কক্সবাজার -টেকনাফ সড়কে চলছে নৈরাজ্য, নেপথ্যে টোকেন বাণিজ্য
একুশে জার্নাল
সেপ্টেম্বর ২৯ ২০২০, ২২:২৫
কায়সার হামিদ মানিক, স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার:
কক্সবাজারে শতকরা আশি ভাগ সিএনজি’র প্রয়োজনীয় বৈধ কাগজপত্র নেই, চালকদের নেই ড্রাইভিং লাইসেন্স। তাতে কি মাসিক টাকার বিনিময়ে নির্দিষ্ট টোকেনে চলে এসব সিএনজি। সড়কের শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্যরাও লাইসেন্স থাকাটাও ভালোভাবে দেখেন না। এভাবে চলছে বছরের পর বছর সিএনজি’র টোকেন বাণিজ্য। ফলে সরকারও প্রতিবছর কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে যাত্রীদের নিকট থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়েরও অহরহ অভিযোগ রয়েছে।
উখিয়া ও কক্সবাজারের একাধিক সিএনজি চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লাইসেন্স থাকার চাইতে না থাকাই ভালো। কারণ, যেসব চালকের লাইসেন্স নেই বা গাড়ির কাগজপত্রে সমস্যা আছে তাদের মাসিক চাঁদার বিনিময়ে নির্দিষ্ট ‘টোকেন’ নিলে পুরো মাস চলে। কিন্তু যাদের সব কাগজপত্র ঠিক আছে, তাদের চেক করার নামে দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখে ট্রাফিক পুলিশ। এছাড়া বিভিন্ন অজুহাতে মামলা দিয়ে হয়রানি করে।
সিএনজি চালক নাজির হোছন বলেন, দীর্ঘ ২ বছর হচ্ছে বিআরটিএ অফিসে গাড়ীর লাইসেন্স বা প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের জন্য টাকা জমা দিয়েছি কিন্তু কোন কাগজ পায়নি। ফলে সরকার প্রতিবছর নবায়ন ফি: যেমন পাচ্ছে না তেমনি এদিকে চাঁদাবাজিও বন্ধ হচ্ছে না। তিনি বলেন, প্রতি মাসে লাইসেন্স বিহীন গাড়ীর জন্য উখিয়ায় মাসিক ৭০০ টাকার টোকেন নিতে হয়। কক্সবাজার শহরের জন্য নিতে হয় ২২০০ টাকায় টোকেন। অন্যদিকে লাইসেন্সধারী গাড়ীর জন্য দিতে হয় মাসিক ৩০০ টাকা। এই চাঁদার হার কোথাও দৈনিক আবার কোথাও মাসিক। চাঁদার জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা টোকেন। এসব টোকেন সরবরাহ করে শ্রমিকনেতা নামধারী এক শ্রেণির দালালরা। তারাই টোকেন বিকিকিনির কাজ করেন।
সিএনজি চালক আব্দু সালাম বলেন, প্রতি মাসের শুরুতে কক্সবাজার শহরের ট্রাফিক পুলিশের ঠিক করা দালাল মো: কবিরকে টাকা দিয়ে সংগ্রহ করতে হয় নির্দিষ্ট টোকেন। এছাড়াও লিংক রোড থেকে পালংখালী স্টেশন পর্যন্ত মাসিক চাঁদা দিয়ে উখিয়া কেন্দ্রিক ছৈয়দ হোছন নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে টোকেন সংগ্রহ করতে হয়। তাদের মাসোহারা এবং দৈনিক চাঁদাবাজির কারণে আমাদের বাধ্য হয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করতে হয়। আর বাড়তি আদায় করতে গিয়ে প্রায় সময় যাত্রীদের সাথে বাকবিতন্ডা হয় বলেও তিনি জানান।
চালকদের অভিযোগ, এসব টোকেন বাণিজ্য স্থানীয় পরিবহন শ্রমিক নেতাদের যোগসাজসে, থানা ও হাইওয়ে পুলিশের ছত্রছায়ায় হচ্ছে। চালকরা আরও বলেন, টোকেন বাণিজ্যে টাকার একটি অংশ যায় পুলিশের পকেটে। তবে সবচেয়ে বড় অংশটি পান তথাকথিত শ্রমিক নেতারা। এসব টোকেন বিক্রি ও চাঁদা আদায়ের জন্য স্টেশন গুলোতে রয়েছে আলাদা লাঠিয়াল বাহিনী। প্রতিটি স্টেশনের এসব লাঠিয়াল বাহিনীকে প্রতিদিন দিতে হয় ১০/২০ টাকা। সরকার পুরো রাস্তা যেন তাদেরকে লীজ দিয়েছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, এসব টোকেন দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নামে। কক্সবাজার জেলা অটো রিক্সা, সিএনজি টেম্পো পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের নামে উখিয়া থেকে কক্সবাজার যাওয়ার জন্য টোকেন নিতে হয় মো: কবির নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে। একই সংগঠনের আওতাধীন উখিয়া উপজেলা অটো রিক্সা, সিএনজি ও টেম্পো শ্রমিক ইউনিয়নের নামে উখিয়া কেন্দ্রিক টোকেন বাণিজ্য করে ছৈয়দ হোছন। মাসিক প্রতিটি টোকেনের মূল্য কক্সবাজার কেন্দ্রিক ২২০০ টাকা ও উখিয়া কেন্দ্রিক ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। এছাড়া কোটবাজার এলাকায় আবদুর রহমান নামে এক ব্যক্তি টোকেন বাণিজ্যের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে পুলিশ ও শ্রমিক নেতাদের টোকেন বাণিজ্য নিয়ে চালকরা প্রকাশ্যে কোনো কথা বলতে চান না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক চালক বলেন, এক কাপড়ে কুমিল্লা থেকে কক্সবাজার আসা সিএনজি’র টোকেন বাণিজ্য করা মো: কবির এখন বহুতল ভবন সহ একাধিক গাড়ীর মালিক বনে গেছে। তার আয়ের উৎস কোথায় ?
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে টোকেন ব্যবসায়ী কবির বলেন, গত ১ বছর ধরে লাইসেন্স বিহীন প্রতিটি সিএনজি থেকে মাসিক ২ হাজার টাকা নেওয়া হয়। তবে চাঁদার বড় একটি অংশ টিআই নাসির ও নবী ভাইকে দিতে হয়। এছাড়া কয়েকজন সাংবাদিকের আশ্রয়-প্রশ্রয়ের কথাও তিনি জানান। তিনি বলেন, যেহেতু বেশিরভাগ গাড়ির কাগজপত্র ঠিক থাকে না। এমনকি অনেক চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্সও নেই। কারও কারও আবার লাইন্সেসের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। ট্রাফিক পুলিশের আইনী জটিলতা থেকে রেহাই পেতে চালকরা মাসিক চাঁদা দেয় বলেও জানায়।
উখিয়া কিংবা কক্সবাজার কেন্দ্রিক মাসিক টোকেন বাণিজ্যের বিষয়ে কিছুই জানেন না বলেন জানিয়েছেন কোটবাজার ফোর ষ্ট্রোক সিএনজি চালক ও মালিক সমবায় সমিতি লি: এর সভাপতি রুহুল আমিন খাঁন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, পরিবহন সেক্টরে অনিয়মের প্রধান কারণ হলো মালিক-শ্রমিকদের নামে গড়ে ওঠা সংগঠনগুলো। টোকেন নিয়ে যা হয় তার পেছনেও রয়েছে এসব নেতারা। তারাই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্যকে ম্যানেজ করে এ ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে।
সিএনজি’র টোকেন বাণিজ্য সহ নানা অনিয়মের জন্য পুলিশ ও পরিবহন নেতারা দুষছেন একে-অপরকে। এ প্রসঙ্গে ট্রাক-পিকআপ মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি ইউনুছ চৌধুরী বলেন, অনিয়ম যখন নিয়ম হয়, প্রতিরোধ তখন অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। তাই পরিবহন খাতের এ ধরণের নৈরাজ্য দমনে দুদক, বিআরটিএ এবং প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন তিনি।
গণমাধ্যমকর্মী গফুর মিয়া চৌধুরী অভিযোগ করে বলেন, সিএনজি’র টোকেন বাণিজ্যের পাশাপাশি ভাড়া নৈরাজ্যও থেমে নেই। উখিয়া থেকে কুতুপালং ১০ টাকার স্থলে জোর করে যাত্রিদের নিকট থেকে আদায় করা হচ্ছে ২০ টাকা। উখিয়া থেকে থাইংখালী ও পালংখালী ৪০ টাকার স্থলে ৬০ টাকা নেওয়া হচ্ছে বলে আরেক গণমাধ্যমকর্মী রফিক মাহমুদ জানিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ আহমেদ সঞ্জুর মোরশেদ বলেন, উখিয়ার জন্য আমি নতুন। পুলিশের টোকেন বাণিজ্যের বিষয়টি যোগদান করার পর প্রথম শুনলাম। তবে এখন থেকে মাদকসহ নানা অপরাধের ব্যাপারে পুলিশ জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করবে।