আহসান মঞ্জিলে এক বিকেল

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জানুয়ারি ২১ ২০১৯, ১৬:২২

আহসান মঞ্জিল। পুরান ঢাকার ইসলামপুরে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। এটি পূর্বে ছিল ঢাকার নবাবদের প্রাসাদ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বহু স্মরণীয় ঘটনার স্মারক। বর্তমানে জাদুঘর হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নবাবদের
সুরম্য এ প্রাসাদ ঢাকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুসলিম স্থাপত্যনিদর্শন। গত ২০ জানুয়ারি ২০১৯ আত-তাহযীব সম্পাদক ও আমি কোনো পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই বাংলার মুসলিম নবাবদের ইতিহাস জানতে আহসান মঞ্জিলে যাই। আহসান মঞ্জিলের প্রধান ফটকের সামনে টিকেট কাউন্টার। আমরা টিকেট কেটে ভেতরে প্রবশের পরই আসরের আযান হয়। ইতিহাসের ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ হাকীমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী থানবী রহ. এর স্মৃতি বিজড়িত আহসান মঞ্জিলের ভেতরেই অযু করে নামায পড়ি। নবাবদের জন্য ফাতেহা পাঠ ও দু’আ করে আমরা আহসান মঞ্জিল পরিদর্শন শুরু করি।
আহসান মঞ্জিলের প্রতিষ্ঠাতা নওয়াব আবদুল গনি। তিনি তার পুত্র খাজা আহসানুল্লাহ’র নামানুসারে এর নামকরণ করেন। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে আহসান মঞ্জিলের নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে সমাপ্ত হয়। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে এখানে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক দল ‘মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। আহসান মঞ্জিল কয়েকবার সংস্কার করা হয়েছে। সর্বশেষ সংস্কার করা হয়েছে অতি সম্প্রতি।

মুঘল আমলে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে জালালপুর পরগনার জমিদার শেখ ইনায়েতউল্লাহ আহসান মঞ্জিলের বর্তমান স্থানে রংমহল নামে একটি প্রমোদভবন তৈরি করেন। পরবর্তীতে তার পুত্র শেখ মতিউল্লাহ রংমহলটি ফরাসি বণিকদের কাছে বিক্রি করে দেন। বাণিজ্য কুঠি হিসাবে এটি দীর্ঘদিন পরিচিত ছিল। এরপরে ১৮৩০-এ বেগমবাজারে বসবাসকারী নওয়াব আবদুল গনির পিতা খাজা আলীমুল্লাহ এটি ক্রয় করে বসবাস শুরু করেন। এই বাসভবনকে কেন্দ্র করে খাজা আবদুল গনি মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানী নামক একটি ইউরোপীয় নির্মাণ ও প্রকৌশল-প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরী করান, যার প্রধান ইমারত ছিল আহসান মঞ্জিল।

এই প্রাসাদের ছাদের উপর সুন্দর একটি গম্বুজ আছে। এক সময় এই গম্বুজের চূড়াটি ছিল ঢাকা শহরের সর্বোচ্চ। মূল ভবনের বাইরে ত্রি-তোরণবিশিষ্ট প্রবেশদ্বারও দেখতে সুন্দর। একইভাবে উপরে ওঠার সিঁড়িগুলোও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে দু’টি মনোরম খিলান আছে যা সবচেয়ে সুন্দর। অভ্যন্তরভাগে গম্বুজের দুপার্শ্বে ভবনটিকে দুটি সুসম অংশে বিভক্ত করা যায়। দোতলায় পূর্ব দিকে রয়েছে বৃহদাকার ড্রইং রুম। এর উত্তরে লাইব্রেরি ও কার্ডরুম এবং পূর্বপ্রান্তে ৪টি বর্গাকার কক্ষ। দোতলায় পশ্চিম দিকে আছে বৃহদাকার জলসাঘর, এর উত্তরে হিন্দুস্থানি কক্ষ এবং পশ্চিম প্রান্তে ৪টি বর্গাকার কক্ষ। ড্রইং রুম ও জলসাঘরের ছাদে কাঠের তৈরী ভল্টেড সিলিং খুবই চমৎকার। এ কক্ষ দুটির মেঝের উপরি আবরণ কাঠের পাটাতনের তৈরী। নিচ তলায় পূর্বাংশে রয়েছে বৃহদাকার ডাইনিং হল ও ছয়টি বর্গাকার কক্ষ। পশ্চিমাংশে রয়েছে বৃহৎ দরবার হল। এর উত্তরে বিলিয়ার্ড কক্ষ। ডাইনিং ও দরবার হলের মেঝে সাদা, সবুজ, হলুদ প্রভৃতি রঙের চীনা টালি দ্বারা অলংকৃত। নিচতলায় পশ্চিম প্রান্তে নির্মিত ৫টি কক্ষের মধ্যবর্তীটি বিখ্যাত স্ট্রং রুম যেখানে নওয়াবদের মূলবান সামগ্রী সংরক্ষিত থাকত।

গম্বুজ কক্ষের উত্তর পাশের কক্ষটিতে রয়েছে আকর্ষণীয় কাঠের সিঁড়ি। সিঁড়িটির রেলিং-এ আংগুর লতা সম্বৃদ্ধ লোহার তৈরী ব্যালাস্টার এবং জ্যামিতিক নকশা সমৃদ্ধ কাঠের সিলিংটি খুবই চিত্তাকর্ষক। নওয়াবদের গৌরবময় দিনগুলিতে এ সিঁড়ি কক্ষে সোনা দিয়ে বাঁধাইকৃত একটি ভিজিটর বুক রাখা থাকত। প্রাসাদে আগত গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ তাতে তাঁদের মন্তব্য লিখতেন।পাকিস্তান আমলেও খুব ঘটা করে আহসান মঞ্জিলে শে’র-কবিতা আসর হতো।

১৯০৬ সালে নওয়াব সলিমুল্লাহর দীর্ঘ প্রচেষ্টাপূর্ণ দাওয়াতে আহসান মঞ্জিলে মেহমান হয়েছিলেন হযরত থানবী রহমতুল্লাহি আলাইহি। সেই বরকতময় সফরে এ অঞ্চলের মুসলমানদের কল্যাণে গৃহীত হয়েছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্তির আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন মুসলিম লীগের সৃষ্টি এবং ঢাকার সর্বপ্রাচীন কওমি মাদ্রাসা জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া তাঁতীবাজারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন। ঢাকার ইসলামী পরিবেশ, হক্কানী ওলামায়ে কেরামের প্রভাব এবং অসংখ্য মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পিছনেও হযরত থানবী রহ. এর বিরাট অবদান রয়েছে।

আহসান মঞ্জিল এমন একটি স্থাপত্য যার সঙ্গে বাংলার ইতিহাসের বেশ কিছু অধ্যায় জড়িত। উনিশ শতকের শেষ ভাগ থেকে পাকিস্তানের প্রথম পর্ব পর্যন্ত প্রায় একশ বছর ধরে এ ভবন থেকেই পূর্ব বাংলার মুসলমানদের নেতৃত্ব দেওয়া হয়েছে। পঞ্চায়েত প্রধান হিসেবে ঢাকার নওয়াবগণ প্রায় প্রতিদিন এখানে সালিশি দরবার বসাতেন। মুসলিম স্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী নওয়াব আহসানুল্লাহর উদ্যোগে এখানে কংগ্রেস বিরোধী বহু সভা হয়েছে। ব্রিটিশ ভারতের যেসব ভাইসরয়, গভর্নর ও লে. গভর্নর ঢাকায় এসেছেন, তাদের সবাই এখানে আগমন করেছেন। ১৮৭৪ সালে নওয়াব আবদুল গনির দানে ঢাকায় জলকলের ভিত্তি স্থাপনের জন্য বড়লাট নর্থব্রুক ঢাকায় এসে এ প্রাসাদে সান্ধ্য অনুষ্ঠানে যোগ দেন। ১৮৮৮ সালে লর্ড ডাফরিন ঢাকায় এসে আহসান মঞ্জিলের আতিথ্য গ্রহণ করেন। বঙ্গবিভাগ পরিকল্পনার প্রতি জনসমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে ১৯০৪ সালে লর্ড কার্জন পূর্ববঙ্গ সফরে এসে ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি এ প্রাসাদে অবস্থান করেন। খাজা সলিমুল্লাহ তার যাবতীয় রাজনৈতিক কর্মকান্ড এ প্রাসাদ থেকেই পরিচালনা করেছেন। নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সূতিকাগার হিসেবে আহসান মঞ্জিল আজ ইতিহাসের অঙ্গ। ঢাকার নওয়াবদের প্রভাব প্রতিপত্তি হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে আহসান মঞ্জিলের জৌলুসও স্তিমিত হতে থাকে।