‘সরকারি শিক্ষাক্রম বাধ্যতামূলক করছে দারুল উলুম দেওবন্দ’

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

সেপ্টেম্বর ২০ ২০২২, ১৯:০২

আতাউর রহমান খসরু: উপমহাদেশের কওমি শিক্ষা ধারার কেন্দ্রভূমি হিসেবে খ্যাত দারুল উলুম দেওবন্দ নিজ কারিকুলামে সাধারণ শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থা, সরকারের একমুখী শিক্ষানীতি ও সময়ের তাগিদ বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আধুনিক শিক্ষা সংযোজনের ব্যাপারে দারুল উলুম দেওবন্দের নীতি নির্ধারকরা একমত। গত ১৮ সেপ্টেম্বর উত্তর প্রদেশের মাদরাসাগুলোর দায়িত্বশীলদের নিয়ে আয়োজিত এক বৈঠকে দারুল উলুম দেওবন্দের সদরুল মুদাররিসিন আল্লামা সাইয়েদ আরশাদ মাদানি এসব কথা বলেন। নিম্নে তাঁর বক্তব্যের সারনির্জাস তুলে ধরা হলো।

দেওবন্দ আধুনিক শিক্ষার বিরোধী নয় : আমরা একটা বিষয় স্পষ্ট করতে চাই যে, আমরা কখনোই আধুনিক শিক্ষার বিরোধী নই। আমরা চাই শিশুরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হোক। তারা ইংরেজি শিখুক, বিজ্ঞান শিখুক, আধুনিক আইন-কানুনে পারদর্শী হোক এবং তারা চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও আইনজীবী হোক। তারা নিয়মিত প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সাফল্য অর্জন করুক।

ধর্মীয় প্রয়োজনকে উপেক্ষা নয় : কিন্তু আমরা এর সঙ্গে সঙ্গে এটাও চাই যে, শিশুরা আগে নিজের ধর্মীয় জ্ঞানটুকু অর্জন করুক। কেননা একটি জাতির যেমন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার প্রয়োজন আছে, তেমনি দক্ষ আলেম ও পারদর্শী মুফতির প্রয়োজন আছে। এটা দ্বিনি প্রয়োজন পূরণের জন্যই দরকার। দ্বিনি প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার জন্য তাদের প্রয়োজন আছে। যেমন মসজিদ পরিচালনার জন্য ইমাম ও মুয়াজ্জিন প্রয়োজন। মানুষকে হারাম-হালালের জ্ঞান দানের জন্য দক্ষ মুফতির প্রয়োজন। এমন ধর্মীয় প্রয়োজন সবধর্মেরই আছে।

আগ থেকেই আধুনিক শিক্ষা ছিল : আপনারা জেনে খুশি হবেন, দারুল উলুম দেওবন্দে প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই আধুনিক শিক্ষা ছিল। আমি যখন দারুল উলুমের শিক্ষাসচিব ছিলাম, তখন প্রাথমিক স্তরের সরকারি পাঠক্রমের পুরোটাই পাঠদান করা হতো। এমনকি আরবি বিভাগে প্রবেশের আগে শিক্ষার্থীদের সপ্তম শ্রেণি সম্পন্ন করতে হতো। তাদেরকে ইংরেজি, বিজ্ঞান, সাধারণ গণিত, ভূগোল, বীজগণিত পাঠ দান করা হতো। পরবর্তী শিক্ষার মান অক্ষুণ্ন রেখে সাধারণ শিক্ষাকে পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্য কারিকুলামের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়। এমনকি দারুল উলুম দেওবন্দের হিফজুল কোরআন বিভাগেও দুই ঘণ্টা করে আধুনিক শিক্ষার পাঠদান করা হবে।

সাধারণ শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হবে : শুধু দারুল উলুম নয়, ভারতের বহু মাদরাসায় আগ থেকেই আধুনিক শিক্ষার পাঠদান হয়ে আসছে। আগামী বছর থেকে মাদরাসাগুলোতে বাধ্যতামূলকভাবে সরকারি শিক্ষাক্রমের পাঠদান শুরু হবে। কেননা আমরা সরকার যে একমুখী শিক্ষানীতি গ্রহণ করেছে, তাতে সহযোগিতা করতে চাই। আগামী দিনগুলোতে মাদরাসায় সাধারণ শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হলে মাদরাসায় ভর্তির সময় তাতে উত্তীর্ণ হওয়ার শর্তারোপ করা হবে। তবে তা এখনই নয়। দুই তিন বছর ব্যবধানে পঞ্চম শ্রেণি তথা প্রাথমিক স্তরের উন্নীত না হলে এবং সাত-আট বছর পর দশম শ্রেণিতে উন্নীত না হলে দেওবন্দের আরবি বিভাগে কেউ ভর্তি হতে পারবে না। ভারতের জাতীয় শিক্ষানীতি বিষয়ে দারুল উলুম দেওবন্দে এরই মধ্যেই ১০-১৫টি বৈঠক হয়েছে। শরিয়তের সীমারেখার মধ্যে থেকে সরকারকে আমরা সর্বোচ্চ সহযোগিতা করব। ভারত নতুন ও একমুখী যে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করছে তাতে প্রত্যেক ভারতীয় শিশুকে অন্তত দশম শ্রেণী পর্যন্ত আধুনিক-জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে।

আল্লামা কাসেম নানুতবির সিলেবাস : আমি যখন প্রথমবার দেওবন্দের শিক্ষাসচিব নিযুক্ত হই, তখন দেওবন্দের প্রবীণ শিক্ষক ও শিক্ষাসচিব মুনশি আবদুল আজিজ আমাকে কাসেম নানুতবি (রহ.)-এর সময়কার সিলেবাস হস্তান্তর করেছিলেন। এই সিলেবাসে আমি নিজে দেখেছি যে দারুল উলুম দেওবন্দে ছাত্রদের ধর্মীয় বিষয়ে পাঠদানের আগে (মিজান জামাত) শুরুর আগে কেবল জাগতিক শিক্ষাভিত্তিক ৮ বছরের পাঠ্যক্রম ছিল। এই ৮ বছরের পাঠ্যক্রমে গণিত, ফারসি-হিন্দি-ইংরেজি ভাষাশিক্ষা, ভূগোল, বীজ গণিত ইত্যাদি বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই পাঠ্যক্রমের কিছু বিষয় সম্পর্কে বর্তমান সময়ের বহু মাদরাসা মাদরাসা কর্তৃপক্ষও জানে না। এই আট বছরের পাঠ্যক্রম শেষ করার পর একজন ছাত্র ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণ শুরু করত। পরবর্তী তা কমে পাঁচ বছরে নেমে আসে। আজও আমি বলছি, দারুল উলুম দেওবন্দে আমরা প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে আধুনিক-জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করব।আমরা দারুল উলুম দেওবন্দে এর প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা কাসেম নানুতবি (রহ.)-এর সিলেবাসের বাস্তবায়ন করব। দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রত্যেক ছাত্রকে পরিপূর্ণ সিলেবাসে পড়ানো হবে এবং কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় অংশগ্রহণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। দশম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর শিক্ষার্থীদেরকে ধর্মীয় বিষয় ছাড়া আর কোনো বিষয়ের পাঠ দান করা হবে না।

উল্লেখ্য, ২০২০ সাল থেকে ভারতের ঐতিহ্যবাহী দ্বিনি সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ‘ওপেন স্কুল’ নামে একটি জাতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এই কার্যক্রমের অধীনে মাদরাসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সাধারণ শিক্ষা লাভ ও সরকারের কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ লাভ করে থাকে। আল্লামা সাইয়েদ আরশাদ মাদানি জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সভাপতি।