আরবি নববর্ষ : মুসলিম উম্মাহর ঐতিহ্য ও গৌরবের প্রতীক

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

আগস্ট ৩১ ২০১৯, ২২:২৮

এহসান বিন মুজাহির

১৪৪০ হিজরি সনের বিদায়ের সাথে সাথে বছর ঘুরে আবারো ফিরে এসেছে আরেকটি নতুন বছর। স্বাগত হিজরি নববর্ষ ১৪৪১।

হিজরি সনের প্রথম মাস মুহররম। ইসলামে হিজরি সন ও তারিখের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ হিজরি সন এমন একটি সন, যার সঙ্গে মুসলিম উম্মাহর তাহজিব-তামাদ্দুন ও ঐতিহ্যের ভিত্তি সম্পৃক্ত। মুসলমানদের রোজা, হজ, ঈদ, শবে বরাত, শবে কদর, শবে মেরাজসহ ইসলামের বিভিন্ন বিধি-বিধান হিজরি সনের ওপর নির্ভরশীল। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও আনন্দ-উৎসবসহ সব ক্ষেত্রেই মুসলিম উম্মাহ হিজরি সনের অনুসারী।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, হিজরি সনের পহেলা মাস মুহররম একের পর এক আমাদের দুয়ারে উপস্থিত হয় ঠিক, কিন্তু হিজরি সনের শুভাগমন উপলক্ষে হইচই নেই, নেই কোনো প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক এবং অনলাইন মিডিয়ার বিশেষ কোনো আয়োজন। যেমনভাবে বিশেষ আয়োজন পরিলক্ষিত হয় ঈসায়ি নববর্ষের আগমনে। বাংলা এবং ইংরেজি নববর্ষকে যেভাবে গুরুত্ব দিয়ে আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে উদযাপন করা হয়, তাতে মনে হয় হিজরি নববর্ষের যেন আমাদের কোন প্রয়োজনই নেই! অথচ হিজরি নববর্ষকে গুরুত্বসহকারে পালন করাই ছিল আমাদের মুসলিম অধ্যুষিত দেশে কাম্য।

হিজরি সন গণনার সূচনা হয়েছিল ঐতিহাসিক এক অবিস্ময়রণীয় ঘটনাকে উপলক্ষ করে। রাসূল (সা.) এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীবর্গের মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই আরবি মুহররম মাসকে হিজরি সনের প্রথম মাস ধরে সাল গণনা শুরু হয়েছিল। আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে পবিত্র মক্কা থেকে মদিনায় রাসূল (সা.) এবং সাহাবায়ে কেরামগণের হিজরত থেকেই হিজরি সনের সূচনা।

হিজরি সনের সূচনাকাল: খোলাফায়ে রাশেদার শাসনকালে মদিনাকেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার গোড়াপত্তন হলে অফিসিয়াল তথ্যাদির নথি ও দিনক্ষণের হিসাব রাখতে গিয়ে বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নররা বিপাকে ও অসুবিধায় পড়েন। যেহেতু তখন ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য কোনো বর্ষপঞ্জি বা একক সন চালু ছিল না। রাষ্ট্রীয় অফিসিয়াল কার্যাদি নির্বিঘ্নে ও যথানিয়মে সম্পন্ন করার প্রয়োজনে নতুন সন প্রবর্তন তখন অনিবার্য হয়ে ওঠে। খলিফাতুল মুসলিমিন হজরত উমর ফারুক (রা.) এর শাসনামলে ১৬ হিজরি সনে প্রখ্যাত সাহাবি হযরত আবু মুসা আশআরি (রা.) ইরাক এবং কুফার গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একদা হযরত আবু মুসা আশআরি (রা.) খলিফা উমরের (রা.) খেদমতে এ মর্মে পত্র লিখেন যে, আপনার পক্ষ থেকে পরামর্শ কিংবা নির্দেশ সম্বলিত যেসব চিঠি আমাদের নিকট পৌঁছে তাতে দিন, মাস, কাল, তারিখ ইত্যাদি না থাকায় কোন চিঠি কোন দিনের তা নিরুপণ করা আমাদের জন্য সম্ভব হয় না। এতে করে আমাদেরকে নির্দেশ কার্যকর করতে খুব কষ্ট করতে হয়। অনেক সময় আমরা বিব্রতবোধ করি চিঠির ধারাবাহিকতা না পেয়ে। হযরত আবু মুসা আশআরির চিঠি পেয়ে হযরত উমর (রা.) এ মর্মে পরামর্শ সভার আহবান করেন যে, এখন থেকে একটি ইসলামী তারিখ প্রবর্তন করতে হবে। উক্ত পরামর্শ সভায় হযরত উসমান (রা.), হযরত আলীসহ (রা.) শীর্ষস্থানীয় সাহাবায়ে কেরাম এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় উপস্থিত সকলের পরামর্শ ও মতামতের ভিত্তিতে এ সভায় ওমর রা. সিদ্ধান্ত দেন ইসলামী সন প্রবর্তনের। তবে কোন মাস থেকে বর্ষের সূচনা করা হবে তা নিয়ে পরস্পরের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি হয়। কেউ মত পোষণ করেন রাসুল (সা.) এর জন্মের মাস রবিউল আউয়াল থেকে বর্ষ শুরু। আবার কেউ কেউ মত পোষণ করেন রাসুলের (সা.) ইন্তেকালের মাস থেকে বর্ষ শুরু করা হোক। কারো কারো মতে হুজুর (সা.) এর হিজরতের মাস থেকে বর্ষ শুরু করা হোক। কেউ বললেন নবী (সা.) এর নবুয়ত প্রকাশের বছর থেকে বর্ষগণনা শুরু করা যায়। এভাবে বিভিন্ন মতামত আলোচিত হওয়ার পর হযরত উমর (রা.) বললেন- নবী (সা.) এর জন্মের মাস থেকে হিজরি সনের গণনা শুরু করা যাবে না। কারণ খ্রিস্টান সম্প্রদায় হযরত ঈসা (আ.) এর জন্মের মাস থেকেই খিস্ট্রাব্দের গণনা শুরু করেছিল। তাই রাসুলের জন্মের মাস থেকে সূচনা করা হলে বাহ্যত খ্রিস্টানদের অনুসরণ ও সাদৃশ্য হয়ে যায়, যা মুসলমানদের জন্য পরিত্যায্য। অপরদিকে নবীজীর (সা.) ওফাত দিবসের মাস থেকেও গণনা শুরু করা যাবে না, কারণ এতে প্রিয় নবীজীর (সা.) মৃত্যুব্যথা আমাদের মাঝে বারবার উত্থিত হবে। পাশাপাশি অজ্ঞ যুগের মৃত্যুর শোক পালনের ইসলাম বিরোধী একটি কুপ্রথারই পুনরুজ্জীবন ঘটবে। হযরত উমর (রা.) এর দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্যকে হযরত উসমান (রা.), হযরত আলী (রা.) একবাক্যে সহমত পোষণ করেন। এরই প্রেক্ষিতে অবশেষে মহানবী (সা.) এর হিজরতের ঘটনাকে মহিমান্বিত করার জন্য মুহররম মাস থেকে হিজরি নামে একটি স্বতন্ত্র সন চালু করার ঘোষণা দেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর ফারুক (রা.)। এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় হিজরতের ১৬ বছর পর ১০ জুমাদাল উলা ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত হিজরী সনের মাসসমূহ মুসলমানদের জীবনধারার সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে।

ইসলামে হিজরি সনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য : ইসলামে হিজরী সনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। আল্লাহপাক এরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে গণনা হিসেবের মাস হলো বারোটি। যেদিন থেকে তিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন এর মধ্যে চারটি মাস বিশেষ সম্মানিত। (সূরা তাওবাহ : ৩৬)। বারো মাস হলো মুহররম, সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউস সানি, জমাদিউল আউয়াল, জমাদিউস সানি, রজব, শাবান, রমজান, শাওয়াল, জুলকদ ও জুলহজ। আর হারাম বা সম্মানিত চারটি মাস হলো মুহররম, রজব, জিলকদ ও জিলহজ। (তাফসিরে বাগাভি ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা নং :৪৪)।

হিজরি সনের প্রথম মাস হলো মুহাররম। মুহাররম একটি তাৎপর্যমণ্ডিত এবং বরকতময় মাস। মুসলিম ইতিহাসে এ মাসটি বিভিন্ন কারণে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। কুরআন কারীমে এ মাসটিকে ‘শাহরুল্লাহ’ তথা আল্লাহর মাস বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনের সূরা তাওবার ছয়ত্রিশ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘চারটি মাস রয়েছে যেগুলো সম্মানিত মাস। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মুহাররম’।

এ আয়াতের চারটি সম্মানিত মাসকে চিহ্নিত করতে গিয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজের সময় মিনা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে বলেন, তিনটি মাস হলো জিলকদ, জিলহজ ও মহররম এবং অপরটি হলো রজব। (তাফসিরে ইবনে কাসির)।

কুরআনে আরও এরশাদ হয়েছে, লোকেরা তোমাকে নতুন চাঁদ সম্বন্ধে প্রশ্ন করে। বলো ‘তা মানুষ ও হজ্বের জন্য সময় নির্দেশক। (সুরা বাকারা : ১৮৯)। কুরআনে আল্লাহ আরও বলেন- তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং তাদের গতিপথ নির্ধারণ করে দিয়েছেন-যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পারো। আল্লাহ এসব নিরর্থক সৃষ্টি করেননি। যাতে জ্ঞানী লোকেরা তাঁর নিদর্শন পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারে’। (সূরা ইউনুস : ৫)।

মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘আল্লাহ ঊর্ধ্বদেশে আকাশমণ্ডলী কোনরূপ স্তম্ভ ছাড়াই স্থাপন করেছেন, তোমরা তা দেখতে পাও, অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হলেন এবং সূর্য ও চন্দ্রকে নিয়মাধীন করলেন। প্রত্যেকে নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত আবর্তন করে। তিনি সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন এবং নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাত সম্বন্ধে নিশ্চিত বিশ্বাস করতে পার।’ (সূরা রাদ : ২)।

মুহাররম মাসেই সংঘঠিত হয়েছিল ঐতিহাসিক কারবালা। এ মাসে রয়েছে ফজিলতপূর্ণ ‘আশুরা’। মানবজাতির পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকেই নানা ঘটনাপ্রবাহের ঐতিহ্য বহন করছে মুহাররম মাস। কাজেই মুসলিম উম্মাহর কাছে হিজরি সনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বিশেষ করে হিজরি সনের সম্পর্ক চাঁদের সঙ্গে থাকার কারণে এই সনের তাৎপর্য অত্যন্ত ব্যাপক। এই চাঁদের হিসাবে মুসলমানদের অনেক ইবাদত বন্দেগি, আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়ে থাকে। কাজেই হিজরি তারিখকে গুরুত্ব দেয়া একান্ত জরুরি।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও শিক্ষক