আল্লামা আহমদ শফী’র বক্তব্য; পক্ষে-বিপক্ষে দু’টি কথা

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জানুয়ারি ১৪ ২০১৯, ০৯:২২

ফুজায়েল আহমাদ নাজমুল: ইসলামী সমাজ চান না, এমন লোকরাই আজ গোটা মিডিয়া জগতটাকে দখল করে রেখেছে। তারা সেখানে বসে সুযোগ বুঝে অর্থাৎ সুবিধামতো চিল্লাচিল্লি করে। হৈচৈ করে। লাফালাফি করে। সমালোচনা করে। দেশের কোন না কোন অঞ্চলে প্রতিদিন স্কুল ছাত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশার নারীরা পর্যন্ত ধর্ষিত হচ্ছে, নির্যাতিত হচ্ছে, হত্যার শিকার হচ্ছে, এসব নিয়ে তাদের কান্না শোনা যায় না। তীব্র প্রতিক্রিয়াও দেখা যায় না। অথচ আল্লামা আহমদ শফী বা তাঁর অনুসারীরা যখন নারীদের ইজ্জত রক্ষার জন্য কোন বক্তব্য সমাজে তুলে ধরার চেষ্টা করেন তখনই তাদের গায়ে আগুন ধরে যায়।

নারী শিক্ষা প্রসঙ্গে এই কয়েক বছরের মধ্যে হেফাজতে ইসলামের আমীর, আল্লামা আহমদ শফী (দা:বা:) একাধিকবার বক্তব্য রেখেছেন। সর্বশেষ গত ১১ জানুয়ারী হাটহাজারী মাদ্রাসার বার্ষিক মাহফিলেও একটি বক্তব্য রেখেছেন। নারী শিক্ষা প্রসঙ্গে তাঁর প্রতিটি বক্তব্যই বাম-ডান উভয়ই ঘরনার মধ্যে আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে বাম ঘরনার তথাকথিত সুশীল ও বুদ্ধিজীবীরা তাঁর কিছু আংশিক বক্তব্যকে ইস্যু বানিয়ে বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন।

যুগান্তরের ইউটিউব চ্যানেল থেকে আহমদ শফী (দা:বা:) এর বক্তব্যের আংশিক অংশ একটি অডিও ক্লিপ থেকে শুনেছি। মাহফিলে অংশগ্রহণকারীদের উদ্যেশ্য করে তিনি বলেছেন, “আপনাদের মেয়েদেরকে স্কুল-কলেজে দেবেন না। বেশি হলে ক্লাস ফোর-ফাইভ পর্যন্ত পড়াতে পারবেন। আর বেশি যদি পড়ান পত্রপত্রিকায় দেখতেছেন আপনারা। ওই মাইয়া (মেয়ে) ক্লাস এইট, নাইন, টেন, এমএ ও বিএ পর্যন্ত পড়ালে কিছুদিন পর আপনার মেয়ে থাকবে না। তাই আপনারা আমার সঙ্গে ওয়াদা করেন। বেশি পড়ালে আপনার মেয়েকে টানাটানি করে অন্য পুরুষ নিয়ে যাবে। আমার এ ওয়াজটা মনে রাখবেন।”

আল্লামা আহমদ শফী’র পুরো বক্তব্যের ভিডিও বা অডিও এখনো পর্যন্ত চোখে পড়েনি। শুধুমাত্র মেয়েদের শিক্ষা বিষয়ক এই অংশটিই স্যোসাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। তবে ১২ জানুয়ারী, শনিবার রাতে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে আল্লামা আহমদ শফী দাবি করেন, মাহফিলে দেয়া তাঁর বক্তব্যের একটি খণ্ডাংশ বিভিন্ন মিডিয়ায় ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তিনি তাঁর বক্তব্যেরও একটি ব্যাখা দেন।

মেয়েদের শিক্ষা প্রসঙ্গে আল্লামা আহমদ শফী যা বলেছেন তা পরিস্কার। এখানে কাটছাঁট করে যুক্তি দেখানোর কোন সুযোগ আছে বলে মনে করি না। বয়োবৃদ্ধ একজন আলেম নারীদের ইজ্জত ও নিরাপত্তার দিকটি বিবেচনা করেই মূলতঃ বক্তব্য দিয়েছেন তা সত্য। তবে আমি মনে করি তাঁর বক্তব্যের উপস্থাপনা সঠিক হয়নি। বক্তব্যটি ছিল অসম্পূর্ণ ও অগোছালো। এমন অসম্পূর্ণ ও অগোছালো বক্তব্য থেকে (ইসলাম বিদ্বেষীদের অপপ্রচার ও সমালোচনার কারণে) সাধারণ মানুষেরা বিভ্রান্তিতে পড়ার সমুহ সম্ভাবনা থেকে যায়।

‘মেয়েদের বেশি হলে ক্লাস ফোর-ফাইভ পর্যন্ত পড়াতে পারবেন’ বর্তমান সময়ে এসে এ ধরণের বক্তব্য সমাজ গ্রহণ করবে না। সমাজ তো দুরের কথা আলেমরাও গ্রহণ করবেন না। অনেক আলেম আছেন যারা যুগ ও সময়ের প্রয়োজনে তাঁদের মেয়েদের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পাঠিয়ে শিক্ষা দিচ্ছেন। মেয়েদের ইজ্জতের নিরাপত্তার বিষয়কে সামনে রেখে যেহেতু বক্তব্যটি এসেছে, সেহেতু মূল বক্তব্যের সাথে এটিও পরিস্কার করে বলা উচিত ছিল যে, নিরাপত্তার সাথে মদরাসায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগে রয়েছে। আপনার মেয়েকে মাদরাসায় পাঠান। অথবা সহশিক্ষার পরিবর্তে মেয়েদের জন্য পৃথক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে নারী শিক্ষক দ্বারা পাঠদানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করুন। এসব কথা আসলে অন্যরা মজা নেয়ার সুযোগ পেতো না।

আল্লামা আহমদ শফী শুধুমাত্র একটি মাদরাসার প্রিন্সিপাল নন, একজন শায়খুল হাদীস কিংবা সাধারণ কোন নেতা নন। তিনি দেশের বৃহৎ একটি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান। দেশের সর্ববৃহৎ ইসলামী সংগঠন ‘হেফাজতে ইসলাম’র সম্মানিত আমীর। তিনি হচ্ছেন বর্তমান বাংলাদেশের উম্মাহর কান্ডারী। তাঁর বক্তব্য বিবিসি, সিএনএন, আল জাজিরাসহ ওয়ার্ল্ড মিডিয়ায় গুরুত্বসহকারে স্থান পায়। তাঁকে নিয়ে ইউরোপের মিডিয়ায়ও আলোচনা হয়। দেশের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক সমাজে তাঁর প্রতিটি কথার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থাকবে। তাঁর ছোট্ট একটি বক্তব্য বা মন্তব্যকে কেন্দ্র করে জাতীয় দৈনিকে লিড নিউজ হবে। টকশোতে আলোচনা-পর্যালোচনা হবে। স্যোসাল মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় ওঠবে। এজন্যে তাঁকে অনেক সচেতনতার সাথে কথা বলার দাবী রাখে।

আমরা সবাই জানি, আল্লামা আহমদ শফী’র বয়স অনেক হয়েছে। মানুষকে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি থেকে মুক্ত করে জান্নাতের সুশীতল ছায়ার নীচে নিয়ে যাবার চিন্তাই তাঁর মাঝে বেশি লক্ষ করা যায়। স্বাভাবিকভাবেই এ বয়সে তাঁর কথাগুলো আখেরাতমূখী। কিন্তু বয়সের কারণে কিছু কথা এলোমেলো হয়ে যায়। অগোছালো হয়ে ওঠে। পরিস্কার কম হয়। তবে দু’টি বৃহৎ সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে কথা বলতে হলে তাঁকে অব্যশই আরো সতর্কতার সাথে কথা বলতে হবে। তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে কোন কিছুই গোপন থাকে না। সব কিছুই রেকর্ড হয়ে অতি দ্রুত চলে যায় মানুষের হাতে হাতে। বিদ্যুৎ গতিতে ছড়িয়ে পড়ে স্যোসাল মিডিয়ায়। এজন্য বিতর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা একান্ত প্রয়োজন মনে করলেও তা সঠিকভাবে উপস্থাপন করা অত্যন্ত জরুরী, যাতে প্রতিপক্ষের কেউ সুযোগ নিতে না পারে।

এবং যারা আল্লামা আহমদ শফী (দা:বা:) -কে পরিচালনা করছেন, সহযোগিতা করছেন তাঁদেরও অনেক দায় আছে। বয়োবৃদ্ধ জাতীয় এ নেতাকে সুষ্ঠুভাবে গাইড দেয়া, সহযোগিতা করা তাদের অন্যতম একটি কাজ। কোন মিটিংয়ে যাবার আগে তাঁর সাথে কথা বলে সংক্ষিপ্ত আকারে হলেও লিখিত একটি বক্তব্য তৈরী করা এবং সে বক্তব্যই মিটিংয়ে উপস্থাপন করা উচিত। আমরা দেখেছি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও মিটিংয়ে লিখিত বক্তব্য রাখেন। তাঁরা লিখিত বক্তব্যের বাইরেও একটি কথাও বলেন না। এবং সেই বক্তব্যের কোন প্রতিক্রিয়া আসলে তাও আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাখা দিতে দেখা যায়।

বাংলাদেশে সহশিক্ষার সুফল আমরা দেখতে পাচ্ছি  না। আমরা শুধু কুফলই দেখতে পাচ্ছি। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর যৌন হয়রানি বেড়ে চলেছে রিতিমত। একজন শিক্ষকের হাতে আজ প্রাইমারী স্কুলের ছোট্ট ছাত্রীটিও নিরাপদ নয়। ইতিমধ্যে স্কুল শিক্ষকদের হাতে  প্রাইমারীর অনেক ছাত্রীরা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা তার প্রতিষ্ঠানের ছাত্র বন্ধুদের হাতে ধর্ষিত হয়েছে। লাঞ্চিত হয়েছে। হত্যার শিকার হয়েছে।

যে দেশে মেয়েরা লেখাপড়া করতে গেলে ধর্ষিত হওয়ার সমুহ সম্ভাবনা রয়েছে সে দেশে মেয়েদের শিক্ষার বিষয়টি আল্লামা আহমদ শফী সহ দেশের আলেম সমাজকে ভাবিয়ে তুলেছে। তবে এর মানে এই নয় যে, আহমদ শফী বা আলেমরা ‘নারী শিক্ষা’ বিরোধী। আলেমরা নারীদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে ইতিমধ্যে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দাওয়ারায়ে হাদীস (মাস্টার্স) পর্যন্ত ক্লাস চালু করেছেন। ছাত্রীদের শতভাগ ইজ্জতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই সেখানে শুধুমাত্র নারীরাই পাঠদান করেন। প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে সব মেয়রাই কি স্কুল-কলেজ ছেড়ে মাদরাসায় চলে যেতে হবে? না, এটা সম্পূর্ণ অভিভাবকদের পছন্দ-অপছন্দের বিষয়।

তবে আমি বলবো, মেয়েদের পড়াশোনার জন্য আপনার প্রথম পছন্দ হোক মাদরাসা। মাদরাসা হচ্ছে যুগের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাব্যবস্থা। এখানে মেয়েকে পাঠাতে পারলে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ নিশ্চিত হবে। আর যদি মাদরাসায় দিতে আগ্রহী না হন, তাহলে ইজ্জত ও নিরাপত্তার স্বার্থে মেয়েদের জন্য পৃথক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবী তুলুন। যেখানে একমাত্র নারীরাই পাঠদান করবেন। অভিভাবকেরা চাইলে বা উদ্যোগ গ্রহণ করলে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে সরকার ও পাবলিকের সহযোগিতায় মেয়েদের জন্য নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ে ওঠতে পারে। মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক এই প্রত্যাশা আজকের।