসলামী শরীয়ার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উৎস আহাদীসে নববী বনোয়াট রচনার সংমিশ্রণ থেকে মুক্তি লাভ করে।

আল্লাহ তায়ালা এভাবেই তার দ্বীন হেফাজত করেন। যার প্রতিশ্রতি তিনি নিম্নোক্ত আয়াতে উল্লেখ করেছেন: إنا نحن نزلنا الذكر وإنا له لحافظون. অর্থঃ- নিশ্চয় আমি কুরআন নাযিল করেছি এবং আমিই তার হেফাজত কারী। আল্লাহ তায়ালার সরাসরি তত্ত্বাবধানে কুরআন সংরক্ষিত। আর তাঁর তাওফিক-প্রাপ্ত একদল বান্দার তত্ত্বাবধানে কুরআনের ব্যাখ্যা হাদীস সংরক্ষিত। অতএব, আজ যারা হাদীস সংরক্ষণের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে হাদীস অস্বীকার করতে চায়, তারা মূলত কুরআনের উল্লেখিত আয়াতটিকে অস্বীকার করে। কেননা কুরআনের ব্যাখ্যা,আহাদীসে নববী বিশুদ্ধভাবে আমাদের পর্যন্ত এসে পৌছার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে সনদ। যেহেতু সনদের পরম্পরা ব্যতিত আহাদীস সংরক্ষণের অন্য কোন বিশ্বস্ত মাধ্যম নেই। সুতরাং এই সংরক্ষণ পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্নতুলে হাদীসের প্রমাণিকতা অস্বীকার করলে পরোক্ষভাবে মহান আল্লাহর কৃত ওয়াদা “কুরআন হেফাজতের” বিষয়টি অস্বীকার করা হয়।

আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে সহীহ সমঝ দান করুন এবং উলামায়ে উম্মতের যেসব মনীষীরা ইলমে হাদীসের খেদমতে নিজেদেরকে বিলিয়ে দিয়েছেন, সবাইকে জাযায়ে খায়ের (উত্তম প্রতিদান) দান করুন। আমীন।

 

লেখক: ফাযিল, জামেয়া ক্বাসিমুল উলূম দরগাহ হযরত শাহজালাল রহ.-সিলেট