আত্মহননের মধ্যদিয়ে আর কত স্বপ্নের মৃত্যু হবে?

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

আগস্ট ০২ ২০১৯, ২০:২৯

এহসান বিন মুজাহির

গত ১৭ জুলাই ২০১৯ সালের উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়। পরীক্ষায় অকৃতকায এবং কাঙ্খিত গ্রেড না পাওয়ায় প্রতি বছরই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। চলতি বছরের এইচএসসির ফলাফল প্রকাশের পর এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৩ জন ছাত্র-ছাত্রী আত্মহত্যা করেছেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে খবর পাওয়া গেছে। পরীক্ষায় ফেল করে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। পরীক্ষায় এ প্লাস না পেয়ে ছাত্র-ছাত্রীর আত্মহত্যার ঘটনা নতুন কিছুৃ নয়। এভাবে প্রতিদিন পত্রিকার পাতায়, অনলাইন মিডিয়ায় আত্মহত্যার খবর দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। অনেক আত্মহত্যার ঘটনা মিডিয়ার আড়ালেও থেকে যায়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা গেছে অপ্রত্যাশিত খারাপ ফলাফলের কারণে পিএসসি, জেএসসি থেকে শুরু করে এসএসসি, এইচএসসির শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। শিশু অধিকার ফোরামের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়-বিভিন্ন পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া বা আশানুরূপ ফল তথা এ প্লাস না পাওয়ার কারণে বছরে ১০ থেকে ১৫ জন শিশু আত্মহত্যা করে। বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ২০১৮ সালের এসএসসি পরীক্ষায় ফেল করার পাশাপাশি কাঙ্খিত গ্রেড না পাওয়ার কারণে ফলাফল প্রকাশের আধা ঘণ্টা পর থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে ৩১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। পরীক্ষায় সর্বোচ্চ পয়েন্ট জিপিএ-৫ বা এ প্লাস পাওয়ার প্রত্যাশা থাকে সব শিক্ষার্থীর। সেই প্রত্যাশা পূরণের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও সবার ভাগ্যে জিপিএ-৫ না জুটলেও কারো কারো ভাগ্যে জুটে। পরীক্ষা শেষে ফল পাওয়ায় অধীর প্রতীক্ষায় থাকেন সবাই। ফল পাওয়ার আগ পর্যন্ত স্কুলের সেরা মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝেও অজানা একটা টেনশন থাকে। ফল প্রকাশের পর টেনশন-অস্বস্তি দূরিভূত হয়। পরীক্ষায় এপ্লাস প্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা ফলপ্রকাশ পরবর্তী সময়টুকু আনন্দে-উচ্ছ¡াসে কাটায় আর অকৃতকার্য শিক্ষার্থীরা ফেল করার অপমানে খারাপ পথ বেছে নেয়। কেউ গলায় ফাঁস নিয়ে, কেউ ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে, কেউ বিষ পান করে, কেউ বা ছুরি ব্যবহার করে, কেউ আবার ট্রেন কিংবা বাসের নিচে পড়ে আত্মহত্যা করে। কিন্তু এটা যে সঠিক কোনো পথ নয়, সেটা বোঝানোর দায়িত্ব আমাদের। একজন শিক্ষার্থী, যে কেবল জীবনের চৌকাঠে পা রেখেছে, কিন্তু ফেল করার অপমানে তারা দরজা থেকেই ফেরত যেতে হয়, কেন তাদেরকে আমরা ফুলেল ডালা নিয়ে বরণ করতে পারি না, কেন তাদেরকে আমরা নিঃস্ব হাতে ফেরত পাঠাই, কেন বেছে নিতে বলি স্বেচ্ছামৃত্যুর মতো করুণ উপসংহারকে! মার্কিন লেখক এডওয়ার্ড ডালবার্গ বলেছেন-‘যখন কেউ উপলব্ধি করে যে, তার জীবনের কোনো মূল্য নেই, তখন সে আত্মহত্যা করে’।

সদ্য প্রকাশিত এইচএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে সারাদেশে এপর্যন্ত ১৩ জন ছাত্র-ছাত্রী আত্মহত্যা করেছেন বলে জাতীয় বিভিন্ন দৈনিক ও অনলাইনপোর্টালে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। ২০১৯ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় ‘গোল্ডেন এ প্লাস’ না পাওয়ায় রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কাদিরাবাদ হাউজিংয়ে স্বাধীন বিশ্বাস নামে এক ছাত্র আত্মহত্যা করেছেন। ১৯ জুলাই রাতে কাদিরাবাদ হাউজিংয়ের ৫ নম্বর রোডের ৯ নম্বর বাসার নিচতলায় ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেন ওই শিক্ষার্থী। আত্মহত্যার আগে লেখা চিরকুটে স্বাধীন বিশ্বাস লেখেন,‘সরি বাবা তোমার ব্যাংক ব্যালেন্স হতে পারলাম না, মাফ করে দিও, মা অনেক ভালবাসি তোমাদের, বোনকে দেখে রেখো, বেশি মন খারাপ করো না, আর বাবাকে বল বেশি যেন টেনশন না করে। আরেক পাতায় লেখা রয়েছে ভালো থাকিস তোরা সবাই, ভুল করে থাকলে মাফ করে দিস, সিরিয়াস…..স্বাধীন। এইচএসসি পরীক্ষায় ইংরেজি ২য় পত্রে অকৃতকার্য হওয়ায় বরগুনা পৌর শহরের চরকোলনী এলাকায় রাসেল নামের এক কলেজছাত্র গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। ২০ জুলাই রাত সাড়ে ৯ টার দিকে রাসেল তার নিজের ঘরে আত্মহত্যা করেন। দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে এইচএসসি পরীক্ষায় ফেল করে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন নকুল কুমার নামে এক শিক্ষার্থী। ১৭ জুলাই বেলা ১টার দিকে পরীক্ষার ফল হাতে পেয়েই ফুলবাড়ী রেলগেট বাজারের কাছে লালমনিরহাট থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী লালমনি এক্সপ্রেস ট্রেনর নিচে ঝাঁপ দিয়ে ওই শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। ভবানীপুর কলেজের মানবিক শাখার ছাত্র ছিলেন নকুল কুমার।এইচএসসিতে জিপিএ-৫ না পেয়ে বগুড়ায় কণা রাণী নামের এক কলেজ ছাত্রীর ১৭ জুলাই বিকালে আত্মহত্যা করেছেন। কুমিল্লার চান্দিনায় এইচএসসি পরীক্ষায় ফেল করে রাজিব চক্রবর্তী নামে এক শিক্ষার্থী ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন। এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় চান্দিনার মহিচাইল শহীদ জিয়াউর রহমান কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে অংশ নেন তিনি। পরপর তিন বার পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হওয়ায় বুধবার দুপুরে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পর রাজিব চক্রবর্তী অকৃতকার্য হলে ১৭ জুলাই সন্ধ্যায় তার নিজ বাড়ির পড়ার ঘরে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন। দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে এইচএসসি পরীক্ষায় ফেল করায় অভিমান করে কণা রানী রায় নামে এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। ১৭ জুলাই বিকাল ৫টার দিকে উপজেলার নশরতপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ নশরতপুর গ্রামের প্যামা জানকি পাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। তিনি রাণীরবন্দর ইছামতি ডিগ্রি কলেজের বিজ্ঞান শাখা থেকে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। পরীক্ষায় ফেল করায় আত্মহত্যা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী মনিজা আক্তার মিতু। তিনি বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। ১৬ জুলাই দিবাগত রাতে নিজ বাড়িতে একটি গাছে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। অনার্স প্রথম বর্ষের প্রকাশিত ফলাফলে তিন বিষয়ে ফেল করায় আত্মহত্যা করেন ওই ছাত্রী। (দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক যুগান্তর, দৈনিক প্রতিদিনের সংবাদ ও দৈনিক ইনকিলাব, ১৭-২০ জুলাই ২০১৯)। চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পর থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত এই ঘটনাগুলো ঘটেছে। আমি যখন এই লেখাটা লিখছি তখন হয়তো নতুন করে কোন ছাত্র-ছাত্রী আত্মহত্যার প্রস্তুতি নিচ্ছেন! আত্মহত্যার মধ্যদিয়ে এভাবে আর কত স্বপ্নের মৃত্যু হবে? আত্মহত্যায় মূলত পিতা-মাতা এবং শিক্ষকের মানসিক চাপ সৃষ্টিই প্রধান দায়ী। প্রতিনিয়ত বাড়ছে আত্মহত্যার ঘটনা। আর আত্মহত্যার এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে পিএসসি, জেএসসি থেকে শুরু করে এসএসসি, এইচএসসির পরীক্ষার ফলাফল পরবর্তী দিনগুলোতে!

আত্মহত্যার প্রবণা রোধ করতে হলে প্রথমে আমাদের কারণটা বের করতে হবে। কেন শিক্ষার্থীরা আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন? পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ মানেই কি জীবনের সব দুয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়া; নাকি ঘুরে দাঁড়ানোর আর অনেক উপায় আছে? স্কুলে কি পরীক্ষাভীতি আর ফলাফলের জুজু নিয়ে কোনো কথা বলেন শিক্ষকেরা? ছাত্রছাত্রীদের অপ্রত্যাশিত খারাপ ফলাফল হলে পুনরায় যাচাইয়ের সুযোগ থাকার পরও কেন ছাত্র-ছাত্রীরা আত্মহত্যার চরম পথ বেছে নিচ্ছেন?

পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ মানেই কি জীবনের সব দুয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়া; নাকি ঘুরে দাঁড়ানোর আর অনেক উপায় আছে? স্কুলে কি পরীক্ষাভীতি আর ফলাফলের জুজু নিয়ে কোনো কথা বলেন শিক্ষকেরা? ছাত্রছাত্রীদের অপ্রত্যাশিত খারাপ ফলাফল হলে পুনরায় যাচাইয়ের সুযোগ থাকার পরও কেন ছাত্র-ছাত্রীরা আত্মহত্যার চরম পথ বেছে নিচ্ছেন? কিছু দিন আগে জাতীয় একটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে পড়লাম ভারতে এক পিতা ছেলে চার বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছে জেনেও ঢাকঢোল পিটিয়ে মিষ্টি খাওয়ালেন ছেলের বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষক এবং প্রতিবেশীদের। বকাঝকা তো দূরের কথা, উল্টো ছেলেকে ফুলের মালা দিয়ে সাজিয়ে রীতিমতো শোভাযাত্রা বের করে পাড়ায় ঘুরিয়েছেন তিনি! এমন অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে ভারতের মধ্যপ্রদেশের সাগরে। অকৃতকার্য ওই ছাত্রের বাবা সুরেন্দ্র কুমার উল্টো পথেহেঁটে ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, পরীক্ষায় ফেল মানেই জীবন শেষ নয়। জীবন সবে শুরু হয়েছে। এমন বিরল ঘটনার মাধ্যমে তিনি ছেলেকে আত্মহত্যার মতো বড় ঘৃণিত কাজ থেকে ফিরিয়ে এনেছেন। সন্তানদেরর অতিরিক্ত চাপ না দিয়ে, তাদের কাছে টেনে ভালোবাসা উচিত। অকৃতকার্য ছাত্রের বাবার এমন সাহস দেখিয়েছেন, তাতে হয়তো আরেকটি আত্মহত্যাকে আটকে দিলেন।

আত্মহত্যা সমাজে ঘৃণিত একটি কাজ। ইসলামের দৃষ্টিতেও মহাপাপ। পবিত্র কুরআন মাজিদে মহান আল্লাহ তায়ালা আত্মহত্যাকে হারাম করেছেন এবং আত্মহত্যাকারীর ভয়াবহ পরিণামের কথা জানিয়েছেন। ইসলামে আত্মহত্যা হলো মহাপাপ। আল্লাহ মানুষকে মরণশীল করে সৃষ্টি করেছেন। তিনিই মৃত্যু ঘটান। কিন্তু আত্মহত্যার ক্ষেত্রে বান্দা স্বাভাবিক মৃত্যুকে উপেক্ষা করে মৃত্যুকে নিজের হাতে নিয়ে নিজেই নিজেকে হত্যা করে ফেলে। এ কারণে এটি একটি গর্হিত কাজ। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন-‘আর তোমরা আত্মহত্যা করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়াশীল। (সুরা নিসা : ২৯)। আল্লাহপাক আরও এরশাদ করেন-তোমরা তোমাদের নিজেদের ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করো না। (সুরা বাকারা : ১৯৫)। হজরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবিজি (সা.) বলেছেন-‘যে ব্যক্তি পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে অনুরূপভাবে আত্মহত্যা করতেই থাকবে এবং এটিই হবে তার স্থায়ী বাসস্থান। যে ব্যক্তি বিষ পান করে আত্মহত্যা করবে, তার বিষ তার হাতে থাকবে, জাহান্নামে সে সর্বক্ষণ বিষ পান করে আত্মহত্যা করতে থাকবে। আর এটা হবে তার স্থায়ী বাসস্থান। আর যে ব্যক্তি লৌহাস্ত্র দিয়ে আত্মহত্যা করবে, সে লৌহাস্ত্রই তার হাতে থাকবে। জাহান্নামেসে তা নিজপেটে ঢুকাতে থাকবে, আরসেখানে সে চিরস্থায়ীভাবে থাকবে। (বুখারি : ২৪৩১)। হজরত জুন্দুব বিন আব্দুল্লাহ (রা.) রাসুল (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন-একজন ব্যক্তি জখম হলে, সে (অধৈর্য হয়ে) আত্মহত্যা করে। এর প্রেক্ষিতে আল্লাহ বললেন আমার বান্দাহ আমার নির্ধারিত সময়ের আগেই নিজের জীবনের ব্যাপারে দ্রæত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আমি তার ওপর জান্নাত হারাম করে দিলাম। (বুখারি : ১৮২৪)।

 

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও শিক্ষক