আল্লামা তাকি উসমানির মুখে সন্ত্রাসী হামলার বিবরণ

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

মার্চ ২৩ ২০১৯, ০৬:১৪

ইতিমধ্যে আসরের আযান হয়ে গেছে। মসজিদের সামনে অসংখ্য আল্লাহ ওয়ালারা কারো জন্য অধীর অপেক্ষায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছেন। সবার দৃষ্টি গিয়ে মিশেছে এক যায়গায়। আমার,আমাদের হৃদয়ের স্পন্দন হযরত শাইখুল ইসলাম মুফতি মুহাম্মদ তাকি উসমানি হাফিযাহুল্লাহর বাসার দরজায়। হযরত আসলেন। আল্লাহু আকবার! তাঁর মুখে ভয়ভীতির লেশমাত্রও নেই! কী নূরানী,হাস্যোজ্জ্বল চেহারা তাঁর! অথচ এইতো, মাত্র একটি আগে তাঁর উপর দিয়ে কী তুফান বয়ে গেলো! পাষণ্ড সন্ত্রাসীরা তাঁকে নিয়ে কী ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের ফাঁদই না পেতেছিলো! কিন্তু আমার রব চান তাঁর প্রিয়ো “তাকি” কে দ্বীনের জন্য বাঁচিয়ে রাখবেন। তিনি রেখেছেন আলহামদুলিল্লাহ!

হামলার পর হুটকরে আজ তাঁকে তিন-চার স্তরের নিরাপত্তায় বেষ্টন করে দেয়া হলো! অথচ এইতো মাত্র কিছুদিন আগে, সরকারি মহলে তাঁর নিরাপত্তা প্রত্যাহারের জন্য জোর দাবি উঠেছিল!
উপচেপড়া মানুষ আজ তাঁদের সেই “আহ্লাদী নিরাপত্তা” মানলেন না। নিরাপত্তা বলয় ভেদ করে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন সবাই। হযরতকে ফিরে পেয়ে কেউ আনন্দে হাসছেন, কেউ কাঁদছেন। হযরতের ঠিক বাঁপাশ ঘেঁষে হেঁটে হেঁটে মসজিদ পর্যন্ত আসলাম। মাঝে মুসাফাহা করে নিজের অজান্তেই হযরতের বাঁহাতটি কিছুক্ষণের জন্য চেপে ধরে রাখলাম। মসজিদের সামনে আসার পর হযরত সবার উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে, মুচকি হেসে শুধু বললেন,
” আলহামদুলিল্লাহ! আপনাদের দোয়ায় আমার শরীরে সামান্য আঁচড়ও লাগেনি।”

আসরের নামাযের পর হযরত মিম্বরে আরোহন করলেন। সংক্ষিপ্তভাবে আক্রমণের পুরো বিবরণ সবার সামনে তুলে ধরে তিনি বলেন-

” আসসালামু আলাইকুম!
আমার ধারণা, আপনারা আজকের ঘটনাটি নিয়ে বেশ চিন্তিত এবং পেরেশান। তাই আমি আপনাদেরকে সংক্ষেপে ঘটনাটির বিবরণ দিচ্ছি।
আমি বাইতুল মোকাররমে (দারুল উলূম থেকে ২০/২৫মিনিট দূরত্বে) জুমআ পড়াই। সে মানসেই আমি দারুলউলুম থেকে বের হয়েছিলাম। আমার সাথে আমার স্ত্রী এবং নাতি নাতনিরা ছিলেন। তারা ছয়-সাত বছরের শিশু। ( বাইতুল মুকাররম হযরতের এক কন্যার বাসা, তাই প্রায় সময় তাঁর আহলিয়াও সাথে যান।) একজন নিরাপত্তা কর্মী যিনি পুলিশের পক্ষ থেকে আসেন তিনি আমার সামনের সিটে বসা ছিলেন। আমার ড্রাইভার হাবিব ড্রাইভিং সিটে বসা ছিলেন।
আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছার পর হঠাৎ বৃষ্টির মতো মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ শুরু হয়ে যায়। তারা আমাদের গাড়িকে লক্ষ্য করেই গুলি চালিয়েছিলো। সামনের দিক, ডান ও বাম দিক থেকে অনবরত বৃষ্টির মতো এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ চলতে থাকলো। আমার ড্রাইভারের ডানহাতে এবং বাহুতে দুটি গুলি লাগে। নিরাপত্তা কর্মীরও মাথায় গুলি লাগে। আল্লাহ তা’আলার দয়া ও অনুগ্রহ আমার শরীরে, আমার স্ত্রী ও বাচ্চাদের গায়ে ভেঙ্গে আসা কাঁচের টুকরোর আঘাত ছাড়া তেমন কোনো আঘাত লাগেনি।
হামলাকারীরা আক্রমণ করে ফিরে যায়। তাদের হয়তো খেয়াল হলো, যাকে তারা লক্ষ্যবস্তু বানাতে চেয়েছিলো তাকে লক্ষ্যে পরিণত করতে পারেনি। তখন তারা ফের ফিরে আসে এবং দ্বিতীয়বারের মতো চতুর্দিক থেকে এলোপাতাড়ি মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ শুরু করে। আমার নিরাপত্তাকর্মী আবারও গুলিবিদ্ধ হন। আমার ড্রাইভারের ডান হাত গুলির আঘাতে অকেজো হয়ে যায়। কিন্তু সে বাম হাত দিয়ে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যায়। সে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে জীবনবাজি রেখে গাড়ি চালাতে থাকে।

আমি তাকে বলেছিলাম, আপনার হাতে আঘাত লেগেছে। আপনি সরে আমাকে দেন, আমি গাড়ি চালাই। কিন্তু সে রাজি হয়নি। সে বললো, হজরত আল্লাহর ওয়াস্তে আপনি এমনটি করবেন না। ওরা আপনার উপর পরপর দুবার হামলা করেছে। সম্ভাবনা আছে ওরা তৃতীয়বারের মতো হামলা চালাবে। আপনি পেছনে বসুন এবং মাথা নিচু করে বসুন যেনো আপনার শরীরে গুলি না লাগে।

তার হাত গুলির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত ছিলো। রক্ত ঝরছিলো। এই অবস্থায় সে নিপা চৌরাঙ্গি থেকে লিয়াকত ন্যাশনাল হসপিটাল পর্যন্ত নিজে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যায়। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর আমি তাকে গাড়ি থেকে নামাই। ড্রাইভার ও নিরাপত্তা কর্মীকে জরুরি বিভাগে নিয়ে যাই। কর্তৃপক্ষ দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
আমরা আশা করেছিলাম, নিরাপত্তা কর্মী বেঁচে যাবেন। কিন্তু ডাক্তাররা জানালেন, হাসপাতালে যাওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। ড্রাইভারের কথা জানালেন যে, এর চিকিৎসা সম্ভব। চিকিৎসা করলে তিনি বেঁচে যাবেন এবং সুস্থ্ হয়ে উঠবেন।
আমাদের পেছনের গাড়িতে একজন ড্রাইভার ও নিরাপত্তা কর্মী ছিলেন। গুলির আঘাতে নিরাপত্তা কর্মী শহিদ হয়ে যান এবং ড্রাইভার মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। তিনিও হাসপাতালে ভর্তি। তার অপারেশন হবে।

আল্লাহর তাআলার কুদরত যে, তিনি আমাকে রক্ষা করেছেন। আপনাদের দোয়া এবং আল্লাহ তা’আলার অনুগ্রহ ছিলো। আল্লাহ তাআলা আমাকে কীভাবে রক্ষা করলেন তার ব্যাখ্যা আমি জাগতিক কোনো জিনিসের মাধ্যমে করতে পারবোনা। আল্লাহ তা’আলার দয়ায় আমি পরিপূর্ণ সুস্থ আছি। ভালো আছি। আমি ভয়ও পাইনি এবং চিন্তিতও নই। কিন্তু আমার দুইজন সাথী শহিদ হয়েছেন। তাদের জন্য আমার হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত। তাদের পরিবারের প্রতি আমার দোয়া ও সমবেদনা। দুইজন আহত হয়েছেন। তার মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে পরিপূর্ণ সুস্থতা দান করেন। আমিন।”