ড্রাইভারকেও অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে ওরা আসে আমার স্ত্রীর কাছে

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জুন ০৪ ২০২১, ১৬:৩৭

আব্দুল্লাহ মায়মুন

(গত পর্বের পর থেকে)
আমাকে আমাদের গাড়ী থেকে টেনে বের করার সময় মাথা থেকে টুপি পড়ে যায়, এরপর যখন জোর করে তাদের মাইক্রোতে রাখে তখন আমার পায়ের জুতা খুলে গাড়ীর বাহিরে পড়ে যায়। পরক্ষণে আবার আমাদের গাড়ীতে যায়। গাড়ীতে তখন দু’টি মোবাইল ছিলো। একটি আমার অপরটি আমার স্ত্রী নুসরাতের। তারা নুসরাতের মোবাইলকে আমার মোবাইল মনে করে নিয়ে আসে। আমার শ্বশুরের সাথে এই মোবাইল দিয়েই কথা হয়। আর আমার মোবাইল আমাদের প্রাইভেট কারেই থাকে। মোবাইলটির কাভার কালো, অন্যদিকে রাতের অন্ধকার, এজন্যে হয়তো চিনতে পারে নি। এরপরে তারা ড্রাইভারকে অস্ত্রের মুখে তুলে নেয়। ড্রাইভার উঠতে চাই নি, সে অনেক শক্তি করে, এতে তার পরনের পাঞ্জাবি ছিড়ে যায়, পরে যখন তার কাঁধে পিস্তল রাখে তখন সে আর শক্তি করে নি। এরপর তাকে উঠিয়ে নেয়।
কিছুক্ষণ পর এরা আবার আসলো, তখন নুসরাতের কাছে ব্যানেটি ব্যাগ ছিলো সে এটি দিয়ে বলে, ‘আপনারা এগুলোর সব নিয়ে নেন, আর উনাকে(আমাকে) ছেড়ে দেন।’ ব্যাগটিতে তার কানের সোনার দুল, আমার দেওয়া হীরার আংটি ও পনের’শ টাকা ছিলো। কিন্তু অপহরণকারীরা এর কোনো জবাব দেয় নি, তারা ব্যানেটি ব্যাগ নিয়ে যায়।
.
নুসরাত শুরুতেই ভয় পেয়েছিলো, এখন তার ভয় আরো বেড়ে গেলো। সে নিজের করণীয়ের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে লাগলো। ভাবলো, হয়তো এরা আবার আসবে তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে, যদি তাকে ধরে নিয়ে যায় তাহলে না জানি কী হবে? এই মুহূর্তে সে নিজেকে নিরাপদ রেখে ঘটনার সাক্ষী হওয়া আবশ্যক। তখন সে গাড়ী থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করে, সে যে পাশে বসা ছিলো ওই পাশে গাড়ীর পিছনের সিটের দরোজার কী-তে হাত দেয়, কিন্তু খুলতে পারে না। কারণ এই দরোজা লক করা ছিলো, রাতের অন্ধকারে লক দেখে নি। একেক গাড়ীর লক একেক রকম হয়। কীভাবে খুলতে হয় তাও জানে না। তখন যে পাশে আমি বসা ছিলাম ওই পাশ দিয়ে সে অতি সতর্কতার সাথে বের হয়। বের হয়ে বসে বসে গাড়ীর ছায়া দিয়ে রাস্তার পাশে চলে যায়। এদিকে অপহরণকারীদের মাইক্রো গাড়ীটি স্থান ত্যাগ করে। গাড়ী ভাঙচুরের সময় অনেকে বাধা দিতে এগিয়ে আসলে তারা নিজেদেরকে র‍্যাবের লোক বলে পরিচয় দেয়, এজন্যে কেউ সাহায্য করতে পারে নি। তাই গাড়ীটি নিরাপদে স্থান ত্যাগ করে। অন্যদিকে ঘটনাস্থলে লোকেরা ভীড় করা শুরু করে। নুসরাত ছিলো রাতের প্রচন্ড অন্ধকারে গাড়ীর অন্যপাশে লুকানো। তখন সে শুনতে পায় লোকেরা বলাবলি করছে- ‘গাড়ীতে একজন মেয়ে লোকও ছিলো’। এতে নুসরাতের ভয় আরো বেড়ে গেলো। সে ভাবতে থাকে এরা হয়তো অপহরণকারী, এরা তাকেও অপহরণ করতে চাচ্ছে। রাস্তার পাশেই ছিলো ক্ষেতের জমি, গত কয়েকদিনের বৃষ্টির কারণে জমিতে সামান্য পানি হয়ে গেছে৷ এতে মাটিও কিছুটা নরম হয়ে গেছে। এদিকে ক্রমান্বয়ে নুসরাতের ভয় বেড়ে চলছে, এক সময় সে এই ভেজা জমি দিয়েই দৌড় শুরু করেছে, তখন উপস্থিত লোকেরা তাকে দেখতে পেয়ে পিছন থেকে ডাকতে শুরু করে। কিন্তু সে এগুলোর পাত্তা না দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে থাকে, ক্ষেতের জমির কাদা ও ছোপ ছোপ ময়লা পানিতে তার বোরকা, জুতা ও পা কর্দমাক্ত হয়ে যায়। একদিকে পিছন থেকে লোক তাকে ডাকতেছে, অন্যদিকে সে সামনে দৌড়াচ্ছে। অজানা গন্তব্যে, সে নিজেও জানে না কোনদিকে যাচ্ছে। হঠাৎ তার সামনে একজন বৃদ্ধ লোকের উদয় হয়। তিনি রাতের অন্ধকারে একটি বোরকাপরা মেয়েকে দেখে জিজ্ঞেস করেন, কী হয়েছে মা? কোথায় যাচ্ছো? তখন সে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, তারপর হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বলতে লাগে, ‘আমার হাজবেন্ডকে একদল লোক কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে। ওরা আমাকেও কিডন্যাপ করতে পারে এই ভয়ে দৌড়াচ্ছি।’ ইতোমধ্যে পিছন থেকে ধাওয়া করা লোকেরাও চলে আসে। তারা বলে, আমরা কিডন্যাপার নই, সাধারণ জনতা, যারা কিডন্যাপার তারা চলে গেছে। এভাবে ক্রমান্বয়ে ভীড় বাড়তে থাকে। তারা একটি দু’তলা বাড়ীর সামনে তাকে নিয়ে যায়, তাকে বাড়ীতে ঢুকতে বলে, সে ভয়ে ঢুকতে চায় না, না জানি কোন ফাঁদে পড়ে। তারা অভয় দিতে থাকে। এদিকে লোকেরা জিজ্ঞেস করতে থাকে সে কোথা থেকে আসছে? যাবে কোথায়?
তারা জানতে পারে তার মোবাইল নিয়ে নিছে, তাই তারা কোনো আত্মীয়ের ফোন নম্বর চায়, কিন্তু সে কোনোটারই সদুত্তর দিতে পারে না। ঠিকানার ক্ষেত্রে একটা শুদ্ধ বললে অন্যটা ভুল বলতে থাকে, দেশের কারো ফোন নম্বরও তার মুখস্ত নেই। এদিকে লোকের সংখ্যা বাড়তেছে, অন্যদিকে উপস্থিত জনতার সন্দেহের তীর তার দিকে নিবদ্ধ হচ্ছে, সবাই অবাক হয়ে যায়, প্রাপ্ত বয়স্ক একটা মেয়ে কীভাবে নিজের পূর্ণ ঠিকানা বলতে পারে না? কেনো তার কাছে কোনো আত্মীয়-স্বজনের ফোন নম্বর থাকবে না। তখন সে বলতে বাধ্য হয়, ‘আসলে আমি ইংল্যান্ড থেকে এসেছি, দেশে আসার বেশি দিন হয় নি, তাই কারো ফোন নম্বরও জানা নেই, দেশের কোনো ঠিকানাই ভালোভাবে বলতে পারি না। হাজবেন্ডের সাথে বেড়াতে বের হয়েছি, পথিমধ্যেই এ দুর্ঘটনা’!

এসব কথাবার্তাই হয় বাড়ীটির সামনে, লোকেরা তাকে বার বার বাড়ির ভেতর ঢুকতে বলে, সে যখন ঢুকতে অস্বীকার করে তখন অনেকে উত্তেজিত হয়ে বলতে থাকে, বাড়ী না ঢুকায় লোকের ভীড় ক্রমশ বাড়তেছে। এরপর সে বাড়ীতে ঢুকে।

বাড়িতে ঢুকার পরপরই শুরু হয় উপর্যুপরি প্রশ্নের বাণ! কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে, তোমার স্বামীকে ধরলো, তোমাকে কেন ধরলো না? কেউ আবার জিজ্ঞেস করে তোমার স্বামীকে ধরার পর তুমি কেন কান্না করতেছো না?
অথচ নুসরাত অনেকক্ষণ কান্না করেছে, কিন্তু চেহারায় কালো নেকাব ও চোখে চশমা আর শীতের কারণে চমশার গ্লাসে কুয়াশা থাকায় ভালোভাবে বোঝা মুশকিল। এভাবে আজগুবি প্রশ্নের দ্বারা তাকে বেসামাল করে দেওয়া হয়। তখন একজন তাকে আমার মোবাইল এনে দেয়। সে বলে গাড়িতে নাকি আমার মোবাইল পাওয়া গেছে।

কিডন্যাপাররা তার মোবাইল আমারটা মনে করে নিয়ে নেয় আর আমারটা গাড়ীতে পড়ে থাকে। ওইটাই লোকেরা এনে তাকে দেয়। এই মোবাইলের মাধ্যমেই সে আমার শ্বশুরের সাথে কথা বলে, শ্বশুর ঘটনা চলাবস্থায় ফোনে জানতে পারায় তিনি তখনই গহরপুর থেকে আমাদের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গিয়েছিলেন। তাই নুসরাত বাড়িটিতে উঠার প্রায় ত্রিশ মিনিট পরেই তিনিও এসে উপস্থিত হন। রাত তখন বারটা হবে হয়তো। তিনি আসায় নুসরাতের প্রাণে পানি আসে। উপস্থিত জনতার বাকী প্রশ্নগুলোর উত্তর তিনিই দিতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর স্থানীয় চেয়ারম্যান আসে। এরপরে থানার পুলিশ আসে। তারা নুসরাতকে এবং আমার শ্বশুরকে পুলিশের গাড়ীতে উঠে বসতে বলে। নুসরাত তখন আমার পড়ে যাওয়া টুপি এবং পায়ের জুতা সংগ্রহ করে। প্রচন্ড ভীড়ে, মানুষের কোলাহলে আমার বিয়েতে পাওয়া সু’টা হারিয়ে যায়, কিন্তু টুপি নুসরাত সংগ্রহ করে রাখে। এরপরে গাড়ীতে উঠে আমার শ্বশুর ও নুসরাত বসে।

ইতিমধ্যে দেশে-বিদেশে অবস্থানরত আমাদের আত্মীয়-স্বজন ঘটনার ব্যাপারে জানতে শুরু করেন। তাদের কেউ কেউ আমার ফোনে আর কেউ কেউ আমার শ্বশুরের মোবাইলে ফোন দিতে থাকেন। ইংল্যান্ডে অবস্থিত আমার আম্মা-আব্বা, ভাই-বোন ব্যাকুল হয়ে উঠেন।

নুসরাতের বয়স যখন তিন বছর তখন তার মা আমার শ্বাশুড়ি উনার ভাইদের প্রচেষ্টায় লন্ডন চলে যান। আমার শ্বাশুড়ির আব্বা অর্থাৎ আমার নানাশ্বশুর বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ছিলেন। তিনি তার ছাত্রাবস্থায়ই আপন খালাত ভায়ের সাথে এপ্লাই করে ইংল্যান্ড চলে যান।সেই সুবাদে আমার শ্বাশুড়িও লন্ডন যান। প্রথমে শুধু আমার শ্বাশুড়ি (তার বড় ভাইয়ের সাহায্যে ছোট ভাইয়ের সাথে ২০০২ সালে) একা লন্ডন যান। এর পাঁচ বছর পর ২০০৭ সালে উনার মাধ্যমেই আমার শ্বশুর, সমন্ধী ও নুসরাত লন্ডন যায়। সেভাবে তিন বছর বয়েসেই নুসরাত মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হয়। তখন আমার শ্বশুরই নুসরাতের মা এবং বাবার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। আমার শ্বশুর তখন তাদের গ্রামের বাড়ী সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুরে থাকতেন। ঘরে ছিলেন নুসরাতের দাদু-দাদীমণি এবং অবিবাহিত দুইজন ফুফু ও চাচা। এদের আদর-সোহাগেই নুসরাত তিন বছর থেকে আট বছর বয়সে উত্তীর্ণ হয়। বাবা-চাচা, দাদা-দাদী এবং দুই ফুফু আপ্রাণ চেষ্টা করেন যাতে নুসরাত কখনো মায়ের অনুপস্থিতি অনুভব না করেে। কিন্তু মা তো মা-ই, মায়ের অভাব কি মাসি দ্বারা পূর্ণ হয়? যাই হোক, আদর-যত্নের ক্ষেত্রে উনারা নুসরাতের কোনো চাহিদা অপূর্ণ রাখতে দেননি।

আমার শ্বশুরের মাত্র দু’জন সন্তান। একজন ছেলে অন্যজন মেয়ে। ছেলে বড় এবং মেয়ে ছোট। দুই ভাই-বোনের মধ্যে আট বছরের ব্যবধান। শ্বশুরের কাছে মেয়েই বেশি আদরের। তিনি প্রকাশ্যেই বলেন, অন্যদের কাছে ছেলেরা হয় ডান পা এবং মেয়ে হয় বাম পা, কিন্তু আমার জন্যে মেয়ে হচ্ছে ডান পা। ছোটকাল থেকে বিয়ের আগ পর্যন্ত কখনো নিজের আদুরে মেয়েকে চোখের সামনে থেকে আড়াল হতে দেননি, কোথাও একা যেতে দেননি। প্রবাসে অবস্থিত মাবিহীন মেয়ের কোনো চাহিদাই অপূর্ণ রাখেননি৷ মেয়ের পায়ে কোনো কাটা বিঁধলে মনে হয় কাটাটি বাবার অন্তরে বিঁধেছে। লন্ডন যাওয়ার সাত বছর পর নুসরাত বাবা ভাইসহ ২০১৫ সালে দেশে আসে। মাসখানেক থাকার পর আবার লন্ডন চলে যায়। এরপর ২০১৮ সালের মার্চ মাসে বাবা-মা এবং বড় ভাইসহ দেশে আসে। ওই বছরই ২রা এপ্রিল আমার সাথে তার বিয়ে হয়। বিয়ের আড়াই মাস পর বাবা-মায়ের সাথে ইংল্যান্ড চলে যায়। এর সাত মাস পর ২০১৯ সালের ১৮ জানুয়ারিতে বাবার সাথে দেশে আসে, ওই সময়েই ৫ মার্চ ঘটে এই দুর্ঘটনা। বেদনাবিধুর ৫ মার্চ! নিজের চোখের সামনেই একদল বন্দুকধারী তার স্বামীকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। স্বামী, বাবা এবং মাহরাম ছাড়া যে মেয়ে কখনো কোনো পুরুষের সাথে একা কথা বলেনি, আজ তাকেও নিজের ইজ্জত-আব্রুর হেফাজতে রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে একা একা ক্ষেতের জমিতে দৌড়াতে হল, অপরিচিত বিভিন্ন পুরুষ কন্ঠের তির্যক মন্তব্য শুনতে হলো।

পুলিশের গাড়ীতে বসার পর তারা আউশকান্দি গ্যাস পাম্পে যায়। এখান থেকেই আমাদের প্রাইভেট গাড়ীতে গ্যাস ভরা হয়। তখন পুলিশ পাম্পে জীপের মধ্যে নুসরাত ও আমার শ্বশুরকে বসিয়ে রাখে। প্রায় দুই ঘন্টা।এরপর তারা তাকে পাম্পের সিসিটিভি রূমে নিয়ে যায়। সেখানে ভিডিও দেখিয়ে নুসরাতকে জেরা করা শুরু করে। আমার শ্বশুরের মোবাইল এবং নুসরাতের কাছে থাকা আমার মোবাইল তদন্তের নামে পুলিশ নিয়ে নেয়। পরে শ্বশুরের মোবাইল দিলেও আজ পর্যন্ত আমার মোবাইল দেয়নি। তারা জিজ্ঞাসাবাদের নামে নুসরাতকে এমন সব প্রশ্ন করতে থাকে যেগুলো প্রকাশ করাও লজ্জাকর, তারপরও লিখতে হচ্ছে। তারা বিভিন্ন ভিডিও দেখায়, বিভিন্ন পুরুষের ছবি নুসরাতকে দেখিয়ে বলে, এদেরকে চিনে কিনা? সে বলে, আমি চিনি না, পুলিশ বলে, অপহরণের সাথে ড্রাইভার জড়িত। তুমিও ড্রাইভারের সাথে মিলে তোমার স্বামীকে অপহরণ করাতে পারো!
এ কথাগুলো যখন নুসরাতের কান দিয়ে ঢুকছিলো, তখন তার কাছে মনে হল, কথা নয় বরং আগুনের বাতাস তার কান দিয়ে ঢুকছে! যে স্বামীর ভালবাসা তার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে বিরাজমান, যার প্রেমে তার প্রতি অংশ-প্রত্যংশ কাতর, তার ব্যাপারেই এরকম অপবাদ!

যাই হোক, তখন সে জবাব দিয়ে বলে এদের কাউকেই চিনে না। ড্রাইভারের নামও জানে না। এই ড্রাইভারকে এই প্রথম দেখেছে। সে আরও বলে, আপনারা কী বলতেছেন? একপর্যায়ে তার গলার আওয়াজ উত্তেজিত হয়ে যায়। ওই সময় আমার শ্বশুর তাকে ঠান্ডা হতে বলেন। আর বলেন, তারা যা জানতে চায় স্থিরভাবে যেন এগুলোর উত্তর দেয়।
পুলিশ শুধু নুসরাতকে সন্দেহ করেনি, বরং আমার শ্বশুরকেও সন্দেহ করা শুরু করে। তারা আমার শ্বশুরকে বলে, আপনি এত তাড়াতাড়ি জানলেন কীভাবে? আপনিও সন্দেহ থেকে মুক্ত নন। নিশ্চয় ঘটনার পিছনে আপনার হাত আছে। তখন শ্বশুর বলেন, আমি ফোন দিয়েছিলাম! এভাবে তারা একের পর এক নিচুমনা ও ঘৃণ্য সব প্রশ্ন করতে থাকে। এভাবে এই গ্যাস পাম্পেই রাত ফুরিয়ে যায়। পরে সকাল ছয়টার সময় নবীগঞ্জ থানার উদ্দেশ্যে গাড়ীটি রওনা দেয়। এক সময় নুসরাত এবং আমার শ্বশুরকে থানায় বসানো হয়। তাদের জন্যে একটি রূম দেওয়া হয়। নুসরাত বলে সে ইশার নামায পড়েনি, তাকে নামাযের প্রস্তুতি স্বরূপ অজু-ইস্তিঞ্জার জন্যে একটি বাথরুম দেখিয়ে দেওয়া হয়। সে বলে, এরকম নোংরা-বিচ্ছিরি পরিবেশ একটি থানার হয় কীভাবে? যাক, অজু সম্পন্ন করে ইশার সালাত আদায় করে।

আরো পড়ুন: মিহনা: গুম জেল রিমান্ডের ৬৪১ দিন

ঘটনাস্থল আউশকান্দি থেকে আমার বাড়ী, নানাবাড়ী এবং নুসরাতের বাড়ী অনেক দূরে। দূরত্ব প্রায় ২৫-৩৫ কিলোমিটার হবে। এই আউশকান্দি থেকে আমাদের সবচেয়ে নিকটতম আত্মীয়ের বাড়ী হচ্ছে সিলেটের উসমানীনগর থানাধীন উমরপুর ইউনিয়নের খুজগীপুর গ্রাম৷ এখানেই আমার দ্বিতীয় খালার বাড়ী। এই খালা আমাকে অনেক স্নেহ করেন। আমার জন্মের সময় এই খালা উপস্থিত ছিলেন। দাইমার ভূমিকা পালন করেন। আমার আম্মা আমাকে বলেন, আমি যেনো এই খালার যত্ন নেই। খালা তখন ছিলেন খুব অসুস্থ, একেবারে মৃত্যুশয্যায় শায়িত৷ কিছুদিন পর আমি গুম থাকাবস্থায়ই তিনি ইন্তেকাল করেন। এই খালার দ্বিতীয় ছেলে আব্দুল আউয়াল শাহেদ ভাই ঘটনা শুনেই রাতে আউশকান্দিতে যান। তিনি অনেক বিচক্ষণ মানুষ। দূরত্বের কারণে আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে আর কেউই এত রাতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হতে পারেননি।

ভোর হতেই আমাদের শ্বশুর বাড়ীর লোক, নানাবাড়ী থেকে আমার মামী এবং মামাত ভাই ও ড্রাইভার আব্দুর রহিমের পরিবারের সদস্য আর আমার গ্রাম থেকে আমার বড়ভাই, দুলাভাই এবং চাচা এলাকার মেম্বারসহ উপস্থিত হন। এভাবে তিন জায়গা থেকে আমাদের অনেক আত্মীয় থানায় যান। ওইসময় দেশে-বিদেশে আমাদের সব আত্মীয়-স্বজনের ভেতরে এক অশান্তি বিরাজ করছিলো। সবাই ব্যাকুল। নুসরাতকে থানায় আটক করায় সবার মধ্যে একধরনের অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে আমি ও ড্রাইভার অপহৃত, অন্যদিকে নুসরাত থানায় আটক। তাই সবাই আমার কথা ভুলে নুসরাতকে কীভাবে উদ্ধার করা যায় এই চিন্তায় পড়ে যায়। এই সময় পুলিশ চরম নোংরা ‘রাজনীতি’ শুরু করে। আমাদের পরিবারের সদস্যদেরকে বলে আমাকে অপহরণের পিছনে ড্রাইভারের হাত আছে। অন্যদিকে ড্রাইভারের পরিবারের সদস্যদের বলে, আমাদেরকে অপহরণের পিছনে আমার শ্বশুর ও নুসরাতের ইন্ধন আছে। আমাদেরকে খোঁজা বাদ দিয়ে ঘটনা অন্যদিকে ঘুরানোর চেষ্টা করে এই পুলিশ। এর ফলে আমার শ্বশুরের পরিবার এবং ড্রাইভার পরিবারের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি শুরু হয়।

চলবে…