শিরকের ভয়াবহতা, পরিণতি; মুসলমানদের কর্তব্য কী?
একুশে জার্নাল ডটকম
অক্টোবর ০৪ ২০২২, ২২:৪৮
আহমদ যাকারিয়া: পৃথিবীতে যত পাপ আছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর গুনাহ হলো আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করা। পৃথিবীতে শির্কের চেয়ে জঘণ্য আর গুনাহ নেই। আল্লাহ যা দ্ব্যর্থহীনভাবে হারাম বলে ঘোষণা দিয়েছেন তার বান্দার জন্য শিরক করা তার মধ্যে অন্যতম।
আল্লাহ পাক বলেন, قُلۡ تَعَالَوۡاْ أَتۡلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمۡ عَلَيۡكُمۡۖ أَلَّا تُشۡرِكُواْ بِهِۦ شَيۡٔٗاۖ وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ إِحۡسَٰنٗاۖ وَلَا تَقۡتُلُوٓاْ أَوۡلَٰدَكُم مِّنۡ إِمۡلَٰقٖ نَّحۡنُ نَرۡزُقُكُمۡ وَإِيَّاهُمۡۖ وَلَا تَقۡرَبُواْ ٱلۡفَوَٰحِشَ مَا ظَهَرَ مِنۡهَا وَمَا بَطَنَۖ وَلَا تَقۡتُلُواْ ٱلنَّفۡسَ ٱلَّتِي حَرَّمَ ٱللَّهُ إِلَّا بِٱلۡحَقِّۚ ذَٰلِكُمۡ وَصَّىٰكُم بِهِۦ لَعَلَّكُمۡ تَعۡقِلُونَ ١٥١ ﴾ [الانعام: ١٥١]
‘বল, ‘এসো, তোমাদের উপর তোমাদের রব যা হারাম করেছেন, তা তিলাওয়াত করি যে, তোমরা তার সাথে কোনো কিছুকে শরীক করবে না এবং মা-বাবার প্রতি ইহসান করবে আর দারিদ্র্যের কারণে তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না। আমিই তোমাদেরকে রিযিক দেই এবং তাদেরকেও রিযিক দেই। আর অশ্লীল কাজের নিকটবর্তী হবে না- তা থেকে যা প্রকাশ পায় এবং যা গোপন থাকে। আর বৈধ কারণ ছাড়া তোমরা সেই প্রাণকে হত্যা করো না, আল্লাহ যা হারাম করেছেন। এগুলো আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা বুঝতে পার’। {সূরা আন‘আম: ১৫১}
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের বহু আয়াতে তার সমকক্ষ ও শরীক গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন, যারা তার সমকক্ষ নির্ধারণ করে, তাদের তিনি নিন্দা করেছেন।
আল্লাহ পাক বলেন: ﴿فَلَا تَجۡعَلُواْ لِلَّهِ أَندَادٗا وَأَنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٢٢ ﴾ [البقرة: ٢٢]
“সুতরাং তোমরা জেনে-বুঝে আল্লাহর জন্য সমকক্ষ নির্ধারণ করো না”। (বাকারা-২২)
অপর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন: ﴿ وَجَعَلُواْ لِلَّهِ أَندَادٗا لِّيُضِلُّواْ عَن سَبِيلِهِۦۗ قُلۡ تَمَتَّعُواْ فَإِنَّ مَصِيرَكُمۡ إِلَى ٱلنَّارِ ٣٠ ﴾ [ابراهيم: ٣٠]
“আর তারা আল্লাহর জন্য সমকক্ষ নির্ধারণ করে, যেন তারা তার পথ থেকে বিভ্রান্ত করতে পারে। বল, ‘তোমরা ভোগ করতে থাক, কেননা, তোমাদের গন্তব্য তো আগুনের দিকে”। (সূরা ইব্রাহিম -৩০)
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন; «من مات وهو يدعو من دون الله ندا دخل النار»
“যে এমতাবস্থায় মারা গেল যে, সে আল্লাহ ছাড়া কোনো সমকক্ষ আহ্বান করত, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে”। (বুখারি:৪৪৯৭, মুসলিম: ৯২)
শিরকের ভয়াবহতা
শিরকের ভয়াবহতা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ﴿ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَغۡفِرُ أَن يُشۡرَكَ بِهِۦ وَيَغۡفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَآءُۚ وَمَن يُشۡرِكۡ بِٱللَّهِ فَقَدِ ٱفۡتَرَىٰٓ إِثۡمًا عَظِيمًا ٤٨ ﴾ [النساء: ٤٨]
‘নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না। তিনি ক্ষমা করেন এ ছাড়া অন্যান্য পাপ, যার জন্য তিনি চান। আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে অবশ্যই মহাপাপ রচনা করে’।{সূরা নিসা: ৪৮}
আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ، أَيُّ الذَّنْبِ أَعْظَمُ؟ قَالَ: «أَنْ تَجْعَلَ لِلَّهِ نِدًّا وَهُوَ خَلَقَكَ»
‘আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল, সবচেয়ে বড় গুনাহ কোনটি? তিনি বললেন, ‘তুমি কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ নির্ধারণ করবে; অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’। [বুখারী:৬০০১; মুসলিম:৮৬]
আল্লাহ পাক অন্যত্র ইরশাদ করেন, ﴿وَٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَلَا تُشۡرِكُواْ بِهِۦ شَيۡٔٗاۖ ﴾ [النساء: ٣٦]
‘তোমরা ইবাদাত কর আল্লাহর, তাঁর সাথে কোনো কিছুকে শরীক করো না’। {সূরা নিসা: ৩৬}
আরেক আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন, ﴿ قُلۡ إِنَّمَآ أُمِرۡتُ أَنۡ أَعۡبُدَ ٱللَّهَ وَلَآ أُشۡرِكَ بِهِۦ﴾ [الرعد: ٣٦]
‘বল, আমাকে কেবল আদেশ দেয়া হয়েছে, যেন আমি আল্লাহর ইবাদাত করি এবং তাঁর সাথে শরীক না করি’। {সূরা রা‘দ: ৩৬}
আরেক আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন, ﴿ فَمَن كَانَ يَرۡجُواْ لِقَآءَ رَبِّهِۦ فَلۡيَعۡمَلۡ عَمَلٗا صَٰلِحٗا وَلَا يُشۡرِكۡ بِعِبَادَةِ رَبِّهِۦٓ أَحَدَۢا ١١٠ ﴾ [الكهف: ١١٠]
‘সুতরাং যে তার রবের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার রবের ইবাদাতে কাউকে শরীক না করে’। (সূরা-কাহফ: ১১০)
আরেক জায়গায় আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ﴿ وَإِذۡ قَالَ لُقۡمَٰنُ لِٱبۡنِهِۦ وَهُوَ يَعِظُهُۥ يَٰبُنَيَّ لَا تُشۡرِكۡ بِٱللَّهِۖ إِنَّ ٱلشِّرۡكَ لَظُلۡمٌ عَظِيمٞ ١٣ ﴾ [لقمان: ١٣]
‘আর স্মরণ কর, যখন লুকমান তার পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিল, ‘প্রিয় বৎস, আল্লাহর সাথে শির্ক করো না; নিশ্চয় শির্ক হল বড় জুলুম’। (সূরা লুকমান: ১৩)
আল্লাহ পাক অপর জায়গায় ইরশাদ করেন, ﴿ أَيُشۡرِكُونَ مَا لَا يَخۡلُقُ شَيۡٔٗا وَهُمۡ يُخۡلَقُونَ ١٩١ وَلَا يَسۡتَطِيعُونَ لَهُمۡ نَصۡرٗا وَلَآ أَنفُسَهُمۡ يَنصُرُونَ ١٩٢ ﴾ [الاعراف: ١٩١، ١٩٢]
‘তারা কি এমন কিছুকে শরীক করে, যারা কোন কিছু সৃষ্টি করে না, বরং তাদেরকেই সৃষ্টি করা হয়? আর তারা তাদেরকে কোন সাহায্য করতে পারে না এবং তারা নিজদেরকেও সাহায্য করতে পারে না’। (সূরা আ‘রাফ : ১৯১-১৯২)
আল্লাহ পাক আরেক জায়গায় বলেন, ﴿ وَيَعۡبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَا لَا يَمۡلِكُ لَهُمۡ رِزۡقٗا مِّنَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ شَيۡٔٗا وَلَا يَسۡتَطِيعُونَ ٧٣ ﴾ [النحل: ٧٣]
‘আর তারা আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুর উপসনা করে, যারা আসমানসমূহ ও যমীনে তাদের কোনো রিযিকের মালিক নয় এবং হতেও পারবে না’। (সূরা নাহল : ৭৩)
শিরককারীর শাস্তি
১- আল্লাহ পাক কুরআনের মধ্যে বলেছেন, ﴿ وَلَوۡ أَشۡرَكُواْ لَحَبِطَ عَنۡهُم مَّا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ٨٨ ﴾ [الانعام: ٨٨]
‘আর যদি তারা শির্ক করত, তারা যা আমল করছিল তা অবশ্যই বরবাদ হয়ে যেত’। (সূরা আন‘আম : ৮৮)
আল্লাহ পাক আরও বলেন, ﴿ وَلَقَدۡ أُوحِيَ إِلَيۡكَ وَإِلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكَ لَئِنۡ أَشۡرَكۡتَ لَيَحۡبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ٦٥ ﴾ [الزمر: ٦٥]
‘আর অবশ্যই তোমার কাছে এবং তোমার পূর্ববর্তীদের কাছে ওহী পাঠানো হয়েছে যে, তুমি শিরক করলে তোমার কর্ম নিষ্ফল হবেই। আর অবশ্যই তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’। (সূরা যুমার : ৬৫)
২- আল্লাহ পাক বলেন, ﴿ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَغۡفِرُ أَن يُشۡرَكَ بِهِۦ وَيَغۡفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَآءُۚ وَمَن يُشۡرِكۡ بِٱللَّهِ فَقَدِ ٱفۡتَرَىٰٓ إِثۡمًا عَظِيمًا ٤٨ ﴾ [النساء: ٤٨]
‘নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না। তিনি ক্ষমা করেন এ ছাড়া অন্যান্য পাপ, যার জন্য তিনি চান। আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে অবশ্যই মহাপাপ রচনা করে’। (সূরা নিসা : ৪৮)
৩- আল্লাহ পাক বলেন, ﴿ إِنَّهُۥ مَن يُشۡرِكۡ بِٱللَّهِ فَقَدۡ حَرَّمَ ٱللَّهُ عَلَيۡهِ ٱلۡجَنَّةَ وَمَأۡوَىٰهُ ٱلنَّارُۖ وَمَا لِلظَّٰلِمِينَ مِنۡ أَنصَارٖ ٧٢ ﴾ [المائدة: ٧٢]
‘নিশ্চয় যে আল্লাহর সাথে শরীক করে, তার উপর অবশ্যই আল্লাহ জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন এবং তার ঠিকানা আগুন। আর জালিমদের কোন সাহায্যকারী নেই’। (সূরা মায়িদা: ৭২)
৪- আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿ فَمَا تَنفَعُهُمۡ شَفَٰعَةُ ٱلشَّٰفِعِينَ ٤٨ ﴾ [المدثر: ٤٨]
‘অতএব সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের তথা শিরককারীদের কোন উপকার করবে না’। (সূরা মুদ্দাসসির: ৪৮)
৫- শির্ককারীদের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুপারিশ করবেন না। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لِكُلِّ نَبِيٍّ دَعْوَةٌ مُسْتَجَابَةٌ، فَتَعَجَّلَ كُلُّ نَبِيٍّ دَعْوَتَهُ، وَإِنِّي اخْتَبَأْتُ دَعْوَتِي شَفَاعَةً لِأُمَّتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ، فَهِيَ نَائِلَةٌ إِنْ شَاءَ اللهُ مَنْ مَاتَ مِنْ أُمَّتِي لَا يُشْرِكُ بِاللهِ شَيْئًا»
‘প্রত্যেক নবীর জন্য একটি করে কবুল দো‘আ রয়েছে। প্রত্যেক নবীই আগেভাগে দো‘আ করে ফেলেছেন। আর আমি আমার দো‘আকে গোপন রেখেছে কিয়ামতের দিন আমার উম্মতের শাফায়াতের জন্য। অতএব সেটি আমার প্রত্যেক উম্মতই ইনশাআল্লাহ পাবে যে আল্লাহর সঙ্গে শির্ক না করে মারা যাবে’। (মুসলিম : ১৯৯)
সুতরাং সকল মুসলিমের কর্তব্য হচ্ছে ছোট-বড় সকল শিরক থেকে বেচে থাকা, কারণ সবচেয়ে বড় নাফরমানি, যা আল্লাহর সাথে করা হয় তা হচ্ছে শির্ক, এবং তার অধিকারে সীমালঙ্ঘন করা, অর্থাৎ তার ইবাদত ও আনুগত্যে শির্ক করা, অথচ তার কোনো শরীক নেই। এ জন্য আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের স্থায়ী নিবাস নির্ধারণ করেছেন জাহান্নাম। তিনি বলেছেন, মুশরিকদের তিনি ক্ষমা করবেন না, তাদের উপর জান্নাত হারাম। অতএব প্রত্যেক বিবেকী ও দীনদার ব্যক্তির জন্যে অবশ্য কর্তব্য শির্কের ভয়ে ভীত থাকা ও স্বীয় রবের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করা, তিনি যেন তাকে শির্ক থেকে মুক্তি দেন, যেমন ইবরাহিম ‘আলাইহিস সালাম বলেছেন: وَٱجۡنُبۡنِي وَبَنِيَّ أَن نَّعۡبُدَ ٱلۡأَصۡنَامَ ٣٥ ﴾ [ابراهيم: ٣٥]
“আমাকে ও আমার সন্তানদেরকে মূর্তির ইবাদত থেকে দূরে রাখুন”। [সূরা ইব্রাহিম -৩৫]
আল্লাহ আমাদেরকে শিরক থেকে বাঁচার তাওফীক দান করুন।