অবতরণিকা : আল্লামা তাফাজ্জুল হক রাহ. একটি নাম। একটি প্রতিষ্ঠান। একটি চিন্তা। বর্তমান বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির আলিমদের একজন। বৃহত্তর সিলেট বিভাগের আলিমকূল শিরোমণি। এক বর্ণাঢ্য ও সমৃদ্ধ জীবনের অধিকারী। দাওয়াত-তাবলিগ, ওয়াজ-নসিহত, সমাজ সংস্কার, শিক্ষকতা, রচনা ও রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে রয়েছে তাঁর সরব পদচারণা। তাঁর এই সমৃদ্ধ জীবনের উপর ‘থিসিস পেপারস’ তৈরি হওয়া উচিত। আর নচেৎ তার জীবনী-লেখা অপূর্ণ থেকে যাবে। তদুপরি “মা লা য়ুদরাকু কুল্লুহু লা য়ুতরাকু কুল্লাহু” (পুরোপুরি না পারলেও পুরোটাই না ছাড়া, অল্প হলেও করা) নীতির ভিত্তিতে এখানে হযরতের জীবনী সম্বন্ধে সংক্ষেপে আরজ করা হল।
এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক যে, হযরতের জীবনীর উপর বক্ষ্যমাণ লেখাটি প্রস্তুত হওয়ার পর হযরত লেখাটি আদ্যোপ্রান্ত পড়েছেন। কিছু কিছু স্থানে প্রয়োজনীয় সংশোধনীও দিয়েছেন। আল্লাহ পাক হয়রতকে দীর্ঘায়ু দান করুন। আমাদেরকে হযরত জীবনী থেকে উপকৃত হওয়ার তৌফিক দান করুন।
পিতা : মাওলানা শাইখ আব্দুন-নূর রহ.(মৃত: ১৯৯৮ইং)
জন্ম : ১৩৫৯হি. মোতাবেক ১৯৩৮ই.।
ইন্তেকাল: ৫ জানুয়ারি ২০২০ ঈসায়ি।
জন্মস্থান : হবিগঞ্জ শহরের অদূরে ‘কাটাখালী’ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মলাভ করেন। তাঁর পিতা শাইখ আব্দুন-নূর রহ.ছিলেন বিজ্ঞ আলিম ও সমাজ সংস্কারক। শাইখ তাফাজ্জুল হক রাহ. এর নানা হলেন, আল্লামা আসাদুল্লাহ রহ.। তিনি বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম সারির একজন মুজাহিদ ছিলেন। হবিগঞ্জ এলাকার বিশিষ্ট সমাজ সেবক ও সমাজ সংস্কারকও ছিলেন।
পরিবার : শাইখ তাফাজ্জুল হক রাহ. তাঁর পাঁচ ভাইদের মাঝে তিনিই বড়। তাঁর অন্যান্য ভাইও নিজ নিজ ময়দানে সফল ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
পড়াশোনা : অন্যদের মত তাঁরও পড়াশোনার হাতেখড়ি পিতা-মাতার কাছেই। পিতা শাইখ আব্দুন-নূর রহ. ছিলেন একজন বিজ্ঞ আলিম ও সফল শিক্ষক। এরপর তিনি হবিগঞ্জের অদূরে রায়ধর গ্রামের ঐতিহাসিক মাদরাসা ‘জামিয়া সা’দিয়্যায়’ ভর্তি হন। সেখানে তিনি তাঁর মামা আল্লামা মুখলিসুর রহমান রহ.(মৃত ১৪২২হি.) এর নিকট আরবী ব্যাকরণ ও আরবিভাষা রপ্ত করেন। তাঁর মামা ছিলেন শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.এর ছাত্র। এ এলাকার এক সময়ের সফল চেয়ারম্যানও ছিলেন। এ কারণে তিনি নিজ এলাকায় ‘চেয়ারম্যান সাহেব’ নামেও পরিচিত। তাঁর নানার মত তাঁর মামাও বড় মুজাহিদ ছিলেন। বাতিলের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার ছিলেন। সমাজ সংস্কারে তাঁরও অসামান্য ভূমিকা রয়েছে।
পড়ালেখার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম গমন : প্রাথমিক স্তরের পড়াশোনা শেষ করে তিনি উপমহাদেশের বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘জামিয়া আহলিয়্যা মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসা’ চট্টগ্রামে গমন করেন। সেখানে তিনি ফিক্হ, উসূলে ফিক্হ, তাফসীর, উসূলে তাফসীর, হাদীস ও উসূলে হাদীস, মানতেক-ফালসাফাসহ ইসলামের বিভিন্ন শাখার গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করেন। এখানে তিনি মুফতী আযম মুফতী ফায়যুল্লাহ রহ. এর বিশেষ সান্নিধ্য লাভে ধন্য হন। ছাত্র হিসাবে তিনি প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন। উস্তাযদের প্রিয় পাত্র ছিলেন। ছাত্র যামানায় সর্বদা পড়াশোনাকে প্রাধান্য দিতেন। সময় নষ্ট করা থেকে সযত্নে থাকতেন। ক্লাসের বাইরে লাইব্রেরীতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অধ্যয়নে মগ্ন থাকতেন।
অবশেষে হাটহাজারী মাদরাসা থেকে ১৯৬০-৬১ইং সনে ‘দাওরায়ে হাদীস’ সফলতার সাথে সম্পন্ন করেন।
উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান গমন : জ্ঞান আহরণের সুতীব্র আকাঙ্খায় কিশোর তাফাজ্জুল ছুটে এসেছেন বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। সবশেষ পাড়ি জমিয়েছেন তৎকালীন সূদুর পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখানে ঐতিহাসিক ইসলামী বিদ্যাপিঠ ‘জামিয়া আশরাফিয়া লাহোর’-এ আরো গভীরভাবে হাদীস অধ্যয়নের জন্য দ্বিতীয়বার দাওরায়ে হাদীস ক্লাসে ভর্তি হন। সময়টা ছিল-৬১-৬২ ঈসায়ী।
লাহোরে থাকাকালীন তিনি ‘খানকায়ে রায়পুরের’ (সাহারানপুর) প্রসিদ্ধ বুযুর্গ ও আল্লাহর ওলী শাইখ আব্দুল ক্বাদের রায়পুরী রহ. (মৃত. ১৩৮২হি.) এর ইসলাহী মজলিসে উপস্থিত হতেন। তাঁর খানকায় এক সপ্তাহ অবস্থানও করেছেন। তাঁর জানাযায়ও উপস্থিত হয়েছিলেন।
এরপর তিনি খানপুরে গমন করেন। সেখানে উপমহাদেশের বিখ্যাত তাফসীরবিদ ও হাদীস বিশারদ হাফিযুল হাদীস আব্দুল্লাহ দরখাস্তী (মৃত.১৪১৫হি.) রহ.এর নিকট তাফসীরের বিশেষ পাঠ গ্রহণ করেন।
এরপর ‘জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া করাচী’ মাদরাসায় বিশ্ববিখ্যাত হাদীস বিশারদ আল্লামা ইউসূফ বিনূরী রহ. (মৃত.১৩৯৭হি.) এর নিকট গমন করেন। তাঁর কাছে তিনি তিনটি বিষয় ও কিতাবের বিশেষ দরস গ্রহণ করেন। যথা-ক.বিষয়: হাদীস শাস্ত্র। কিতাব: সহীহুল বুখারী। খ. বিষয়: শরীয়তের বিধানের বিভিন্ন রহস্য ও ভেদ। কিতাব: হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা। গ.বিষয়: তাফসীরুল কুরআনিল কারীম। এভাবে তিনি পূর্বোক্ত আল্লামা আব্দুল্লাহ দরখাস্তী রহ. ও আল্লামা বিনূরী রহ.এর কাছে দরস গ্রহণের মাধ্যমে তাফসীর শাস্ত্রে বিশেষ বুৎপত্তি লাভ করেন। এখানে তিনি কয়েক মাসের মত ছিলেন।
ভারত গমন : এরপর তিনি ভারতের বিখ্যাত মাদরাসা ‘দারুল উলূম দেওবন্দ’ গমন করেন। দেওবন্দ গমনের পথে অনাকাঙ্খিত ভাবে তিনি তাবলীগ জামাতের বড় মুরুব্বী ও দাঈ আল্লামা ইউসূফ ইবনে ইলইয়াস কান্ধলভী রহ. এর সঙ্গ লাভে ধন্য হন। এক সফরেই তাঁর সাথে হযরতের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
হযরতের আবেদনে আল্লামা ইউসূফ কান্ধলভী রহ. হযরতকে সাহারানাপুরে শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রহ.এর সোহবতে পৌঁছিয়ে দেন। তিনি শাইখুল হাদীস ছাহেবের সোহবতে দশদিনের মত ছিলেন। এখানে অবস্থানকালীন সময়ে তিনি শাইখের সহীহুল বুখারীর দরসেও উপস্থিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন।
এরপর আল্লামা ইউসূফ কান্ধলভী রহ.-ই হযরতকে দারুল উলূম দেওবন্দে নিয়ে যান। দেওবন্দে তিনি ফেদায়ে মিল্লাত আসআদ মাদানী রহ.এর মেহমান হয়ে ধন্য হন। এখানে তিনি ঐতিহাসিক ‘মাদানী মনযিলে’ মেহমান হিসাবে অবস্থান করেন।
আল্লাহর কুদরতের কী কারিশমা! মাত্র একটি সফরে তিনি পৃথিবী বিখ্যাত কয়েকজন মনীষীর সান্নিধ্য পেয়ে গেলেন। সবই তাক্বদিরের ফায়সালা। আল্লাহ পাক যাকে বড় করতে চান তাকে এভাবেই পর্দার আড়াল থেকে গড়ে তুলেন তিলে তিলে। একসময় তা ফুল হয়ে সুবাস ছড়ায় পৃথিবীর বুকে।
দারুল উলূম দেওবন্দে তখন পাকিস্তানী কোন ছাত্র ভর্তি হওয়ার নিয়ম ছিল না। এদিকে ভর্তির সময়ও শেষ। এই দুই কারণে তিনি ভর্তি না হয়ে তৎকালীন মুহতামিম (প্রিন্সিপাল) ক্বারী তৈয়ব ছাহেব রহ.এর অনুমতিতে ‘খুসূসী দরস’ (বিশেষ পাঠ) গ্রহণ করেন। জামে তিরমিযী পড়েন শাইখ ইবরাহীম বলিয়াভী রহ.এর নিকট। তাফসীরে বায়যাবী পড়েন আল্লামা ফখরুল হাসান মুরাদাবাদী রহ.এর নিকট। তখন ক্বারী তৈয়ব ছাহেব রহ.এর হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগার-দরসেও উপস্থিত হয়েছেন। এভাবে ‘খুসূসী দরস’ শেষ করে বার্ষিক পরীক্ষার আগেই ১৯৬৩ সনে দেশে ফিরে আসেন।
তাঁর উস্তাযবৃন্দ : আমরা দেখেছি, তিনি বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের বড় বড় আলিমদের সান্নিধ্য লাভে ধন্য হয়েছেন। নিম্নে! হযরতের উস্তাযবৃন্দের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা পেশ করা হল।
হবিগঞ্জ-
তার পিতা মাওলানা শাইখ আব্দুন নূর হবিগঞ্জী রহ.।
মামা মাওলানা মুখলিসুর রহমান হবিগঞ্জী রহ.।
মামা মাওলানা আব্দুল লতিফ ছাহেব হবিগঞ্জী রহ.।
ক্বারী মাওলানা মেছবাহুজ্জামান কদুপুরী রহ.।
মাওলানা আব্দুল কদ্দুস ছাহেব
মাওলানা আশরাফ আলী ছাহেব (শায়েস্তাগঞ্জী)।
মুফতী আব্দুল গফুর দরিয়াপুরী রাহ. (মৃত্যু : ১৯৯৮ ঈ.)। তাঁকে হবিগঞ্জের মুফতীয়ে আযম বলা হত।
আল্লামা শরফুদ্দীন রহ. (শাইখে বেড়াখালী)।
চট্টগ্রাম, হাটহাজারী-
আল্লামা আব্দুল ওয়াহাব রহ. (মৃত.১৪০২হি.)
আল্লামা নযীর আহমদ রহ.
আল্লামা আব্দুল কাইয়্যূম রহ. (মৃত.১৪০১হি)
আল্লামা আব্দুল আযীয রহ. (মৃত.১৪২০হি.)
আল্লামা আবুল হাসান রহ.
আল্লামা মুহাম্মাদ আলী রহ.।
আল্লামা মুফতী আহমাদুল হক রহ. (মৃত. ১৪৩১হি.)
মুফতী আযম মাওলানা ফায়যুল্লাহ রহ. (মৃত.১৩৯৬হি.)
মাওলানা হামিদ ছাহেব রহ.।
আল্লামা শাহ আহমদ শফী হাফিযাহুল্লাহ।
পাকিস্তান-
হাফিযুল হাদীস আব্দুল্লাহ দরখাস্তী রহ. (মৃত.১৪১৫হি.)
আল্লামা ইউসূফ বিনূরী রহ. (মৃত,১৩৯৭.)
আল্লামা ইদরীস কান্ধলভী রহ. (মৃত.১৩৯৪হি.)
আল্লামা রসূল খান ছাহেব রহ. (মৃত.১৩৯১হি.)
ভারত-
শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রহ. (মৃত.১৪০২হি.)
আল্লামা ক্বারী তৈয়ব ছাহেব রহ. (মৃত.১৪০৩হি.)
আল্লামা ফখরুল হাসান মুরাদাবাদী রহ. (মৃত.১৩৯২হি.)
আল্লামা ইবরাহীম বলিয়াভী রহ. (মৃত.১৩৮৭হি.)
উপরোক্ত উলামায়ে কেরামের অনেকের আলোচনা হযরতের ‘নীষীদের স্মৃতিচারণ’ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে।
কর্মজীবন : এ বিষয়ে তিনি নিজেই তাঁর স্মৃতিচারণমূলক প্রকাশিতব্য পুস্তিকা ‘মণীষীদের স্মৃতিচারণে’-এ আলোচনা করেছেন। সেখান থেকে হুবহু হযরতের যবানে এখানে পেশ করা হল-
কুমিল্লার দারুল উলূম বরুড়া মাদরাসা
‘পাকিস্তান ও ভারতে পড়ালেখা শেষ করে দেশে ফিরে প্রথমে কুমিল্লার দারুল উলূম বরুড়া মাদরাসায় শিক্ষকতা শুরু করি। ৬৪-৬৬ ঈ. মোট তিন বছর এ মাদরাসায় হাদীস, তাফসীর ও ফুনূনাতের বিভিন্ন কিতাবের দরস দানের সুযোগ হয়।
আশরাফুল উলূম বালিয়া মাদরাসা : এরপর ৬৬ ঈ. সনের শেষে ময়মনসিংহের আশরাফুল উলূম বালিয়া মাদরাসার শাইখুল হাদীস মাওলানা মোহাম্মদ আলী ছাহেব কিশোরগঞ্জের মাওলানা আতহার আলী ছাহেবের মাদরাসায় চলে যান। তখন বালিয়া মাদরাসার মুহতামিম ছিলেন মাওলানা দৌলত আলী ছাহেব। তিনি হাটহাজারী মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা শাহ আব্দুল ওয়াহ্হাব ছাহেবের নিকট পত্র লিখলেন, বালিয়া মাদরাসার জন্য একজন শাইখুল হাদীস দেয়ার জন্য। শাহ ছাহেব তখন আমাকে চিঠি লিখে বালিয়া মাদরাসায় যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। বড়দের নির্দেশ অনুযায়ী ৬৯ ঈ. সন পর্যন্ত মোট তিন বছর বালিয়া মাদরাসায় ছিলাম। আগেও তিন, এখানেও তিন।
জামিয়া ইসলামিয়া ময়মনসিংহ : ১৯৬৯-৭১ ঈ. ১৬ ডিসেম্বরের পূর্ব পর্যন্ত ময়মনসিংহ জামেয়া ইসলামিয়ায় দরসে হাদীসের খেদমতের সুযোগ হয়েছে। এখানেও তিন। এভাবে ‘তিনে তিনের’ এক আশ্চর্য ছন্দ তৈরি হয়ে গেল।
জামেয়া আরাবিয়া উমেদনগর, হবিগঞ্জ : ৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর হবিগঞ্জে আসি। এলাকাবাসী ও মুরুব্বীদের অনুরোধে হবিগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী জামেয়া আরাবিয়া উমেদনগর মাদরাসায় যোগদান করি। আজ অবধি এ মাদরাসাতেই আছি’।
জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গা
সর্বশেষ গতবছরের ৩ জুন দেশের শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি বিদ্যাপীঠ জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গার শায়খুল হাদিস হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি।
জামেয়া রেঙ্গার অর্ধশতাব্দিকালের শায়খুল হাদিস আল্লামা শিহাব উদ্দিন চতুলী রাহ. ইন্তেকাল করলে তার স্থলাভিষিক্ত হন তিনি।
বৈবাহিক জীবন : ময়মনসিংহের বিখ্যাত আলিম মাওলানা আরিফ রব্বানী রহ.(১৯৯৭ইং) এর কন্যাকে ১৯৬৭ ইং সনে বিবাহ করেন। হযরতের ৫ ছেলে ও ৪ মেয়ে। সবাই যোগ্য আলিম ও আলিমা হয়ে দ্বীনের বিভিন্ন খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।
বাইতুল্লাহর যিয়ারত : আল্লাহর রহমতে হযরতের বহুবার হজ্জ ও উমরা করার সুযোগ হয়েছে। সর্বপ্রথম ৭৫ সালের শেষ দিকে বাইতুল্লাহর যিয়ারতের জন্য রওয়ানা হন। হজ্ব হয়েছিল ৭৬ এর শুরুতে।
গুণাবলী : হয়রত হবিগঞ্জী হুযুর রাহ. এর মাঝে আল্লাহ প্রদত্ত বহু গুণ ও বৈশিষ্ট্যের সমাহার ছিল। এখানে সংক্ষেপে কিছু উল্লেখ করা হল-
১. প্রখর মেধা ও স্মৃতিশক্তি
হযরত বাল্যকাল থেকেই প্রখর মেধার অধিকারী। তাই সহজেই উস্তাযগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হতেন। ছোটবেলায় হযরতের কুরআনুল কারীম হিফয করার সুযোগ হয়নি।
হাটহাজারী মাদরাসায় যখন তিনি সহীহ বুখারী পড়েন। তখন তাঁর শাইখ ও মুরশিদ মুফতী আযম মাওলানা ফায়যুল্লাহ রহ. হযরতকে কুরআনুল কারীম হিফয করার প্রতি উৎসাহিত করেন। কিন্তু পড়াশোনার ব্যস্ততায় তখন তা হয়ে উঠেনি।
এরপর যখন লাহোরে জামিয়া আশরাফিয়ায় গমন করেন, তখন কুরআন হিফযের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। এ মর্মে তিনি তাঁর হজ্বযাত্রী শাইখ রসূল খান ছাহেবকে লিখিতভাবে দুআর আবেদন করেন। শাইখ রসূল খান ছাহেব হযরতের জন্য কুরআন হিফযের দোআ করেন। এর বরকতেই তিনি নিজে নিজে মাত্র ছয় মাসে দাওরায়ে হাদীসের পড়াশোনার ব্যস্ততা থাকা সত্ত্বেও পুরো কুরআনের হিফয সম্পন্ন করেন।
এছাড়া হযরতের উক্ত গুণের অন্যতম সাক্ষী প্রকাশিতব্য ‘মনীষীদের স্মৃতিচারণ’। তাতে তিনি তাঁর উস্তায ও সমসাময়িক মাশায়েখদের স্মৃতিচারণ করেছেন। হযরতের বয়স এখন প্রায় আশি। আজ থেকে ৫০ বছরের আগের স্মৃতি এখনও আয়নার মত মনে আছে। স্থান, কাল, সময়, তারিখ ও শাইখদের বক্তব্য হুবহু উর্দূতে এখনও মনে আছে। আমি তাঁর স্মৃতিচারণ সংগ্রহ করতে যেয়ে যারপরনাই অবাক হয়েছি। এই বুড়ো মানুষ এত কথা কিভাবে মনে রাখেন। অথচ আমরা নওজোয়ানরা গতকালের কথা আজকে ভুলে যাই।
২. উদার মানসিকতা ও নিরহংকার
আমি কাছ থেকে দেখেছি, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ছোট-বড় সকলের কথাই মনোযোগ দিয়ে শুনেন। কাউকে নিরাশ করেন না। মানুষ যেকোন সমস্যা বা পরামর্শের জন্য আসলে উদার মনে তার সাথে কথা বলেন। সময় দেন। জ্ঞান ও গুণে এত বড় হওয়া সত্ত্বেও কোন ধরনের অহমিকা বা অহংকারমূলক আচরণ থেকে মুক্ত। আমি তাঁর কাছে যতবার গিয়েছি, তাঁর সাথে কথা বলেছি, আমি তাঁকে একজন প্রকৃত উদার মনে মানুষ হিসাবেই পেয়েছি।
আমাকে হযরতের এই গুণটি বিশেষভাবে মুগ্ধ করেছে। হযরতের এলাকার জনৈক লোক এক যামানায় হযরতকে অনেক কষ্ট দিয়েছিলেন। কিন্তু হযরত যখন তাঁর প্রকাশিতব্য স্মৃতিচারণে ঐ লোকের আলোচনা করেছেন তখন তাঁর কেবল ভাল দিকগুলো তুলে ধরেছেন। ঐ আলোচনা থেকে কোনভাবেই এটি বুঝার উপায় নেই যে, এক যামানায় তিনি ঐ আলিম থেকে কষ্ট পেয়েছিলেন। এমন উদার মননশীলতার এখন বড় অভাব।
৩. নিয়মানুবর্তিতা
প্রতিদিনের কাজ যথাসময়ে যথানিয়মে করা এটি হযরতের জীবনের একটি বড় বৈশিষ্ট্য। লক্ষ্য করেছি, হযরতের সাধারণ আদত হল, ফজরের নামায জামেয়া আরাবিয়া উমেদনগরে পড়া বা ফজরের পরই মাদরাসায় চলে আসা। (মাদরাসা থেকে হযরতের বাসায় হেঁটে আসলে প্রায় দশ মিনিটের দূরত্বে) সেই শীতের সময়ও দেখেছি, হযরত ভোর বেলা মাদরাসায় হাযির হয়ে গেছেন।
অধম লেখক হযরতের নিকট ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’-র দরস গ্রহণ করেছি। মাদরাসা ছুটি হলে হযরতের নিকট ছুটে আসতাম। আমি একাই ছিলাম। হযরত আমাকে অত্যন্ত যতেœর সাথে ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’-র একাংশ পড়িয়েছেন। আল্লাহর কৃপায় হযরতের গুরুত্বপূর্ণ দরসগুলো রেকর্ডের মাধ্যমে সংগ্রহ করেছি। ইনশাআল্লাহ! বই আকারে ছাপানোর ইচ্ছা আছে। পাঠকবৃন্দের নিকট দোয়া চাচ্ছি।
‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’ কিতাবের দরস যখন তিনি আমাকে প্রদান করতেন, তখন বলতেন, ফজরের পর মাদরাসায় চলে এসো। সেখানে হুজ্জাতুল্লাহ দরস হবে ইনশাআল্লাহ। হযরত যথাসময়ে কনকনে শীত-সকালে মাদরাসায় হাযির হয়ে যেতেন। কিন্তু আমি জোয়ান হয়েও মাদরাসায় যেতে পারতাম না। একটু রোদ হলে রওয়ানা করতাম। মাদরাসা বন্ধ হলেও হযরতের উক্ত নিয়মানুবর্তিতায় কোন ব্যতয় ঘটতে দেখিনি। জীবনে বড় ও সফল হওয়ার জন্য নিয়ম ও সময়ানুবর্তিতা একটি প্রধান শর্ত। আল্লাহ তাআলা আমাকে ও তালিবুল ইলম ভাইদেরকে এ গুণটি দান করুন।
৪. ওয়াজ-নসীহত
আল্লাহ তা’আলা হযরতকে যেমন মেধা ও জ্ঞান দিয়েছেন, তেমনি সেই জ্ঞান বিতরণের জন্য চিত্তাকর্ষক বয়ানের যোগ্যতাও দান করেছেন।
হযরতের বয়ান ও ওয়াজ শুনার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ চলে আসে। হযরতের কুরআন তেলাওয়াত এত সুন্দর ও মুগ্ধকর, যা খুব সহজেই আকৃষ্ট করে। বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনী নয়; সরাসরি কুরআন-হাদীসের আলোকে ওয়াজ করেন। সমাজের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো এতটা দরদমাখা ভাষা ও যুক্তিসহ পেশ করেন যে, মানুষ সহজেই অভিভূত হয়ে যায়।
হযরতের ওয়াজের মৌলিক কয়েকটি বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ-
ক. তাঁর ওয়াজকে সাধারণ মানুষের জন্য ‘দরসুল হাদীস’ (হাদীসের পাঠ) ও ‘দরসুল কুরআন’(কুরআনের পাঠ) হিসাবে গণ্য করা হয়। কারণ, তাঁর পুরো ওয়াজেই হয় কুরআনের তাফসীর থাকে, না হয় হাদীসের শরাহ বা ব্যাখ্যা থাকে।
খ. তাঁর প্রায় ওয়াজের মধ্যেই একটি মৌলিক বিষয় হল, সমাজে প্রচলিত বেদআত ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে অত্যন্ত মযবুত যুক্তি ও দলীলের আলোকে আলোচনা করা।
গ.বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনী না বলে, সরাসরি আম্বিয়ায়ে কেরাম ও সাহাবায়ে কেরামের জীবন থেকে শিক্ষণীয় ঘটনা তুলে ধরেন। এক রমযানে হযরতের মসজিদ ‘নুরুল হেরা জামে মসজিদ’-এ পুরো মাস ব্যাপী সূরা ইউসূফের মুগ্ধকর তাফসীর করেছেন। মানুষ অন্যান্য মসজিদে তারাবীহের নামায শেষ করে নুরুল হেরা মসজিদে চলে আসত তাফসীর শুনার জন্য। আমি নিজেও কয়েক দিন উপস্থিত ছিলাম। হযরত এত সুন্দর করে তাফসীর করতেন যে, শ্রোতারা মন্ত্রের মত মুগ্ধ হয়ে শুনত। সূরা ইউসূফকে যে কুরআনে কারীমে ‘আহসানুল কাসাস’ বলা হয়েছে তা তখন ভালভাবে উপলব্ধি হয়েছে।
তাফসীরের ফাঁকে-ফাঁকে হযরত আমাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়গুলোও সুন্দর করে তুলে ধরতেন। আল্লাহ তাআলা হযরতকে দরসে কুরআন ও দরসে হাদীসের বিশেষ যোগ্যতা দান করেছেন।
৫. অতুলনীয় অধ্যাপনা
হযরতের জীবনের ব্রত হল, অধ্যাপনা ও শিক্ষকতা। তাই পড়ালেখা শেষ করে আজ অবধি এর সাথে লেগে আছেন। হযরতের অধ্যাপনার বিশেষ বিষয় হল- হাদীস। সেই ৬৩ সন থেকে আজ অবধি সহীহ বুখারীসহ বিভিন্ন হাদীসগ্রন্থের পাঠ দিয়ে আসছেন। এ কারণে তিনি ‘মুহাদ্দিস সাহেব হুয়ুর’ নামেও পরিচিত। তাঁর অধ্যাপনার নীতি হল, এক প্রতিষ্ঠানে থেকে অধ্যাপনা করা। খুব বেশি প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনার দায়িত্ব না নেয়া। কারণ, এতে কোন প্রতিষ্ঠানই পূর্ণরূপে উপকৃত হতে পারে না। আমি তার থেকে এ নীতি কয়েকবার শুনেছি। তাই তিনি- একই ব্যক্তি বহু মাদরাসায় শাইখুল হাদীস হওয়াকে ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দ করেন।
হযরতের দরসের বৈশিষ্ট্য : হযরতের আলোচনা অত্যন্ত সাজানো গুছানো ও পরিপাটি হয়। কঠিন থেকে কঠিন বিষয়কেও বিভিন্ন উদাহরণের মাধ্যমে সহজ করে ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। ক্লাসের দুর্বল ছাত্রও তাঁর দরস বুঝতে বেগ পেতে হয় না। এই বয়সেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকরীর ও আলোচনা করেন। চেহারায় কোনরূপ ক্লান্তির ছাপ দেখা যায় না।
হযরতের দরসের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হল, নিয়মিত দরস করা। দেখা গেছে, কাল ফ্লাইট হবে। কিন্তু ঐ দিন ফজরের পর দরসগাহে এসে হাযির। অথবা রাতে বিদেশ থেকে ফিরেছেন। পরদিন ফজরের পর দরসগাহে হাযির। এমনও হয় যে, বিদেশ থেকে ফিরে প্রথমেই মাদরাসায় আসেন। দরস করে এরপর বাসায় যান। অথচ সফরে লাগাতার দুই রাত নির্ঘুম কাটিয়ে এসেছেন।
গভীর রাত পর্যন্ত মাহফিল করেছেন। ওয়ায করেছেন। ঠিকমত ঘুম হয়নি। কিন্তু পরদিন ঠিকই ফজরের পরপরই দরসদানের জন্য হাযির। চেহারায় কোন ক্লান্তির ছাপ নেই।
হযরত আরো অগণিত গুণের অধিকারী। এখানে অল্প পরিসরে সব আলোচনা করা সম্ভব হল না।
অধ্যয়ন : ছাত্র জীবন থেকেই হযরত মুতা’লা ও অধ্যয়নে বিশেষ মনোযোগী। কর্মজীবনে হযরত অন্যান্য অধ্যয়নের পাশাপাশি দুটি বিষয়ে বিশেষ অধ্যয়নে আত্মনিয়োগ করেন। এক. হাদীস। দুই.কোরআনে কারীম।
হাদীসের বিভিন্ন সংকলন অধ্যয়ন করেছেন। বিশেষ করে সহীহ বুখারীর সাথে হযরতের এক বিশেষ সম্পর্ক গড়ে উঠে। হযরত এ কিতাবটি মোট ৫ বার পড়েছেন। প্রথমবার পূর্ণরূপে পড়েছেন হাটহাজারী মাদ্রসায় শাইখ আব্দুল কাইয়্যুম রহ. এর নিকট। এরপর দ্বিতীয়বার পড়েছেন মুফতী আযম শাইখ ফয়যুল্লাহ রহ. এর নিকট তাঁর বাড়িতে বিশেষ মজলিসে। এরপর তৃতীয়বার পড়েছেন লাহোরে মাওলানা শাইখ ইদরীস কান্ধলভী রহ. এর নিকট। এরপর চতুর্থবার পড়েছেন- আল্লামা ইউসূফ বিনূরী র.এর নিকট। আর পঞ্চমবার পড়েছেন-দারুল উলূম দেওবন্দে শাইখ ফখরুদ্দিন আহমদ মুরাদাবাদী রহ.এর নিকট।
এছাড়া সাহারানপুরে শাইখুল হাদীস যাকারিয়া কান্ধলভী রহ.এর কাছেও সহীহ বুখারীর একাংশ পড়েছেন বড় বড় মনীষীদের কাছে ৫-৬বার সহীহ বুখারী পাঠ করার কারণে পরবর্তী জীবনে এ কিতাবের দরসদানে বিশেষভাবে আত্মনিয়োগ করেন। আল্লাহ তাআলা হযরতকে এ কিতাবের দরসের জন্য কবুল করে নিয়েছেন। সেই আশরাফুল উলূম বালিয়া মাদরাসায় ৬৬ সন থেকে অদ্যাবধি সহীহ বুখারীর দরস দিয়ে আসছেন। সুদীর্ঘ ৫৬/৫৭ বছর যাবত সহীহ বুখারীর দরস দিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া উমেদনগর, হবিগঞ্জ মাদরাসায় বর্তমান পর্যন্ত ৪৭/৪৮ বছর যাবত সহীহ বুখারীর দরস দিয়ে যাচ্ছেন। আল্লাহ তাআলা হযরতকে দীর্ঘ হায়াত দান করুন।
সহীহ বুখারীর সাথে হযরতের বিশেষ সম্পর্ক থাকার কারণে জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ, ঢাকার শাইখুল হাদীস আল্লামা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ রহ.এর ইন্তেকালের আগের বছর মালিবাগ মাদরাসায় খতমে বুখারীর জন্য হবিগঞ্জী হুযুরকে দাওয়াত করা হয়। আর কুরআনে কারীমের সাথে হযরতের সম্পর্ক এত গভীর যে, হযরত সময় পেলেই কুরআন তেলাওয়াত করেন। এর তাফসীর অধ্যয়ন করেন। হাফিযুল হাদীস আব্দুল্লাহ দরখাস্তী রহ., আল্লামা ইদরীস কান্ধলভী রহ. ও আল্লামা ইউসুফ বিনূরী রহ.-এই তিন মনীষীর নিকট তিনি তাফসীরের জ্ঞান লাভ করেছেন। এ কারণে পরবর্তী জীবনে তাফসীরুল কুরআন তাঁর বিশেষ অধ্যয়ন হিসাবে স্থান পায়।
আরেকটি কিতাবের সাথে ছাত্র যামানা থেকেই হযরতের বিশেষ সম্পর্ক গড়ে উঠে। তা হল, ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’। শরীয়তের ভেদ ও রহস্য বর্ণনার ক্ষেত্রে কিতাবটি পৃথিবীবিখ্যাত গ্রন্থসমূহের একটি। এ কিতাবটি তিনি প্রথম পড়েন হাটহাজারী মাদরাসায় আল্লামা আব্দুল আযীয রহ.এর নিকট। এরপর পড়েছেন করাচীতে আল্লামা ইউসুফ বিনূরী রহ.এর নিকট। এর কিছু অংশ ক্বারী তৈয়্যব ছাহেবের নিকটও পড়েছেন।
জীবনের শেষ দিকে এসে হযরত অধমকে এ কিতাবের দরস দিয়েছেন। হুজ্জাতুল্লাহ কিতাবকে হযরত অনেক মহ্ববত করেন। কিন্তু এ দেশে কিতাবটির দরস প্রদানের বিশেষ প্রচলন না থাকায় এর দরস প্রদানের খুব বেশি সুযোগ হয়ে উঠেনি। আমি যখন হযরতের নিকট কিতাবটি পড়ার আগ্রহ ব্যক্ত করলাম, হযরত তখন আবেগ-আপ্লুত হয়ে বললেন, ‘সেই কবে পাকিস্তানে কিতাবটি বিনূরী রহ.এর নিকট পড়ে আসলাম। আজ পর্যন্ত কেউ তা পড়ার আগ্রহ ব্যক্ত করল না। ঠিক আছে, আমি তোমাকে তা পড়াব।’ হযরত যেভাবে কথাটি বলেছেন, মনে হয়েছে-কিতাবটি প্রতি হযরতের অব্যক্ত ভালবাসা ও মহব্বতগুলো বিন্দু বিন্দু হয়ে ঝড়ে পড়ছিল।
এরপর হয়রত আমি একজন ছাত্রকে নিয়ে যে আবেগ ও উদ্দিপনা সহকারে দরস প্রদান করেছেন তা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। হযরতের সামনে আমি এক অধম ছাড়া কেউ নেই। কিন্তু হযরতের আবেগময়ী তাকরীর ও আলোচনায় মনে হত ঘরভরা ছাত্র। আলহামদুলিল্লাহ, হযরত মূল্যবান তক্বরীর (আলোচনা) রেকর্ডের মাধ্যমে সংরক্ষণ করেছি।
আধ্যাত্মিক সাধনা ও খেলাফত লাভ : হযরত হবিগঞ্জী সাহেব জীবনের দীর্ঘ সময় বিভিন্ন মনীষীদের সান্নিধ্য থেকে আধ্যাত্মিক সাধনায় ব্রতী হন। সর্ব প্রথম তিনি মুফতী আযম শাইখ ফায়যুল্লাহ রহ.এর নিকট বায়আত হন। এরপর হযরতের ইন্তেকালের পর সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার বৃহত্তর রেঙ্গা এলাকার প্রখ্যাত বুযুুর্গ, খলিফায়ে মাদানী আল্লামা বদরুল আলম শায়খে রেঙ্গা (মৃত.১৯৮৫হি.) রহ. এর নিকট বায়আত হন। তিনি শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. এর ছাত্র ও খলীফা ছিলেন। দীর্ঘদিন রিযায়ত-মুজাহাদা করেন। এরপর এক সময় শাইখ রেঙ্গা রহ. ইজাযত ও খেলাফত দান করেন। অধ্যাপনা ও অধ্যয়নের পর হযরতের সময় কাটে ইবাদত-বন্দেগীর মধ্যে দিয়ে। বিশেষত রমযান মাসে হযরতের রাত জাগা ও ইবাদত বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। রমযান মাসে দীর্ঘদিন যাবত তাহাজ্জুদের সময় নিজে কয়েক খতম কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করেন। শাইখুল ইসলাম মাদানী রহ.এর মতানুসারে তাহাজ্জুদের জামাত করেন। আর প্রতি রমযানে শেষ দশকের ইতিকাফ নিয়মিত করতেন। এলাকার দ্বীনদার মানুষ ও দূর দূরান্ত থেকে আলিম-উলামারা ছুটে আসেন তাঁর সাথে রমযানের ই’তিকাফ করার জন্য। কোন কোন বছর পুরো রমযান মাসই ইতিকাফে কাটান।
রাজনৈতিক জীবন : তিনি শুরু থেকেই ইসলামী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের তিনি ‘নায়বে রঈস’। আর হবিগঞ্জ জেলার প্রধানের দায়িত্বে নিযুক্ত। হবিগঞ্জ ও দেশে ইসলাম বিরোধী কিছু হলে তিনি জমিয়তের পক্ষ থেকে এর প্রতিবাদ জানান। মিছিল, মিটিং করেন। রাজপথে জনগণের সাথে নেমে একাত্মতা ঘোষণা করেন। এই বয়সেও যেকোন ইসলামী ইস্যুতে রাজপথে হুইল চেয়ারে বসে প্রতিবাদ করেন। শান্তিপূর্ণ মিছিলে অংশগ্রহণ করেন।
সমাজ সংস্কার : বর্তমান আমাদের মুসলিম সমাজ বিভিন্ন কুসংস্কারে পরিপূর্ণ। এর প্রবল বিষক্রিয়ায় সমাজ ব্যাধিগ্রস্থ। বিশেষ করে হবিগঞ্জ ও সিলেট এলাকায় বেদআতের তৎপরতা অনেক বেশি। এসব রোধের জন্য তিনি বিভিন্নভাবে কাজ করেছেন।
ক. বিভিন্ন ওয়াজ-মাহফিলের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সচেতনা তৈরি করা।
খ. প্রতি জুমআয় বয়ানে কুসংস্কার ও বেদআত নিয়ে আলোচনা করা।
গ. বাৎসরিক সীরাত মাহফিলের ব্যবস্থা করা।
ঘ. বাৎসরিক তাফসীরুল কুরআন মহা সম্মেলনের ব্যবস্থা করা।
তাঁর সমাজ সংস্কারের আরেকটি উজ্জলতম দিক হল, নারীদেরকে ইসলামী শিক্ষা প্রদানের উদ্যোগ নেয়া। এ বিষয়টি নিম্নে স্ববিস্তারে উল্লেখ করা হল-
নারীদের পাঠশালা : বর্তমান বাংলাদেশে পুরুষদের জন্য দ্বীনি শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। মাদরাসা আছে। সাধারণ পুরুষদের জন্য ওয়াজ-মাহফিলে ও জুমআয় যাওয়ার সুযোগ হয়। কোন না কোন ভাবে পুরুষরা দ্বীনি আলোচনার মজলিসে অংশগ্রহণ করতে পারে। কিন্তু নারীদের জন্য এপথটি সুগম নয়। তারা মসজিদে যেতে পারে না। ওয়াজ-মাহফিলে তাদের জন্য ভাল ব্যবস্থা থাকে না। আর নিয়মতান্ত্রিক মাদরাসায় পড়ার সুযোগও তাদের জন্য নিতান্ত কম। এর ফলে মাতৃজাতি শুধু যে দ্বীনি শিক্ষা থেকেই বঞ্চিত তা নয়, বরং তারা তাদের মঙ্গলজনক খেদমত থেকেও বঞ্চিত। কারণ, একজন নারী শুধু স্ত্রীই নয় বরং সে একাধারে জীবন সঙ্গিনী, জননী, শিশুদের প্রথম শিক্ষিকা ও একজন গৃহিনীও। তাদের সঠিক দ্বীনি জ্ঞান না থাকার দরুন তারা তাদের এসব দায়িত্ব যথাযথভাবে আঞ্জাম দিতে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখিন হয়। বাংলাদেশে প্রায় ৬ কোটি (বরং আরো বেশি) মহিলার দ্বীনি শিক্ষার অবস্থা এতই করুণ যে, তাদের মাত্র ৫০% নামায পড়ে না। বাকী ৫০% যারা নামায পড়ে তাদের মধ্যে চল্লিশ ভাগের নামায শুদ্ধ হয় না। তাদের অধিকাংশই পাক-নাপাকের মাসআলা সম্বন্ধে অজ্ঞাত। বহু মহিলা এমন আছেন, যারা হাযেয়-নেফাসের মাসআলা সঠিকভাবে জানে না। এভাবেই তারা ইহজগত শেষ করে পরপারে পাড়ি জমাচ্ছে।
সমাজে নারীদের দ্বীনি শিক্ষা ব্যবস্থার এই করুণ দৃশ্য আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী হুযুরকে বিশেষভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। তিনি এই শূন্যতা পূরণের জন্য মৌলিকভাবে দুটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। যথা-
১. ছেলেদের মাদরাসার পাশাপাশি মেয়েদের জন্য মহিলা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মহিলা মাদরাসার নাম-‘জামিয়া শারইয়্যাহ মহিলা মাদরাসা’। এখানে হিফযুল কুরআন থেকে দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত পড়ালেখার সুযোগ রয়েছে। মাদরাসটি প্রতিষ্ঠার কিছু দিনের মধ্যেই তা বেশ গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে। এ মাদরাসার একটি বৈশিষ্ট্য হল, এখানে মহিলা শিক্ষিকাই বেশি। হযরতের পুত্রবধু ও কন্যাদের অনেকেই এর শিক্ষকতার সাথে জড়িত।
২. এলাকার সাধারণ মহিলাদের জন্য নিজ বাসভবনে গড়ে তুলেছেন ‘মহিলাদের মাসিক ইজতেমা’। এতে নারীরা দলে-দলে পর্দার সাথে একত্রিত হয়। হযরত ভিন্ন রুম থেকে মাইকের মাধ্যমে নসিহত করেন। এর মাধ্যমে বহু পরিবারে দ্বীন ছড়িয়ে পড়েছে।
রচনাবলী : ছাত্র জীবন থেকেই তাঁর লেখালেখি শুরু হয়। তবে বেশ কিছু রচনা হারিয়ে যায়। এখন পর্যন্ত তাঁর লিখিত যেসব গ্রন্থ পাওয়া য়ায় সংক্ষেপে তা হল-
১. تحذير الإخوان عن صحبة الأمارد والصبيان (ছোট বাচ্চাদের সাথে মিলামিশা করা থেকে সতর্কিকরণ) পুস্তিাকার উপর মুফতী আযম ফায়যুল্লাহ রহ. ও শাইখ কুরবান আলী রহ.এর অভিমত লেখা আছে। মূল গ্রন্থটি উর্দূতে লেখা। আজ থেকে অন্তত ৫০ বছর আগের রচনা।
২. اقتناص الشوارد في صحبة الأمارد এটি প্রথম পুস্তিকার আরবী সংস্করণ। পুস্তিকাটি আমার সংগ্রহে আছে। এটিও অন্তত ৫০ বছর আগে একবার ছেপেছে। এরপর আর ছাপেনি।
৩. جواهر الأدب في لسان العرب এটি আরবী ভাষায় কাছাকাছি বিভিন্ন শব্দের আভিধানিক পার্থক্যের উপর লিখিত এক অনবদ্য গ্রন্থ। গ্রন্থটি প্রায় আড়াইশ পৃষ্ঠার। হযরতের ছোট জামাতা বন্ধুবর মাওলানা তাহমিদুল মাওলার টীকা ও সম্পাদনায় গ্রন্থটি ছেপেছে। প্রকাশক: মাকতাবাতুল আযহার, ঢাকা । প্রকাশকাল: ২০১৩ ইং., মার্চ।
৪. হয়রত লুকমান আ.এর সতর্কবাণী।
৫. হাফিযুল হাদীস আল্লামা আব্দুল্লাহ দরখাস্তী রহ.এর জীবনী।
৬. দরসে হুজ্জাতুল্লাহ। এটি আমাকে দেয়া হযরত হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা কিতাবের এক দূর্লভ দরসের সংকলন। সংকলনটি অচিরেই প্রকাশ করার ইচ্ছা আছে। পাঠকবৃন্দের নিকট দোয়া চাচ্ছি।
৭. মনীষীদের স্মৃতিচারণ। এটি হযরত কাছ থেকে অধম লেখক শুনে শুনে প্রস্তুত করেছি। এর কিছু অংশ মাসিক আল-কাউসার পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে। ইনশাআল্লাহ অচিরেই তা বই আকারে প্রকাশ হবে।
৮. تحرير الأسانيد এটি হযরতের বিভিন্ন হাদীসের গ্রন্থের সনদ ও ইজাযতের উপর লিখিত। গ্রন্থটি সংকলন করেছেন হযরতের জামাতা মাওলানা তাহমিদুল মাওলা। এটিও অচিরেই প্রকাশের পথে।
পরিশেষে আমরা আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী রাহ. কে আল্লাহপাক যেনো আলা মাকাম দান করেন। আমিন।
উৎস : হযরতের এই জীবনী জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া উমেদনগর, হবিগঞ্জ- এর ১০সালা দস্তারবন্দী স্মারক থেকে সংগৃহীত।