আমার বঙ্গবন্ধু

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মার্চ ১৭ ২০১৯, ১২:৩৪

মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত

আজ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। তাই আজকের লেখায় আমি কিভাবে বঙ্গবন্ধুকে দেখি, জানি ও বুঝি সেটা নিয়ে আলাপ করতে চাই। কাজেই এই লেখা একান্তভাবেই বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আমার নিজস্ব বয়ানের আলেখ্য — আমার বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে আমি আমার বাল্যকালে ৭/৮ বছর বয়সে বছর দুয়েকের জন্য স্বচক্ষে দেখেছি। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত।

আমার বঙ্গবন্ধু নিয়ে আলাপ শুরুর আগে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য জাতীয় ঘটনা ১৯৭১ নিয়ে আমার কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলা প্রয়োজন। এতে বোঝা যাবে সেসময়ের কন্টেক্সটে আমি একজন শিশু হিশেবে মুক্তিযুদ্ধকে কতটুকু এবং কিভাবে দেখতে পেয়েছিলাম। শিশুর বয়ানে মুক্তিযুদ্ধ কিন্তু সচরাচর খুব একটা দেখা যায় না। কিন্তু আমার বঙ্গবন্ধু নিয়ে বলতে গেলে অনিবার্যভাবেই আমার কাছে এসে যায় আমার ১৯৭১।

আমার ১৯৭১ এর অভিজ্ঞতা হল একজন ৪ বছর বয়সী শিশু হিশেবে। শিশু হলেও আমার স্মৃতিতে ১৯৭১ এর অল্প কিছু আবছা দৃশ্য এখনো টিকে আছে। যেমন আমি যেখানে সেখানে অসংখ্য মানুষের লাশ পড়ে থাকতে দেখেছি। সেটি সেই শিশুবয়সে ভীষণ অস্বাভাবিক ও অস্বস্তিকর বলে মনে হয়েছিল। আমার পরিবার তখন শহর থেকে গ্রামে ও পরে আরেকটি মফস্বল শহরে পর্যায়ক্রমে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল।

এই যে দেশের ভেতরে থেকেই একধরনের উদ্বাস্তুর মত অনিশ্চিত অনিরাপদ জীবন তা এই শিশু আমিসহ আমার পরিবারকে মেনে নিতে হয়েছিল। একজন শিশু হলেও সেই সময়ের কিছু বিশেষ স্মৃতি আমার মনের পটে দাগ কেটে আছে। যেমন সেই সময়ের যে বিশেষ স্মৃতিটি আমার বেশি মনে পড়ে সেটি হল অনেকের সঙ্গে একত্রে শহরের আকাশে পাকিস্তান ও ভারতীয় জেটগুলোর ডগফাইট দেখা। একজন শিশুর অবোধ দৃষ্টি দিয়ে এইসব ঘটনার তাৎপর্য কিছু বুঝি আর নাই বুঝি এইসব চাঞ্চল্যকর অভিজ্ঞতা কিন্তু দারুণ কৌতূহল এবং শিহরণ জাগিয়েছিল আমার মনে। আজও একাত্তরের কথা ভাবতে গেলে প্রথমে আমার একান্ত ব্যক্তিগত এইসব স্মৃতিই মনের পর্দায় ভেসে ওঠে।

আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে আমি প্রথম স্বচক্ষে দেখি ১৯৭৩ সালে এক নির্বাচনী জনসভায়। মাস বা দিন নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না। তখন তিনি পাকিস্তানী কারাগার থেকে ফিরে বছরখানেক হয়েছে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। তিনি তখন অধিষ্ঠিত হয়েছেন জাতির পিতা হিশেবে। তিনি অবিসংবাদিত ঐতিহাসিক জননন্দিত নেতা। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা হিশেবে তাঁর অবস্থান ও মর্যাদা তখন প্রশ্নাতীত। একজন বালক বয়সী আমার কাছে তাঁকে এরকম একজন জীবন্ত কিংবদন্তী হিশেবেই উপস্থাপন করা হয়েছিল। তাঁকে দেখে আমার মনে হয়েছিল আমি যেন ইতিহাসকে দেখছি, অসাধারণ ক্ষণজন্মা কোন অতিমানবিক ব্যক্তিত্বকে দেখছি।

যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ হলেও সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে তখন মানুষের মধ্যে বিপুল স্বপ্ন ও প্রত্যাশা। আর বঙ্গবন্ধু সেই সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বপ্ন ও প্রত্যাশার একক প্রতীক পুরুষ। মোদ্দা কথা তখন তিনি তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় অতিবাহিত করছেন। বালক হিশেবে তাঁকে অবলোকন করে এসব কিছু না বুঝলেও লোকজনের বিপুল উৎসাহ আর আতিশয্যে এটুকু বুঝেছিলাম যে তিনি বিশাল কেউ একজন। সাধারণ আটপৌরে লৌকিক কেউ অবশ্যই নন। ভেবে দেখুন কোন জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ও জাতির পিতাকে চাক্ষুষ দেখার সৌভাগ্য কজনের হয়।

এ প্রসঙ্গে আমার অনুভূতি হয়েছিল অনেকটা আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের মত। হেনরি কিসিঞ্জার যখন ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখলেন তখন তিনি কিছুটা রসিকতা করে বলেছিলেন যে এই প্রথম তিনি কোন একজন জাতির জনককে চাক্ষুষ দেখছেন। কারণ আমেরিকার জাতির জনক জর্জ ওয়াশিংটনকে তো আর তাঁর প্রজন্মের পক্ষে দেখা সম্ভব হয় নি।

এরপরে ১৯৭৫ সাল খুব দ্রুতই চলে এল। আমি তখন স্কুলে ক্লাস টুতে পড়ি। ১৫ আগস্টের সকালে আমাদের পরিবারের সবার একধরনের রুড এওয়েকেনিং হল। অর্থাৎ রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিহত হবার ঘটনায় আমাদের সকালটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। আমাদের পরিবারের সবাই হতভম্ব ও বিহবল হয়ে পড়েছিল। আমি একজন ৭/৮ বছরের বালক হলেও ঘটনার নির্মমতা ও আকস্মিকতায় সবার চোখেমুখে কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা দেখতে পেয়েছিলাম। এভাবেই আমার বঙ্গবন্ধু নিয়ে একান্ত অভিজ্ঞতা মাত্র দুবছরের মধ্যে উজ্জ্বল এক অতিমানব দর্শন থেকে এক ট্র্যাজিক নায়কের অকস্মাৎ আচমকা মৃত্যু্র খবরে পরিণত হয়েছিল।

এরপরে পরিবারে, স্কুলে ও সমাজে এই মৃত্যুর কারণ নিয়ে অনেক আনুমানিক ও অদালিলিক আলাপ ও বিলাপ শুনতাম। বালক ও কিশোর বয়সে এই ধরণের অভিজ্ঞতা অনেক হয়েছে। সেখানে উঠে আসত রক্ষী বাহিনীর কথা, ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষের কথা, জাসদের গণবাহিনীর অনেক কর্মীর নিহত হবার কথা, সিরাজ সিকদার ও সর্বহারা পার্টির কথা, বাকশালের কথা ইত্যাদি।

এছাড়া শুনতাম শেখ কামাল সম্পর্কে অনেক কাহিনী, মেজর ডালিমের স্ত্রীর অপমানের কথা, ব্যাংক ডাকাতির সিনেমাটিক বয়ান, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিক্রি করে দেয়ার বয়ান — এসব তখন গুজব ও গালগল্পের আকারে আমার মত এক বালক/কিশোরের কানেও আসত। দালিলিক গবেষণা বলতে কিছু ছিল না সেই সময়ে। এসবই ছিল হাওয়ায় উড়ে বেড়ানো কাহিনী। যেহেতু রেডিও টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে তিনি তখন নিষিদ্ধ হয়ে গেছেন সেহেতু আমরা তাঁকে এইভাবে ওরাল ট্রাডিশনের আলাপ আলোচনাতে পেতে পেতে বড় হতে লাগলাম।

এরপরে সময় গড়িয়ে আমি যখন আশির দশকের দ্বিতীয়ার্ধে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে দেশে এবং বিদেশে পড়াশুনা করতে শুরু করলাম তখন একাধারে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে দালিলিক পড়াশুনা করার সুযোগ পেলাম। এই প্রক্রিয়া আজ অবধি চলছে। এবং আমি ক্রমাগত এই দুটি বিষয়ে বিভিন্ন রকমের বয়ান ও বিশ্লেষণের মুখোমুখি হয়ে চলেছি। এইসব পড়াশুনা ও গবেষণার ভেতর দিয়ে আজকে আমার বঙ্গবন্ধু হলেন একজন বহুমাত্রিক রাজনৈতিক নেতা।

তিনি শুরু করেছিলেন একজন মুসলিম জাতীয়তাবাদী হিশেবে। এটা তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে পরিস্কার। তিনি কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রতীক পুরুষ হিশাবে ভীষণ ভালবাসতেন। আবার অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগ নেতা হিশেবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক মেন্টর। আবার মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী থেকে তিনি জনসংযোগের কলাকৌশল রপ্ত করেছিলেন।

পশ্চিম পাকিস্তানের জালিম শাসক শ্রেণির বৈষম্যমূলক শাসন থেকে পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক পুরুষ হয়ে উঠেছিলেন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ সরাসরি না চাইলেও ১৯৭১ এ তাঁর অনুপস্থিতিতে উপমহাদেশের পাক-ভারত রাজনৈতিক-সামরিক লড়াইয়ের ফলে যে বাংলাদেশ উদ্ভূত হয় তাকে একটি বাস্তবতা হিশেবে গ্রহণ করে তিনি একে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিশেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।

তাঁর প্রথম জীবনের মুসলিম জাতীয়তাবাদ তাঁর মনের গভীরে রেশ হিশেবে থেকে গিয়েছিল বলে মনে হয়। তা না হলে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে এত দ্রুত তিনি ফেরত পাঠাতে পারতেন না। কিংবা ১৯৭৪ সালে ভারতের বাধা সত্ত্বেও ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিতে লাহোরে যেতে পারতেন না। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার আদায় করার জন্য আগরতলায় গিয়ে ভারতীয় সাহায্য চেয়েছিলেন একথা যেমন সত্য তেমনি উপরের পদক্ষেপগুলোও সত্য।

যাহোক তিনি তাঁর অতি ভারতপন্থী ও ভারতবিরোধী অনুসারীদের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও ক্ষমতার লড়াইয়ের শিকার হয়েছিলেন। অনেকদিন ধরে তিনি এই দুই পক্ষকে ভারসাম্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁর প্রশাসনিক অনভিজ্ঞতা ও দুর্বলতার সুযোগে স্বাধীন বাংলাদেশে যে নৈরাজ্য ও সুশাসনের ঘাটতি দেখা দিয়েছিল তারই ফলাফল হল তাঁর আকস্মিক ও মর্মান্তিক শেষ পরিণতি।

আমার বঙ্গবন্ধুকে আমি এভাবেই ক্রিটিক্যালি দেখি। একজন মানবোচিত রাজনৈতিক নেতা হিশেবে। তাঁকে নিন্দা করে ও তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা রচনা করে তাঁকে নাকচ করা বা উড়িয়ে দেয়ার পক্ষপাতী আমি নই। আবার তাঁকে অন্ধভক্তির আলোকে অতি বন্দনা বা পূজা করতেও আমি রাজী নই।

বাংলাদেশ যতদিন একটি বাস্তবতা ততদিন তাঁর ভূমিকা ও প্রভাব কেউ অগ্রাহ্য বা অস্বীকার করতে পারবে না। বাংলাদেশকে একটি শক্তিমান, স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিশেবে গড়ে তোলার বর্তমান ও ভবিষ্যত সংগ্রামেও আমরা তাঁর ঐতিহ্যকে বিরাট একটা ভূমিকা রাখতে দেখবো এই আশা করি।