ইউরোপে মুসলমানদের জীবন ও আমাদের করণীয়

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

মে ১৭ ২০১৯, ০২:৩৫

হাফেজ মাওলানা আব্দুল কাদির আল মাহদি

সমগ্র ইউরোপের দ্বীনী হালতের কথা বললে বলতে হয় মন্দের ভাল। ইউরোপ থেকে সামান্য উত্তর-পশ্চিমের দেশ ইউকে বা ইংল্যান্ড। সেই ইংল্যান্ডকে দ্বীনী দিক দিয়ে ইউরোপের সাথে তুলনা করলে দেখা যায় রাতদিন তফাৎ। সেখানে মুসলমানদের বসতি এলাকায় আছে অলিতে-গলিতে মসজিদ, ফুল টাইম- হাফ টাইম মাদ্রাসা। আছে বাচ্চাদের সহিহ ভাবে কোরআন ও দৈনন্দিন জীবন যাপনের দু’আ-মাসআলা শেখানোর অসংখ্য মক্তব। প্রতিটি মসজিদের পাশাপাশি বিভিন্ন হল রুম ভাড়া করে বাচ্চাদেরকে দ্বীন শেখা শেখানোর আছে যথাযথ ব্যবস্থা। মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) বলতেন, “মুসলমানদের দ্বীনের উপর ইস্তেকামতের সাথে থাকতে হলে পাড়ায় মহল্লায় মক্তব কায়েমের বিকল্প নেই”। এর বাস্তব চিত্র ইংল্যান্ডের মাটিতে পরিলক্ষিত হয়।

অথচ কমবেশি ৩০ মাইল দক্ষিণ-পুর্বদিকের দেশসমুহ ইউরোপের দেশ। আটলান্টিকের ইংলিশ চ্যানেল মাঝখানে ৩০ মাইলের তফাৎটা ফিজিক্যালি সামান্য হলেও স্প্রিচুয়্যালি অনেক ধরতে হবে। এখানে (ইউরোপে) মসজিদের কমতি নাই, তবে এগুলো যেন মৃত সাদৃশ্য। হেদায়তশূণ্য। অবস্থা দেখলে রাসুল (সা.) এর এই একখানি হাদিস স্মৃতিপটে চলে আসে। হযরত আলী (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, “ভবিষ্যতে মানুষের সামনে এমন একটা যুগ আসবে যখন নাম ব্যতিরেকে ইসলামের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না, আল-কুরআনের আক্ষরিক তিলাওয়াত ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। তাদের মসজিদগুলো হবে বাহ্যিক দিক দিয়ে জাঁকজমকপূর্ণ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা হবে হেদায়াতশূণ্য। (বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান অধ্যায়)

পুরো ইউরোপ জুড়ে হাতেগোনা এক-দুটি মাদ্রাসা আছে জানি। সাগরকন্যা বলে খ্যাত “পর্তুগালে” দুটি মাদ্রাসা আছে। যেগুলো আফ্রিকান মুজাম্বিক মুসলিম কমিউনিটি দ্বারা পরিচালিত। এছাড়া ইটালিতে ইদানিং নতুন দু-চারটি হেফজখানা ও মক্তব চালু হয়েছে। গ্রীসে আমাদের বাংলাদেশিদের মোটামুটি একটা অবস্থান আছে বলে সেখানেও আমাদের বাংলাদেশি কমিউনিটি দ্বারা দু-চারটি মক্তব চালু আছে। বাকি পুরো ইউরোপ জুড়ে মাদ্রাসা তো দুরের কথা উপযুক্ত মক্তব পাওয়া দুষ্কর। কারণ হিসেবে যেটা মনে করি, এখানে আমাদের এশিয়ান সাব কন্টিনেন্ট তথা বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইন্ডিয়ান আলিম উলামাদের উপস্থিতি অনেক কম।

কাজেই কিছু মানুষ ধর্ম-কর্ম যেন ভুলেই বসে আছে। তাদের অনেকের চালচলন ইউরোপিয়ানদেরকেও হার মানিয়ে দিচ্ছে। মদ, শরাব, নাইট ক্লাব আর যুবতি মেয়েদের নিয়ে মত্ত আছে। আবার কেউ কেউ রুজি-রুটি ব্যবস্থার ব্যস্ততায় এতই মত্ত যে, দ্বীন ধর্ম পালনের ফুরসত নেই। রাতদিন গাঁধার মত খাটছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে পড়ে একটি হাদীসের কথা-

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. বলেন- “আল্লাহ তা’আলা ঐ ব্যক্তিকে ঘৃণা করেন যে কঠোর মেজাজী হয়, অতি মাত্রায় খায়, বাজারে চিৎকার করে কথা বলে, রাতে মরার মত ঘুমাতে থাকে, দিনের বেলায় গাধার মত খাটে, দুনিয়াবী বিষয়ে পারদর্শি হয়, আখেরাতের বিষয়ে অজ্ঞ থাকে ৷” (আল বায়হাক্বী)

বর্তমান ইউরোপিয়ান মুসলমানদের অবস্থা বিলকুল এ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। দুনিয়ার বিষয়ে অনেক গাইড দিতে পারবে। কিন্তু আফসোস আখেরাতের বিষয়ে কোন জ্ঞান নেই।

এসব দেশসমুহে মুলত আরবিয়ানদের উপস্থিতি বেশি। আমাদের এশিয়ান সাব কন্টিনেন্ট কমিউনিটির তুলনায় তারা প্রতিষ্ঠিত বেশি। এরা মসজিদ প্রতিষ্ঠায় বেশ উদ্যোগি হলেও মক্তব বা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় এরা এখনও শিশু পর্যায়ে বলা যায়। এসব নিয়ে চিন্তা-চেতনা বা উদ্দীপনা এখনও জাগেনি। তাদের হালত এমন পর্যায়ে যে, শুধু মসজিদ কায়েম করে নিলেই হল। মসজিদ আবাদের মেহনত বা ফিকিরের কোন দরকার নেই।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তোলনের পথ হচ্ছে মসজিদ নির্মাণের পাশাপাশি মসজিদ আবাদের মেহনতকে আ’ম ভাবে চালু করা। মসজিদকে অন্য ধর্মের মত শুধু প্রার্থনার স্থান মনে না করা। প্রার্থনার পাশাপাশি তালিম, তারবিয়াত চালু করা। আগামি প্রজন্মকে সে পথে ধাবিত করার লক্ষে এটলিস্ট প্রত্যেক মসজিদে মক্তব চালু করা।

এসব দেশে আমাদের আলেম উলামাদের উপস্থিতি কম বলে মক্তব, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার খুব একটা মেহনত বা মুভমেন্ট হচ্ছে না। কারণ আমাদের আলেম উলামাদের মাঝে আছে এক স্প্রিহা, উদ্দীপনা। যেটা অন্য জাতির মাঝে সাধারণত দৃষ্টিপাত হয় না। আমাদের আলেমরা যেই “মসলক বা মানহাজের” হোক। সবার চিন্তাধারা এক জায়গায় মিল পাওয়া যায়। কোথাও উপস্থিত হলে বা অবস্থান করলে নিজের উপার্জনের পাশাপাশি সেখানকার মুসলমানদের ঈমান আমলের হেফাজতের ব্যপারে উদ্বিগ্ন থাকে। এর ফলে ধীরে ধীরে কিছু দ্বীনী প্রতিষ্ঠান গড়ে কোলা সম্ভব হয়। যেটা ইংল্যান্ড, আমেরিকাতে হয়েছে।

এখানে এমন মেহনত করবে কে? রম্য-সাহিত্যের পথিকৃৎ সৈয়দ মুজতবা আলী-র ‘প্রবাস বন্ধু’ শীর্ষক গল্পে লেখকের একটি উক্তি মনে পড়ছে, ‘কুইনিন’ জ্বর সারাবে বটে, কিন্তু ‘কুইনিন’ সারাবে কে? এখানে হাতেগোনা কয়েকজন আলেম উলামা ইতিপুর্বে এসেছিলেন। কিন্তু বহমান স্রোতের সামনে কয়জন টিকে থাকে সেটাই বড় জিনিস। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়মিত পড়বে তো দূরে, সপ্তাহে জুম্মার নামাজও পড়তে দেখা যায় না। আবার কেউ কেউ নিজ পরিচয় গোপন রাখে। যাতে মানুষ বুঝতে না পারে তিনি হাফেজ বা আলেম। এই পরিস্থিতিতে কে হাল ধরবে? জাতীয় কবি কাজী নজরুলের ভাষায়-
“দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুশিয়ার!
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভূলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
কে আছ জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যত
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার!”

তবে এর ভিতর আশার বাণী হচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে ইংল্যান্ড তথা লন্ডন হয়ে ইউরোপের দেশে কিছু যুবক, নওজোয়ান আলেম অবস্থান করছেন। এরাই এখন বিভিন্ন জায়গায় প্রথমিক আলোচনা পর্যালোচনা শুরু করেছেন। জানি না কত দুর অগ্রসর হয়! কারণ আমাদের দেশীয় পলিটিক্সে অনেক ফায়দা থাকলেও কোন কোন সময় এক প্রকার ভাইরাস ৷ আমি সে বিষয়ে অত বলতে চাই না বা বলার স্পর্ধা আমার নেই। শুধু প্রসঙ্গক্রমে দু’একটি কথা বলতে চাই৷

এই ভাইরাস যার ভিতর ঢুকেছে সব জায়গায় নিজ পলিসি চালানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। অথচ আমি মাঝে মাঝে চিন্তা করে দেখি, উন্নত বিশ্বের এসব দেশে প্রায় সব দেশের মানুষের বসবাস আছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত দেখলাম না। নিজ দেশীয় পলিটিক্স নিয়ে বিদেশের মাটিতে মারামরি, হানাহানি করতে বা কারও পিছু টানতে। তাদের ভিতরেও ঠিকই “দেশ প্রেম” বিদ্যমান আছে। বিদেশের মাটিতে দেশীয় রাজনীতির প্রতি মনোনিবেশ করার চেয়ে সে দেশের মানুষদের ঈমান আমল হেফাজতের রাজনীতি করলে আরও মঙ্গল হত। সেটিও তো ”পার্ট অফ রাজনীতি”।

রাসুল (সা.) মদীনায় হিজরত করার পর এই পলিসিই তো প্রথম আরম্ভ করছিলেন। প্রথমেই মসজিদ প্রতিষ্ঠা করলেন, যেটা ইতিহাসে “মসজিদে কুবা” নামে পরিচিত। সেখানকার অধিবাসীদের ঈমান ও আমল বাঁচানোর লক্ষ্যে “দারুল আরক্বাম” নামীয় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করলেন। মুহাজিরদের দ্বারা নব্য আনসার সাহাবিদের তালিমের ব্যবস্থা করলেন। কাজেই আল্লাহর রাসূল সা. এর প্রকৃত অনুসরণ করতঃ ইউরোপের এসব দেশে দেশীয় রাজনীতির চর্চা করার চেয়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ঈমান আমলের হেফাজতের রাজনীতি করা বেশি জরুরী।

ব্যক্তিগত একক প্রচেষ্টার অবশ্যই জরুরত আছে। তাবে হালতের কারণে সেই ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা খুব বেশি ফায়দা বয়ে আনবে না। কর্মের চেয়ে কাজের ফিল্ডটা অনেক অনেক বিশাল। তাই একক প্রচেষ্টা ভেস্তে যাওয়াই নরমাল। কোন ভালো রেজাল্টের আশা করতে হলে অবশ্যই আল্লাহ তা’আলার “নির্দেশ তোমরা সংঘবদ্ধ ভাবে আল্লাহর রজ্জু আকডে ধর এবং তোমরা পৃথক হয়ো না” এই আয়াতের উপর আমল করা শুরু করতে হবে। তারপর কিছু একটা রেজাল্ট আসার আশা করা যেতে পারে।

অবশ্যই সাথে সাথে একে অপরের উপর অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস রাখা কাম্য। তাহলে সমাজ বা রাষ্ট্রীয় ভাবে দ্বীন প্রতিষ্ঠা না করা গেলেও অন্তত ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।

ইউরোপে আমাদের প্রধান কর্তব্য হচ্ছে, নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের সত্যিকার ঈমান-ইসলামের মৌলিক জ্ঞানে শিক্ষিত করে তোলা। পরিবারগুলোতে ইসলামি আবহ তৈরি ও সংরক্ষণে কাজ করা। এ জন্য মসজিদের ইমাম ও খতীবদের মিশনারী ভুমিকা পালন করতে হবে। মসজিদের বাহিরে যারা প্রাইভেট হোম শিক্ষক আছেন, ইসলামি তাহজিব তামাদ্দুন সামনে রেখে ছেলে মেয়েদের ইসলামি আখলাক গঠনের বিশাল এক সুযোগ তাদের সামনে আছে। মিশনারী মন মানসিকতা নিয়ে এ সুযোগও কাজে লাগাতে হবে। (ইনশাআল্লাহ!) ব্যক্তি হিসেবে আলেম হাফেজ না হলেও ঈমানদার হবে। ওয়েস্টার্ন দেশে এটাই আমাদের সবচে’ বড় প্রয়োজন। নতুবা আগামি প্রজন্মের পথ অন্ধকার!

এছাড়া সময় সুযোগে ইসলাহি মাহফিল, ইসলামি সভা, সমিতি, স্যাম্পোজিয়াম, শিশু-কিশোর প্রতিযোগিতা এগুলোর আয়োজন করারও দরকার আছে। যেগুলো “মাইন্ড সেট’ গঠনে কার্যকরী ভুমিকা রাখতে পারে। সুতরাং ইউরোপে বসবাসরত আলেম, উলামা ও দ্বীনদার, ঈমানদার ভাইদের স্প্রিহা, উদ্দীপনায় সেই দারুল আরক্বামের চেতনা জলে উঠুক! দ্বীনের আলোয় আলোকিত হোক এই জমিন!

সম্পাদনা: ইলিয়াস সারোয়ার