‘স্বাধীনতার কাব্যইতিহাস’ এর ইতিহাস কথন

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

ডিসেম্বর ১৬ ২০২০, ২৩:০১

জগলুল হায়দার

স্বাধীনতার কাব্যইতিহাস। প্রচণ্ড আবেগ আর উত্তেজনায় বাংলার (গোটা উপমহাদেশের) ৫ হাজার বছরের ইতিহাস নিয়া আমগো ভৈরবের বাসায় ২০০১ কিম্বা ২০০২-এ একরাতে লেখা একটা ছড়া। সেইদিন ডিনার সাইরা কিছুক্ষণ পর আমার শিশুপুত্র ও স্ত্রীকে ঘুম পারায়া লিখতে বসি এই ছড়া। কুনো রেফারেন্স ছাড়া পৌরানিক যুগ থিকা শুরু কইরা ৫ হাজার বছরের ইতিহাস সারারাত পাগলের মতো লিখতে থাকি। কি এক ঘোরলাগা নেশায় ছড়ায়-ছন্দে লিখতে লিখতে রাত কাবার হইছে টেরও পাই নাই। টের পাই তখন, যখন আমার স্ত্রী ঘুম থিকা উইঠা বললো- ফজরের ওয়াক্ত হইছে তুমি এখনো ঘুমাও নাই? তখনও আমার লেখা শেষ হয় নাই। বললাম-এখনো আজান দেয় নাই তো, লেখা আর একটু বাকি আছে। সে অবাক হয়ে অজু করতে গেলো। আমি যথারীতি লেখতেছি। এর মধ্যেই পাশের মসজিদ থিকা ভাইসা আসলো ফজরের আজান- আসসালাতু খায়রুম মিনান্নুম’। অজু শেষে সে আবার বললো; আজান হইছে এইবার উঠো। এই বইলা সে নামাজে দাঁড়াইলে কিছুক্ষনের মধ্যে আমিও ছড়ায় ফিনিশিং টাচ দিয়া উইঠা পড়লাম।

এর কয়দিন পর আজিজে (শাহাবাগে) বজ্রকন্ঠের সম্পাদক অনুজ প্রতিম কবি অরিত্র রতন সরকার ছড়টা শুইনা বললো; বাবু ভাই ছড়াটা কাওকে দিবেন না, আমি ছাপমু। সম্ভবত ২০০১ কিম্বা ২০০২ সালে বজ্রকন্ঠে ছাপা হইল স্বাধীনতার কাব্যইতিহাস। সেই সংখ্যা এবং ‘স্বাধীনতার কাব্যইতিহাস’ ব্যাপক সাড়া ফেললো। যারা সেই সংখ্যা পাইলেন তাদের অনেকেই আমার কাছে, অনেকে সম্পাদকের কাছে ব্যপক প্রশংসা করলেন। এদের মধ্যে কবি নির্মলেন্দু গুণ, সমুদ্র গুপ্ত, ছড়াকার খালেক বিন জয়েনউদ্দীন, আসলাম সানী ও প্রাবন্ধিক আইয়ুব হোসেন এর কথা না বললেই নয়। খাস কইরা গুণদার কথা বলি; তিনি আজিজের জাতীয় কবিতা পরিষদের অফিসে অনেকের সামনে আমার অনুপস্থিতিতেই বলছিলেন- ‘আমি ইয়াহিয়া কাল লিখছি, সেইটা সত্তর থেকে আর জগলুল তো অসম্ভব সুন্দর কাজ করছে’। তখনই অরিত্র আজিজ থিকা ফোনে আমাকে গুণদার সেই কথা শুনায়। শুনায় সেইখানে উপস্থিত প্রিয় আসলাম সানী ভাইয়ের মুগ্ধতার কথাও। তখনো গুণদার সঙ্গে আমার তেমন পরিচয় ছিল না এমুনকি সানী ভাইয়ের সঙ্গেও খুব একটা ঘনিষ্ঠতা ছিল না। যাক এর কিছুদিন পর ইত্তেফাকে সানী ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হইলে তিনি আমাকে জড়াইয়া ধইরা বলেন; তুমি এইটা কি করছো মিয়া! তুমার ‘স্বাধীনতার কাব্যইতিহাস’ নিয়া ডকুমেন্টারি হওয়া দরকার। প্রিয় ছড়াকার খালেক বিন জয়েনউদ্দীন তার কচিকাঁচার অফিসে বইসা অনেকের উপস্থিতিতে বলছিলেন; আমি সম্পূর্ণ ছড়াটা মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়ছি, বাবু আপনি খালি অসম্ভব একটা কাজ করেন নাই বরং আপনি ছাড়া ছড়ায় এই কাজ করা আর কারো পক্ষেই সম্ভব হইত না।

আজিজের তিনতলার সিঁড়িতে জনবিজ্ঞান পত্রিকা ঘিরা আমগো একটা আড্ডা হইত। আইয়ুব ভাই, সাংবাদিক জাকির, অরিত্র, মুবিন, শামীম, মেরি ও পুতুলুসহ আমরা অনেকেই সেই আড্ডায় উপস্থিত থাকতাম। প্রায়ই কবি সমুদ্র গুপ্ত তাতে অংশ নিতেন। সেইখানেও স্বাধীনতার কাব্যইতিহাস আলোচিত হইছে। এমনি এক আড্ডায় প্রিয় কবি সমুদ্র গুপ্ত বলছিলেন; বাবুর (জগলুলের) মতো নীতিনিষ্ঠ লেখক আমি আর দেখি নাই। এইজন্যই ওর পক্ষে এমুন সাচ্চা ইতিহাস লেখা সম্ভব হইছে। মনে আছে সেই আড্ডায় জনবিজ্ঞান সম্পাদক প্রিয় আইয়ুব ভাই বলছিলেন; বাবুর (জগলুলের) ছড়া প্রবন্ধেরও অধিক।

যাক এর কিছুদিন পর স্বাধীনতার কাব্যইতিহাস দেশের বৃহত্তম পেশাজীবী সংগঠন আইডিইবির মুখপাত্র মাসিক কারিগর-এ প্রকাশ হয়। আইডিইবির বুদ্ধিবৃত্তিক সেলে ছড়াটা ব্যপক প্রশংসিত হয়। খালি তাই নয় বরং গণবুদ্ধিজীবী মনিরুল ইসলাম পিলু ভাইয়ের উদ্যোগে আইডিইবির সর্বোচ্য পরিষদের এক সভায় বলতে গেলে শুধু স্বাধীনতার কাব্যইতিহাস নিয়াই আলোচনা হয়। এর মাঝেই এক প্রকাশক বই করতে চাইলেও আমি দেই নাই। অতঃপর ২০০৬ সালের বইমেলায় দেশের খ্যাতিমান প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সুবর্ণ থিকা বের হয় ‘স্বাধীনতার কাব্যইতিহাস’ বই। বই হবার পর ‘স্বাধীনতার কাব্যইতিহাস’ আরেক দফা আলোচনায় আসে। অনেক ছড়াকার দৈনিক এবং শিশুকিশোর পত্রিকায় এই বই নিয়া চমৎকার আলোচনা করেন। এছাড়া সম্ভবত ২০১২ সালে দৈনিক আমাদের সময়ের উদ্যোগে দেশবরেণ্য কবি ও ছড়াকারদের উপস্থিতিতে আয়োজকদের অনুরোধে ৫২০ লাইনের পুরা বইটাই আমারে পাঠ করতে হয়। এবং উপস্থিত লেখকগণ বইটার ব্যাপক প্রশংসা করেন।

এদিকে প্রকাশের দুইতিন বছরের মধ্যে বইটা শেষ হয়ে যায়। এরমধ্যে দুইয়েকজন প্রকাশক বইটার নুতুন সংস্করণ প্রকাশ করতে চাই্লেও দেই নাই। সর্বশেষ প্রিয় অনুজ ছড়াকার কাদের বাবু তার বাবুই থেকে বইটা প্রকাশ করতে চাইলে আমি রাজি হই। বাবু কাজটা বেশ আন্তরিকতার সাথে আগায়া নিলেও আমার আমেরিকা চইলা আসার কারণে বইটা আর প্রকাশ হয় নাই। এই বই প্রকাশ নিয়া আজকের বিজয় দিবসেও বাবুর সঙ্গে কথা হইল। মূলত সেই আলাপের ফলোআপেই আজ ‘স্বাধীনতার কাব্যইতিহাস’ নিয়া এই স্মৃতিচারণ। স্মৃতিচারণের সঙ্গে বইয়ের কাভারের একটা ছবি দিলে মন্দ হয় না। কিন্তু আমার বইয়ের সেলফে এই বই নাই। আমার স্ত্রী, পুত্র, কন্যাও খুঁইজা পাইলো না। অতঃপর প্রিয় অনুজ লেখক শরিফ বিল্লাহকে ফোন দিলে সে বইটার প্রচ্ছদের কয়েকটা ছবি পাঠায়। সেইসব ছবিতেই বিজয় দিবসের শুভেচ্ছাসহ এই স্মৃতিচারণ।