আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ প্রসঙ্গে

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুন ১১ ২০১৯, ১৭:০৮

মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত জেনারেল শিক্ষিত একজন বুদ্ধিজীবির মত আচরণ করেছেন। পঞ্চাশ দশকের শেষ দিকে উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। ঐ সময়ে বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে হাতে গোনা কিছু লোক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। এমএ পাশ করেছে। কাজেই এদের মধ্যে তখন থেকেই একটা অহংকার কাজ করত যে এরা বিশেষ একটা শ্রেণী। তার উপরে তিনি ষাট দশকে সাহিত্য আন্দোলনে সম্পাদক হিশেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ‘কন্ঠস্বর’ পত্রিকা এদেশের আধুনিকতাবাদী সাহিত্য আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া তিনি ছিলেন একজন জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপক এবং ব্যক্তিত্ব। আর সবার উপরে তিনি একজন জনপ্রিয় কলেজ শিক্ষক হিশেবে ঢাকা কলেজে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। তাঁর গুণমুগ্ধ ছাত্রের সংখ্যা বিপুল। সবশেষে তিনি ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করে বই পড়াকে একটা আন্দোলনে রূপ দিতে চেয়েছেন। দেশের স্কুল-কলেজ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে তাঁর এই আন্দোলন ব্যাপক প্রচার ও প্রসার লাভ করেছে।
কিন্তু এতকিছু করবার পরেও তাঁর ঐ যে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণীর অহংকার ও জাত্যাভিমান তা কিন্তু দূর হয়নি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম। খুব ঘনিষ্ঠভাবে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিন বই পড়া কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছি। আমি তাঁকে হাড়ে হাড়ে চিনি।
তিনি দ্বিতীয় প্রজন্মের শিক্ষিত ছিলেন; তাঁর পিতা ইংরেজী ভাষার অধ্যাপক ছিলেন এবং কলেজের প্রিন্সিপাল হয়েছিলেন; তাঁর পিতা একজন নাট্যকার হিশেবে নাটক চর্চা করতেন। এসব তিনি বেশ গর্ব করে প্রায়ই বলতেন। এছাড়া আমি তাঁকে রসিকতার ছলে গর্ব করে একথাও বলতে শুনেছি যে তাঁর রক্তে হয়তো পর্তুগীজ রক্ত থেকে থাকতে পারে কারণ তাঁর চেহারা-সুরত টিপিক্যাল বাঙালির মত নয়; তাঁর পৈতৃক অঞ্চল বাগেরহাটে নাকি পর্তুগীজ জলদস্যুদের বেশ প্রভাব ছিল। এছাড়া আমি বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করতাম যে তিনি প্রায়ই শিক্ষিত জ্ঞানী ব্যক্তি হিশেবে নিজেকে রূপকার্থে “ব্রাহ্মণ” ভাবতেন; বলতেন জ্ঞানী শিক্ষকেরা হলেন ব্রাহ্মণ, তাই বৈশ্য ও শূদ্র তো দূর কি বাত এমনকি ক্ষত্রিয় রাজাও (একথা দিয়ে সমকালীন রাজনীতিবিদদের বোঝাতেন তিনি) তাঁর চাইতে নীচু। এসব কথা রসিকতার ছলে বললেও এর ভেতর দিয়ে তাঁর মনের অবচেতনে লালন করা একটি বর্ণবাদী উঁচু-নীচু স্তরভেদের মানসিকতা তিনি প্রায়ই প্রকাশ করতেন।
আর অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর একজন প্রিয় শিষ্য হিশেবে তিনি পোশাকে-আশাকে চলনে-বলনে বেছে নিয়েছিলেন কলকাতার বাঙালির রেনেসাঁর প্রোডাক্ট বাঙালি বাবুর ঢাকাই ভার্শন বাঙালি মিয়ার ফ্যাশন (অর্থাৎ বাঙালি বাবু মাইনাস ধুতি)। এখানেই তার চিরাচরিত এবং সার্বক্ষণিক পোশাক অর্থাৎ ঢোলা পাজামা, হাই কলার পাঞ্জাবি ও ঘিয়ে রঙের কুর্তার মূল উৎস খুঁজে পাওয়া যাবে। এর সঙ্গে বলিউডের কিংবদন্তী নায়ক রাজ কাপুর স্টাইলে ছেঁটে গোঁফ রাখতেন।
তাঁর কাছে প্রায় একমাত্র প্রিয় ও সম্মানীয় ছিলেন এদেশের ডাকসাঁইটে আমলারা। সিএসপি আমলারা ছিল তাঁর সকল শ্রদ্ধা ও আনুগত্যের কেন্দ্রবিন্দু। আর বাদ বাকী সব ছিল তার কাছে তুচ্ছ ও পাতে তোলার অযোগ্য। এক্ষেত্রে তাঁর ভেতরে একধরণের ঔপনিবেশিক মানসিকতা কাজ করতে দেখেছি আমি। নিঃসন্দেহে সিভিল সার্ভিসে একধরণের মেধাতন্ত্র ছিল এবং তাঁরা অনেকেই অনেক যোগ্য। কিন্তু তাই বলে তাদেরকে প্রায় দেবতাতুল্য মনে করা ও বাকীদেরকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা একটি জঘন্য ঔপনিবেশিক বর্ণবাদী মনোভাব। তাঁর এই মানসিকতা যে অনেকটা লর্ড ম্যাকলের নেটিভ “ব্রাউন সাহিব” তত্ত্ব বা কিপলিঙের “হোয়াইট ম্যান’স বার্ডেন” তত্ত্বের সমার্থক সেটি তিনি এই সিএসপিদের লজ্জাহীন পদলেহনের সময় বেমালুম ও বেখেয়াল হয়ে থাকতেন। উত্তরাধুনিক বি-উপনিবেশীকরণের তত্ত্ব ও মাইন্ডসেট তাঁর কখনো ছিল না। শেষ পর্যন্ত তিনি ঐ ষাটের দশকের নেটিভ “ব্রাউন সাহিব” বা নাক উঁচু “ব্রাহ্মণ” বা ঢাকাই “বাঙালি বাবু/মিয়া” বুদ্ধিজীবিই ছিলেন।
এই ধরণের মানুষ “আলোকিত মানুষ চাই” স্লোগান দিয়ে যে আলোর সন্ধান করেন তার মধ্যেই আসলে থেকে যায় অন্ধকার। প্রদীপের শিখার নীচেই যেমন থাকে গাঢ় অন্ধকার। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাঁর যুগ ও শ্রেণী চরিত্রকে অতিক্রম করতে পারেন নি। তাই তিনি যখন আমাদের দেশের খেটে খাওয়া প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে সারক্যাজম করেন আমি তখন অবাক হইনা। এর আগে বিদেশে গিয়ে কোন এক বক্তৃতায় তিনি প্রবাসীদের উপরে স্পেশাল ট্যাক্স আরোপের প্রস্তাব করেছিলেন; অন্যথায় তাদের দেশে আসার পথ বন্ধ করে দেবার পরামর্শও দিয়েছিলেন। কাজেই এটা নতুন কিছু নয়। আমি অবাক হই যে এতদিন এইসব লোক কি করে তাদের আসল চেহারা লুকিয়ে রাখতে পেরেছিল?