আল মাহমুদ ছাড়া বামদের উপায় নেই

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

ফেব্রুয়ারি ১৮ ২০১৯, ০৪:০২

মুসা আল হাফিজ: মজার বিষয় হচ্ছে,বামদের উপায় নেই আল মাহমুদ ছাড়া। কারণ বামপন্থার শ্রেষ্ঠতম কবিতা তিনি লিখেছেন। এ ধারায় তিনি সুকান্তের চেয়ে বড়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের চেয়ে বড়। কবিতায় কম্যুনিজমের যে প্রতিফলন, সেদিক থেকে বাংলা কাব্যে আল মাহমুদের চেয়ে বড় কবি বামদের নেই। তারা যদি কম্যুনিজমে থাকতেন, তাহলে আল মাহমুদই হতেন তাদের বাপ। এদিক থেকে শামসুর রাহমান ছোট বালকের মতো।
যদি কোনো দিন কেউ কম্যুনিজম চায়, বাংলা ভাষায় আল মাহমুদকে বাপ মানতে হবে। শুধু সোনালি কাবিনের কারণে।

দুই।
এই যে বললাম বামরা বামপন্থায় নেই, এর মানে কী? এর মানে সত্যিই বামপন্থা তারা ছেড়ে দিয়েছে। তারা এখন পুজিবাদের সেবাদাস। সাম্রাজ্যবাদের চাকর-বাকর। বামপন্থার স্বর্গভূমি রাশিয়া-চীন যেখানে পুজির গোলাম, সেখানে তার বঙ্গদেশীয় আওলাদরা কার ছাতার তলে আশ্রয় নেবে? তারা দল বেঁধে আশ্রয় নিয়েছে সাম্রাজ্যবাদ-ভোগবাদ, পুজিবাদের তাবুতে। এখন তাদের উদর ভরে আছে পুজিবাদের বমিতে। নতুন এই প্রভুকে তুষ্ট রাখবে বলে তারা যার পর নেই যত্নবান। পুজিবাদ যেহেতু ইসলামকে দুশমন ভাবে, ইসলামের সাথে যুদ্ধ করে, অতএব এই বাম এতিমরা ইসলামের বিরুদ্ধে হম্বিতম্বি করে গোলামির হক আদায় করেন।
আল মাহমুদের পাপ হলো, তিনি এদের মতো হননি। একসময়ের কম্যুনিস্ট কবি পুজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যে দ্রোহের নিশান উড়িয়েছিলেন, মানবমুক্তির যে মন্ত্রঘোষণা করেছিলেন, সেখান থেকে তিনি বোল পাল্টে সরে আসতে পারেননি।
যখন দেখলেন, কম্যুনিজম পুজিবাদের মোকাবেলায় ব্যর্থ, সাম্রাজ্যবাদের প্রতিরোধে বিফল এবং মানবতার মুক্তিবিধানে অক্ষম, তখন তিনি পুজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ ইসলামের জীবনবাদিতায় আত্মনিবেদিত হলেন। কেননা মানবমুক্তির মহোত্তম নিশ্চয়তা এখানেই তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন।

তিন।

দেখবেন, আল মাহমুদ ইসলামের দিকে আসার আগে বলতেন মানবমুক্তির কথা, সাম্যের কথা, লোকায়ত ঐতিহ্যের কথা, প্রেম ও কামের কথা, নারী ও নিসর্গের কথা। তার কবিতায় ছিলো লোকজ উপাদান, আবহমান জীবনচিত্র, গ্রাম ও নগর-বাস্তবতা।
যখন কবি ইসলামের দিকে এগুলেন, তার মায়াবী পর্দা দোলে উঠলো, বখতিয়ারের ঘোড়া দৌড়ালো, তখন কি তিনি মানবমুক্তির কথা বলছেন না? সাম্য, মানববাদ, প্রেম, কাম, নারী- নিসর্গ ইত্যাদি তার কবিতায় তখনও সমানে বিদ্যমান। গ্রাম-নগর, লোকজ উপাদান, আবহমান জীবন তার কবিতায় সবেগে স্পন্দমান। শুধু যুক্ত হলো ইসলাম। ইসলামের জীবনবাদীতা। আগে তার কণ্ঠে ছিলো কর্মজীবি সাম্যের দাওয়াত, এখন সেখানে যুক্ত হলো বিশ্বাস ও ঐশী প্রেরণা।
একে তিনি উচ্চারণ করেছেন সবল ও কাব্যিক পরাক্রমে। আর এ উচ্চারণই তাকে, তার প্রেম, মানববাদ, সাম্য, ঐতিহ্যপ্রীতি, এমনকি নারী-নিসর্গ ও কামকে পর্যন্ত অসহনীয় করে ছাড়লো বামশিবিরে।
নতুন এই আল মাহমুদের সব কিছুই হতে থাকলো অপরাধ। তার নিন্দা হতে থাকলো অভিশাপের ভাষায়। তাকে মাটিতে মিশিয়ে দেবার আয়োজন সমূহ একের পর এক মাঠে আসতে লাগলো। তিনি আক্রান্ত হতে থাকলেন আর করতে থাকলেন পাল্টা আঘাত। প্রবল ও পরাক্রান্ত প্রত্যাঘাত। একটা যুদ্ধের মতো অবস্থা। এখানে কবি আল মাহমুদকে দেখা ও দেখানো হতো কবিতা বা শিল্প ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে। তলে তলে সবাই জানতো, এর একমাত্র কারণ তার ইসলামঅভিমুখিতা।

চার ।

সব অভিযোগ , নিন্দা, অভিশাপ, উপেক্ষা, বিদ্বেষ এসে জমা হলো এক জায়গায়। আল মাহমুদ জামাতিদের পত্রিকা দৈনিক সংগ্রামে চাকুরি করেছেন। মারাত্মক ব্যাপার!
মারাত্মক তো বটেই!
এ অভিযোগের কারণে আল মাহমুদকে পারলে ফাসিতেই ঝুলাবেন প্রগতির পুত্র-কন্যারা। কিন্তু হে প্রগতির যোদ্ধারা, হে বামসৈনিকেরা! একটু থামুন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দৈনিক পাকিস্তানে হানাদারদের পক্ষে, মুক্তিযোদ্ধাদের বিপক্ষে নজজুম আদিব ছদ্মনামে যে কবি প্রায় প্রতিদিন কলাম লিখতেন, সেই কবির নামটা তালাশ করবেন? তাকে তো মুক্তিযুদ্ধের মহান কবি বানিয়ে তাকে দিয়ে আল মাহমুদকে আড়াল করতে চেয়েছেন আপনারা!

জামাতি পত্রিকায় চাকুরি করার কারণে মুক্তিযোদ্ধা আল মাহমুদকে যদি বার বার ফাসি দিতে হয়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হানাদারদের মুখপত্র দৈনিক পাকিস্তানে চাকুরি করে, যে কবি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বিষোধগার করে গেলেন, তার বিষয়ে কী করা যায়?