আমার ভারত ভাবনা

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

মে ২৯ ২০১৯, ২১:৫৭

মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত

১. ভারতবর্ষ সুদীর্ঘ অতীত ঐতিহ্য সমৃদ্ধ একটি সভ্যতা। সিন্ধু সভ্যতা থেকে শুরু করে উত্তরে গঙ্গা অববাহিকা ও দক্ষিণে কাবেরী ও অন্যান্য নদী অববাহিকায় বিস্তৃত এই ভারতীয় সভ্যতার বয়স পাঁচ হাজার বছর হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। বেদ, উপনিষদ ও বেদান্ত দর্শন ভারতবর্ষের উৎকৃষ্ট চিন্তার আদি রূপ। সংস্কৃত ভাষা ভারতবর্ষের একটি প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ ও চিরায়ত ভাষা। যার সঙ্গে প্রাচীন ইরানী ফারসি ও ওল্ড জার্মান ভাষার সংযোগ খুঁজে পাওয়া গেছে। রামায়ণ ও মহাভারত — এই দুটি মহাকাব্য ভারতবর্ষের সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক দুটি আইকনিক আকর। এছাড়া রাগ সঙ্গীত, ভাস্কর্য, স্থাপত্য, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, অর্থশাস্ত্র, চিকিৎসাশাস্ত্র ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের রয়েছে বিপুল অর্জনের ইতিহাস।

কিন্তু এত এত সাফল্য ও অর্জনের মধ্যে যে নেতিবাচক জিনিসটি ভারতবর্ষের সুদীর্ঘ ইতিহাসে বারবার দেখা গেছে সেটা হল এর বিপুল জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক, সামাজিক, ধর্মীয়, জাতিগত, ভাষিক ও রাজনৈতিক অনৈক্য ও অন্তর্বিবাদ। আর্য বলে দাবিদার একটি বহিরাগত জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য বজায় রাখার স্বার্থে প্রাচীনকাল থেকেই একটি বর্ণবাদী অসাম্যভিত্তিক ধর্মীয় ও সামাজিক কাঠামোর প্রবক্তা হয়ে উঠেছে। এর ফলশ্রুতিতে ভারতবর্ষ সুদীর্ঘ কাল ধরে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে বিভিন্ন বহিরাগত শক্তির অনুপ্রবেশ ও আক্রমণের শিকার হয়েছে। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এই ঘটনা বারবার ঘটেছে।

আর দ্বিতীয় যে নেতিবাচক বিষয়টি উল্লেখ করতে চাই সেটি হল ভারতবর্ষের সুদীর্ঘ কালের ইতিহাসে সবসময় চরম ধনী ও চরম দরিদ্র এই দুই শ্রেণীর মধ্যে একটি চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য বজায় থেকেছে। ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান প্রত্যেক সভ্যতায় ছিল, আছে এবং হয়তো থাকবেও। কিন্তু ভারতবর্ষে এই ব্যবধান এত বেশি যে তা এই সভ্যতার একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হিশেবে আজ অব্দি টিকে আছে।

ভারতবর্ষের এই দুটি ঐতিহাসিক নেতিবাচক উত্তরাধিকার বহন করছে আজকের গান্ধী-নেহরু-ইন্দিরা-মোদীর আধুনিক ভারত রাষ্ট্র। ইতিহাসের শিক্ষা বলে যে এই দুটি বিষয়কে যদি সাম্য, ন্যায় ও সুবিচারের আলোকে নিষ্পত্তি না করা হয় তাহলে আধুনিক ভারত যতই উপরিতলে ফুলে ফেঁপে বড় রাষ্ট্র হয়ে ধন-সম্পদ, জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও সামরিক শক্তি অর্জন করুক না কেন তা শেষমেশ টেকসই না হবার আশঙ্কা প্রবল।

২.ভারতীয় সভ্যতার শ্রেষ্ঠতম প্রতিভূ হলেন গৌতম বুদ্ধ। তিনি অমানবিক বর্ণাশ্রম প্রথার বিরুদ্ধে মহান বিদ্রোহী পুরুষ। যদিও ব্রাহ্মণ্যবাদীরা তাঁর বিদ্রোহী চেতনার অনুসারীদের অনেককে নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছে; অনেকে এই দমন থেকে বাঁচবার অভিপ্রায়ে ভূ-ভারত ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে।

ভারতবর্ষে ইসলামের আগমন ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে গৌতম বুদ্ধের অনুসারীদের এই বিদ্রোহের পটভূমিতে। ইসলাম যে ভারতবর্ষে দ্রুত প্রসারিত হয়েছে সেটা সম্ভব হয়েছে এই কারণে। শুধুমাত্র তুর্কী, আফগান বা মুঘলদের সামরিক সাফল্যের কারণে তা হয়নি। ভারতবর্ষে একটা দার্শনিক ও আদর্শের লড়াই দীর্ঘদিন ধরে চলছিল; ইসলাম বাইরে থেকে এসে সেই লড়াইয়ের ন্যায়সঙ্গত পক্ষে যোগ দিয়েছিল। তা না হলে বাইরে থেকে এসে একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতি কি করে প্রায় আটশো বছর প্রাধান্য বিস্তার করেছিল?

৩. প্রখ্যাত জার্মান সমাজতাত্ত্বিক ম্যাক্স ভেবর বলেছিলেন অন্য কোন কিছু বিবেচনার আগে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে বর্ণাশ্রমভিত্তিক জাতিভেদ প্রথাই হল হিন্দু সমাজের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য — “before anything else, without caste there is no Hindu” [১] “caste is the fundamental institution of Hinduism”[২]

ভেবর এবং তাঁর অনুসারীরা জাতিভেদ প্রথাকে একটি হিন্দু সামাজিক নির্মাণ হিশেবে দেখেছেন। তাঁরা বলেছেন যে এই প্রথাটি হল একটি সম্পূর্ণ প্রতীকি জগৎ — অনন্য, স্বয়ম্ভূ (self-contained) এবং যা অন্য কোন সমরূপ ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনীয় নয়। ভেবর মনে করতেন যে ভারতবর্ষে ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সামাজিক স্তরবিন্যাসের মধ্যে যে সম্পর্ক তা হচ্ছে একদম সরাসরি ও সুস্পষ্ট। সুতরাং তিনি জাতিভেদ প্রথা হিন্দু ধর্মের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলে মনে করতেন।

ভেবর হিন্দু জাতিভেদ প্রথাকে সম্যকভাবে বোঝার জন্য ইউরোপীয় গিল্ড প্রথার সঙ্গে এর একটি তুলনামূলক আলোচনার অবতারণা করেছিলেন। এই পদ্ধতিতে তিনি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে জাতিভেদ প্রথা কেবলমাত্র কাজ বা পেশাগত বিশেষায়ণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; মধ্যযুগের ইউরোপীয় গিল্ড প্রথা হিন্দু জাতিভেদ প্রথার মত এতটা আবদ্ধ ও অন্তর্বিবাহে সীমিত সামাজিক কাঠামো ছিল না। এখান থেকেই ভেবর প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে হিন্দু জাতিভেদ প্রথার মূল উপাদান এর অর্থনৈতিক বা বৈষয়িক অনুষঙ্গ নয়, বরঞ্চ এর মূল গাঠনিক উপাদান হল এর মতাদর্শ — হিন্দু ধর্ম। তিনি জাতিভেদ প্রথাকে ব্যাখ্যা করেছিলেন একটি সম্মান ও মর্যাদা ভিত্তিক সামাজিক ব্যবস্থা হিশাবে। এই ব্যবস্থায় আত্মপরিচয় তৈরি এবং বজায় রাখা হত যারা বিশেষ বর্ণ ও জাতির অংশীদার নয় তাদের সঙ্গে সামাজিক সংযোগ ও সম্পর্ক স্থাপনের উপরে বিভিন্ন কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার মাধ্যমে। বিশেষ করে যারা সামাজিক সম্মান ও মর্যাদার দিক থেকে “নীচু” স্তরের বলে গণ্য হত তাদেরকে কোনভাবেই ধারে কাছে ঘেঁষতে দেয়া হত না। হিন্দু জাতিভেদ প্রথায় এই ব্যবস্থাকে কঠোর অন্তর্বিবাহ রীতি ও ছোঁয়া-নাছোঁয়া, শুচি-অশুচি বা পবিত্র/অপবিত্র ধারণা চালু রেখে একটি চরম অমানবিক স্তরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

ভেবর ইউরোপীয় শিল্পায়নের ব্যাখ্যা হিশেবে আর্থ-সামাজিক শ্রেণী ও প্রটেস্ট্যান্ট এথিকের মধ্যে একটি নিবিড় সম্পর্ক আবিস্কার করেছিলেন। শিল্পায়নের কারণ হিশাবে তিনি জন ক্যালভিনের ধর্মীয় বিশ্বাসকে সামনে এনেছিলেন; ক্যালভিন প্রটেস্ট্যান্ট এথিক হিশাবে যে কঠোর পরিশ্রম, আত্ম-শৃঙ্খলা এবং মিতব্যয়িতা ও সঞ্চয় প্রবণতার কথা বলেছিলেন, ম্যাক্স ভেবর সেকথাকে আধুনিক পুঁজিবাদী শিল্পায়নের সহায়ক চেতনা বলে গণ্য করেছিলেন। একইভাবে তিনি বলেছিলেন যে পুনর্জন্মে দৃঢ় বিশ্বাস হিন্দুকে কঠোরভাবে তার নির্দিষ্ট বর্ণ ও জাতির ধর্ম বা কর্তব্য পালনে উদ্বুদ্ধ করে এবং এভাবে তার জন্য ভবিষ্যতের তুরীয় (transcendental) পুনর্জন্মসমূহের পুরস্কার নিশ্চিত করে। ভেবর এভাবে জাতিভেদ প্রথা ও হিন্দু ধর্মের যে নিবিড় সম্বন্ধ নিরূপণ করেছেন সেখানে মতাদর্শ হিশাবে কর্ম (Karma) হল প্রধানতম বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডব্যাপী সত্য।

আরেক সমাজতাত্ত্বিক সিলেস্টিন বুগল হিন্দু জাতিভেদ প্রথা নিয়ে একটি মাইলফলক গবেষণা করেছেন। তিনি জাতিভেদ প্রথার চেতনা হিশেবে (“the spirit of caste”) তিনটি মূল বৈশিষ্ট্য প্রস্তাব করেছেন —

১. বংশানুক্রমিক বিশেষায়ণঃ কোন একটি বিশেষ কাজ বা পেশার সঙ্গে কোন বিশেষ বর্ণ ও জাতির সংশ্লিষ্টতা

২. উঁচু-নীচু ক্রমঃ ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদা তার অধিকার ও কর্তব্য নির্ধারণ করে; আর এই অধিকার ও কর্তব্য সমাজে অসমভাবে বন্টন ও বিন্যস্ত থাকে; আর এসব নির্ধারিত হয় ঐ ব্যক্তির নির্দিষ্ট সামাজিক স্তর ও অবস্থানের উপর

৩. বিকর্ষণঃ সামাজিক স্তর গুলোর একে অপরকে বিকর্ষণ করার প্রবণতা; বিপরীতমুখী বিভিন্ন অংশে ভাগ হয়ে যাওয়া; প্রতিটি স্তরের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্নতা; স্তরের সীমাকে অতিক্রম করে অপর স্তরের সঙ্গে সম্পর্ক বা জোট বাঁধার সকল সম্ভাবনাকে নাকচ করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতির ব্যবস্থা বজায় রাখা যেমন অন্তর্বিবাহ, ছোঁয়া-নাছোঁয়া, শুচি-অশুচি, পবিত্র-অপবিত্র এবং খাদ্য বিষয়ক বিভিন্ন ট্যাবু বা বিধিনিষেধ। [৩]

একবিংশ শতকের আধুনিক ভারত রাষ্ট্রেও এই হিন্দু বর্ণ ও জাতিভেদ প্রথা বিবর্তিত রূপে সমাজে প্রভাব বিস্তার করে আছে। আগের মত স্থূল আকারে এখন এর উপস্থিতি কমে এসেছে বটে কিন্তু এখন বিভিন্ন সূক্ষ্ম আকারে এই প্রথা বিদ্যমান আছে। গবেষকেরা বলছেন যে আগের মত এই প্রথা এখন আর অতটা ধর্মীয় অধিকার ও কর্তব্য আকারে হাজির থাকে না; এখন এই প্রথা আধুনিক হিন্দু সমাজে ব্যক্তির সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আত্মপরিচিতি নির্মাণ, মান-মর্যাদা-সম্মান ও সংঘবদ্ধতার নিয়ামক হিশেবে বেশি হাজির থাকে।

রেফারেন্সঃ

[১] Max Weber quoted in Lunheim, Rolf. 1993. Desert People: Caste and community – A Rajasthani Village. University of Tronheim & Norsk Hydro AS, p. 64

[২] cited in Leach, Edmund R. (1960). “Introduction: What Should We Mean by Caste?” In E.R. Leach, (ed.) Aspects of Castes in South India, Ceylon and North-west Pakistan, Cambridge: Cambridge University Press, p. 2

[৩] Lunheim, Rolf. 1993. Desert People: Caste and community – A Rajasthani Village. University of Tronheim & Norsk Hydro AS, p. 66