আল-আযহার থেকে সর্বোচ্চ ফলাফল নিয়ে পিএইচডি সম্পন্ন কওমী আলেম হাসিবের

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জানুয়ারি ১২ ২০২২, ০০:৪৭

তাওহীদুল ইসলাম, মিশর প্রতিনিধি: 

গতকাল ১০ই জানুয়ারি ২০২২ আয়োজিত হয় আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী শিক্ষার্থী ডক্টর মুহাম্মাদ হাসিবুর রহমান আযহারীর পিএইচডি থিসিস ডিসকাশন অনুষ্ঠান। তিনি ২০০৭ সাল থেকে অদ্যাবধি দীর্ঘ প্রায় ১৪ বছর যাবত আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করে আসছেন। ফ্যাকাল্টি অফ ইসলামিক স্টাডিজ এন্ড এরাবিক থেকে ২০১১ সালে তিনি কৃতিত্বের সাথে গ্রাজুয়েশন সমাপ্ত করেন। এক্সিলেন্ট রেজাল্টের সাথে ২০১৪ সালে সমাপ্ত করেন পোস্ট গ্রাজুয়েশন। ২০১৭ সালে সম্পন্ন হয় তার এমফিল গবেষণা। এভাবে তিনি পৌঁছে যান আন্তর্জাতিক শিক্ষাধারার চূড়ান্ত পর্বে।

২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে আল – আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অফ ইসলামিক স্টাডিজ এন্ড এরাবিক এর উসুলুদ্দিন ডিপার্টমেন্ট এর অধীনে পিএইচডি গবেষণার জন্য নাম নিবন্ধন করেন তিনি। তার গবেষণার বিষয়বস্তু ছিলো “ইমাম শাফেয়ি রহ. ও ইমাম ত্বহাবি রহ. এর মানহাজ : বিধানসম্বলিত আয়াতসমূহের তাফসিরে উভয়ের বক্তব্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণ।”
দীর্ঘ তিন বছর নয় মাসের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে পূর্ণতা পায় তার এ দুর্লভ গবেষনাটি। গবেষণার এ সময়ে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিদগ্ধ তাফসিরবিদ ও ইসলামি স্কলারদের সাথে মতবিনিময় করেন। তাদের থেকে আহরণ করেন তাফসির ও উলুমুল কুরআন শাস্ত্রের বিভিন্ন শাখার জ্ঞান। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য শরণাপন্ন হন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গ্রন্থাগারের। উদ্ধার করেন তাফসিরসহ সংশ্লিষ্ট ইসলামি বিভিন্ন জ্ঞান-শাস্ত্রের বহু দুর্লভ পান্ডুলিপি। তুরস্কের মুরাদ মোল্লা গ্রন্থাগার থেকে সংগ্রহকৃত ইমাম শাফেয়ি রহ. এর আহকামুল কুরআন যার মধ্যে অন্যতম। এভাবে দীর্ঘ অধ্যবসায় ও সাধনার মাধ্যমে পূর্ণতা পায় আল-আযহারের সর্বোচ্চ মান অর্জনকারী তার কালজয়ী এ পিএইচডি থিসিসটি।

ডক্টর হাসিবুর রহমান আযহারীর পিএইচডি থিসিস গবেষণার প্রধান সুপারভাইজার ছিলেন ডক্টর যাকি মুহাম্মাদ আবু সারি (সাবেক অধ্যাপক: তাফসির ও উলুমুল কুরআন বিভাগ)। সহকারী সুপারভাইজার ছিলেন ডক্টর আব্দুল জাওয়াদ খলফ মুহাম্মাদ আব্দুল জাওয়াদ (সাবেক অধ্যাপক: ইসলামি আইন অনুষদ)। এছাড়াও আরো দুজন বিখ্যাত মিশরীয় তাফসিরবিদ তার গবেষণা থিসিসের পর্যবেক্ষক ছিলেন। তারা হলেন, উসুলুদ্দিন অনুষদের তাফসির ও উলুমুল কুরআন বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর মুহাম্মাদ সলাহ শাদ্দাদ ও ডক্টর সায়্যিদ আব্দুল হামিদ ফাতহুল বাব। এ চারজন বিদগ্ধ আলেমের উপিস্থিতিতেই অনুষ্ঠিত হয় তার পিএইচডি থিসিস ডিসকাসন।

গত সোমবার অনুষ্ঠিত এ থিসিস ডিসকাশন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন আল-আযহারে অধ্যয়নরত কওমী শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ‘আযহার ওয়েলফেয়ার সোসাইটি, মিশরের কায়রোতে অধ্যয়নরত সকল বাংলাদেশী শিক্ষার্থীর সম্মিলিত প্লাটফর্ম ‘বাংলাদেশ স্টুডেন্ট অর্গানাইজেশন’ এর দায়িত্বশীল ও সদস্যবৃন্দসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দুই শতাধিক শিক্ষার্থী। ডিসকাশারগণ তাঁর গবেষণা থিসিসের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তাঁর থিসিসের প্রধান সুপারভাইজার ও সহকারী সুপারভাইজার তার অধ্যবসায় ও সাধনার প্রতি ছিলেন রীতিমত মুগ্ধ; যা তাদের রকমফের প্রশংসাবাক্যের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠছিলো। গবেষক ডক্টর মুহাম্মাদ হাসিবুর রহমান আযহারী ডিসকাশার প্যানেলে উত্থাপিত সবগুলো প্রশ্নেরই জ্ঞানগর্ভ উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলেন। ডক্টরগণ এ থিসিস ডিসকাশনকে তাদের জীবনের অন্যতম একটি থিসিস ডিসকাসন আখ্যায়িত করেন।

তাঁরা মুহাম্মদ হাসিবুর রহমানকে তাঁর গবেষণা থিসিসটির দুটি নুসখা দুই রকম ভার্সনে বিভক্ত করে বর্ধিত কলেবরের নুসখাটি বাংলাদেশ ও ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমদের নিকট পৌঁছে দিতে বলেন এবং পরিমার্জিত নুসখাটি প্রকাশনার জন্য আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিতে বলেন। তাফসীর ও উলুমুল কুরআন শাস্ত্রে তার এ সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ফলাফল তথা “মারতাবাতুশ শারফিল উলা মাআত তাওসিয়াতি বিতাবয়ির রিসালাতি ওয়া তাদাউলিহা বাইনাল জামিআতিল উখরা (সর্বোচ্চ সম্মানজনক স্থান ও থিসিসটি আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক মুদ্রণ এবং মুদ্রিত কপি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেরণের নির্দেশ) প্রদান করা হয়।

উল্লেখ্য, ডক্টর মুহাম্মাদ হাসিবুর রহমান আযহারী আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের তাফসীর ও উলূমুল কুরআনের উপর ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জককারী সর্বপ্রথম বাংলাদেশী শিক্ষার্থী। বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলার সদর থানার অধীনস্থ হরিণখানা গ্রামে ১৮ই ডিসেম্বর ১৯৮১ সালে তার জন্ম। তার পিতা মুহাম্মাদ আব্দুল হাকিম একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়।

পারিবারিকভাবেই তার প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তিনি ১৯৯৫ সালে গওহরডাঙ্গা মাদরাসা থেকে হিফজুল কুরআন সমাপ্ত করেন। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত মাদরাসাতুল মাদীনায় কিতাব বিভাগে অধ্যয়ন করেন। জামিয়া শরইয়্যাহ মালিবাগ থেকে ২০০২ সালে কৃতীত্বের সাথে দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করে ভর্তি হন বাংলাদেশের সুপ্রশিদ্ধ ইসলামি জ্ঞান – গবেষণা কেন্দ্র মাররকাজুদ দা’ওয়ায়। এখানে তিনি উলুমুল হাদিস, ইফতা ও সোহবাতুশ শাইখসহ দীর্ঘ পাঁচ বছর উচ্চতর গবেষণায় রত থাকেন। এরপর উস্তায মাওলানা আব্দুল মালেক দা.বা. এর দিকনির্দেশনায় তিনি তৎকালীন আল-আযহারের সাথে মুআদালা চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের পটিয়া মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদীসের সনদ অর্জন করে ২০০৭ সালে ইলমের ভূমি মিশরে আগমন করেন। আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের শুরু থেকে তাঁর অর্জিত অসাধারণ কৃতিত্বে মুগ্ধ হয়ে ইতোপূর্বে মিশরস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসও তাকে প্রদান করেছে “বিশেষ দূতাবাস সম্মাননা”।

ডক্টর হাসিবুর রহমান আযহারীর থিসিস ডিসকাশন পরবর্তী ফলাফল প্রকাশ পেতেই মিশরস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের মান্যবর রাষ্ট্রদূত জনাব মনিরুল ইসলাম তাঁকে অভিবাদন জানিয়ে বলেন, “আমার আন্তরিক অভিনন্দন ও গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি ডক্টর হাসিবুর রহমানকে। তিনি শুধু নিজের, পরিবারের ও বন্ধু-স্বজনদেরই নয়, বরং সমগ্র বাংলাদেশেরই গৌরব ও সম্মান সমৃদ্ধ করেছেন! মিশরের মাটিতে এসকল হাসিবরা আমার দেশের গর্বিত সন্তান!”: (লেখা তৈরি: আবদুর রহমান, শিক্ষার্থী: আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়)