হেফাজতের রাজনৈতিক দর্শনই আগামি বিপ্লবের পথ

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জানুয়ারি ০৭ ২০২২, ১০:২১

সৈয়দ শামছুল হুদা: আপনি কি বাংলাদেশে ইসলামী বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেন? দেশকে ইসলামের উর্বর ভূমি মনে করেন? দেশে ইসলামী ভাবাদর্শের সরকার প্রতিষ্ঠার কল্পনা করেন? তাহলে আপনার সামনে ইসলামি বিপ্লবের রাজনৈতিক দর্শন হতে পারে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। আমার এ কথায় হয়তো আপনার মধ্যে অনেক কৌতুহল জেগেছে। তাই না! যে সংগঠন অস্তিত্ব সংকটে সেই সংগঠনের আবার দর্শন কি? তাইতো ভাবছেন?

আসুন, একটু আলোচনা করি। আমি একটা জিনিস বিশ্বাস করি, দৃঢ়ভাবেই করি, আর সেটা হলো, হেফাজত হলো একটি প্রতীকি নাম। প্রকৃত বিষয় হলো এর অন্তরালে লুকিয়ে থাকা রহস্য। চেতনা। বিশ্বাস। মূল্যবোধ। ঝিমিয়ে থাকা অসংগঠিত শক্তি। হেফাজত নিয়ে গভীরভাবে বিশ্লেষণ হওয়া উচিত। অনেক দিন হয়ে গেল এ নিয়ে এখনো পর্যন্ত আমার চোখে বিশেষ কোন বিশ্লেষণ চো্খে পড়েনি।

আমি এটাও বিশ্বাস করি যে, বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক দর্শনের সামনে একসময় জাসদ কোণঠাসা হয়েছে। তারা বিপুল সংখ্যক মেধাবি, পরিশ্রমি, দায়িত্বশীল লাখো তরুনকে একছাতার নীচে নিয়ে এসেও বিপ্লব ঘটাতে পারেনি। যেই কর্ণেল তাহের বামবিপ্লব ঘটানোর জন্য জিয়াকে জেলখানা থেকে মুক্ত করলো, সেই জিয়াই দেশের সংবিধানে বিসমিল্লাহ প্রতিস্থাপন করলো। কর্ণেল তাহেরসহ অভুত্থানকারিদের ফাঁসিতে ঝুলালো। কারণটা কি? কারণ ছিল, সেই জাসদ ছিল সমাজতান্ত্রিক চেতনায় ডুবন্ত। ইসলাম, মুসলমান তাদের কাছে ছিল নস্যি। তারা বাংলাদেশের মানুষের পালস বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। জিয়া সফল হয়েছে। সুতরাং জাসদকে প্রচন্ডরকম মেধাবি সংগঠন হওয়া সত্ত্বেও এদেশের মানুষ আপন মনে করেনি।

এমনিভাবে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন জামায়াত। তারা এদেশে একটি ব্যাপক প্রশিক্ষিত জনশক্তি গড়ে তুলেছে। তাদের রয়েছে অর্থভান্ডার, রয়েছে প্রচুর ইন্টেলেকচুয়াল। কিন্তু তাদের যেই জিনিসটির অভাব সেটা হলো, তারা এদেশের আলেম সমাজের সাথে সখ্যতার সম্পর্কটা গড়ে তুলতে পারেনি। তাদের এত মেধাবি লোকজন আছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা ইগোর সংকটে ভোগতেছে। এর আগে আমি একবার একটি লেখায় জামায়াতের প্রিয় ভাইদের উদ্দেশ্যে ১০দফা প্রস্তাবনা দিয়েছিলাম। সেদিনও বলেছিলাম, আপনারা অনেক কিছুই করেছেন, দেশে বৃহত্তর ইসলামি বিপ্লবের স্বার্থে আরো একটু নরম হন, নত হন। সফলতটাকে প্রাধান্য দেন। ব্যক্তিবিশেষকে নয়। কিন্তু তাদের মধ্যে কোন পরিবর্তন দেখা যায়নি। আমি আজোও পরিস্কার বলতে পারি, কোনদিন যদি বাংলাদেশে জামায়াত ক্ষমতায় যাওয়ার কাছাকাছি অবস্থানে যায়, সেদিন বাংলাদেশে কেয়ামত ঘটে যাবে, যেমনটা ইখওয়ানের ক্ষেত্রে ঘটেছে। কেন ঘটবে, কীভাবে ঘটবে? সেটা বিস্তারিত অন্য আলোচনায়।

বর্তমানেও একটি ইসলামী দল তাদের নীচের স্তরের কর্মীদের মধ্যে একটি স্বপ্ন ঠেলে দিয়েছে যে, তাদের নেতৃত্বে আগামি কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশে ইসলামি বিপ্লবের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। জামায়াত যেই ভুলটা করেছে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও সেই একই ভুল করে যাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জে একজন হেফাজত নেতা ফেরদাউস বিএনপির অঘোষিত প্রার্থী তৈমুর আলমকে কেন সমর্থন দিলো, সেটার পরিপ্রেক্ষিতে যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তা কল্পনাতীত। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমীরের মুখ থেকে সাধারণ একজন হেফাজত নেতাকে নিয়ে এতটা কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখানো আমার কাছে মনে হয় ঠিক হয়নি। তবে এটা জানা উচিত যে, হেফাজত দলগত, দর্শনগত দিক দিয়ে ইসলামী আন্দোলনকে সমর্থন করে না। সেটা ১৩সাল থেকে পরিস্কারভাবে প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও তারা নিজেদেরকে হেফাজত মনে করে। অথবা হেফাজতের চেয়ে বড় কিছু মনে করে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ হেফাজতের সদ্য বিলুপ্ত কমিটিকে বারবার পকেট কমিটি বলেছে। রাবেতার নাম শুনলে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রতিটি কর্মীর গায়ে আগুন ধরে গেছে। এই যে, অসহিষ্ণুতা এটাই ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম দুর্বলতা। এদেশের অসংখ্য আলেম ইসলামী আন্দোলনের সাথে আছে। যেমনটা জামায়াতের সাথেও এদেশের অনেক আলেম আছে। তারপরও এইদেশে একটা নীরব আলেম শ্রেণি আছে যারা মূলত: নির্দিষ্ট কোন দলের বাইরে তারাই কওমী ধারার মূল চালিকা শক্তি। এটাকে অবজ্ঞা করে কেউ ধর্মীয় রাজনীতিতে সফল হতে পারবে বলে মনে হয় না।

এবার আসি আসল কথায়। বর্তমানে প্রায় মৃত হেফাজত একটি দর্শন আমাদেরকে দিয়ে গিয়েছে। সেটা হলো, দল-মত নির্বিশেষে সকল ইসলামী দলের এক আমীরের নেতৃত্বে প্রশ্নহীনভাবে আনুগত্য প্রদর্শনপুর্বক দেশের সকল কিছু পাল্টে দেওয়ার জন্য চূড়ান্ত আন্দোলনের ডাক দেওয়া। সেই আন্দোলনে সকলে মিলে ঝাপিয়ে পড়া।

এইক্ষেত্রে মাওলানা মওদুদি রহ. এর কিছু কিছু রাজনৈতিক দর্শন যা নিয়ে আলেম সমাজে বিতর্ক আছে সেগুলো ভুলে যেতে হবে। ভুলে যেতে হবে কওমী আলেমদেরকেও, একমাত্র আমরাই হক ও হক্কানিয়্যাতের এজেন্ট। এর বাইরে আর কিছু নেই। ভুলে যেতে হবে বিএনপি, জামায়াত, লীগের দূরত্ব।কিছু মৌলিক বিষয় থাকবে আন্দোলনের মূল ইস্যূ যেটা জনগণের মৌলিক সমস্যার কথা বলবে, ধর্মীয় ইনসাফ ও গণসাম্যের কথা বলবে।

গণমানুষের আশা-আকাঙ্খা বাস্তবায়নে হয়তো এমন কোন আলেম নেতৃত্ব সামনে আসবেন, যিনি মাওলানা ভাসানীর মতো সকল রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহনযোগ্যতা পাবেন, আল্লামা আহমদ শফী রহ. এর মতো একটি আহ্বানের অপেক্ষায় থাকবে গোটা জাতি, ডাক আসতে দেরি, মাটে ঝাপিয়ে পড়তে দেরি নাই। দেশের সাধারণ মানুষ প্রস্তুত। কিছু স্বার্থবাদি মানুষের নেতৃত্ব হারানোর ভয়ই আমাদেরকে পিছিয়ে রেখেছে।

দেশে দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমে ময়দান তৈরি হয়ে আছে। জামায়াতে ইসলামীর মাধ্যমে লাখ লাখ কর্র্মী তৈরি হয়ে আছে। ইসলামী আন্দোলনসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতাও তৈরি হয়েছে। এখন এই সবগুলো দলের নেতাদের বাদ দিয়ে এমন একজন নেতাকে বেছে নিতে হবে, যার ডাকে সবগুলো দলের সাধারণ কর্মীরা ময়দানে ঝাপিয়ে পড়বে। বর্তমান নেতারাই ইসলামী বিপ্লবের পথে বড় বাধা। এরা শুধূ থিউরি দেয়। কিন্তু এক হয় না। চীনের কমিউনিস্ট বিপ্লবের আগে যেমন সবনেতাদের মেরে ফেলা হয়েছিল, তেমনি সব নেতাদের সরিয়ে দিতে হবে। এদেশে একটি নতুন নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে, যারা এই দলীয় বেড়াজালকে মানবেন না। টানবেন না। পাত্তা দিবেন না।

গতকাল বগুড়ার গুনাহার ইউপিতে একজন তরুন নেতা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি মাঝে মাঝেই একটা কথা বলেন। আর সেটা হলো, আপনি সৎ বলেই আপনাকে মানুষ নেতা মেনে নিবে এমনটা ভাবলে হবে না। আপনাকে গণমানুষের কাছে যেতে হবে। তারা কী চায় সেটা ‍বুঝতে হবে। তিনি এই দর্শনে কাজ করেই সফল হয়েছেন। ১২হাজার ভোটের ব্যবধানে ক্ষমতাসীন লীগের প্রতিদ্বন্ধিকে হারিয়েছেন। আশ্চার্যজনকভাবে তাকে স্থানীয় ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা পর্যন্ত সমর্থন জানিয়েছে। পাশাপাশি বিএনপি, জাতীয় পার্টি এমনকি অনেক লীগের ভোটও পেয়েছেন। যদিও সেটা ইউপি নির্বাচন, তারপরও এর একটি রাজনৈতিক প্রভাব আছে।

দলমতের উর্ধ্বেউঠে ৯০% মুসলমানের দেশে ইসলামের কথা না বলে, ইনসাফ ও সাম্যের কথা বলেই মানুষকে নিয়ে ইসলামী বিপ্লব করা সম্ভব। খালি খালি ইসলাম-ইসলাম জপলেই মানুষ আপনাকে ভোট দিবে না। জুব্বা-পাঞ্জাবী পড়লেই আপনাকে সমর্থন জানাবে না। মুফতি প্রার্থী হলেই আপনাকে চুমু খাবে না। বিভক্তি সৃষ্টি করে এমন সব বিষয় পরিহার করে ইসলামের সুমহান সৌন্দর্যকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হেফাজতে ইসলাম যেভাবে সকলকে আপন করে নিয়েছিল, যেভাবে তাবলীগ, বিএনপি, জাতীয়পার্টি, জামায়াতসহ অন্যান্য সকল ইসলামী রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক দলকে আপন করে নিয়েছিল, সেটা যতদিন না হবে ততদিন এদেশে কারো একার পক্ষেই ইসলামী বিপ্লব ঘটানো সম্ভব না। ঘটাতে চেষ্টা করলেও এমন বিপদ নেমে আসবে যেটা সামাল দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারতা দান করুন। সবাইকে আপন করে নেওয়ার মতো উদারতা দান করুন। যোগ্য ও মেধাবি মুসলিম নেতৃত্ব দান করুন।