আল্লামা হাফিজ মাসউদ আহমদ (বাঘার হুজুর রহ.) স্মরণে আলোচনা ও দোয়া মাহফিল সম্পন্ন

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

ফেব্রুয়ারি ২৪ ২০২২, ০১:৩১

আহমদ মালিক,ওসমানীনগর প্রতিনিধি: সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার ৩নং পশ্চিম পৈলনপুর ইয়ুথ উলামা ফোরাম আয়োজিত, শাইখুল হাদিস আল্লামা হাফিজ মাসউদ আহমদ (বাঘার হুজুর ) (রাহ:) এর জীবন ও কর্ম শীর্ষক আলোচনা ও দোয়া মাহফিল গত ১৯/২/২০২২ইং রোজ শনিবার বিকাল ৩ ঘটিকা থেকে রাত ১০ঘটিকা পর্যন্ত গলমুকাপন জামে মসজিদ ঈদগাহ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়।

১ম অধিবেশন: গলমুকাপন মাদরাসার প্রবীণ শিক্ষক কারী নূর হুসাইন সাহেবের সভাপতিত্বে ও মাওলানা ময়নুল ইসলাম মশকুরে’র পরিচালনায়,পবিত্র কোরআনু কারীম থেকে তিলাওয়াত করেন হাফিজ আবু রায়হান ও বাঘার হুজুর (রাহঃ) এর নাতি এহসান আহমদ।

আলোচনা ও দোয়া মাহফিলে উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন, আল্লামা বাঘার হুজুর (রাহ:) এর ছোট ছাহেবজাদা ইংল্যান্ড প্রবাসী মুফতি মাসরুর আহমদ বুরহান। হুজুরের স্মৃতিচারণ মূলক আলোচনা পেশ করেন, হাফিজ মাওলানা আশরাফ আলী খাঁন সাহেব কিয়ামপুরী, হাফিজ মাওলানা আব্দুল্লাহ , মাওলানা মুতাসিম বিল্লাহ জালালী, মাওলানা লুৎফুর রহমান জুনাইদ, মাওলানা হুমায়ূন আহমদ, মাহবুব আহমদ রুমন হাফিজ মনছুর আহমদ।

২য় অধিবেশন: মাওলানা নসিরুদ্দিন সাহেবের সভাপতিত্বে ও মাওলানা রশিদ আহমদ এর সঞ্চালনায় আলোচনা পেশ করেন, গলমুকাপন মাদরাসার শাইখুল হাদিস মাওলানা শামছুল হক সাহেব, মাওলানা জিয়াউল হক সাহেব কিয়ামপুরী, ইংল্যান্ডের প্রবীণ আলিম হযরত মাওলানা সৈয়দ আশরাফ আলী, মাওলানা আং সাত্তার আথানগিরী, মাওলানা মামুন আহমদ।

৩য় অধিবেশন: মাওলানা নাসিরুদ্দিন সাহেবের সভাপতিত্বে এবং মাওলানা আব্দুল বাতিন বিজু, মাওলানা লুৎফুর রহমান জুনাইদও মাওলানা শামিম আলমের যৌথ পরিচালনায় আল্লামা বাঘার হুজুরের জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা পেশ করেন, হযরতের প্রিা ছাত্র আল্লামা মখলিছুর রহমান সাহেব কিয়ামপুরী হাফি:, আল্লামা আব্দুল মালিক মোবারক পুরী, আল্লামা আব্দুল মতিন ধনপুরী, হযরত মাওলানা ইমামুদ্দিন সাহেব নবীগঞ্জী, হযরত মাওলানা ওয়াহিদুল ইসলাম বানিয়াচংগী, হযরত মাওলানা রুহুল আমিন সাহেব গুজাখাইর, মাওলানা সালমান সাদী, সাবেক এম,পি মাওলানা শাহিনুর পাশা চৌধুরী মুহতামিম দারুল কোরআন মাদরাসা সিলেট, মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন রাজু মুহতামিম জামেয়া হুসাইনিয়া গহরপুর, মাওলানা শামিম আহমদ সাহেব, মুহতামিম শামিমাবাদ মাদরাসা ,মাওলানা শাহ নজরুল ইসলাম সাহেব, উপপরিচালক ইসলামী ফাউন্ডেশন হবীগন্জ জেলা, লন্ডন প্রবাসী মাওলানা মামনুন মহিউদ্দীন ,মাওলানা শাহ মমশাদ আহমদ , মুহাদ্দিস জামেয়া মাদানিয়া কাজির বাজার, সিলেট, লন্ডন প্রবাসী মাওলানা শাহ আমীনুল ইসলাম, মাওলানা জুনাইদ কিয়ামপুরী, মুহাদ্দিস জামেয়া কাসিমুল উলুম দরগাহ মাদরাসা, এছাড়া আলোচনা ও দোয়া মাহফিলে আল্লামা বাঘার হুজুর ( রহঃ) খলিফা, ছাত্র, ভক্তবৃন্ধ ও বৃহত্তর সিলেটের অসংখ্য প্রবীণ উলামায়ে কেরাম ও তাওহীদী জনতা উপস্থিত ছিলেন।

পরিশেষে জামিয়া আওরঙ্গপুর শেরপুর মাদরাসার মুহতামিম ও জামিয়া দারুসসালাম মাদরাসার শাইখুল হাদিস, আল্লামা বাঘার হুজুরের প্রিয় ছাত্র আল্লামা মুফতি ওলিউর রহমান সাহেবের মোনাজাতের মাধ্যমে আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল সমাপ্ত হয়।

আল্লামা হাফিজ মাসউদ আহমদ বাঘার হুজুর (রাহ:)

১৩৩০ হিজরীতে সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলাধীন ঐতিহ্যবাহী বাঘা গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। কায়দা ও কোরআনুল কারীম নাজারা পড়েন নিজ ঘরে ও গ্রামের মসজিদের মক্তবে।

কোরআনুল কারীমের হিফজ শুরু করেন হাফিজ আবদুল গণি নামে বাঘা মাদরাসার এক ছাত্র উনার নিকট, তিনি তাঁর মহল্লার মসজিদের তখনকার ইমাম ছিলেন, এবং আল্লামা বশির আহমদ শায়খে বাঘা (রহঃ) এর কাছে হেটে হেটে সবক শুনাতেন। পরবর্তীতে আল্লামা বশির আহমদ শায়খে বাঘা রহঃ এর পরামর্শে রাজাগঞ্জ মাদরাসায় গিয়ে আল্লামা হাফিজ মাওলানা শায়েখ আবদুল করীম সাহেব শায়খে কৌড়িয়া (রহ.) এর কাছে হিফজুল কোরআন সম্পন্ন করেন।

তারপর গাছবাড়ি মাদরাসায় ভর্তি হয়ে কাফিয়া জামাত পর্যন্ত পড়ে আল্লামা বশির আহমদ শায়খে বাঘা (রহঃ) এর পরামর্শে চলে যান ভারতের ঐতিয্যবাহী দিনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুলউলুম দেওবন্দ মাদরাসায়। সেখানে শারহে জামী জামাত পর্যন্ত পড়ে বার্ষিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও মুজাহিরুল উলুম সাহারানপুর মাদরাসায় গিয়ে আবারও শরহেজামী ও মুখতাসারুল মাআনী দুই বছর পড়েন মাওলানা সিদ্দিক সাহেব কাশ্মীরী (রহ.) এর কাছে।

এরপর আবার দারুল উলুম দেওবন্দে ফিরে এসে দরসে নিজামীর অন্যান্য কিতাবাদী শেষ করে ১৩৭৭ হিজরিতে দাওরায়ে হাদীসে দাখিল হন।

সে বছর (শায়খুল হাদীস) কুতবুল আলম হযরত মাওলানা সাইয়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদনী (রহ.) অসুস্থ হয়ে পরেন এবং মৃত্যু শয্যায় শায়িত ছিলেন। তখন মাদনী (রহ.) এর পরামর্শক্রমে দারুল উলুম দেওবন্দবের মজলিসে শুরা আল্লামা হুসাইন আহমদ মাদানী (রহঃ) এর স্থলে হযরত মাওলানা সাইয়্যিদ ফখরুদ্দীন মুরাদাবাদী (রহ.) কে দারুল উলুম দেওবন্দের শাইখুল হাদীস হিসেবে নিয়োগ দেন।

আল্লামা ফখরুদ্দীন মুরাদাবাদী (রহ.) এর কাছেই আল্লামা মাসউদ আহমদ শায়খে বাঘা (রহঃ) পবিত্র বুখারী শরীফ পড়েন এবং তাঁর থেকেই হাদীসের ইজাজাহ প্রাপ্ত হন।

তাঁর তাকমিল ফিল হাদিসের বছর তথা ১৩৭৭ হিজরীত কুতবে আলম সৈয়দ হুসাইন মাদানী (রহ.) ইন্তেকাল করেন।

মাদানী (রহঃ) এর ইন্তেকালের কয়েক মাস পর হযরত মাওলানা নুরুদ্দীন গহরপুরী (রহঃ) জিয়ারতের উদ্দেশ্যে দারুল উলুম দেওবন্দে যান, এবং শায়খে বাঘার কাছ থেকে ওয়াদা নেন যে তিনি যেন ফারিগ হওয়ার পরই তাঁর প্রতিষ্ঠিত জামেয়া হোসাইনিয়া গহরপুর মাদরাসায় খেদমতে চলে আসেন।

ওয়াদা মোতাবেক শায়খে বাঘা (রহঃ) তাকমিল ফিল হাদীস শেষ করে দেশে এসে ১৩৭৮ হিজরীতে জামেয়া হুসাইনিয়া গহরপুর মাদরাসায় এসে বেশ কয়েক বছর মাদরাসার খেদমতে নিয়োজিত থাকেন। ঘটনাচক্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময়ে ১৯৭১ সালে আল্লামা নূরুদ্দীন গহরপুরী (রহ) জেল হাজতে বন্দি হন এবং সে বছর গহরপুর মাদরাসা এক বছর বন্ধ থাকে।

এই এক বছর গহরপুর মাদরাসা বন্ধ থাকাকালীন সময়ে শায়খে বাঘা (রহঃ) দারুল উলুম মৌলভীবাজার মাদরাসায় ১ বছর শিক্ষকতা করেন। পরবর্তী বছর গহরপুর এলাকার কিছু মুরব্বিয়ানে কেরাম আবারো শায়খে বাঘা (রহঃ) এর খোঁজ নেন এবং নিজেদের মধ্যে মিটিং করে তাঁর মাধ্যমে আবারও গহরপুর মাদরাসা খোলার অনুরোধ করেন।

তাঁদের অনুরোধে শায়খে বাঘা (রহঃ) আবার গহরপুর মাদরাসায় ফিরে এসে প্রথম বছর মিশকাত জামাত চালু করার মাধ্যমে মাদরাসার শিক্ষা কার্যক্রম আবারো শুরু করেন এবং পরের বছর আল্লাহর উপর ভরসা করে দাওরায়ে হাদীস তাথা তাকমিল ফিল হাদিস জামাত চালু করেন। তখনও তাকমিল ফিল হাদীস জামাতের সবক শুরু হয়নি, শুধু ভর্তি কার্যক্রম চলছিল, এমতাবস্থায় মাওলানা নুরুদ্দীন গহরপুরী (রহ.) জেল থেকে ফিরে আসেন।

যেহেতু আল্লামা গহরপুরী (রহঃ) এর অনুপস্থিতিতির কারণে এলাকার মুরব্বিয়ানদের অনুরোধে শায়খে বাঘা (রহঃ) গহরপুর জামেয়ার ইহতেমাদের দায়িত্ব পালন করছিলেন, আল্লামা গহরপুরী (রহঃ) জেল থেকে ফিরে আসায় তাঁকে শাইখুল হাদীসের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন।

এর কয়েক মাস পর এলাকার মানুষদেরকে ডেকে এক জরুরী মিটিংয়ে তাদের দেওয়া এহতেমামের দায়ীত্ব আদায়ে অপারগতা প্রকাশ করেন এবং ইহতেমামের দায়ীত্ব আল্লামা নূরীদ্দীন গহরপুরী রহঃ কে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। মিটিংয়ে আল্লামা গহরপুরী (রহঃ) এহতেমামের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, কিন্তু শায়খে গহরপুরী (রাহঃ) শায়খে বাঘা (রহঃ) কে নাজিমে তালিমাতের দায়িত্ব চাপিয়ে দেন। এভাবে ওখানে আরো তিন বছর শিক্ষকতার পর আল্লামা ফখরুদ্দিন (রাহঃ) এর অনুরোধে এবং পারিবারিক কারণে জামেয়া দারুসসুন্নাহ গলমুকাপন মাদরাসায় চলে আসেন এবং শায়খুল হাদিসের দায়িত্ব পালন করেন। সেই থেকে জীবনের শেষ পর্যন্ত জামেয়া দারুস্সুন্নাহ গলমুকাপন মাদরাসায় দীর্ঘ ৫০ বছর শাইখুল হাদীসের দায়ীত্ব পালন করেন এবং শেষ দুই বছর সদরে মুহতামিমের দায়িত্বও পালন করেন।

আল্লামা শায়খে বাঘা (রহঃ) খেলাফতি লাভ করেন আল্লামা হাফিজ আব্দুল করিম শায়খে কৌড়িয়া রাহঃ এর কাছ থেকে।

ইন্তেকাল: ০২/০২/২০২২ ইংরেজী রোজ বুধবার সকাল ৬ ঘটিকার সময় সিলেটের নর্থইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাজার হাজার ছাত্র ও ভক্তদের কাঁদিয়ে রফিকে আ’লার ডাকে সাড়া দিয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন- ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে হুজুরের বয়স ছিলো ১১৩ বৎসর। তাঁর ইন্তিকাল সংবাদ সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার হতেই, হসপিটাল থেকে হযরতের লাশ গ্রামের বাড়িতে পৌছার আগেই, শতশত আলেম-উলামা ও মুসল্লিদের সমাগম ঘটে হযরতের বাড়িতে।

ঐ দিনই হুজুরের ছোট ছাহেবজাদা মাওলানা মুফতি মাসরুর আহমদ বুরহান সাহেবের ইমামতিতে বিকাল ৩ ঘটিকার সময় জামেয়া দারুসসুন্নাহ গলমুকাপন মাদরাসার দক্ষিণের মাঠে নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়।গলমুকাপন (ঘোরাইয়্যা) হযরতের পারিবারিক মাকবারায় তাকে চিরনিদ্রায় সমাহিত করা হয়।

মৃত্যুকালে হযরতের স্ত্রী, ৪ ছেলে, ২ মেয়ে ও নাতি নাতনি রেখে যান।

তাঁর জীবনের অমূল্যসম্পদ হচ্ছে নিজের হাতেগড়া ছাত্র। অসংখ্য আলোকিত মানুষ তৈরীতে সারাটি জীবন অকাতরে বিলিয়ে গেছেন হযরত বাঘার হুজুর।

দেশ-বিদেশে তার আলোকিত রুহানী সন্তানদের খেদমতের অবদান অব্যাহত আছে,থাকবে-ইনশাআল্লাহ।তাদের অনেকেই যেন আকাশের দ্রুবতারা।তাদের মধ্যে রয়েছেন বিদগ্ধ মুহাদ্দিস,মুহতামিম,মুআল্লিম,মুফাক্কির,ইমাম,খতিব,সংগঠক ও সমাজসেবক।

আমাদের প্রিয় হযরত বাঘা (রহ.)-কে যেন আল্লাহ তাআলা জান্নাতুল ফিরদাউসের সুউচ্চস্থানে অধিষ্ঠিত করেন,মহান প্রভুর সকাশে এই মিনতি।