আহমদ শফির বক্তব্য, নারীমুক্তির জন্য নিয়ামক শক্তি

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জানুয়ারি ১৬ ২০১৯, ১১:৩০

বিগত ক’দিন আগে হাটহাজারী মাদরাসার মাহফিলে ইসলামের মৌলিক বিধান পর্দার বিষয়ে আলোচনা করেন। শরিয়তের দৃষ্টিতে পর্দার বিষয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে  কী করা উচিত এবং কেন উচিত সে বিষয়ে একটা নাতিদীর্ঘ আলোচনা পেশ করেন সে বয়ানে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আল্লামা আহমদ শফির সেদিনের দরদভরা আহ্বানকে কেন্দ্র করে অতি উৎসাহি নারীবাদী মহলে অজানা কারণে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়েছে।  তারা এই বক্তব্যকে ভিত্তি করে দেশের শীর্ষস্থানীয় ও বয়োজ্যেষ্ঠ এই অশীতিপর আলেমকে নারী বিদ্বেষী ও স্বাধীনতার প্রতিবন্ধক শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
এদের এই হঠাত্ গর্জে উঠা রোগের প্রাদুর্ভাব আমরা অতীতেও দেখেছি এখনও দেখছি এবং আগামীতেও দেখব। কারণ এরা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পেইন্ট এজেন্ট। এদের নিজস্বতা বা স্বাতন্ত্র্যতা বলতে আলাদা কিছুই নেই। এদেরকে তাদের প্রভুরা যেভাবে নির্দেশ প্রদান করবে সেভাবেই তারা নির্দেশিত হবে এবং তাদের পরিকল্পিত কার্য সম্পাদনে তৎপর হবে। তারা নীতি-নৈতিকতার চর্চা করে না, এদের জ্ঞানের পরিধিও খুবই সীমিত; এদের মূল উদ্দেশ্যই হলো নিজেকে ক্যামেরার সামনে উপস্থাপন করা আর এতে নিজের চেহারা যেমন প্রকাশিত হলো সাথে সাথে কিছু আর্থিক আয়ও হলো।
এদেরকে সুবর্ণচরের ধর্ষিতার পাশে দাঁড়াতে দেখবেন না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তথাকথিত ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতার ধর্ষণের উপর সেঞ্চুরি করে উল্লাস প্রকাশের পর এর প্রতিবাদ করতে দেখবেন না। অন্তঃরাষ্ট্র বা আন্তঃরাষ্ট্র শক্তির বিরুদ্ধে যায় এমন কোন কর্মতত্পরতা তাদের থেকে পাবেন না। তারা সর্বদা নিজের স্বার্থটাই দেখে। জাতির স্বার্থ তাদের কাছে সর্বদাই গৌণ বলে বিবেচিত হয়, মাঝেমধ্যে জাতিকে যেসব বক্তব্য বা বিবৃতি দেখতে পান তাদের থেকে এর সবটুকুই হলো ধান্দাবাজি আর ভাঁওতাবাজির পসরা, এছাড়া বৈ অন্য কিছুই নয়।
ধর্ষণ কেন হচ্ছে? কিভাবে হচ্ছে? এর কারণ কী? প্রতিক্রিয়া কী? এসব জিনিসকে আগে মোটাদাগে চিহ্নিত করতে হবে, চিহ্নিত করে তার উপশমের বাস্তব ভিত্তিক সমাধান প্রদান করতে হবে। আহমদ শফি যা উচ্চারণ করেছেন এটা কি নিজের কথা নাকি শরিয়তের কথা তিনি উচ্চারণ করেছেন সেটা তলিয়ে দেখুন। শরিয়তের কথা হলে সেটাকে তাচ্ছিল্য করার তো কোনো কথাই নেই। তিনি তার ধর্মীয় ভাবাবেগ থেকে ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী যা হয় তাই বলেছেন। আর যদি তার নিজস্ব কথা হয় তাহলে সেটা নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা করা যেতে পারে। তবে আমরা যতটুকু জানি আহমদ শফি সাহেব ইলিম, আমল, আখলাক ও আফকারের দিক থেকে উন্নত ও মার্জিত লোক। তাই তার দ্বারা ধর্মের অপব্যাখ্যা কস্মিনকালেও কল্পনা করা যায় না। সুতরাং ধর্মীয় আলোচনাকে যারা জলঘোলা করে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের কুৎসিত খেলা খেলতে চাচ্ছেন তাদের প্রতি একগাদা ঘৃণা।
কেউ কেউ তাকে কেন্দ্র করে ইসলামকে নারী বিদ্বেষী ধর্ম বলে চিত্রিত করার ঘৃণ্য অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছেন। অথচ ইসলাম সর্বদাই নারী শিক্ষা ও নারীর উন্নয়নে তৎতপর। যদিও তার পদ্ধতিটা একটু ভিন্ন। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো যেভাবে নারীর স্বাধীনতা চাচ্ছে ইসলাম এই পদ্ধতিতে স্বাধীনতা প্রদান করেনি। তাদের স্বাধীনতা পদ্ধতিতে রয়েছে আশঙ্কা আর ইসলামের স্বাধীনতা পদ্ধতিতে রয়েছে সম্ভাবনা। তারা সহশিক্ষায় বিশ্বাসী ইসলাম পৃথক শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশ্বাসী। তার সহকর্মে বিশ্বাসী আর ইসলাম পৃথক কর্মসংস্থানে বিশ্বাসী। তারা অবাধ মেলামেশা করতে এতে নাকি বিশ্বাসী নারী স্বাধীনতা রয়েছে। আর ইসলাম এসব অশ্লীলতার ঘোর বিরোধী। আর এই ঐতিহাসিক বিরোধ থেকেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রতিবন্ধক হলো ইসলাম। ইসলাম সুদীর্ঘ কর্মসূচি ঘোষণা করে মানুষের জীবন বিধান প্রণয়ন করেছে আর এদিকে এসব মানবমস্তিষ্ক প্রসূত জ্ঞান নির্ভর সাম্রাজ্যবাদী মতবাদ থেকে যে চিন্তা আর যুক্তি উপস্থাপন করা হয় নারীর কল্যাণে, তার মেয়াদ হয়ে থাকে অল্পমেয়াদি।
তথ্য সন্ত্রাসের শিকার হয়ে সত্য আজ বুলন্ঠিত। হযরতের বয়ানের আগ-পিছ না শুনে খন্ডিত বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে রাগ, ক্ষোভ আর বিদ্বেষ ছড়ানো তো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। উনার কথার ধরন আর উচ্চারণভঙ্গি এসব তো পর্যালোচনা করা ইনসাফের দাবী! কিন্তু আমরা এই ক’দিন ধরে কী দেখতে পাচ্ছি? ইসলাম বিরোধী অপশক্তিগুলো যারপরনাই চটেছে এই খন্ডিত বক্তব্যের উপর, ফলশ্রুতিতে দেদারসে ইসলামের বিপক্ষে কোরাস গেয়েই যাচ্ছে। তারা ইসলামের মানবিক দিকগুলোকে অমানবিক আর অগণতান্ত্রিক হিসেবে আখ্যায়িত করতে আদাজল খেয়ে নেমেছে। তাদের বক্তব্য ও বিবৃতি থেকে ধর্ষণ বন্ধের কোন পন্থা বা পদ্ধতি বিবৃত হচ্ছে না, যাই বিবৃত হচ্ছে তার সবটুকুই হিংসা আর বিদ্বেষের কুৎসিত চিত্র। তাদের এসব কর্মকাণ্ড দ্বারা ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধা তো থাকেই না বরং সমাজে নীরবেই জন্ম নেয় অসহিষ্ণু পরিবেশ। তাই সমাজকে শান্ত রাখতে এখনই এসব উচ্ছিষ্টদের ভ্রষ্টাচার বন্ধ করা দরকার।
আহমদ শফি সাহেবের নারী সম্পর্কিত এসব বক্তব্য সম্পর্কে পরিকল্পিত ভাবে জনমনে বিভ্রান্তির ধুম্রজাল সৃষ্টির ঘৃণ্য অপপ্রয়াস চালানো হচ্ছে। তাদের বক্তব্যে উচ্চারিত হচ্ছে যে, আহমদ শফি সাহেবের বক্তব্য দ্বারা নারী উন্নয়নের যে অগ্রগতি হচ্ছে সেটা ব্যাহত হবে এবং জাতীয় উন্নয়ন অগ্রসরতা বাধাগ্রস্থ হবে। তার এই বক্তব্য   নারীকে ঘরে বন্ধী করে রাখার হাতিয়ার বলে কেউ কেউ চিহ্নিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তার বক্তব্যকে উপলক্ষ করে এক শ্রেণীর নারীবাদীরা মিথ্যার বেসাতি করে দেশবাশিকে  বিশেষকরে মহিলা সমাজকে বিভ্রান্ত করার প্রাণান্তকর অপপ্রচার  চালাচ্ছেন।
অথচ পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক তাত্ত্বিক জৌল সিমসন, সমাজতান্ত্রিক দার্শনিক ব্রুদান, প্রখ্যাত বৃটিশ দার্শনিক বার্নার্ড  রাসেল, প্রখ্যাত বৃটিশ লেখিকা লেডি কুক, অভিনেত্রী মেরিলিন মনরো, আমেরিকান অভিনেত্রী বারবারা ষ্টিয়ার্ড, ড. ইডালিন, ফরাসী লেখিকা মারয়াম হ্যারি,  সাবেক মার্কিন ফার্স্ট লেডি হিলারী ক্লিন্টন, মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ সদস্য নিউট গিংগ্রিচ, হিটলার ও মুসোলিনীসহ প্রমূখ রাজনীতিবিদ, সমাজ বিজ্ঞানী, দার্শনিক, অভিনেত্রী, প্রখ্যাত লেখিকা এ্যানি বোর্ড পাশ্চাত্যে নারীদের অবাধ জীবনের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে  চিন্তা-ভাবনা ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা শুরু করেন বহু আগে থেকে।
ব্রিটেনে ’অফিস ফর ন্যাশনাল ষ্ট্যাটিস্টিকস’ পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়, নারীর অবাধ মেলামেশায় ২০৩১ সাল নাগাদ ব্রিটেনে বৈধ মা-বাবার সংখ্যা ব্যাপকহারে কমে যাবে। ১৯৯০ সালে তৎকালীন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার এক সাক্ষাৎকারেও বলেছিলেন যে, ১৯৭৯-১৯৮৭ সাল পর্যন্ত নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার কারণে ব্রিটেনে ৪ লাখ জারজ সন্তান জন্ম গ্রহণ করেছে।
ইসলাম চায় পরিশীলিত জীবন ব্যবস্থা, অশ্লীলতা ও বেলেল্লাপনা ইসলাম সমর্থন করে না। এ কারণেই পশ্চিমা নগ্নাশ্রয়ী অপসংস্কৃতির পথ রুদ্ধ করতে আল্লামা আহমদ শফির এই বক্তব্য আমি মনে করি একটা ঐতিহাসিক দস্তাবেজ হিসেবে আখ্যায়িত হোক।
যদি আহমদ শফি সাহেবের এই বক্তব্যের যথার্থতা উপলব্ধি করে এ বিষয়ে চিন্তা ও গবেষণা করা হয় এবং ইসলাম নির্দেশিত নৈতিকতা ও শালীনতার দ্বারা শুদ্ধ সমাজ গড়ে তুলে নারীর কল্যাণ সাধনের পথ প্রশস্ত করতে ব্রতী হন তাহলেই নারীর অহরহ ধর্ষণ প্রক্রিয়া বন্ধ হবে; ইনশাআল্লাহ।
কেননা নারী পর্দাহীন অবস্থায় অবাধ চলাফেরা করার কারণে তার দ্বারা   সৃষ্ট কাম ও প্রবৃত্তিপরায়ণতায় অনেক জাতিকে  নারকীয় গহ্বরে নিমজ্জিত হতে হয়েছে। তাই পাশ্চাত্যের নারীরা ও অবাধ নারী স্বাধীনতায় উন্মত্ত স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে অবশেষে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত, ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে পড়েছেন এবং মুক্তির দিশা হিসেবে ইসলামী জীবন পদ্ধতি বেছে নেয়ার প্রয়াস চালাচ্ছেন।
আল্লামা আহমদ শফি সাহেব কিন্তু  নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী উন্নয়ন বিরোধী নন। শালীনতা বজায়ে  রেখে নারীর সর্বক্ষেত্রে বিচরণে বাধা নেই এই কথাই বুঝাতে চেয়েছেন তিনি। নারীর কর্মদক্ষতা অনুপাতে তার কর্মক্ষেত্র তৈরী করা এবং তার কাজ নিরাপদে সম্পাদনের জন্য আলাদা কর্মক্ষেত্র তৈরী করতে তিনি আবেদন করেছেন। তিনি নারীর ক্ষমতায়নের বিরোধী বলে যারা অপপ্রচার চালাচ্ছেন, তাদের উদ্দেশ্য সৎ নয়। তাদের এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ  মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
তাই এসব থেকে আমাদের সতর্ক থাকা উচিত।