শান্তি বাহিনীর অশান্তির রাজত্ব; নির্যাতিত বাঙালিদের কেউ নেই

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুন ২৩ ২০২১, ১৮:৫০

তাহমিদুল ইসলাম:  পাহাড়ে যদি আপনি শান্তিতে থাকতে চান, তাহলে আপনাকে ‘শান্তিবাহিনী’র কথা মেনে নিতে হবে। আর তাদেরকে ট্যাক্স দিতে হবে।

যদি তাদের বিরুদ্ধাচরণ করতে চান, তাহলে আপনার শান্তি নষ্ট করার দায়িত্ব তারা খুব যত্নের সাথে পালন করবে। বেশী শান্তি চাইলে শান্তির ঘুম পাড়িয়ে দেবে।

আমরা পাহাড়ে ঘুরতে যাই, ঘুরেটুরে ছবি তুলে চলে আসি। কিন্তু পাহাড়ের চিত্র আমাদের চোখে পড়েনা। শত শত গাছ কেটে পাহাড় সাফ করে ফেলার চিত্র আমরা দেখিনা। স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে কথা বলে কখনো তাদের দুঃখ বুঝার চেষ্টা করিনা।

বুঝলেও সেটুকু বুঝি, যতটুকু শান্তিবাহিনীর প্রধানদের টাকায় ফ্ল্যাট কেনা বুদ্ধিজীবী আর সাংবাদিকরা আমাদেরকে বুঝায়। আমরা ভাবি যে, আহা! আমরা তাদের উপর কতই না নির্যাতন চালাচ্ছি।

অথচ পাহাড়ে থাকলে আপনার তাদেরকে ট্যাক্স দিতে হবে। আপনার বাড়ীর ট্যাক্স দিতে হবে। আপনার যদি জমি থাকে, সেটার ট্যাক্স দিতে হবে। আবার সেই জমিতে যদি চাষ করেন, তার জন্যও ট্যাক্স দিতে হবে।

বছরে দুইবার করে জমির উপর ট্যাক্স দিতে হয় বাঙালীদের। ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা করবেন? গাড়ী এবং প্রতি চালানের উপর আপনাকে ট্যাক্স দিতে হবে। অষুধ কোম্পানী গুলোকে পর্যন্ত সেখানে ট্যাক্স দিতে হয়।

সেখানকার উপজাতিরা থানায় বিচার দিতে আসেনা। তাহলে ‘সেটেলারদের কাছে যাওয়ার অপরাধে’ তাদের শাস্তি হবে। যদি অনুমতি পাওয়া যায় থানায় যাওয়ার, তাহলেই আসতে পারে কেবল। তাদের চাওয়া মত চাঁদা না দিলেও আপনাকে খুন করা হবে।

পাহাড়ী এই সন্ত্রাসীরা চায় না সেখানে রোড হোক। সেখানে উন্নয়ন হোক, মানুষজন যাক। ভাবছেন পরিবেশ নষ্ট হবে এজন্য বিরোধিতা করে? যারা গাছ কাটে, পাহাড় পুড়িয়ে ফেলে তারা পরিবেশের চিন্তা করে? সেরকম কিছুই না।

পাহাড়ে পর্যটন হলে, উন্নয়ন হলে সাধারণ পাহাড়ীদের লাভ। কিন্তু এতে সন্ত্রাসীদের প্রভাব, দৌরাত্ম কমে যাবে। স্বাভাবিকভাবেই সন্ত্রাসীরা এটা চায় না। এজন্য তারা পোস্টার সাঁটিয়ে দেয়, পাহাড়ে পর্যটন বন্ধ করতে হবে।

পাহাড়কে তারা নিজেদের সম্পদ মনে করে সেটা নতুন কিছু নয়। বাঙালীদেরকে তারা বলে সেটেলার। নিজেদেরকে দাবী করে আদিবাসী।

আপনারা খেয়াল করেছেন কিনা জানিনা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরই হঠাৎ করে উপজাতি টার্ম থেকে আদিবাসী টার্ম ব্যবহার শুরু হয়। অনেকে বুঝে না বুঝে আদিবাসী টার্মটা ব্যবহার করেন। আদিবাসী অর্থ ঐ এলাকার আদিবাসিন্দা। উপজাতিদের মধ্যে বাংলাদেশের সত্যিকারের আদিবাসী হচ্ছে রাখাইন, সাঁওতাল এরা।

যারা নিজেদেরকে আদিবাসী দাবী করছে এদের পূর্বপুরুষরা মাত্র দেড়-দুইশ বছর আগে মিয়ানমার আর ভারত থেকে পালিয়ে এই দেশে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। মিয়ানমারের বর্মী রাজার হাত থেকে বাঁচতে তারা পালিয়ে এদিকে চলে আসে। এর বহু আগে থেকেই পাহাড়ে বাঙালী থাকতো। তবে ওদের মত গহীনে থাকতো না।

তারা গহীনে থাকার পেছনে তখনকার কারণ ছিল দুটি।

এক. যারা বর্মী রাজার হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসেছিল। এরা এত গহীন এবং দূর্গম পাহাড়ে চলে গিয়েছিল, যাতে বর্মী রাজা তাদের খুঁজে না পায়।

বার্মিজরা জাতিগতভাবে সহিংস। আমাদের রাখাইনদেরও উপরও তারা গণহত্যা চালিয়েছিল। প্রাণ বাঁচাতে তারা এদেশে চলে এসেছিল। তেমনি ভাবে অনেক গুলো গোষ্ঠী একেবারে গহীনে চলে যায়। সেখানেই বসবাস শুরু করে।

দুই. দস্যু। আমরা বইপত্রে যাদের মগজলদস্যু বলে পড়েছি। এরা জলে যেমন ডাকাতি করত, স্থলেও ডাকাতি, লুটতরাজ করত।

ডাকাতির জিনিষপত্র নিয়ে তারা একেবারে গহীনে দূর্গম পাহাড়ের ভেতর চলে যেত। লুটের জিনিষপত্র এখানেই লুকিয়ে রাখত।

শাসকরা আর খুঁজে পেত না তাদের।

যাই হোক, তারা এখন আদিবাসী হয়ে গেছে সমস্যা নাই। দলে দলে তারা খ্রিস্টান হয়ে যাচ্ছে, তাও সমস্যা নাই। সমস্যা হচ্ছে- মুসলমান হলেই।

পাহাড়ে আপনি যাই হোন, মুসলমান হতে পারবেন না। হয়ে গেলে আপনাকে খুন করা হবে। আপনি শহরের দিকে পালিয়ে গেলে খুঁজে বের করে খুন করা হবে। তাদের সেই পরিমাণ টাকা এবং রিসোর্স আছে।

কিন্তু তারা খ্রিস্টানদের সাথে লাগতে যায় না। এর কারণ হচ্ছে, তাদের আল্টিমেট লক্ষ্য হচ্ছে জুম্মল্যান্ড নামক আলাদা দেশ প্রতিষ্ঠা। সেক্ষেত্রে ইন্টারন্যাশনাল যে সাপোর্ট দরকার, খ্রিস্টানদের মারতে গেলে তারা সেটা পাবে না। আর খ্রিস্টানদেরকে তারা খুব একটা সমস্যা বলেও মনে করেনা। তাদের সমস্যা হচ্ছে বাঙালী আর মুসলমান।

পাহাড়ে বেড়ে উঠা একটা বাঙালী শিশুও জানে তাদের কত ক্ষমতা সেখানে৷ এই কারণে চাকমা একটা ছেলে তাকে থাপ্পড় মারলেও সে তার প্রতিবাদ করেনা। এমনকি কখনো যদি পিতাকে গিয়ে বিচার দেয়, তার পিতা তাকে চুপ থাকতে শিখিয়ে দেন। সেখানে তাদের সামান্য বিরোধিতা করলেও টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠবে।

আপনি মুসলমান হলে হত্যা করা হবে, সমস্যা নাই। খুব একটা প্রতিবাদ হবে না। কিন্তু আপনি মুসলিম হয়েছেন এটা প্রচার করা হলে ‘পাহাড়ী সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে’ বলে চিৎকার করে উঠবে পুরা ঢাকা। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা।

খ্রিস্টান হয়ে গেলে অবশ্য পাহাড়ী সংস্কৃতি সবুজই থাকে।

পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা শান্তিবাহিনী নামে আর নেই, তারা এখন নাম বদলেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী হয়েছে সন্তু লারমার জেএসএস।

তারা একই সঙ্গে ঢাকার ফেভারও পায়, রাষ্ট্রীয় অতিথি হয় আবার পাহাড়ে নির্বিঘ্নে চাঁদাবাজি আর খুন রাহাজানি করে।

১৯৮৪ সালের ৩০ মে এক ভোরে সারারাত নিরস্ত্র বাঙালীদের উপর হত্যাকাণ্ড চালিয়ে ৪০০ এর বেশী মানুষের একটা গ্রামকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়৷ ধরে ধরে জবাই করা হয়েছিল বাঙালীদের। গুলি করে মারা হয়েছিল।

২০১৫ সালে সম্ভবত, দুই লাখ টাকা চাঁদা না দেয়ায় মাটিরাঙা বাজারে এক ব্যবসায়ীকে দিন দুপুরে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। তখন আমি সেখানে।

পাহাড়ে সাধারণ পাহাড়ী এবং বাঙালীদের নিরাপত্তার জন্য সেনাবাহিনী নিয়োগ দেয়া হয়েছিল সেখানে। এতে পাহাড় কিছুটা শান্ত ছিল। যদিও সেনা সদস্যদেরও প্রায় হত্যা করা হত।

২০১০ এর পর শান্তিবাহিনীর সাথে শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবে বেশীরভাগ সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।

হত্যাকাণ্ডের এমন আরো কিছু ঘটনা নীচে উল্লেখ করা হলো। হয়তো পড়বেন না। কিন্তু ডকুমেন্টস হিসেবে উল্লেখ করলাম। পড়লে একটা ভালো ধারণা পাবেন।

ঘটনাক্রম :

(১৯৭৭-) : পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি ও সেনা হত্যা

৬ মে ১৯৭৭ : সাঙ্গু নদীতে কর্তব্যরত অবস্থায় আবদুল কাদিরসহ পাঁচ সেনাসদস্যকে হত্যা।

২৫ অক্টোবর ১৯৭৭ : বান্দরবানে নিহত হন নায়েক আবদুল গণি মিয়া, নায়েক আবদুস সাত্তার, নায়েক আরিফ, সিপাহী লুৎফর রহমান, সিপাহী আলী হোসেন এবং সিপাহী আবদুল খালেক মুন্সি।

২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ : সাঙ্গু নদীতে অ্যামবুশ, এক সেনাসদস্যকে হত্যা এবং প্রচুর গোলাবারুদ লুট।

৫ জুলাই ১৯৭৯ : কাপ্তাই নতুন বাজার থেকে ২ জন আনসার সদস্যকে অপহরণ করে হত্যা।

১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭৯ : দীঘিনালায় নায়েক এসএম রুহুল আমিনকে হত্যা।

১৪ অক্টোবর ১৯৭৯ : খাগড়াছড়িতে পাঁচ সেনাসদস্যকে হত্যা।

১৯ ডিসেম্বর ১৯৭৯, লংগদু : একই রাতে একযোগে কয়েকটি গ্রামে হামলা, ২০ অ-উপজাতীয়কে হত্যা, আহত ৪০, ১০৪টি বাড়ি অগ্নিদগ্ধ।

২৩ জানুয়ারি ১৯৮০ : খাগড়াছড়িতে তিন সেনাসদস্য খুন, আহত ৫।

২১ এপ্রিল ১৯৮০ : ফালাউংপাড়া নামের একটি স্থানে অ্যামবুশ করে ১১ রাইফেল ব্যাটালিয়নের ২০ জন জওয়ানকে হত্যা, প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র লুট।

১ মার্চ ১৯৮০ : ঘন্টিছড়া নামের একটি স্থানে অ্যামবুশ করে হত্যা করা হয় মেজর মহসিন আলমসহ ২২ জন সেনাসদস্যকে।

২৫ মার্চ ১৯৮০, কাউখালী : বাঙালি বসতিতে হামলা, দুই পক্ষে নিহত ২৯, আহত ১১ জন।

১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৮০, কাউখালী, বেতছড়ি ও কচুখালী : আকস্মিক আক্রমণে ৬ বাঙালি খুন, আহত ২৫ জন।

২৯ এপ্রিল ১৯৮৪ : খাগড়াছড়ি মাটিরাঙ্গায় বাঙালি বসতিতে গণহত্যা। হতাহতের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায়নি।

৩১ মে ১৯৮৪, বরকল : দিবাগত রাতে বাঙালি বসতিতে হামলা, ৮৮ জনকে গুলি করে হত্যা, আহত ৩৩ এবং ১৮ জন অপহৃত। আগুনে পুড়ে ছাই ২৬৪টি বাড়ি।

১৯ জুলাই ১৯৮৬ : খাগড়াছড়িতে এক সেনাসদস্য নিহত, আহত ৭।

২২ জুলাই ১৯৮৬, দীঘিনালা : সশস্ত্র হামলায় ২৪ বাঙালি খুন, ৩২ জনকে অপহরণ।

৭ আগস্ট ১৯৮৬ : ২ জন আনসার সদস্যকে অপহরণ করে হত্যা।

২১ জুন ১৯৮৭ : নাড়াইছড়ির অদূরে অ্যামবুশ, সেনাসদস্য আবদুর রাজ্জাক, ইসমাঈল হোসেন ও মোহনলালকে হত্যা।

২৪ নভেম্বর ১৯৮৭ : শিলছড়িতে দুই সেনাসদস্যকে গুলি করে হত্যা।

১৮ এপ্রিল ১৯৮৯, বাশখালী : পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে ১৫ জনের মৃত্যু।

২৭ জানুয়ারি ১৯৮৯ : বন কর্মকর্তা আবুল হোসেন, বজল আহমদ ও মাহবুবুল আলমকে অপহরণ করে হত্যা।

৪ মে ১৯৮৯, লংগদু : আকস্মিক আক্রমণে ১৫ বাঙালির মৃত্যু।

১৬ এপ্রিল ১৯৯০, নাইক্ষ্যংছড়ি ও বলিপাড়া : ১৯ বাঙালিকে গুলি করে হত্যা। এ বছরই থানচিতে ১১ জন সেনা জওয়ানকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়।

১০ জানুয়ারি ১৯৯২, খিরাম : খিরাম বন কার্যালয়ে আক্রমণ, ৬ কর্মচারীকে হত্যা।

২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২, লংগদু : চলন্ত লঞ্চে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ১৭ বাঙালিকে হত্যা।

২৯ জুন ১৯৯২ : মহালছড়ি-রাঙ্গামাটি সড়কে পাহারা চৌকির ওপর হামলা, দুজন সেনা সদস্য নিহত।

১৪ জুন ১৯৯৫ : শান্তিবাহিনীর ২০ সদস্যের একটি গ্রুপের হাতে ব্যাংক লুট। গার্ডকে হত্যা এবং দুই ব্যাংক কর্মচারীকে অপহরণ।

৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬, পাকুয়াখালী (রাঙামাটি) : নৃশংস হামলা চালিয়ে ৩৫ জন বাঙালী কাঠুরিয়াকে হত্যা। আমাদের সেনাবাহিনীকে তারা বলে জলপাই সন্ত্রাসী। বাঙালীদের বলে সেটেলার। এমনকি কোনো উপজাতি ইসলাম গ্রহণ করলে তাকেও সেটেলার বলে গালি দেয়।

সর্বশেষ দুই দিন আগে ইসলাম গ্রহণের অপরাধে বান্দরবনের রোয়াংছড়িতে ওমর ফারুক ত্রিপুরাকে গুলি করে হত্যা করে সন্তু লারমার জন সংহতি সমিতি – জেএসএস। ইসলাম ত্যাগ করার জন্য তাকে অনেকদিন ধরেই তারা আল্টিমেটাম দিয়ে রেখেছিল।

পাহাড়ে নিরীহ মানুষরা মারা যায়, রাষ্ট্রদোহী সন্ত্রাসীরা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়। আমরা না বুঝে শুধু তাদের পারপাসই সার্ভ করি।

পাহাড়ে শুধু ঘুরতে যাবেন না, সুশীলরা যা বলে তাতে বিশ্বাস করবেন না। পাহাড় সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখেন। না হয় একসময় পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়ার জন্যও ভিসা লাগবে।