আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সমস্যাটা কোথায়?

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

সেপ্টেম্বর ০২ ২০১৯, ০০:১৩

মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত

১.
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একজন ভাল মানের শিক্ষা সংগঠক। তিনি খুব কুশলতার সাথে এদেশের প্রতিটি দলীয় — যেমন বিএনপি, এরশাদ ও আওয়ামী লীগ — সরকারের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে রাষ্ট্রের শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তার বিভিন্ন সম্পূরক শিক্ষা কর্মসূচির জন্যে প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহ করতে পেরেছেন। এক্ষেত্রে তার মূল শক্তি ছিল এদেশের আমলাতন্ত্রের সংগে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক; গুরুত্বপূর্ণ ও ক্ষমতাবান সচিবদের সংগে তার ব্যক্তিগত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তাকে আমলাতন্ত্রের কাছে একজন বিশ্বস্ত ও অনুগত বুদ্ধিজীবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। তার সৎ, নির্লোভ ও সহজ সরল জীবন যাপন তাকে এদের কাছে সম্মানীয় ও নির্ভরযোগ্য করে তুলেছে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বিভিন্ন কর্মসূচির মূল অর্থায়ন তিনি এভাবেই করেছেন। এর সাথে দেশের কিছু ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও বহুজাতিক কোম্পানি তাকে সহায়তা করেছে। এসব কারণে তাকে অন্যান্য এনজিওর মত বিদেশী টাকা খুব একটা নিতে হয়নি।

তবে একজন চিন্তক বা লেখক হিশেবে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তত উঁচু মাপের নন বলে মনে হয়েছে। অর্থাৎ সংগঠক হিশাবে তিনি যত বড় মাপের হোন না কেন, চিন্তক বা লেখক বা বুদ্ধিজীবি হিশেবে তিনি তত বড় মাপের নন। একারণে সমাজে তার চিন্তা বা লেখা তেমন কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। হ্যা, তবে তিনি একজন জনপ্রিয় শিক্ষক এবং বিনোদক-উপস্থাপক একথা অনস্বীকার্য।

সংগঠক ও বিনোদক-উপস্থাপক হিশেবে তার ব্যাপক সাফল্য ও অর্জনের কারণে তার কাছ থেকে বুদ্ধিজীবি হিশেবে মানুষের যে প্রত্যাশা তা তিনি পূরণ করতে পারছেন না। বরঞ্চ বেফাঁস ও অবিবেচক কথাবার্তা বলে ও লিখে তিনি ইদানিং চিন্তক ও লেখক হিশেবে যে বেশ গড়পড়তা মানের একজন সেই প্রমাণটাই বারবার দিচ্ছেন। আসলে একজনের ব্যক্তিত্বে যদি মেধা ও ক্ষমতার বিভিন্ন দিকের মধ্যে অসমতা থাকে তাহলে এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক; এতে অবাক হবার কিছু নেই।

২.
কলকাতার বাঙালি রেনেসাঁ এবং তিরিশি আধুনিকতার উত্তরসূরি বাংলাদেশের ষাট দশকীয় আধুনিকতার ধারক হিশেবে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এমন কথা, আমরা যারা তার নিয়মিত ছাত্র ছিলাম, তাদের সামনে ছোট পরিসরে অহরহ বলেছেন; আমরা তার প্রতিবাদ বা ক্রিটিক করলেও তা ওই ছোট্ট পরিসরেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।

এখন পার্থক্য হল উনি একজন জাতীয় আইকন হয়ে গেছেন নানা কারণে; এছাড়া ওনার বয়স আশি পেরিয়েছে; ওনার দেশে বিদেশে বিপুল ভক্তকুল রয়েছে। তাই প্রথম আলোর মত এদেশের উঠতি মধ্যবিত্তের মুখপত্রে উনি যখন সেই ষাট দশকীয় আধুনিকতাকে অবলীলায় তুলে ধরেন তখন সেটা এখনকার তরুণ প্রজন্ম, যারা ওই ষাট দশকীয় আধুনিকতাকে অতিক্রম করে আরো অগ্রসর চিন্তার ধারক বাহক হয়েছে, তারা সহজেই মেনে নিতে পারছে না। ব্যস ঘটনা এটাই।

এই বুড়ো ভাম সেই ষাট দশকের আবর্তেই আটকে আছেন। কিন্তু তার ভক্তকুলের একটা বড় অংশ সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে। তারা নারীর শরীর, যৌনতা, পোশাক, সৌন্দর্য, এথনিসিটি ও বর্ণের সংগে সৌন্দর্যের আপেক্ষিকতা, জাতীয়তা ও দেহমন গঠনের সম্পর্ক, কিভাবে সংবেদনশীল হয়ে এসব বিষয়ে কথা বলতে হয় ইত্যাদি নিয়ে অনেক অগ্রসর চেতনা ও ধারণার সংগে পরিচিত হয়ে গেছে ইতিমধ্যে; অথচ তিনি তার জীবনের এই বৃদ্ধাবস্থায় এসব বিষয়ে তার ষাট দশকীয় চেতনা ও বিশ্বাসের জড়তা ও পশ্চাতপদতাকেই বারবার উন্মোচিত করছেন।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের চাইতে তার পরবর্তী প্রজন্মের মননশীল ও সৃজনশীল অংশ অনেক বেশি আলোকিত হয়ে উঠেছে। এসবের মধ্য দিয়ে এটাই বারবার প্রমাণিত হচ্ছে।