কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতি : একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

সেপ্টেম্বর ২০ ২০১৮, ২০:৫২

ফুজায়েল আহমাদ নাজমুল: কওমি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা হচ্ছে বাংলাদেশের অন্যতম একটি আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা। এ শিক্ষাব্যবস্থায় রয়েছে ছয়টি স্তর: ১. ইবতেদাইয়্যাহ (প্রাথমিক) ২. মুতাওয়াসসিতাহ (নিম্নমাধ্যমিক) ৩. সানাবিয়্যাহ আম্মাহ (মাধ্যমিক) ৪. সানাবিয়্যাহ খাসসাহ (উচ্চ মাধ্যমিক) ৫. মারহালাতুল ফজিলত (স্নাতক) ৬. মারহালাতুত তাকমিল বা দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স সমমান)। দাওরায়ে হাদিস হচ্ছে সর্বোচ্চ স্তর। মেধার লড়াইয়ে বিজয়ী হয়ে ধাপে ধাপে দীর্ঘ সতেরো বা আটারো বছরে এ ছয়টি স্তর অতিক্রম করে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করতে হয় একজন শিক্ষার্থীকে।

কওমি শিক্ষাব্যবস্থার সাথে জড়িয়ে আছে দেশের বিশাল একটি জনগোষ্ঠী। দীর্ঘ কয়েক যুগে এখান থেকে অগণিত আলেম তৈরী হয়েছেন। অগণিত খোদাভীরু, চরিত্রবান, সৎ ও যোগ্য ব্যাক্তি তৈরী হয়েছেন তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কওমি থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেছেন এমন অনেকের অসাধারণ প্রতিভা, সৃজনশীলতা ও যোগ্যতা ছিল কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে সার্টিফিকেকের মূল্য না থাকায় সরকারি বা বেসরকারি ভাল কোন প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করা তো দুরের কথা চাকুরীর জন্য আবেদন করারও সুযোগ ছিল না তাদের। দেশের পড়াশোনা শেষ করে অনেকেই উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করতে চাইলে তাও সম্ভব ছিল না।

আজ কওমি সনদ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছে। বিশাল এই শিক্ষাব্যবস্থা রাষ্ট্রের খাতায় যোগ হয়েছে। মন্ত্রী আমলা ও তথাকথিত সুশীলদের মতামত উপেক্ষা করে ওলামায়ে কেরামদের চাহিদামতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতি ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ হাসিনার জন্য এটি একটি ভাল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আওয়ামী ঘরনার বাহিরের রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা জাতীয় নির্বাচনের আগমুহূর্তে কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতি প্রদানকে নির্বাচনী বৈতরনী পার হওয়ার জন্য শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে মন্তব্য করলেও আমি কওমির একজন সন্তান হিসেবে মনে করি এ স্বীকৃতি কারো করুণা নয়, এটি আমাদের অধিকার। এ স্বীকৃতি আমাদের প্রাপ্য ছিল আমরা তা পেয়েছি। এখানে রাজনীতির গন্ধ খুঁজে লাভ নেই। শেখ হাসিনার উদ্দেশ্য যাই হোক এ স্বীকৃতির মধ্যদিয়ে আংশিক হলেও কওমির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবী পূরণ হয়েছে যা অতীতের কোন সরকার পূরণ করতে পারেনি। এ স্বীকৃতি প্রদানের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রীসহ সরকারের উর্ধতন কর্মকর্তাদের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

কওমি শিক্ষার্থীরা সর্বোচ্চ স্থর দাওরায়ে হাদিস পাস করে এখন থেকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকুরীর জন্য আবেদন করতে পারবে। মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতার লড়াইয়ে বিজয়ী হতে পারলে চাকুরী করার সুযোগ পাবে এবং এর মাধ্যমে সমাজ ও দেশে দুর্নীতি, অনিয়ম, সুদ-ঘুষের প্রচলন হ্রাস পাবে। এখানে একটি কথা আমাদের জেনে রাখা দরকার যে, কওমি সনদের সরকারী স্বীকৃতির দাবী নতুন করে আওয়ামীলীগ সরকারের চলিত শাসনামলেই ওঠেনি। এ দাবী সর্বপ্রথম ১৯৯২ সালে একটি জাতীয় সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করা হয়েছিল। এ স্বীকৃতির পক্ষে জনমত তৈরী করতে দুই যুগেরও বেশি সময় কাজ করতে হয়েছে ছাত্র সমাজের একটি অংশকে। নানা আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যদিয়ে এ স্বীকৃতি এসেছে। এর পেছনে রয়েছে একটি ইতিহাস। নতুন প্রজন্মের কাছে এ ইতিহাস তুলে না ধরলে অনেক বিষয় অজানা থেকে যাবে এ চিন্তা থেকেই আজকের এ লেখা।

২. ভাবনায় সরকারি স্বীকৃতি:

কওমি শিক্ষাব্যবস্থা যুগযুগ থেকে চলে আসছে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ছাড়া। রাষ্ট্রের মুলধারার (কলেজ, ইউনিভার্সিটি ও আলীয়া মাদরাসা) শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ডিগ্রি অর্জনকারীদের মতো এ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনকারী জনশক্তিদের রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা গ্রহণের সুযোগ ছিল না। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির বাহিরে থাকার কারণে বিশাল এই জনশক্তির বিপুল মেধা একমাত্র প্রাইভেট বা পাবলিক ধর্মীয় সেক্টর ছাড়া জাতীয় কোন কাজেই আসছিল না। রাষ্ট্রীয় সব সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকার পরও যারা এই কওমি শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তক তাঁরা কোনদিন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চাননি। এমনকি সরকারের কাছে স্বীকৃতির আবেদনও জানাননি।

নব্বইয়ের দশকে কওমি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ছাত্র সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিস।’ তখনকার পরিবেশে এ প্রসঙ্গটি প্রকাশ্যে উত্থাপনের নানান প্রতিবন্ধকতা ছিল। ওলামায় কেরামসহ সাধারণ জনমতও ছিল এর বিপক্ষে। কওমি শিক্ষা যেহেতু একটি বেসরকারী শিক্ষা তাই সরকারের যেকোন প্রকারের সংশ্লিষ্ঠতা এর মান ও বৈশিষ্ট্য ক্ষুন্ন করতে পারে, এ আশংকাই ছিল মূল কারণ।

এদিকে দেশের বৃহত্তম কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড ‘বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ’ এর সাবেক মহাসচিব মাওলানা আব্দুল জাব্বার জাহানাবাদী (র.) -কেও এ বিষয়টি বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল। কওমিকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেতে হলে মাদরাসা সিলেবাসকে যুগোপযোগী করে তুলতে হবে এ চিন্তা থেকে তিনি নিরলসভাবে কাজ করেন। মূল সিলেবাসের সাথে বাংলা, ইংরেজী, অংক, ইতিহাস ও ভূগোল সংযুক্ত করে সময়ের চাহিদা ও দাবী পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখেন। অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদগণ দ্বারা অনেক পুস্তকও রচনা করান। নানা প্রকারের বাধাবিপত্তি থাকা সত্বেও এক্ষেত্রে তিনি একটুও থেমে থাকেননি। তাঁর একান্ত প্রচেষ্টায় প্রতিবছরই নতুন নতুন মাদ্রাসা বেফাকের সাথে নিবন্ধিত হয়। সরকারি স্বীকৃতি প্রশ্নে প্রায় সবাই স্পর্শকাতরভাবে নেতিবাচক হলেও তিনি ছিলেন এ ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। পরিবেশ এবং জনমত গঠনে মৃত্যুর পূর্বমূহুর্ত পর্যন্ত তিনি নিরবচ্ছিন্ন কাজ করেন।

কওমী মাদরাসা শিক্ষার সরকারী স্বীকৃতির স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রস্তাবকারী ছিলেন বেফাকের সাবেক মহাসচিব মাওলানা আব্দুল জাব্বার জাহানাবাদী রহ. ।

৩. প্রথম আনুষ্ঠানিক দাবী উত্থাপন:

১৯৯২ সালের ২৯শে মার্চ মতিঝিলে অবস্থিত ঢাকা জেলা ক্রীড়া সমিতি মিলনায়তনে (ডি ডি এস এ) ইসলামী ছাত্র মজলিসের কলেজ প্রতিনিধি সম্মেলন ছিল। সম্মেলনের প্রস্তুতি অবহিতকরন ও জাতীয় শিক্ষা দাবী দফা প্রনয়নে খেলাফত মজলিসের নির্বাহী পরিষদের পরামর্শ গ্রহণের জন্য খেলাফত মজলিসের তৎকালীন অভিভাবক পরিষদের চেয়ারম্যান শায়খুল হাদীস আল্লামা আজীজুল হক (র.) এর পরামর্শ ও নির্দেশনার জন্য ছাত্র মজলিসের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি অধ্যাপক মাওলানা আব্দুল কাদির সালেহ ও সেক্রেটারী জেনারেল এডভোকেট মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসাইন সাক্ষাত করলে তিনি নির্বাহী পরিষদের তিন শিক্ষাবিদের সাথে আলোচনা করতে বলেন। এরই প্রেক্ষিতে খেলাফত মজলিসের তৎকালীন মহাসচিব, ভাষাসৈনিক অধ্যক্ষ মুহাম্মদ মাসউদ খাঁন ও যুগ্ম-মহাসচিব অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের এবং বেফাকের তৎকালীন মহাসচিব মাওলানা আবদুল জাব্বার জাহানাবাদী (র.) এর সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন ছাত্র মজলিস নেতৃবৃন্দ। তখন বেফাক মহাসচিব মাওলানা আব্দুল জাব্বার (র.) ছিলেন খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের অন্যতম সদস্য।

কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতি যদিও ছাত্র মজলিসের নীতিনির্ধারণী ফোরামে আলোচনায় ছিল তারপরও বেফাক মহাসচিব মাওলানা আব্দুল জাব্বার (র.) কওমি শিক্ষার সরকারি স্বীকৃতির দাবীটি ছাত্র মজলিসের জাতীয় শিক্ষা দাবীর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করার জোর তাগিদ দেন। তখনকার সময়ে গুরুত্বপূর্ণ এ দাবিটি সরাসরি তাঁদের পক্ষে প্রকাশ্যে উত্থাপন করা সহজ ছিল না বলেই তিনি ছাত্র মজলিসের সম্মেলনকেই উপযুক্ত মাধ্যম এবং সংগত মনে করেন। ছাত্র মজলিসের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ ও কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি পরিষদের বৈঠকে কওমি সনদের সরকারী স্বীকৃতির দফাটি বেশ গুরুত্ব পায়। সাথে আলীয়া মাদ্রাসা এবং ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত আরো দুটি দফাও গৃহীত হয়।

দীর্ঘ মতবিনিময়, অভ্যন্তরীন পরামর্শ গ্রহণ, মতবিনিময় ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শেষে ২৯শে মার্চ এক বৈরী পরিবেশে ছাত্র মজলিসের কলেজ প্রতিনিধি সম্মেলনে সংগঠনের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা আব্দুল কাদির সালেহ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার সরকারি স্বীকৃতিসহ ১৩ দফা জাতীয় শিক্ষা দাবী উত্থাপন করেন। ইসলামী ছাত্র মজলিস ত্রিধারার (কওমি মাদরাসা, সরকারী আলীয়া মাদরাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়) বিভক্ত ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম হিসেবে গোটা ছাত্র সমাজের মৌলিক দাবীগুলো ১৩ দফাতে গুরুত্বের সাথে স্থান পায়। সম্মেলনে দেশের ১১১টি কলেজ প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, জামেয়া পটিয়া , জামেয়া রাহমানিয়া, জামেয়া মোহাম্মাদিয়া, জামেয়া লালমাটিয়া, জামেয়া মাদানিয়া কাজিরবাজার, জামেয়া নুরীয়া ভার্থখলা, জামেয়া গহরপুর, জামেয়া এমদাদিয়া এবং ঢাকা, সিলেট, বগুড়া আলীয়াসহ দেশের ৫০টি মাদ্রাসার প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৬টি বিশ্বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও মাদ্রাসা শিক্ষকগণও অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলন স্মারক ‘৯২ -তে অনেক অতিথির নাম থাকলেও স্পর্শকাতরতা বিবেচনায় অনেকেই তাঁদের নাম স্মারকে প্রকাশ না করার পরামর্শ দেন এবং পরিবেশ ও মাদ্রাসা প্রশাসনের কঠোর নজরদারির কারণে অনেক প্রতিনিধির নাম কোথাও লিখিতরূপে উল্লেখ করা হয়নি।

কওমী মাদরাসা শিক্ষার সরকারী স্বীকৃতি আন্দোলনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তৎকালীন খেলাফত মজলিসের আমীর আল্লামা আজিজুল হক রহ.।

জাতীয় কলেজ প্রতিনিধি সম্মেলনে ইসলামী ছাত্র মজলিসের উত্থাপনকৃত ১৩ দফা জাতীয় শিক্ষাদাবী:

০১.সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষাঙ্গন চাই।
০২. আদর্শ নাগরিক সৃষ্টির উপযোগী গণমুখী সার্বজনীন ও ইসলামী শিক্ষা চাই।
০৩. বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারী কলেজসমূহ পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগসহ ডাবল শিফট চালু কর।
০৪. শিক্ষা শেষে কর্মসংস্থানের ব্যবস্তা করতে হবে, নইলে বেকার ভাতা চালু করতে হবে।
০৫. সেশনজট নিরসন, পরীক্ষার সকল অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।
০৬. গরীব ছাত্রদের জন্য শিক্ষা ঋণ প্রকল্প চালু করতে হবে।
০৭. কাগজ, কলম, বই সহ শিক্ষা উপকরণের দাম কমাতে হবে।
০৮. প্রতি থানায় একটি করে সরকারি কলেজ ও প্রতি জেলায় একটি করে সরকারী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
০৯. মেয়েদের জন্য পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ চাই।
১০. সকল যানবাহনে ছাত্রদের জন্য কনসেসান চাই।
১১. ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর চলবে না, ফাজিল শ্রেনীর স্নাতক সমমান সর্বত্র কার্যকর করতে হবে।
১২. কওমি মাদরাসা শিক্ষাকে সরকারি স্বীকৃতি দিতে হবে।
১৩. বেসরকারি শিক্ষার উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারি অনুদান বৃদ্ধি এবং শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
কলেজ প্রতিনিধি সম্মেলনে ১৩ দফা জাতীয় শিক্ষা দাবী উত্থাপন করেই শেষ নয়। এ দাবীর পক্ষে সারা দেশে ক্যাম্পিং করে ছাত্র মজলিস। দেশের বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের এক লক্ষ সাক্ষর সংগ্রহ করে। প্রথম সাক্ষর করেন দেওয়ান মুহাম্মদ আজরফ। দ্বিতীয় সাক্ষর করেন ভাষাসৈনিক অধ্যক্ষ মুহাম্মদ মাসউদ খাঁন এবং তৃতীয় সাক্ষর করেন দৈনিক ইনকিলাবের প্রফেসর আব্দুল গফুর। এক লক্ষ সাক্ষর সংগ্রহ করে তৎকালীন বিএনপি সরকারের শিক্ষামন্ত্রী বরাবর জমা দেয়া হয়।

৪. ব্যাপক জনমত তৈরী ও দাবী বাস্তবায়নে ধারাবাহিক কর্মসূচী :

জাতীয় কলেজ প্রতিনিধি সম্মেলন শেষে শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল (র.) ও খেলাফত মজলিসের পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামী ছাত্র মজলিস কওমি শিক্ষার সরকারি স্বীকৃতির দাবীর প্রতি জনমত গড়ে তুলতে ও দাবী বাস্তবায়নে সরকারকে বাধ্য করতে ব্যাপক ও ধারাবাহিক কর্মসূচী গ্রহণ করে। কর্মসূচী মধ্যে ছিল- লিফলেট বিতরণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের সাথে মতবিনিময়, দেশব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও যানবাহনে “কওমী মাদরাসা শিক্ষাকে সরকারী স্বীকৃতি দিতে হবে” দাবী সম্বলিত স্টিকার ব্যাপকহারে লাগানো, রাস্তার গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে দেয়াল লিখন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দেয়াল, গেইট ও গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে হাতের লেখা পোষ্টার লাগানো, গণস্বাক্ষর অভিযান কর্মসূচি পালন শেষে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে শিক্ষামন্ত্রী বরাবরে স্বারকলিপি প্রদানসহ দেশব্যাপী সমাবেশ-মিছিল প্রভৃতি।

১৯৯৭ সালে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ছাত্র মজলিসের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি শেখ গোলাম আসগরের সভাপতিত্বে ও সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ মুনতাসির আলীর পরিচালনায় অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় সহযোগী সদস্য সম্মেলনে কওমি মাদরাসা শিক্ষার সরকারী স্বীকৃতির দাবীসহ ১৩ দফা জাতীয় শিক্ষাদাবী উত্থাপন করা হয় এবং পৃথক পৃথক প্রস্তাবে তা বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবী জানানো হয়।

কওমী মাদরাসা শিক্ষার সরকারী স্বীকৃতি নিয়ে প্রথম আনুষ্ঠানিক দাবী উত্থাপন করেন তৎকালীন ইসলামী ছাত্র মজলিসের কেন্দ্রীয় সভাপতি প্রফেসর মাওলানা আব্দুল কাদের সালেহ।

২০০০ সালের ২১ ও ২২ এপ্রিল আদর্শ নাগরিক সৃষ্টির উপযোগী গণমুখী ও সার্বজনীন ইসলামী শিক্ষা চাই’ প্রতিপাদ্য শ্লোগান নিয়ে ও কওমি মাদরাসা শিক্ষার সরকারি স্বীকৃতির দাবীসহ ১৩ দফা জাতীয় শিক্ষা দাবী বাস্তবায়নের লক্ষে ‘ইসলামী ছাত্র মজলিস’ রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে আয়োজন করে ‘জাতীয় ছাত্র কনভেনশন’। ছাত্র মজলিসের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি মুহাম্মদ মুনতাসির আলীর সভাপতিত্বে দুদিনব্যপী এ কনভেনশন উদ্বোধন করেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি মুহাম্মদ আব্দুর রউফ। প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন, আমীরে মজলিস শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক। বক্তব্য রাখেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, দেশের শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরাম এবং জাতীয় ছাত্র নেতৃবৃন্দ। ছাত্র মজলিসের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা জয়নুল ইসলামের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত জাতীয় ছাত্র কনভেনশন থেকে কওমি মাদরাসা শিক্ষার সরকারি স্বীকৃতিসহ ছাত্র মজলিসের ১৩ দফা জাতীয় শিক্ষা দাবী বাস্তবায়নের জোর দাবী জানানো হয়। এছাড়াও ছাত্র মজলিসের প্রতিটি জাতীয় সম্মেলন ১৩ দফা জাতীয় শিক্ষা দাবী উত্থাপন করা হয়। আর এই ১৩ দফা দাবীর মধ্যে কওমি মাদরাসা শিক্ষার সরকারী স্বীকৃতির দাবী ছিল অন্যতম। প্রতিটি সম্মেলন স্মারকই তার সত্যতা প্রমান করে।

১৯৯২ সালে কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতির দাবীসহ ১৩ দফা জাতীয় শিক্ষা দাবী বাস্তবায়নের লক্ষে ছাত্র মজলিস আয়োজিত কলেজ প্রতিনিধি সম্মেলনে প্রকাশিত সম্মেলন স্মারকে শিক্ষা দাবীগুলো তুলে ধরা হয়েছিলো।


২০০৫ সালের ১৫ এপ্রিল পল্টন ময়দানে কওমি মাদরাসা শিক্ষার সরকারী স্বীকৃতির দাবীতে ‘কওমী মাদরাসা জাতীয় ছাত্র কনভেশন’ আয়োজন করেন শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (র.)। সেই কনভেনশন থেকে তৎকালীন চারদলীয় জোট (বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোট) সরকারের কাছে কওমি মাদরাসা শিক্ষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জোর দাবী জানানো হয়। পরবর্তীতে শায়খুল হাদীস ঢাকার মুক্তাঙ্গনে হাজার হাজার ছাত্র জনতা এবং ওলামায়ে কেরামদের নিয়ে রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে লাগাতার ৫দিন অবস্থান কর্মসূচী পালন করেন। চরমোনাইয়ের পীর মরহুম সৈয়দ ফজলুল করীমসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরাম ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মুক্তাঙ্গনে উপস্থিত হয়ে কর্মসূচী ও দাবীর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। অনশনের ৫ম দিনে অবস্থা বেগতিক দেখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তড়িঘড়ি করে তাঁর কার্যালয়ে ওলামা সম্মেলন ডেকে কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্সের সমমান ঘোষণা দিবেন বলে আশ্বাস দিলে শায়খুল হাদীস (র.) অনশন কর্মসূচী স্থগিত করেন।

৫. আওয়ামীলীগ সরকারের মাধ্যমেই স্বীকৃতি:

১৯৯২ থেকে ২০১৮ সাল। এ সময়ের ভেতর ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে কয়েকবার। চারদলীয় জোট ক্ষমতা গ্রহণের শুরুতেই শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (র.) সরকারের কাছে কওমি সনদের স্বীকৃতির জোর দাবী জানালেও সরকার রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য ঝুলিয়ে রাখে ঐতিহাসিক এ দাবীকে। ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ব মূহুর্তে বেগম জিয়া কওমি সনদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ঘোষণা দেন এবং ২০০৬ সালের ২০ডিসেম্বর তাড়াহুড়ো করে মন্ত্রণালয় গেজেটও প্রকাশ করে। ষড়যন্ত্রের কারণে হোক আর সরকারের সদিচ্ছার অভাবে হোক স্বীকৃতির ঘোষণা শুধু ঘোষণার মধ্যেই থেকে যায়, রহস্যজনক কারণে তা আর বাস্তবায়িত হয়নি। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসলে ২০১০ সালের পরবর্তী সময়ে জমিয়তে ওলামার সভাপতি আল্লামা ফরিদ উদ্দীন মাসউদসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরাম, বৃহত্তম অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম ও ‘বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ’ সহ দেশের প্রথমসারির ৬টি শিক্ষাবোর্ড কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতির দাবীতে সোচ্চার হয়ে ওঠে।

২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় ১১এপ্রিল ২০১৭ গণভবনে দেশের শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরামদের এক অনুষ্ঠানে কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণভবনে ওলামায়ে কেরামদের এই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী কওমি মাদ্রাসার গৌরবময় ঐতিহ্য ও ইসলামী শিক্ষার গুরুত্বের কথা স্বীকার করে বক্তব্য রাখেন। তিনি কওমির স্বকীয়তা শতভাগ অক্ষুণ্ন রেখে এবং ‘কওমি সনদ বাস্তবায়ন সমন্বয় পরিষদ’ এর চেয়ারম্যান আল্লামা শাহ আহমদ শফির নেতৃত্বে বেকাফসহ ৬টি বোর্ডের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির দেয়া শর্তসমূহ মেনে তাঁর সরকারের মেয়াদেই স্বীকৃতি বাস্তবায়ন করবেন বলে ওলামায়ে কেরামদের আশ্বস্ত করেন।

আওয়ামীলীগ সরকারের কাছ থেকে ক্বওমী স্বীকৃতি আদায়ে যথেষ্ট ভূমিকা রাখেন মাওলানা ফরিদ উদ্দীন মাসউদ।

বেকাফসহ ৬টি বোর্ডের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির দেয়া শর্তসমূহ হচ্ছে:
১. কওমি মাদ্রাসার নেসাবে তালিম সমুন্নত রাখতে হবে।
২. কওমি মাদ্রাসার মূলভিত্তি দেওবন্দের উসুলে হাস্তাগানার (আট মূলনীতি) আলোকে মান দিতে হবে।
৩. সরকারি কোন ধরণের হস্তক্ষেপ চলবে না।
৪. কওমি মাদ্রাসার পরিক্ষাসমূহ ও নিয়ম নীতিমালা কওমি আলেমগণ ঠিক করবেন। সরকারের কোন কর্তাব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অধীনে পরিক্ষা নিয়ন্ত্রণ চলবে না।
৫. কওমি সনদ সমন্বয় পরিষদ বা কওমি মাদ্রসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান বা কো-চেয়ারম্যানের পদে সবসময় কওমি আলেম মনোনীত ব্যক্তিই থাকবেন। সরকারী কর্মচারী বা কর্মকর্তা চেয়ারম্যান বা কো-চেয়ারম্যান পদে থাকতে পারবে না।
৬. সরকারের কোন রকম সাহায্য সহযোগিতা কওমি মাদ্রাসা গ্রহণ করবে না। সাহায্যের নামে কওমি মাদ্রাসার ওপর হস্তক্ষেপ ও নজরধারী করা যাবে না।
৭. কওমি মাদ্রাসার নেসাবে তালিম ও পরিচালনার ক্ষেত্রে সার্বিক স্বাধীনতা কওমি আলেমদের হাতে থাকবে, শুধুমাত্র দাওরা হাদিসের সনদকে সমন্বয় কমিটির সত্যায়নে সরকার সনদের মান দিবে।

১৩ এপ্রিল ২০১৭, রাতে কওমি মাদরাসার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে এবং দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতিগুলোর ভিত্তিতে কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসের সনদকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রীর সমমান দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সভাপতি (পদাধিকার বলে) ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে একটি কমিটিও গঠন করে দেয়া হয়।

৬. ‘আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ গঠন:

কওমি শিক্ষা সনদকে মাস্টার্স (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান প্রদান করে প্রজ্ঞাপন জারির পর ১৬ এপ্রিল ২০১৭ দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারীতে স্বীকৃতি বাস্তবায়ন কমিটির চেয়ারম্যান আল্লামা আহমদ শফী এর সভাপতিত্বে কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে পরীক্ষা ও সনদের জন্য “আল-হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ” নামে সর্বোচ্চ সংস্থা গঠন করা হয় এবং উক্ত সংস্থার আওতায় দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষা গ্রহণ ও সনদ বিষয়ক কার্যক্রম পরিচালনা এবং ২০১৭ সাল থেকেই অভিন্ন প্রশ্নপত্রে দাওরা হাদিসের পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে এছাড়াও বেফাক থেকে ৬ জন এবং অন্য ৫ বোর্ড থেকে ১জন হারে মোট ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক উপকমিটিও গঠন করা হয় এবং গওহরডাঙ্গা মাদরাসার মাওলানা শামসুল হককে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হিসেবে মনোনীত করা হয়। এই কমিটি তাদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সরকার থেকে কোন ধরণের আর্থিক সহযোগিতা বা সুবিধা গ্রহণ করবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়।

সর্বেশেষ কওমী মাদরাসা শিক্ষার সরকারী স্বীকৃতির ঐতিহাসিক দাবীটি বাস্তবায়ন হয় হাটহাজারী দারুল উলুমের মহাপরিচালক, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর, কওমী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকের চেয়ারম্যান আল্লামা শাহ আহমদ শফী হাফিজুল্লাহ এর নেতৃত্বে ।

৭. দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) এর প্রথম পরীক্ষা:

প্রজ্ঞাপন জারির পর প্রথমবারের মতো দাওরা (মাস্টার্স ) পরীক্ষা ‘আল হাইআতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশে’ এর অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। কওমি মাদরাসা বোর্ডগুলোর সম্মিলিত বোর্ডে প্রথম ও একই সময়ে অভিন্ন প্রশ্নে সারা দেশে মোট ২১৮টি কেন্দ্রে ১৫মে ২০১৭ পরীক্ষা শুরু হলে তা শেষ হয় ২৫মে ‘১৭।

দেশের প্রায় ৭৩৭টি কওমি মাদ্রাসার ১৯ হাজার ৩৯৩ জন শিক্ষার্থী এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। ১৯,৩৯৩ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ থেকে অংশ নেয় ১১,১৯১জন ছাত্র ও ৩,৭৫২ জন ছাত্রী। চট্টগ্রামের ইত্তেহাদের অধীনে ১,০০৭ জন ছাত্র ও ৩৭ জন ছাত্রী। সিলেটের আযাদ দ্বীনি এদারা’র অধীনে ১,০৫০ জন ছাত্র ও ১২৭ জন ছাত্রী। গওরডাঙ্গার বোর্ডের অধীনে ৪৭৫ জন ছাত্র ও ১৪৫ জন ছাত্রী। উত্তরবঙ্গ তানযীমের অধীনে ১,১২৬ জন ছাত্র। জাতীয় দ্বীনি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ৪৪৯ জন ছাত্র ও ৩৪ জন ছাত্রী। পরীক্ষা গ্রহণের সুবিধার্থে সারা দেশকে ২৯টি জোনে বিভক্ত করা হয়। পরীক্ষার বিষয় ছিল ১০ টি। মোট নম্বর ছিল ১০০০ (এক হাজার)। পরীক্ষা প্রতিদিন সকাল ৯টায় শুরু হয় এবং ১২.৩০ মিনিটে শেষ হয়।

‘আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামিয়াতিল কওমীয়া বাংলাদেশ’ এর অধীন ও তত্ত্বাবধানে দাওরায়ে হাদিসের প্রথম পরীক্ষা শিক্ষার্থীরা বেশ উৎসবমুখর পরিবেশে দিতে দেখা যায়। এখানে অর্থের কাছে নৈতিকতার পরাজয় ছিল না। প্রশ্নফাঁসের হিড়িক ছিল না। নকলের ছড়াছড়ি ছিল না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতির প্রয়োজন ছিল না। দেশের শিক্ষামন্ত্রনালয়, জেনারেল শিক্ষিত মহল, স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটির পরীক্ষানিয়ন্ত্রক বিভাগগুলোর জন্য অভিন্ন প্রশ্নপত্রে দাওরায়ে হাদিসের এ পরীক্ষা একটা রোল মডেল ও শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হতে পারে বলে বিশ্লেষকদের মন্তব্য ছিল।

৮. প্রধানমন্ত্রী বরাবরে আল্লামা আহমদ শফীর বিশেষ চিঠি:

কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্সের সমমান প্রদানের বিষয়টি জাতীয় সংসদে পাস করার আবেদন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে চিঠি লিখেন হেফাজতে ইসলামের আমীর, শায়খুল হাদীস আল্লামা শাহ আহমদ শফী। ১১ জুন ২০১৭ জাতীয় সংসদ ভবনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আলেমদের এক প্রতিনিধি দলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত বৈঠকে প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আল্লামা শাহ আহমদ শফীর চিঠি হস্তান্তর করেন। সেই চিঠিতে আল্লামা শাহ আহমদ শফী প্রথমেই কওমি স্বীকৃতির জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘কওমি মাদরাসার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে ও দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতিসমূহকে ভিত্তি ধরে কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্স (ইসলামিক স্টাডিজ এবং আরবি) এর সমমান প্রদান করা হল।’ আপনার এ যুগান্তকারী ঘোষণা দ্বারা একটি শুভ ইতিহাস ও সদকায়ে জারিয়া সূচিত হল। “

চিঠিতে কওমি সনদের আইনগত ভিত্তি জীবনের সর্বশেষ কামনা বলে উল্লেখ করে আল্লামা শাহ আমদ শফী বলেন, “আমি আমার বয়সের শেষপ্রান্তে উপনীত। আর কত দিন বেঁচে থাকব তা একমাত্র মহান আল্লাহই জানেন। কওমি মাদরাসার সনদের মানের আইনগত ভিত্তি রচিত হোক, এটাই আমার জীবনের সর্বশেষ কামনা। আপনার কাছে আমার সবিনয় অনুরোধ, কালবিলম্ব না করে সনদের মান আপনার মন্ত্রীসভায় পাস করতঃ আগামী সংসদ অধিবেশনে তা পাস করিয়ে নেবেন।

৯. মন্ত্রীসভায় অনুমোদন :

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন এর আলোকে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) উচ্চপর্যায়ের আলেমদের সঙ্গে দফায় দফায় বসে কওমি মাদরাসা সমুহের দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান সংক্রান্ত আইনের খসড়া চূড়ান্ত করে। আর এ আইনের খসড়া ১৩ আগস্ট ২০১৮ অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

প্রস্তাবিত আইনটির নাম ‘কওমি মাদ্রাসাসমূহের দাওরায়ে হাদিসের (তাকমিল) সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান প্রদান আইন, ২০১৮’। ১৩ আগস্ট সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের বলেন, প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে যারা দাওরায়ে হাদিস পাস করেছেন, তারাই মাস্টার্স ডিগ্রি সমমানের সনদ পাবেন।

১০. জাতীয় সংসদে বিল পাস:

১৯ সেপ্টেম্বর ‘১৮, মহান জাতীয় সংসদের ২২তম অধিবেশনে ‘কওমি মাদরাসা সমূহের দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল)-এর সনদকে আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমীয়া বাংলাদেশ’ এর অধীনে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান প্রদান বিল ২০১৮’ পাসের প্রস্তাব উপস্থাপন করেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং তা কণ্ঠভোটে পাস হয়।

স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশনে বিলটি পাসের আগে জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। এর আগে জাতীয় সংসদের ২২তম অধিবেশনের দ্বিতীয় দিন (১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮) বিলটি উত্থাপন করেন শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ এবং উত্থাপনের পর বিলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়।

বিল উত্থাপনকালে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, আমি আশা করছি, আমরা সকলে এই বিলের ঐতিহাসিক পটভূমি গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারছি। ২০০ বছরের অধিক সময় ধরে কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা স্বীকৃতির জন্য আন্দোলন করে অাসছে। ১৫ লক্ষ শিক্ষার্থী এ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। ৬টি বোর্ড রয়েছে। প্রায় ৩ থেকে ৪ লক্ষ শিক্ষার্থী প্রতি বছর শিক্ষা সমাপ্ত করছে। এখন তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির প্রয়োজন রয়েছে।

জনমত যাচাই ও বাছাইয়ের ব্যাপারে তিনি বলেন, অন্যান্য বিলের ক্ষেত্রে যে পরিমাণ জনমত যাচাই ও বাছাই করা হয় তার চাইতে বেশি এ বিলের ক্ষেত্রে হয়েছে। দীর্ঘ নয় বছর ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদরাসার বোর্ডগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে আসছেন। এখন আর নতুন করে কোন যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন আসে না। তিনি আরো বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কওমি ধারার শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি সম্মান জানিয়ে এ স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। আমি মনে করি, বিলটি পাস হলে ঐতিহাসিকভাবে তা লিখিত থাকবে।

১১. স্বীকৃতি আন্দোলনের নেতৃত্ব:

কওমি স্বীকৃতির দাবীটি অত্যন্ত যৌক্তিক ও সময়োপযোগী হলেও একসময় কওমী ঘরনার প্রায় সবাই দ্বিধান্বিত ছিলেন। ছাত্র মজলিস কর্তৃক উত্থাপিত এ দাবী নিয়ে শুরুতে অনেকেই তীব্র সমালোচনা করেছেন। তবে সময়ের ব্যবধানে এ দাবীটি জাতীয় দাবীতে পরিণত হয় এবং এক পর্যায়ে তা রাজনৈতিক দাবী হিসেবেও রূপ লাভ করে। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে গেলেও অবশেষে সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় স্বীকৃতি আদায় করা সম্ভব হয়েছে। এ বিজয় শুধু ছাত্র মজলিস কিংবা সংশ্লিষ্ট নেতৃত্বের নয়। এ বিজয় গোটা কওমী অঙ্গনের। এ বিজয় গোটা জাতির।

কওমি মাদরাসা শিক্ষার সরকারি স্বীকৃতির স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রস্তাবক ছিলেন বেফাকের সাবেক মহাসচিব মাওলানা আব্দুল জাব্বার জাহানাবাদী (র.), পৃষ্ঠপোষক ছিলেন খেলাফত মজলিসের সাবেক আমীর, শায়খুল হাদীস আল্লামা আজীজুল হক (র.) এবং প্রথম আনুষ্ঠানিক দাবী উত্থাপনকারী ছিলেন ইসলামী ছাত্র মজলিসের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা আব্দুল কাদির সালেহ। শুরুতে পুরো বিষয়টি সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ছাত্র মজলিসের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি এডভোকেট মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসাইন। সর্বশেষ স্বীকৃতির মহান দাবীটি বাস্তবায়ন হয় হেফাজতে ইসলামের আমীর ও বেফাকের চেয়ারম্যান আল্লামা শাহ আহমদ শফী (দা. বা.) এর মাধ্যমে।

এছাড়াও কওমি শিক্ষার সরকারি স্বীকৃতির আন্দোলনে কেউ বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্নভাবে সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছেন আবার কেউ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ এর সাবেক সভাপতি শায়খুল হাদীস আল্লামা নুর উদ্দীন আহমদ গহরপুরী (র.), খেলাফত মজলিসের সাবেক নায়েবে আমীর অধ্যাপক আখতার ফারুক (র.), সাবেক এমপি শায়খুল হাদীস আল্লামা উবায়দুক হক (র.), জাতীয় মসজিদের খতিব মাওলানা উবায়দুল হক (র.), ইসলামী ঐক্যজোটের সাবেক চেয়ারম্যান মাওলানা মুফতি ফজলুল হক আমিনী (র.), খেলাফত মজলিসের আমীর অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমীর প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমান, জমিয়েতে উলামায়ে ইসলামের সাবেক নির্বাহী সভাপতি মাওলানা মুহি উদ্দীন খান (র.), খেলাফত মজলিসের সিনিয়র নায়েবে আমীর ভাষাসৈনিক অধ্যক্ষ মুহাম্মদ মাসউদ খাঁন, জমিয়তে উলামার সভাপতি আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ, বেফাকের সিনিয়র সহ সভাপতি মাওলানা আশরাফ আলী, বেফাকের মহাপরিচালক অধ্যাপক মাওলানা জুবায়ের আহমদ চৌধুরী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি মাওলানা মুফতি ওয়াক্কাস (সাবেক এমপি), খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা নুর হোসাইন কাসিমী, কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড গওহরডাঙ্গার চেয়ারম্যান আল্লামা মুফতি রুহুল আমীন, বেফাকের মহাসচিব মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ এর সহ-সভাপতি মুফতি ফয়জুল্লাহ, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র সমাজের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. আ.ফ.ম খালিদ হোসাইন, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিসের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি শেখ গোলাম আসগর, মুহাম্মাদ মুনতাসির আলী ও মাওলানা জয়নুল ইসলাম, কওমি মাদরাসা শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন (কমাশিসা)-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি খতিব তাজুল ইসলাম প্রমুখ। কওমি সনদের স্বীকৃতির আন্দোলনে শুরু থেকে শেষপর্যন্ত যারাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ময়দানে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁদের নাম ইতিহাসের পাতায় সোনালী হরফে লিখা থাকবে।

বলতে গেলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একক আন্তরিক প্রচেষ্টায়ই শেষপর্যন্ত কওমী সনদ বিল সংসদে পাস হয়।

১২. সংসদে পাস হওয়া সনদের বিলে যা আছে:

বিলটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, আলেমদের দাবি ও সব শর্ত মেনে দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতি অনুসারে এ স্বীকৃতির প্রস্তাব করা হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান কোনো আইন এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে কওমি আইনই বলবৎ থাকবে বলেও বলা হয়েছে বিলের ৩ নং ধারায়।

সংসদে উত্থাপিত বিলটির হুবহু নিম্নরূপ:

কওমি মাদরাসাসমূহের দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল)-এর সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি)-এর সমমান প্রদানসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ে বিধান করিবার নিমিত্ত আনীত বিল।

যেহেতু কওমি মাদরাসার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা বজায় রাখিয়া দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতিসমূহকে ভিত্তি ধরিয়া ‘আল-হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ এর অধীন কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল)-এর সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি)-এর সমমান প্রদানসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ে বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়। সেহেতু এতদদ্বারা নিম্নরূপ আইন করা হইল-
১। সংক্ষিপ্ত শিরােনাম, প্রবর্তন ও প্রয়ােগ।
(১) এই আইন “আল-হাইআতুল উলয়া লিল জামি‘আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ এর অধীন কওমি মাদরাসাসমূহের দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল) এর সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি)-এর সমমান প্রদান আইন ২০১৮ নামে অভিহিত হইবে।
(২) ইহা অবিলম্বে কার্যকর হইবে।
(৩) এই আইন সমগ্র বাংলাদেশে দারুল উলুম দেওবন্দের নীতি, আদর্শ ও নিসাব (পাঠ্যসূচি) অনুসরণে পরিচালিত কওমি মাদরাসাসমূহের দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল)-এর ক্ষেত্রে প্রয়ােজ্য হইবে।

২। সংজ্ঞা। – বিষয় বা প্রসঙ্গের পরিপন্থি কোনাে কিছু না থাকিলে, এই আইনে –
(১) “কওমি মাদরাসা” অর্থ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা’আত ও দারুল উলুম দেওবন্দের অাদর্শ, মূলনীতি ও মত-পথের অনুসরণে মুসলিম জনসাধারণের আর্থিক সহায়তায় উলামায়ে কেরামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত ইলমে ওহীর শিক্ষাকেন্দ্র।

(২) “কওমি মাদরাসার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা” অর্থ:
(ক) ঈমান, তাকওয়া ও তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ (একমাত্র আল্লাহর উপর নিরংকুশ ভরসা) এবং সর্বাবস্থায় সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার রিযামন্দী ও সন্তুষ্টি অর্জনকে জীবনের পরম ব্রত ও লক্ষ্য স্থির করিয়া একমাত্র আল্লাহ তাআলার সত্ত্বার সহিত ভয় ও আশার সম্পর্ক স্থাপন এবং তাহাতে অবিচল থাকা।
(খ) মহানবি হযরত মুহাম্মদ সা. এর বাণী “আমি ও আমার সাহাবীগণ যে মত, পথের উপর প্রতিষ্ঠিত)” এর আলোকে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা’আত এর মতাদর্শ অনুসরণে আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের মাসুম (নিষ্পাপ) হওয়ার বিশ্বাস এবং সাহাবায়ে কিরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমের যথাযথ আজমত (মার্যাদা) ও তাঁহাদের ‘মিয়ারে হক’ (সত্যের মাপকাঠি) হওয়ার বিশ্বাস অন্তরে সুদৃঢ় করা ও তদনুসারে জীবন যাপন।
(গ) চার মাযহাবের প্রতি শ্রদ্ধা ও পরমত সহিষ্ণুতার সহিত হানাফী মাযহাব অনুসরণ।
(ঘ) সুলুক ও আধ্যাত্মিকতায় সুপরিচিত চার তরীকা (চিশতিয়া, সােহরাওয়ারদিয়া, নকশবন্দিয়া-মুজাদ্দিদিয়া ও কাদিরিয়া) সহ সকল হকপন্থী ধারার প্রতি সহনশীল ও উদার মনােভাব পােষণ।
(ঙ) উপমহাদেশে ইসলামী রেনেসাঁর অগ্রদূত হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) এর চিন্তাধারার অনুসারী ও অনুগামী হযরত কাসেম নানুতবী (রহ.) ও হযরত রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ) প্রমুখ আকাবিরে দেওবন্দের চিন্তা-চেতনার অনুসরণ এবং তা’লীম তরবিয়াতসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতি, আদর্শ ও কর্মপদ্ধতি অনুসরণ।
(চ) আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি’আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ কর্তৃক প্রণীত নেসাবে তা’লীম (পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচি), শিক্ষা, গবেষণা, প্রশিক্ষণ, ভৌত অবকাঠামাে নির্মাণ, মাদরাসা পরিচালনা ইত্যাদিতে প্রভাবমুক্ত থাকিয়া স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বজায় রাখা।

(৩) “কো-চেয়ারম্যান” অর্থ আল-হাইআতুল উলয়ার কো-চেয়ারম্যান।
(৪) “চেয়ারম্যান” অর্থ আল-হাইআতুল উলয়ার চেয়ারম্যান।
(৫) “দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল)” অর্থ কওমি মাদরাসার স্নাতকোত্তর ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি)-এর সমমান।
(৬) “বিধি” অর্থ এই আইনের অধীন প্রণীত বিধি;
(৭) “সদস্য” অর্থ আল-হাইআতুল উলয়ার কোনাে সদস্য।

৩। আইনের প্রাধান্য। – আপাতত বলবৎ অন্য কোনাে আইনের যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের বিধানাবলী প্রাধান্য পাইবে।

৪। বাের্ড। ‘আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি‘আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ এর অধীন নিম্নবর্ণিত অনুর্ধ্ব ৬টি কওমি মাদরাসা শিক্ষা বাের্ড থাকিবে, যথা :
(ক) বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ।
(খ) বেফাকুল মাদারিসিল কওমিয়া গওহরডাঙ্গা বাংলাদেশ।
(গ) আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশ।
(ঘ) আযাদ দ্বীনি এদারায়ে তালীম বাংলাদেশ।
(ঙ) তানযীমূল মাদারিসিদ দ্বীনিয়া বাংলাদেশ।
(চ) জাতীয় দ্বীনি মাদরাসা শিক্ষাবাের্ড বাংলাদেশ।

৫। আল-হাইআতুল উলয়ার কার্যালয়। আল-হাইআতুল উলয়ার প্রধান কার্যালয় থাকিবে ঢাকায় এবং প্রয়ােজনে, বাংলাদেশের যে কোন স্থানে উহার আঞ্চলিক বা শাখা কার্যালয় স্থাপন করা যাইবে।

৬। আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ এর কমিটি।— (১) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ১৩-০৪-২০১৭ খ্রিস্টাব্দ তারিখে ৩৭.০০.০০০০.১১৮.২০.০০৫.১৭-১২১ নম্বর স্মারকমূলে জারীকৃত প্রজ্ঞাপনের আলােকে ‘আলআতুল উলয়া লিল-জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ এর নিম্নরূপ একটি কমিটি থাকিবে। যথা : (ক) চেয়ারম্যান: বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ-এর সভাপতি (পদাধিকার বলে)।
(খ) কো-চেয়ারম্যান: সিনিয়র সহ-সভাপতি, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (পদাধিকার বলে)।
(গ) বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ এর ৫জন সদস্য (পদাধিকার বলে মহাসচিসহ অথবা বাের্ড কর্তৃক মনােনীত)।
(ঘ) বেফাকুল মাদারিসিল কওমিয়া গওহরডাঙ্গা বাংলাদেশ এর ২জন সদস্য (পদাধিকারবলে সভাপতি ও মহাসচিব অথবা বাের্ড কর্তৃক মনােনীত)।
(ঙ) আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশ এর ২জন সদস্য (পদাধিকার বলে সভাপতি ও মহাসচিব অথবা বাের্ড কর্তৃক মনােনীত)।
(চ) আযাদ দ্বীনি এদারায়ে তালিম বাংলাদেশ এর ২জন সদস্য (পদাধিকার বলে সভাপতি ও মহাসচিব অথবা বোর্ড কর্তৃক মনােনীত)।
(ছ) তানজিমুল মাদারিসিদ দ্বীনিয়া বাংলাদেশ এর ২জন সদস্য (পদাধিকার বলে সভাপতি ও মহাসচিব অথবা বাের্ড কর্তৃক মনােনীত)।
(জ) জাতীয় দ্বীনি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড, বাংলাদেশ এর ২জন সদস্য (পদাধিকার বলে সভাপতি ও মহাসচিব অথবা বাের্ড কর্তৃক মনােনীত)।

(২) চেয়ারম্যান প্রয়োজনে, যে কোনাে সংখ্যক সদস্যকে কমিটিতে কো-অপট করিতে পারিবেন; তবে উক্ত সংখ্যা ১৫জনের অধিক হইবে না ।
(৩) অন্যূন এক-তৃতীয়াংশ সদস্যের উপস্থিতিতে কমিটির সভার কোরাম পূর্ণ হইবে।
(৪) দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল)-এর সিলেবাস প্রণয়ন, পরীক্ষা পদ্ধতি, পরীক্ষার সময় নির্ধারণ, অভিন্ন প্রশ্নপত্র পণয়ন, উত্তরপত্র মূল্যায়ন, ফলাফল ও সনদ তৈরীসহ আনুষাঙ্গিক কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে কমিটি এক বা একাধিক উপ-কমিটি গঠন করিতে পারিবে ।
(৫) কমিটি স্থায়ী কমিটি বলিয়া বিবেচিত হইবে এবং উহা দলীয় রাজনীতির উর্ধ্বে থাকিবে।

৭। দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল)-এর সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রির সমমান প্রদান। -শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ১৩-০৪-২০১৭ খ্রিস্টাব্দ তারিখের ৩৭.০০.০০০০.১১৮.২০.০০৫.১৭-১২১ নম্বর স্মারকমূলে জারীকৃত প্রজ্ঞাপনের পরিপ্রেক্ষিতে কওমি মাদরাসার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট বজায় রাখিয়া ও দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতিসমূহকে ভিত্তি ধরিয়া গঠিত আল হাইয়াতুল উলয়া লিল-জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ কর্তৃক প্রদত্ত কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল)-এর সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি)-এর সমমান এমনভাবে প্রদান করা হইল যেন উহা এই আইনের অধীন প্রদান করা হইয়াছে।

৮। শিক্ষা কার্যক্রম।—ধারা ৪ এ উল্লিখিত ‘আল হাইআতুল উলয়া লিল-জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ এর অধীন বাের্ডসমূহ ধারা ৬ এ উল্লিখিত কমিটি দ্বারা নিবন্ধিত কওমি মাদরাসাসমূহে দারুল উলুম দেওবন্দের নীতি, আদর্শ ও নিসাব (পাঠ্যসূচি) অনুসারে দাওরায়ে হাদিসের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হইবে।

৯। আল হাইআতুল উলয়া লিল-জামি‘আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ এর কমিটির কার্যাবলি। –
(১) ধারা| ৬ এ উল্লিখিত কমিটি নিম্নরূপ দায়িত্ব পালন করিবে, যথা :
(ক) কওমি মাদরাসাসমূহের দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল) সনদের শিক্ষার মান নিশ্চিতকরণ।
(খ) দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল) সনদ বিষয়ক যাবতীয় কার্যক্রমের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
(গ) দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল)-এর পরীক্ষা গ্রহণ ও তত্ত্বাবধায়ন।
(ঘ) দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল)-এর সিলেবাস প্রণয়ন, পরীক্ষা পদ্ধতি ও পরীক্ষার সময় নির্ধারণ, অভিন্ন প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, উত্তরপত্র মূল্যায়ন এবং ফলাফল ও সনদ তৈরীসহ আনুষাঙ্গিক কার্যক্রম পরিচালনা।
(২) কমিটি উহার কার্যক্রম সম্পর্কে, সময় সময়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করিবে।

১০। বিধি ও সংবিধি প্রণয়ন— এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণের স্বার্থে সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে এই আইনে উল্লিখিত যে কোন বিষয়ে কমিটি কর্তৃক বিধি ও সংবিধি প্রণয়ন করা যাইবে।

উদ্দেশ্য ও কারণ সম্বলিত বিবৃতি:

১। দেশে কওমি মাদরাসার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট বজায় রাখিয়া দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতিসমূহকে ভিত্তি ধরিয়া ‘আল হাইআতুল উলয়া লিল-জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ এর অধীন কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল)-এর সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি)-এর সমমান প্রদানের উদ্দেশ্যে একটি আইন প্রণয়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

২। কওমি মাদরাসার বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করিয়া এবং কওমি মাদরাসার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট ও স্বকীয়তা বজায় রাখিয়া দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতিসমূহকে ভিত্তি ধরিয়া ‘আল হাইআতুল উলয়া লিল-জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ এর অধীন কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল)-এর সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি)-এর সমমান প্রদানের উদ্দেশ্যে একটি আইন প্রণয়ন করা অতীব প্রয়ােজন ও যুক্তিযুক্ত।

৩। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার আলােকে কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল)-এর সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি)-এর সমমান আইন, ২০১৮” বিল আকারে প্রস্তাবক্রমে জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হইল।)

নুরুল ইসলাম নাহিদ
ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী।

১৩. স্বীকৃতি নিয়ে নানা বিশ্লেষণ:

কওমি শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমর্যাদা দেয়া নিয়ে বিশ্লেষকেরা নানা বিশ্লেষণ করছেন। নিচের স্তরগুলো বাদ দিয়ে শুধু মাস্টার্সের সনদ দেয়া বা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া কোনো সংস্থার অধীনে এ সনদ দেয়া বাস্তবসম্মত কি না, তা আলোচনায় ওঠে এসেছে। আবার নিচের স্তরের সনদ না পেয়ে শুধু মাস্টার্সের (দাওরায়ে হাদিস) সনদ কওমি শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবনে কতটুকু কাজ দেবে, তা নিয়েও কথা বলছেন কেউ কেউ। কয়েকটি দেশের দৃষ্টান্ত দিয়ে কওমি আলেমরা বলছেন, সরাসরি মাস্টার্সের সনদ দেয়া অযৌক্তিক হবে না। অবশ্য এজন্য সনদদাতা সংস্থাকে আইনগত মর্যাদা দিতে হবে। তবে সাধারণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাঠ্যক্রম সংস্কার করে নিচের স্তর থেকে পর্যায়ক্রমে উপরের স্তরের সনদ দেয়া যুক্তিযুক্ত। আমিও মনে করি মাদরাসা সিলেবাসকে যুগোপযোগী করে তুলতে হবে। মূল সিলেবাসের সাথে বাংলা, ইংরেজী, অংক, ইতিহাস, সমাজ ও বিজ্ঞান সংযুক্ত করে সময়ের চাহিদা ও দাবী পূরণ করার মধ্যদিয়ে নিচের বাকি ৫টি স্তরকেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ, নিচের স্তরগুলোতে স্বীকৃতি না পেলে যারা দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পারবে না, মধ্যখানে আটকে যাবে তারা নিশ্চয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর এ ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা হবে অনেক।

শেষ কথা :

স্বীকৃতির দাবী পূরণের জন্য অবশ্যই আমরা শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব। তবে শেখ হাসিনার এ স্বীকৃতি পেয়ে কওমীওয়ালাদের আবেগে বেসে যাওয়ার মতো কিছু নেই। ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে হেফাজত কর্মীদের হত্যা, হেফাজতে ইসলাম ও আল্লামা আহমদ শফীকে (দা. বা.) -কে নিয়ে জাতীয় সংসদে শেখ হাসিনার তিরস্কার ও শাপলা চত্বরে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি, হেফাজত কর্মীরা গায়ে রং মেখে শুয়েছিল বলে প্রধানমন্ত্রীর মিথ্যাচার সহজে ভুলে যাবার নয়। তাঁর প্রতি স্বীকৃতির কৃতজ্ঞতা যেমন থাকবে, তেমনি শাপলা চত্বরের জুলুমেরে অভিশাপও থাকবে।

কওমি মাদরাসার স্বতন্ত্র ও স্বাধীন বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে ও দারুল উলূম দেওবন্দের মূলনীতিসমূহকে ভিত্তি ধরে সরকার নিয়ন্ত্রিত কোন কমিটি, কমিশন, বিদ্যমান কারিকুলাম পরিবর্তন ও মাদ্রাসা পরিচালনায় কোনরূপ সরকারী হস্তক্ষেপ ছাড়া কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদের মাস্টার্স (ইসলামিক স্টাডিজ ও এবং আরবি) এর সমমানের দাবী অর্জিত হলেও সামনে রয়েছে কঠিন চ্যালেঞ্জ। স্বীকৃতি পেয়ে কওমি আপন স্বকীয়তা নিয়ে বেচে থাকতে পারবে কি না এ প্রশ্ন আজ কওমি অঙ্গনে।

আমি মনে করি কওমির স্বকীয়তা ও পবিত্রতা ধরে রাখার দায়িত্ব সরকারের নয়, এ দায়িত্ব কওমি অভিভাবকদের। কোন কারণে যদি কওমি তার স্বকীয়তা হারায় তাহলে সরকার নয়, অভিভাবকমহলকে জবাবদিহি করতে হবে। আপন স্বকীয়তা, ঐতিহ্য ও পবিত্রতা রক্ষার্থে অভিভাবকদের সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। স্বকীয়তা ও পবিত্রতা নষ্ট হয় সরকার কর্তৃক এমন কোন কাজ বা কর্মসূচী চাপিয়ে দেয়া হলে তা ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দিতে হবে। “আল-হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমীয়া বাংলাদেশ” নিয়ে বর্তমান প্রজন্মেরা বিজয়ের ‘স্বপ্ন’ দেখছে। সততা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও বিশ্বস্ততার সাথে, বিরামহীন প্রচেষ্টার মাধ্যমে যারা কান্ডারী তারা এ স্বপ্নকে ব্যাপক নিরাপত্তা দিয়ে নিয়ে যেতে হবে মঞ্জিলের শেষপ্রান্তে। আল্লাহ সেই তাওফিক দিন। আমীন।