আরব বসন্ত: একজন মুরসির উত্থান ও বিদায়

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুন ১৯ ২০১৯, ০০:৫৮

সোয়ালেহীন করীম চৌধুরী

কারান্তরিন অবস্থায় মিসরের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার মধ্য দিয়ে বিশ্বমুসলমানের চোখ আবার নিবিষ্ট হয়েছে মিসরের দিকে। ২০১১ সালে ঐতিহাসিক আরব বসন্তের মধ্য দিয়ে যে মুরসির নেতা হিসাবে আবির্ভাব মাত্র এক বছরের ব্যবধানে কেনো তাকে ক্ষমতাচ্যুত হতে হলো তা জানতে সবার মতো আমিও Curious.

হোসনে মোবারকের তিন দশকের জুলুমের অবসান করে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য ২০১১ সালের শুরুতে সমগ্র মিসরবাসী তাহরির স্কোয়ারে এক মোহনায় মিলিত হয়ে। ডানপন্থি, বামপন্থী, ধর্মনিরপেক্ষ বাদী এমনকি কট্টর ইসলাম পন্থীরা সবাই একই সুরে সুর মিলিয়েছিলো। ১৮ দিনের সেই রক্তাক্ত গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জুলুমের অবসান করে গণতন্ত্রের দ্বার উন্মোচন করে। ২০১২ সালে ৫১.৭ ভাগ ভোট পেয়ে প্রথমবারের মতো মুসলিম ব্রাদারহুড এর প্রার্থী ড. মুহাম্মদ মুরসি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হোন।

কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে দেখা যায় মাত্র এক বছরের ব্যবধানে সেই মুরসির বিরুদ্ধেই আবার তাহরির স্কোয়ার জেগে উঠলো। সেখানে মুসলিম ব্রাদারহুড ছাড়া আবার সবাই জড়ো হলো তার পদত্যাগের দাবীতে। গঠিত হলো ন্যাশনেল সালভেশন ফ্রন্ট (NSF)। NSF কে সমর্থন জানালেন বিশ্ববিখ্যাত আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রান্ড মুফতি আহমেদ আল তৈয়ব, কপটিক চার্চের প্রধান পোপ টাওয়াড্রস। এমনকি হেলিকপ্টার থেকে মিসরের পতাকা আন্দোলনকারীদের উপর নিক্ষেপ করে মৌন সমর্থন জানায় মিসরের সেনাবাহিনী। Tamaud – Rebel নামে দ্বীতিয় বৃহত্তর ইসলামী সংগঠনের যুবকরা মুরসীর পদত্যাগের সমর্থনে ২২ মিলিয়ন স্বাক্ষর সংগ্রহ করে।

অথছ তখন পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন মুরসি সরকারের পক্ষেই ছিলো। খারাপ হওয়া পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়ে মুরসির নিয়োগকৃত সেনাপ্রধান ফাত্তাহ সিসি তার সাথে বারবার নেগসিয়েশন করার পর ব্যার্থ হয়ে যোগাযোগ করে প্রাশ্চাত্য নেতৃবৃন্দের কাছে। মিসরের তৎকালীন মার্কিন এম্বেসেডর এ্যান পেটারসন স্পষ্ট বলে দেন মুরসিই মিসরের নির্বাচিত প্রতিনিধি। তাছাড়া অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য মুরসি সরকারকে তিনি প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলারে ঋণের ব্যাবস্থা করে দেন। মার্কিন প্রতিরক্ষা সেক্রেটারি হ্যাজেল, জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ জেনারেল মার্টিন ডিম্পসেও তাদের অবস্থানে অনড় থাকেন। যদিও তাদের মধ্যপ্রাচ্যের বন্ধু সৌদী, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরার আরব পেনিন্সিলায় মুসলিম ব্রাদারহুডের উত্থান নিয়ে ছিলো সংকিত। কারণ স্ট্রাটিজিক দিক দিয়ে মুসলিম বিশ্ব ও আরব রাষ্ট্রগুলোর জন্য মিসরের অবস্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ। তেল রপ্তানীর এক বিরাট অংশ পরিভ্রমণ করে সুয়েজ খাল ব্যবহার করে যার নিয়ন্ত্রক মিশর। অর্থনৈতিক এসব হিসাব নিকাশ ছাড়াও মুরসির জনপ্রিয়তা দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে আভ্যন্তরীণ বিভিন্ন কারণেঃ

১। বছরের পর বছর থেকে মিসরকে নিয়ন্ত্রক Established রাষ্ট্রিয় শক্তির সাথে সরকারের দ্বন্দ্ব। প্রশাসন, পুলিশ, বিচারবিভাগ ও সেনাবাহিনীর সাথে সৃষ্ট দূরত্ব।
২। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়কে কাজে লাগাতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্যর্থতা।
৩। আরব বসন্তে অংশ নেয়া অন্যান্য মতাদর্শী, ইসলামপন্থী অথবা ডানপন্থী শক্তিকে কাছে টেনে নিতে না পারা।
৪। সাম্প্রতিক তুরস্কে মতো লিবারেল ইসলাম প্রতিষ্ঠা না করে আরো রক্ষণশীলতার দিকে ধাবিত হওয়া। যা প্রতিষ্ঠিত শক্তিগুলোকে আতঙ্কিত করে তুলে।
৫। প্রশাসনে Experienced আমলাদের কাজে না লাগিয়ে অনভিজ্ঞ ব্রাদারহুড নেতাদের প্রাধান্য দেয়া। যার ফলশ্রুতিতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয়

ড. মোহাম্মদ মুরসি আইসা আল আয়াত স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে ২০০০ সালে মিসরের পিপলস এসেম্বলির সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হোন। যিনি একই সাথে ছিলেন একজন কুরআন এর হাফিজ ও এ্যারোনটিকেল ইঞ্জিনিয়ার। ১৯৭৫ সালে তিনি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং এ স্নাতক ডিগ্রী ও ১৯৭৮ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে আমেরিকার University of California থেকে Phd ডিগ্রী অর্জন করে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। তিনি একই সাথে NASA তেও বিজ্ঞানী হিসাবে কাজ করেন। ১৯৮৫ সালে দেশে ফেরত গিয়ে মিসরের জাগাজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। ড. মুরসি সমসাময়িক মুসলিম বিশ্বের একজন অবিসংবাদীত নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা তৈরী করেছিলেন। নেতা হিসাবে তার সাফল্য ও ব্যার্থতা হয়তো ইতিহাসবিদরা পর্যালোচনা করবে কিন্তু মিসরে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় তার এই আত্মত্যাগ আল্লাহর দরবারে কবুল হবে এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। উনার এই আত্মত্যাগ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জান্নাতের বিনিময়ে কবুল করুন।