অপ্রতিরোধ্য শক্তির বিপরীতে জনতার রাজনীতি ভাবনা

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

ডিসেম্বর ২৬ ২০১৮, ১৬:৩৩

আশরাফ মাহদী: সংখ্যালঘুদের মতামতকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আর সবার মত আমিও চাই জালেমের পতন হোক। সেই দোয়াও করি। কিন্তু সেটা যদি না হয়…?

সবদিক বিবেচনায় এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে ক্ষমতার পরিবর্তন সুদূরপরাহত। নির্বাচনের বাকি আর মাত্র চারদিন। অপ্রতিরোধ্য সরকারী দলের সাথে বিরোধী দল কোনভাবেই সুবিধা করতে পারছেনা।

আবারো যদি আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এসে যায় তাহলে কি হবে? একটা দেশের সরকার যদি এভাবে একনায়কতন্ত্র কায়েম করার সুযোগ বারবার পেতে থাকে তাহলে একটা সময় সে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। যার আন-অফিশিয়াল ট্রেইলার আমরা ইতিমধ্যেই দেখতে শুরু করেছি।

একটু পেছনে ফিরলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও একই চিত্র দেখা যাবে। কোথাও স্বৈরশাসন আর কোথাও রাজতন্ত্র কয়েমের মাধ্যমে একক পরিবারের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রিভূত হওয়ার পর রাষ্ট্রের স্বার্থ নিয়ে জনগণের ভাবনার পথকে চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এজ এ রেজাল্ট, পলিটিক্স ইটসেল্ফ একটা ফোবিয়া হয়ে দাড়ায়। অর্থাৎ
রাজনীতি নিয়ে কোন ধরনের কোন কথা বলাটাই আরব দেশের জনগণের জন্য যে কত ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন এটা কেউ নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবেনা। কিন্তু এরপরও জালেমের বিরুদ্ধে বিস্ফোরণ হয়। সত্যের দ্রোহের আগুন জুলুমকে দগ্ধ করে নিয়ে আসে নতুন ভোর। স্বাভাবিকভাবেই জনগণ প্রতিষ্ঠিত নিয়ম মেনেই নতুন মোড়কে ক্ষমতার পুরাতন কাঠামোকেই স্বাগত জানায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক চক্রান্তের সাথে পেরে না উঠে আবারো জনগণ বিপর্যস্ত হয়। তাই হয়তো এখনকার অনেক রাষ্ট্র চিন্তকরাই বলে থাকেন, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য গনতান্ত্রিক ব্যবস্থাটা অনেকক্ষেত্রেই আত্মঘাতী। বিশেষ করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ইশারার সাথে যেসব রাষ্ট্রের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট হয়ে থাকে তাদের কাছে গনতন্ত্র অনেকটাই ফাঁকা বুলি। কারণ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে নিজের স্বার্থের বিপরীতে গিয়ে কখনোই জনগণের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রকৃত গনতন্ত্রের চর্চা হতে দেয় না। এর বড় একটি উদাহরণ হচ্ছে আরব বসন্তে স্বৈরাচারদের বিরুদ্ধে এত বড় পরিসরে গণজাগরণ তৈরী করার পরও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে আরবের গনতন্ত্রের রাজনৈতিক পরাজয়।

গনতন্ত্রের সমস্যা নিয়ে সমালোচনা আছে। আমাদের সমাজে অনেকে গণতন্ত্রকে ধ্রুব ভেবে এর সমস্যা নিয়ে কথা বলাটা ট্যাবু বানিয়ে রাখলেও পশ্চিমা দেশগুলোতে একাডেমিকভাবেই এসব দূর্বলতা নিয়ে ক্রিটিসিজমের চর্চা আছে। প্রকৃত অর্থে জনগণের সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়িত করার যে মৌলিক আদর্শ গনতন্ত্র লালন করে সেই আদর্শ চর্চার সুযোগকে বন্ধ করে দেওয়াটাই স্বৈরাচারদের চরিত্র। নিজ স্বার্থ উদ্ধারে একটি জাতির ভেতর এই সমস্যা তৈরী করে রাখার কারণে এখন পুরো গনতান্ত্রিক সিস্টেমটাকেই একটা ধোকা মনে হচ্ছে। কারণ গনতন্ত্রের এই মাধ্যমটাকে ধোকা বানিয়েই এর ফায়দা লুটছে কখনো স্বৈরশক্তি, কখনো সাম্রাজ্যবাদী শক্তি।
কিন্তু গনতন্ত্র মানুষের অধিকার রক্ষায় যে মৌলিক নীতিগুলোর কথা বলে সেসবের চর্চা ও বাস্তবায়ন সম্ভব হলে রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে মানুষের অধিকার ফিরিয়ে আনা সম্ভব হত এবং স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব হত।

এখানে একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে, স্বৈরশাসক যখন এই গণতন্ত্রের অপব্যবহার করেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে তখন যতই গণতান্ত্রিক নিয়ম মেনে নিয়ে যুগের পর যুগ শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে যাওয়া হোক, সেই স্বৈরাচারের পতন সম্ভব না। এক্ষেত্রে পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বৈরাচার বিরোধী সংগ্রামে নেমে পড়ার কোন বিকল্প নেই৷ এখান থেকেই গনতন্ত্রের দুর্বলতা ধরা পড়ে।

তাহলে কি সিস্টেম পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে? হয়তোবা। এ সিদ্ধান্ত অনেকাংশেই জনগণের চিন্তা ও দেশীয়-আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল। তবে পরিবর্তন হলেও খুব অবাক হওয়ার কিছু নেই।

একটা সময় যখন সমাজতন্ত্রের বসন্তকাল চলছিল তখনকার তরুণদের মধ্যে নাকি সমাজতন্ত্র না করাটা অসচেতনতা বলে ধরা হত। অনেকে ফ্যাশন হিসেবেও করতে গিয়েও সেই আদর্শের টুকটাক চর্চা করতেন। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ধীরে ধীরে সবখানে সমাজতন্ত্রের দূর্বলতাগুলো দৃশ্যমান হওয়াতে সেই প্রবণতাটা একসময় কেটে গেছে। তারপর থেকেই তরুণদের মধ্যে “আই হেইট পলিটিক্স” প্রজন্মের উত্থান আশংকাজনক হারে বাড়তে থাকলো। যারা ফ্যাশনের কারণেও কখনো গনতন্ত্রের মৌলিক আদর্শ চর্চায় তেমন একটা সময় দেয়নি। বরং গণতন্ত্রেও সেই বুড়োরাই এসে সময় দিলেন যারা তরুণ বয়সে সমাজতন্ত্র করে পার করেছিলেন।

পয়েন্ট হচ্ছে, তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে আমাদের এই বাংলাদেশে যদি সমাজতন্ত্রের মত গনতন্ত্রের চর্চাকেও অবাস্তব ও অসার বলে প্রমাণিত হওয়ার সময় চলে আসে, অথবা জনগণের কাছে এরই কোন আপডেট চেয়ে বসে সেক্ষেত্রে দেশের জনগণ কতটুকু প্রস্তুত?

অমানিশার অন্ধকারে হোঁচট না খেয়ে আমাদের আগামির রূপরেখা নিয়ে ভাবনাটাও কি শুরু করা উচিত না? প্রত্যেক দুঃশাসনের পরই একটা সুশাসনের যুগ আসে, আমাদের প্রজন্ম সেই যুগের আগমনকে স্বাগত জানাতে কতটুকু সক্ষমতা অর্জন করেছে সে নিয়েও চিন্তাভাবনা করা উচিত।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কলামিস্ট, আলেম