গণমাধ্যমে বামপন্থার বিকাশ: সুযোগ-সুবিধার নানান ফাঁদে আটকে থাকছে যে যেভাবে

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

ডিসেম্বর ১০ ২০২১, ০০:২৭

শরীফ মুহাম্মদ: চালু গণমাধ্যমের প্রভাব নিয়ে প্রধান কাজ থাকে তার অন্য ব্যবসার সুরক্ষা দেয়া। নানারকম সুবিধার জন্য চাপ সৃষ্টির সুযোগ দাঁড় করানো। ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীন রাজনৈতিক শগণমাধ্যমের পুঁজি তো এখন বড়। পরিসর ও অঙ্গনও বড়। সচল দৈনিক পত্রিকার সংখ্যাই তো পচিশের উপরে। চলমান টেলিভিশন-রেডিওর সংখ্যাও বিশ-পচিশের কম নয়। কয়েক ডজন পেরিয়েছে পাঠক-পরিচিত অনলাইন পত্রিকার সংখ্যাও। কাটতি ও বিজ্ঞাপনই এসবের আয়ের খাত। সে হিসেবে সবকটি সচল পত্রিকা ও চ্যানেলে বিনিয়োগকৃত পুঁজি যে লাভ নিয়ে ফিরে আসছে- ব্যাপারটা এমন নয়। কিন্তু টাকার অংকে সরাসরি লাভ না হলেও ‘অন্য লাভটাই’ থাকে বিনিয়োগকারীদের প্রধান টার্গেট। ক্তির পক্ষ-বিপক্ষের কাভারেজ দিয়ে নিজেদের গুরুত্ব বাড়ানো। প্রতিদ্ব›দ্বীর বিপরীতে নিজের সামর্থ তুলে ধরা। মতাদর্শিক কোনো সংকট কিংবা বিচ্যুতি না থাকলেও এসব পেয়েই খুশি থাকে মালিকপক্ষ।

মালিকের মাথায় ঈমানের পক্ষ-বিপক্ষ, মূল্যবোধ, ইতিহাস, চেতনা আর আদর্শের সূক্ষ্ম বিষয়গুলো কোনো অনুভূতিই জাগাতে পারে না। এ কারণেই ‘বামদুর্বল’ সম্পাদক  পলিসি নির্মাতাদের হাতে পড়ে ‘ডানপন্থী’ বিত্তবান রাজনীতিক কিংবা ব্যবসায়ীর গণমাধ্যমও হয়ে উঠে উগ্র ‘সেকুলার’ ও ‘মুক্তচিন্তা’ তোষণের কড়া হাতিয়ার। বেচারা মালিক সেটা দেখেও যেন বুঝতে পারেন না। বুঝলেও কিছু করতে পারেন না।

অপর দিকে ‘বামদুর্বল’ নীতিনির্ধারক সংবাদকর্মীরা বেছে নেন অন্য সুবিধা। প্রথমত ইসলামবিরোধী, বস্তুতান্ত্রিক ও পশ্চিমানুরক্ত একটি গণমাধ্যমের বিস্তারে তারা মিশন সাফল্যের আনন্দ লাভ করেন। দ্বিতীয়ত অনৈতিক এ পক্ষপাতের মধ্য দিয়েই তারা নিজেরা গ্রহণ করেন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত, আর্থিক ও পরিবেশগত বিভিন্ন সুখের আয়োজনে তারা যুক্ত হতে পারেন সহজেই। পেশা ও সমাজের নিরাপত্তা পেয়ে উপকৃত হন। কেউ কেউ ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ব্যবসাও এভাবে স্ফীত করার প্রয়াস পান। বিনিময়ে তারা অকাতরে চিন্তা, আদর্শ, শিক্ষা ও জীবনযাত্রার ক্ষেত্রগুলোতে বিদেশী এজেণ্ডা ও ভাবধারার ব্যাপক, সূক্ষ্ম ও ধারাবাহিক আবেদনমূলক প্রচার দিতে থাকেন।

কোনো কোনো সময় ভিন্ন দেশের ব্যবসা ও নিরাপত্তা স্বার্থের অনুকূলেও দূর থেকে জনমত তৈরির কাজ করার অভিযোগ পাওয়া যায় এসব গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে। পশ্চিমা ও আঞ্চলিক দেশগুলোর কাছে সমাদৃত কিছু নাগরিককে সুশীল ও মেধাবী অভিজাত নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার একটি পর্যায়ক্রমিক অভিযান রচনায় ব্যস্ত হয়ে উঠেন তারা। পশ্চিমা-পছন্দ এনজিও ও ইস্যুর সঙ্গেও সহযাত্রী হয়ে সুর উঁচু করেন। আর এসব কিছুই করা সহজ হয়ে উঠে সংঘবদ্ধতা ও ‘বামদুর্বল’ এবং ‘ইসলাম নিস্পৃহ’ মানসিকতার ঐক্যের কারণে।

এ ক্ষেত্রে যে দুয়েকটি গণমাধ্যম ও তার কর্মী-কর্ণধাররা ভিন্নধারায় টিকে থাকতে চান তারা সম্মিলিত উল্টো চিন্তার স্রোতের সামনে টিকতে পারেন না। গণমাধ্যমের এসব মতান্ধ কারিগররা বর্তমানে অবশ্য বাম আদর্শের মৌলিক কোনো কিছু অনুসরণ করেন না। বরং বিত্ত ও ভোগের সঙ্গে একাত্ম হয়ে এরা কেবল ইসলাম-অনুরক্ততার বিরুদ্ধে মেধা ও শ্রমের বড় অংশ ব্যয় করে তুষ্টি লাভ করেন। পুঁজি, সাম্রাজ্যবাদ ও ইসলামবৈরি বহুমুখি সাম্প্রদায়িকতার নিষ্ঠাবান কর্মী হতে পেরে আত্মপ্রসাদ অনুভব করেন।

গণমাধ্যমের বর্তমান ইসলাম-নিরাসক্ত ও কথিত মুক্তচিন্তাবান্ধব চেহারার পেছনের পটভূমি মূলত এগুলোই। ব্যবসার প্রভাব পেয়ে খুশি মালিক বেচারাকে অন্ধকারে রেখেই গণমাধ্যমের ধূর্ত চক্র এসব করে যায়। অভিযোগ উঠেছে, এভাবেই তারা কোটি কোটি দর্শক-পাঠকের সামনে অসরল ও অস্বচ্ছ একটি এজেণ্ডা চাতুর্যের সঙ্গে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষের ধর্মবিশ্বাস ও ঐতিহ্য চেতনা- যারা তাদের দর্শক-পাঠক-যেমন তারা আমলে নিচ্ছেন না তেমনি ধর্ম এবং আদর্শের জায়গাটাতে বিনিয়োগকারীর চিন্তা ও বোধেরও প্রতিনিধিত্ব করছেন না। বলা হয়ে থাকে, একশ্রেণীর সরল ও মেধাহীন পুঁজির জোরেই এই বামদুর্বল ও ইসলাম-নিস্পৃহ গণমাধ্যমের এজেণ্ডা বাস্তবায়িত হতে পারছে।

অবশ্য সাম্প্রতিক বাস্তবতায় আরেকটু ভিন্নতাও সামনে আসছে। সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে, চিন্তায় ও দৃষ্টিভঙ্গিতে ইসলাম-নিষ্পৃহ, পশ্চিমানুরক্ত একশ্রেণির মালিকও গণমাধ্যমে পুঁজি বিনিয়োগ করছেন। এদের কেউ কেউ বহুজাতিক ব্যবসার স্থানীয় প্রতিনিধি। কেউ আবার বিত্তের সঙ্গে সেকুলার রাজনীতির নব্য ক্রিমসন্ধানী। সেক্ষেত্রে মালিক-কর্মীর মতে মতে পূর্ণ মিলনও ঘটে থাকে।

বড় ব্যাপার হলো, গণমাধ্যম এখন আর হাতে গোনা কিছু মানুষের মনোযোগ-আকর্ষক অঙ্গন নয়। গণমাধ্যম বর্তমানে সার্বক্ষণিক বাস্তবতা। প্রতিদিন তথ্য ও চেতনা বিতরণ করছে। সংবাদপত্রে, টিভি চ্যানেলে ও অনলাইন পোর্টালে। নতুন নতুন ইস্যু আনছে। পুরনো অনেক কিছুকে ভুলিয়ে দিচ্ছে। সংস্কৃতির নতুন উপলক্ষ তৈরি করছে। ইতিহাস ও চেতনার নতুন শিরোনাম এঁকে দিচ্ছে। গতিপথ বদল করছে সভ্যতার।

গণমাধ্যম কেবল এখন শিক্ষিতজনের পঠনীয় নয়। এখন সার্বজনীন পাঠের, দেখার, গেলার বিষয়। কোটি কোটি অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষও টেলিভিশনের পর্দায় আর মোবাইলের এফএমে এখন খবর ও আলোচনা দেখেশুনে সময় কাটায়। ওইসব খবর ও আলোচনার ফলাফল সরাসরি গ্রহণ করে। নিজের মত অজান্তেই অন্যের সরবরাহ করা মতের মধ্যে ঢুকে যায়। পক্ষের জন বিপক্ষে চলে যায়। নিজের ধর্ম ও বিশ্বাসকে অপ্রয়োজনীয় করে তুলে ধরা হয়। অন্যের ধর্ম ও অপরের কৃষ্টিকে আপন বানিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। নতুন করে জনগণ পর্যায়ে শেখানো হয় অনেক তত্ত¡। যখন তখন উত্তেজনা, ক্ষোভ, পক্ষ-বিপক্ষ দাঁড় করানো হয়। মুহূর্তের মধ্যেই ক্লেশের বারুদ আর ঘৃণার আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। গত দুই দশক ধরে গণমাধ্যম অনেক বেশি নির্মাণ ও ধ্বংসের ক্ষমতা নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে এ দেশে।

এজন্যই গণমাধ্যমকে এখন উপেক্ষাযোগ্য কোনো বিষয় মনে করা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় সাধারণ স্তরের লঘু- আমলযোগ্য কোনো বিষয় হিসেবেও গ্রহণ করা। এর প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া অনেক দূর চলে গেছে। গণমাধ্যম হয়তো কড়া এন্টিবায়োটিক ও ভিটামিন হবে, নয়তো হবে অনেক শক্তিশালী ভাইরাস ও ইনফেকশন। গণমাধ্যমের এ দুই ভূমিকার বাইরে নয় আজকের সমাজ। তাই গণমাধ্যমের ভেতর-বাইরের কর্মকাণ্ড নিয়ে সচেতন হতে হবে দ্বীনদার শিক্ষিত মানুষকে। গণমাধ্যমে পুঁজির বিনিয়োগ ও গণমাধ্যমের কর্মী নিয়োগ এবং নীতি বিন্যাসের প্রতিটি বিষয় নিয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষকে ভাবতে হবে।

ছাপা হওয়া ও সম্প্রচার হওয়া বিষয় মানেই অকাট্য সত্য কিংবা অবধারিত- এ চিন্তা বাদ দিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়টি নিয়ে বিপরীত দিক থেকেও ভাবতে শেখাতে হবে জনসাধারণকে। ভাবতে হবে গণমাধ্যমের পুঁজি ও তার কর্মীদের সচেতনতা ও হেদায়েতের উপায় নিয়েও। পাত্র অনুযায়ী দাওয়াতের পদ্ধতি নিয়েও। গণমাধ্যম এখন নিছক সংবাদ-মাধ্যমের স্তরে আবদ্ধ নয়। বরং কার্যকারিতার দিক থেকে গণমাধ্যম বর্তমানে গণবিচ্যুতি কিংবা গণশিক্ষার বড় মাধ্যম। গণমাধ্যম এখন কেবল তথ্য জানার উপলক্ষ নয়, বরং গণমাধ্যম বর্তমানে জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা ধ্বংস বা গড়ারও বড় মাধ্যম। গণমাধ্যম কেবল খবর ও আলোচনার প্রাঙ্গন নয়। চরিত্র ও শালীনতা রক্ষা কিংবা ধ্বংসেরও বড় কেন্দ্র। সংস্কৃতি ও চেতনা বদলের জন্য এর চেয়ে সহজ ও স্বল্পমেয়াদী প্রক্রিয়ায় সাফল্যলাভ আর কোনো মাধ্যমের পক্ষে হয়তো সম্ভব নয়। এজন্যই গণমাধ্যমের পুঁজি-কর্মী ও নীতির বিষয়গুলোর প্রতি আলেম-দাঈ ও শিক্ষিত দ্বীনদার শ্রেণির সবারই সমান মনোযোগ দরকার। আল্লাহ তাআলা কবুল করুন।

[জানুয়ারি ২০১৬’ তে প্রকাশিত ‘গণমাধ্যমে মেধাহীন পুঁজি ও অন্যান্য’ প্রবন্ধ থেকে।]