যেকোন কাজ করার আগে আমাদের ভাবা উচিৎ, আমরা কি করছি এবং কেন করছি?

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

অক্টোবর ২২ ২০১৯, ০০:১৪

সৈয়দ মবনু : এক তরুণের ফেসবুক মেসেঞ্জারে কথাবার্তা বা তর্কবিতর্কে হযরত মুহাম্মদ (স.) ও হযরত ফাতেমা (রা.)-কে নিয়ে অবমাননাকর উক্তি করা হয়েছে এমন স্ক্রিনশট ভায়রাল হলে ‘তৌহিদী জনতা’র ব্যানারে প্রতিবাদ শুরু হয়। পরে তা মারামারি-হানাহানি থেকে রক্তারাক্তি পর্যন্ত হয়ে যায়। ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করে আমার নিজের একটি অভিজ্ঞতা বন্ধুদের সাথে শিয়ার করতে ইচ্ছে করে। ঘটনাটি হলো, ফায়যুর রহমানকে নিয়ে। সিলেটের ফায়যুর রহমান একজন কোরআনে হাফিজ, কওমী মাদরাসায় আলেমের ছাত্র এবং লিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ছাত্র, সাথে সাংবাদিকও। র‌্যাব-৯ তাকে সিলেট শহরের বাদাম বাগিচা থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। অথচ পূর্বের দিন এশার নামাজ পর্যন্ত সে আমি এবং সাংবাদিক নোমান বিন আরমান একসাথে ছিলাম। প্রশ্ন হলো, হঠাৎ এমন কি ঘটলো যে র‌্যাব তাকে গ্রেফতার করবে? র‌্যাব অফিস থেকে জানাগেলো ফায়যুর রহমান বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় আইনমন্ত্রীকে হত্যার হুমকি দিয়েছে। আমি চিন্তা করে পাই না, যে ছেলে আমাকে হুমকি দেয়ার সাহস নেই, সে ছেলে সত্য কি দেশের অত্যন্ত প্রতাপশালী আওয়ামীলীগ সরকারের আইনমন্ত্রীকে হত্যার হুমকি দিয়েছে? ফায়যুরকে যারা জানে তারা সংবাদ শোনে হাসতে হাসতে নীচের কাপড় ভিজিয়ে দেওয়ার উপক্রম। ফায়যুরের বিরুদ্ধে তথ্য ও প্রযুক্তি আইনে মামলা হয়। এদিকে আবার মামলা চলাকালিন সময় কে বা কারা নোমানের ই-মেইল আইডি হ্যাংক করে আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মিথ্যাকথা লিখে পত্রিকায় সংবাদ করে। কোন কোন অনলাইন পত্রিকা যেন সংবাদ সংকটে ছিলো। এই সংবাদ পেয়ে হৈ চৈ শুরু করে দিলো। নোমান বিষয়টি দেখে সাথে সাথে সংবাদটি তার করা নয় বলে থানায় জি ডি করে। তবু র‌্যাব আমার পিছু ছাড়ে না। আমি এবং আমার পরিবার ফালতু একটি সংবাদের ফলে বেশ পেরেশান হয়েছি। অবশেষে পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতায় বিষয়টি মিথ্যা প্রমাণ করতে পেরেছি। ফায়যুর রহমানকে দীর্ঘ ৬ মাস এই মামলায় জেল কাটতে হয়। সিলেটের আদালতে তথ্য ও প্রযুক্তি আইনে মামলা এটাই ছিলো প্রথম। অবশেষে মহসিন ভাই আদালতে প্রমাণ করেন কীভাবে একজনের আইডি হ্যাংক করে কিংবা সফটওয়ারের মাধ্যমে অন্যজনকে হুমকি দেয়া সম্ভব। কিন্তু সরকারী পিপি এই বিষয়টিকে মানতে রাজি নয়। আমরা একজনকে দিয়ে আদালতে বসেই পিপির মোবাইল থেকে মহসিন ভাইকে হত্যার হুমকি দেই। মহসিন ভাই আদালতকে বিষয়টি অবগত করেন। পিপি অস্বীকার করেন। পিপি না, মহসিন ভাই হ্যাঁ। এ নিয়ে দীর্ঘ তর্ক-বিতর্ক হয়। সকল প্রমাণাদি বলে পিপি হুমকি দিয়েছেন। পিপি স্বীকার করেন, অন্যকেউ তা করে থাকবে। অতঃপর মহসিন ভাই ঘটনা স্বীকার করে বললেন, এইটা যেমন অন্যের পক্ষ থেকে সম্ভব, তেমনি সম্ভব ফায়যুর রহমানের মোবাইল ব্যবহার না করেও তার নাম্বার থেকে অন্যকে হুমকি দেয়া। আড়াই ঘন্টা চলে জজকোর্টে এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক। অবশেষে জজ সাহেব ফায়যুর রহমানের জামিন মঞ্জুর করেন।
ঘটনা টি এজন্য বললাম, ভোলায় বিপ্লব রায় এমন কিছুর শিকার নয় তো? সংবাদ মাধ্যমগুলো এমনই বলছে। দৈনিক কালেরকণ্ঠের সূত্র অনুযায়ি সে শুক্রবারেই থানায় গিয়ে তাঁর ফেসবুক আইডি হ্যাক হওয়ার বিষয়টি জানিয়েছে। পুলিশ এ নিয়ে ঝামেলা হওয়ার বিষয়টি আঁচ করে তরুণকে নিজেদের হেফাজতে রেখে তাঁকে সঙ্গে নিয়েই অভিযান চালিয়ে হ্যাকারদের ধরে ফেলে। পাশাপাশি আলেম-উলামাদের নিয়ে প্রশাসন রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে। কিন্তু এর পরও একদল তরুণ তৌহিদী জনতার নামে লিফলেট ও মাইকে প্রচারণা চালানোর কারণে ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার ঈদগাহ মাঠে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হয়। একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাধে। সমাবেশটি না করার জন্য বোরহানউদ্দিন ঈদগাহ মসজিদের ইমাম মাওলানা জালাল উদ্দিন ও বাজার মসজিদের ইমাম মাওলানা মিজানকে পুলিশ অনুরোধ জানায়। পুলিশের অনুরোধে এ দুই ইমাম সকাল ১০টার দিকেই যেসব লোক এসেছিল, তাদের নিয়ে দোয়ার মাধ্যমে সমাবেশ সমাপ্ত করেন। কিন্তু ততক্ষণে বোরহানউদ্দিনের বিভিন্ন গ্রাম থেকে কয়েক হাজার লোক এসে ঈদগাহে জড়ো হয়। একপর্যায়ে তারা ওই দুই ইমামের ওপর ক্ষিপ্ত হয় এবং সেখানে থাকা পুলিশের ওপর চড়াও হয়। পুলিশ মসজিদের ইমামের কক্ষে আশ্রয় নেয়। জনতা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। পরে পুলিশ গুলি ছোড়ে।
পত্রিকা আরও জানায়, ভোলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র সোহেল রানা। শুক্রবার রাত ১০টা ৫৮ মিনিটে তাঁর ফেসবুক আইডির টাইমলাইনে দুটি স্ক্রিনশট শেয়ার করেন। বিপ্লব চন্দ্র শুভর সঙ্গে অন্য এক ব্যক্তির মেসেঞ্জারের ‘ধর্ম অবমাননাকর’ কথোপকথনের দুটি স্ক্রিনশট। একই সঙ্গে সোহেল তাঁর টাইমলাইনে স্ট্যাটাসে বলে, ‘এটা বেশি বেশি করে শেয়ার করে ছড়িয়ে দেন। এই জানোয়ারের কঠিন শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।’ সোহেল তাঁর এই স্ট্যাটাস ৪২ জনের টাইমলাইনে ট্যাগ করেন। রাত ১১টা ৫২ মিনিটে বিপ্লবের ছবি ও পাশে ম্যাসেঞ্জারের কথোপকথনের একটি স্ক্রিনশট দিয়ে সোহেল টাইলাইনে আরেকটি স্ট্যাটাস দেয়। সেখানেও উসকানিমূলক অনেক কথা বলে। সোহেলের সূত্রে আরো অনেকেই এভাবে স্ক্রিনশট দিয়ে ফেসবুকে ‘ধর্ম অবমাননাকর’ পোস্ট দেওয়ার অভিযোগ তোলে। শুরু হয় ‘ফেসবুকে প্রতিবাদ’। ‘ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়েছে’ দাবি করে জিডি করতে শুক্রবার রাতে বিপ্লব বোরহানউদ্দিন থানায় যান। বিপ্লবের ফেসবুক আইডি হ্যাক হওয়ার বিষয়টি রাতেই পুলিশ নিশ্চিত হয়। পরের দিন শনিবার এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে পুলিশ আটক করে।
বিষয়টি এভাবে সত্য হতে পারে, অবশ্য মিথ্যাও হতে পারে। বিপ্লব রায় হয়তো গালি দেয়নি হযরত মুহাম্মদ (স.)-কে, হয়তো সে গালি দিয়েছে। যদি সে গালি দিয়ে থাকে তবে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে এবং সরকারকে অনুরোধ করবো এই শাস্তি যেন হয় সর্বোচ্চ শাস্তি। আর যদি মিথ্যা হয়, তবে প্রশ্ন হলো; এসব করে কারা?
তৌহিদী জনতা, আমজনতা, জনগণ, নাগরিক সমাজ, শহরবাসী, গ্রামবাসী ইত্যাদি ব্যানারে যে কোন আন্দোলনে যাওয়ার আগে দেখতে হবে; ঘটনার সূত্রপাত কোথায় থেকে এবং কীভাবে? এই আন্দোলনের ব্যানার কারা তৈরি করেছে এবং তাদের মূল উদ্দেশ্য কি? আপনি তো বৃহৎ কোন শক্তির ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছেন না? যেকোন কাজ করার আগে আমাদের অবশ্যই ভাবা উচিৎ : আমরা কি করছি এবং কেন করছি? শুধু আবেগ দিয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি করা যায়, সমস্যার মৌলিক সমাধান হয় না।