যেসব কারণে রিজিকে বারাকাত আসে বা রিজিক বৃদ্ধি হয়

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

নভেম্বর ২৩ ২০২০, ১৭:০৯

আব্দুল কাদির আল মাহদি: আল্লাহ তা’আলা সমস্ত সৃষ্টিকুলের স্রষ্টা, এবং তাদের জীবিকার দায়িত্ব তিনি নিজ হতে রেখেছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন- وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إِلَّا عَلَى اللَّهِ رِزْقُهَا وَيَعْلَمُ مُسْتَقَرَّهَا وَمُسْتَوْدَعَهَا ۚ كُلٌّ فِي كِتَابٍ مُبِينٍ

আর পৃথিবীতে কোন বিচরণশীল নেই, তবে সবার জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহ নিয়েছেন। তিনি জানেন তারা কোথায় থাকে এবং কোথায় সমাপিত হয়। সবকিছুই এক সুবিন্যস্ত কিতাবে রয়েছে। (আল কোরআন ১১/৬)

তিনিই একমাত্র একক সত্ত্বা, যিনি সমস্ত সৃষ্টিকুলকে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন- ‎إِنَّ اللَّهَ هُوَ الرَّزَّاقُ ذُو الْقُوَّةِ الْمَتِينُ

আল্লাহ তা’আলাই তো জীবিকাদাতা শক্তির আধার, পরাক্রান্ত। (আল কোরআন ৫১/৫৮)

প্রত্যেক সৃষ্টিজীবের রিজিক তথা জীবিকা অলরেডি নির্ধারিত ও বন্টিত। আর বিষয়টি অপরিবর্তিত। মানুষ ও জীবজন্তু শুধু আপন আপন চেষ্টা চালিয়ে যাবে, এবং মাধ্যম গ্রহন করবে। তাদের চেষ্টার ভিতর দিয়ে নির্ধারিত জীবিকা তাদের কাছে পৌঁছবে। রিজিক নির্ধারিত হলেও কিছু বিষয় আছে- যে বিষয়গুলোর মাধ্যমে রিজিকে বারাকাত আসে। রিজিক প্রশস্ত হয়। জীবনযাপন সহজ হয়। আসুন জেনে নেই রিজিক বৃদ্ধি ও প্রশস্ত হওয়ার কিছু উল্লেখযোগ্য কারণ।

রিজিক বৃদ্ধির একটি কারণ হচ্ছে তাক্বওয়া তথা আল্লাহ তা’আলার সাথে ভাল লিঙ্ক রাখা। নিজেদের ভিতর আল্লাহ ভীতি রাখা।এর মাধ্যমে রিজিকে বারাকাত ও প্রশস্ততা আসে। কেননা তাক্বওয়া হচ্ছে- সব ভালোর মূল ও সব উন্নতির চাবিকাটি। আল্লাহ তা’আলা বলেন- وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَىٰ آمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ وَلَٰكِنْ كَذَّبُوا فَأَخَذْنَاهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ

আর যদি সে জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং পরহেযগারী অবলম্বন করত, তবে আমি তাদের প্রতি আসমানী ও পার্থিব নেয়ামত সমূহ উম্মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। সুতরাং আমি তাদেরকে পাকড়াও করেছি তাদের কৃতকর্মের বদলাতে। (আল কোরআন ৭/৯৬)

এখানে আল্লাহ তা’আলা পূর্বসূরি জাতির কথা উল্লেখ করেছেন। তারা যদি তাদের সময়ের নবী, রাসুলদের প্রতি ঈমান আনত। তাক্বওয়ার পথ অবলম্বন করত। তাহলে আল্লাহ তা’আলা তাদের জন্য প্রবৃদ্ধির পথসমূহ খুলে দিতেন। তাদের জন্য পর্যাপ্ত মেঘবৃষ্টির ব্যবস্থা করতেন। জমিন থেকে পর্যাপ্ত উদ্ভিদ ফসলাদির ব্যবস্থা করতেন। পশুপালকে তাদের আনুগত্য করে দিতেন। দুনিয়াতে বারাকাতময় জীবনযাপনের ব্যবস্থা হত আর আখেরাতে ভাগ্যবানদের সাথে তাদের স্থান হত।

এই তাক্বওয়ার গুণাগুণ হচ্ছে সব সুখ স্বচ্ছন্দের চাবি কাটি। আল্লাহ তা’আলা বলেন- وَأَنْ لَوِ اسْتَقَامُوا عَلَى الطَّرِيقَةِ لَأَسْقَيْنَاهُمْ مَاءً غَدَقًا

আর এই প্রত্যাদেশ করা হয়েছে যে, তারা যদি সত্যপথে কায়েম থাকত, তবে আমি তাদেরকে প্রচুর পানি বর্ষণে সিক্ত করতাম। (আল কোরআন ৭২/১৬)

দ্বিতীয়ত দান-সদকা হচ্ছে রিজিক বৃদ্ধির আরেকটি কারণ। ইউসুফ (আ) এর ভাইদের ভাষায় কোরআনে বলা হচ্ছে- إِنَّ اللَّهَ يَجْزِي الْمُتَصَدِّقِينَ

আল্লাহ দাতাদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকেন। (আল কোরআন ১২/৮৮)

অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা সদকার মাধ্যমে আখেরাতে ছাওয়াবের অধিকারী করেন ও দুনিয়াতে রিজিক প্রশস্ত করে দেন। আর আল্লাহ তা’আলা তার চেয়ে উত্তম অবশিষ্ট প্রতিদান প্রস্তুত করে রেখেছেন। দানকৃত বস্তু থেকে উত্তম জিনিস স্থলাভিষিক্ত করে থাকেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَمَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ شَيْءٍ فَهُوَ يُخْلِفُهُ ۖ وَهُوَ خَيْرُ الرَّازِقِينَ

তোমরা যা কিছু ব্যয় কর, তিনি তার বিনিময় দেন। তিনি উত্তম রিযিক দাতা। (আল কোরআন ১২/৮৮)

দান-সদকা মালকে যেমন বৃদ্ধি করে তেমনি মালের ভিতর বারাকাত চলে আসে। রাসুল (সা) হাদিসে ক্বুদসীতে বলেন, আল্লাহ তা’আলা বলেন-  قَالَ اللَّهُ تعالي أَنْفِقْ أُنْفِقْ عَلَيْكَ

তুমি খরচ কর, আল্লাহ তা’আলা তুমার উপর খরচ করবেন। আর্থাৎ তুমাকে আরও সম্পদশালী বানাবেন।রাসুল (সা) এর অন্য বর্ণনায় বলেন- يَدُ اللَّهِ مَلأَى لاَ يَغِيضُهَا نَفَقَةٌ سَحَّاءُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ

আল্লাহ তা’আলার হাত পরিপূর্ণ, এবং সারা রাতদিন ব্যয় করে তা হ্রাস পায় না।

এইজন্য রাসুল (সা) হাদিসে শপথ করে, দান-সদকার মাধ্যমে মাল ও রিজিক বৃদ্ধির ঘোষণা করেন। রাসুল (সা) বলেন- ثَلاثَةٌ أُقْسِمُ عَلَيهِنَّ، وَأُحَدِّثُكُم حَدِيثًا فَاحْفَظُوهُ: مَا نَقَصَ مَالُ عَبدٍ مِن صَدَقَةٍ

আমি তিনটি বিষয়ে শপথ করছি, এবং তোমাদের কাছে বর্ণনা করছি, তুমরা এগুলো মুখস্ত করে রাখবে। বিষয় তিনটির অন্যতম হচ্ছে দান-সদকা করলে কোন বান্দার সম্পদ হ্রাস পায় না। (তিরমিজি)

কাজেই যেব্যক্তি তার রিজিকে বরকত চায় সে যেন দান-সদকা করে। অভাবী গরীবদের যেন না ভুলে। দূর্বলদের প্রতি যেন সহানুভূতিশীল হয়। তাদেরকে সামর্থনুযায়ী যেন সাহায্য সহায়তা করে।

রিজিক বৃদ্ধির আরেক অন্যতম কারণ হচ্ছে- আত্মীয়তার সাথে সম্পর্ক ভাল রাখা। আত্মীয় বা রক্তের সম্পর্কের মানুষদের সাথে ভাল সম্পর্ক রিজিকে বারাকাত আসে। রিজিক প্রশস্ত হয়। রাসুল (সা) বলেন-  مَنْ سَرَّهُ أَنْ يُبْسَطَ لَهُ فِي رِزْقِهِ أَوْ يُنْسَأَ لَهُ فِي أَثَرِهِ فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ

রাসুল (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি পছন্দ করে যে, তার জীবিকা বৃদ্ধি হোক অথবা তাঁর মৃত্যুর পরে সুনাম থাকুক, তবে সে যেন আত্মীয়ের সঙ্গে সদাচরণ করে। (বুখারী ও মুসলিম)

এই হাদিসে তাদের জন্য সুসংবাদি যারা মাতাপিতার সাথে সদাচরণ করে। আত্মীয়-স্বজনদের দেখবাল করে। এমন ব্যবহারে রিজিক ও জীবনে অনেক বারাকাত আসে।

রিজিক বৃদ্ধির আরেকটি কারণ হচ্ছে- বেশি বেশি ইস্তিগফার ও আল্লাহ তা’আলার কাছে তাওবা করা। আল্লাহ তা’আলা হুদ (আ) এর ঘটনা বর্ণনা দিতে গিয়ে হুদ নবী (আ) এর ঘোষণা উল্লখ করে বলেন-

وَيَا قَوْمِ اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُوا إِلَيْهِ يُرْسِلِ السَّمَاءَ عَلَيْكُمْ مِدْرَارًا وَيَزِدْكُمْ قُوَّةً إِلَىٰ قُوَّتِكُمْ وَلَا تَتَوَلَّوْا مُجْرِمِينَ

আর হে আমার কওম! তোমাদের পালন কর্তার কাছে তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা কর, অতঃপর তাঁরই প্রতি মনোনিবেশ কর; তিনি আসমান থেকে তোমাদের উপর বৃষ্টি ধারা প্রেরণ করবেন এবং তোমাদের শক্তির উপর শক্তি বৃদ্ধি করবেন, তোমরা কিন্তু অপরাধীদের মত বিমুখ হয়ো না। (আল কোরআন ১১/৫২)

বৃষ্টি হচ্ছে রিজিক বন্দোবস্তের অন্যতম কারণ। উমর (রা) বলেন- (أينما كان الماء كان المال) যেখানে পানি সেখানে মাল তথা ধন।

এভাবে আল্লাহ তা’আলা নুহ (আ) এর ঘটনা বর্ণনা দিতে গিয়ে কোরআনে বলেন- فَقُلْتُ اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ إِنَّهُ كَانَ غَفَّارًا (10) يُرْسِلِ السَّمَاءَ عَلَيْكُم مِّدْرَارًا (11) وَيُمْدِدْكُم بِأَمْوَالٍ وَبَنِينَ وَيَجْعَل لَّكُمْ جَنَّاتٍ وَيَجْعَل لَّكُمْ أَنْهَارًا (12)

অতঃপর বলেছিঃ তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা প্রার্থনা কর। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের উপর অজস্র বৃষ্টিধারা ছেড়ে দিবেন। তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে দিবেন, তোমাদের জন্যে উদ্যান স্থাপন করবেন এবং তোমাদের জন্যে নদীনালা প্রবাহিত করবেন।

অর্থাৎ তোমরা যদি আল্লাহ তা’আলার কাছে ক্ষমা চাও, এবং তাওবা কর, তাঁর আনুগত্য কর। তিনি তোমাদের রিজিক বৃদ্ধি করে দিবেন। আসমানের পানি দ্বারা প্রশমিত করবেন। জমিন থেকে ভিবিন্ন উদ্ভিদ ফসলাদি দ্বারা ধন্য করবেন। তাছাড়া সন্তান-সন্ততিতেও বারাকাত দান করবেন।

আল্লাহ তা’আলার উপর সর্বাবস্থায় তাওয়াক্কুল হচ্ছে রিজিক বৃদ্ধির অন্যতম বিশেষ কারণ। আল্লাহ তা’আলা বলেন- وَمَن يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ

যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্যে তিনিই যথেষ্ট। (আল কোরআন ৬৫/৩)

প্রতিদিন রাসুল (সা) এর উপর দুরুদ পাঠ করা হচ্ছে- রিজিক বৃদ্ধির আরও একটি কারণ। রাসুল (সা) বলেন-من صلى علي مائة صلاة حين يصلي الصبح قبل أن يتكلم قضى الله له مائة حاجة عجل له منها ثلاثين حاجة وأخر له سبعين، وفي المغرب مثل ذلك.

যে ব্যক্তি প্রতিদিন ফজরের সময় একশতবার দুরুদ পাঠ করবে, আল্লাহ তা’আলা তার একশতটি জরুরত তথা প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে দিবেন। তিরিশটি প্রয়োজন এই দুনিয়াতে পূরণ হবে আর সত্তরটি আখেরাতের জন্য অবশিষ্ট থাকবে। এভাবে যদি মাগরিবের সময় আরও একশতবার দুরুদ পাঠ করে।

দুনিয়াতে পূরণ হওয়া প্রয়োজনীয়তার অন্যতম হচ্ছে-পেরেশানি মুক্ত রিজিকের বন্দোবস্ত হওয়া। রিজিক প্রশস্ত হওয়া। রিজিক বৃদ্ধি পাওয়া তথা প্রবৃদ্ধি লাভ করা। জীবনযাপনের সর্বক্ষেত্রে বারাকাত চলে আসা।

এভাবে রিজিক বৃদ্ধি বা প্রশস্ত হওয়ার আরও অনেক কারণ বিদ্যমান রয়েছে। সর্বাবস্থায় আল্লাহ তা’আলার কৃতজ্ঞতা তথা শোকর আদায় করা হচ্ছে রিজিক বৃদ্ধির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত একটি বিষয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন-  وَإِذْ تَأَذَّنَ رَبُّكُمْ لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ ۖ وَلَئِنْ كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ

যখন তোমাদের পালনকর্তা ঘোষণা করলেন যে, যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর, তবে তোমাদেরকে আরও দেব এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি হবে কঠোর। (আল কোরআন ১৪/৭)

যে ব্যক্তি শোকর আদায় করল, মূলত সে আল্লাহ তা’আলার শোকরের যোগ্য হল। কারণ আল্লাহ তা’আলা নিজে একজন শাকুর তথা কৃতজ্ঞতা আদায় কারী। আল্লাহ তা’আলা বলেন–(إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ شَكُورٌ)নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাকারী, গুণগ্রাহী।

আল্লাহ তা’আলা আমাদের রিজিকে বারাকাত দান করুন ও রিজিককে যেন প্রশস্ত করে দেন। আমিন

দারুল কোরআন ইসলামিক সেন্টার বার্সেলোনা স্পেনে আব্দুল কাদির আল মাহদি প্রদত্ত খুতবা