বন্দী রুমে কোরআন শিক্ষা ও দাওয়াতি কাজ: আলেমের সাহচর্য ও তাবলীগের প্রভাবে পার্থক্য

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

সেপ্টেম্বর ০৩ ২০২১, ১৪:০৯

আব্দুল্লাহ মায়মুন


গত পর্বের পর থেকে…

আব্দুর রহীমের মেধা সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিলো না। এরপরও আমি অতি উৎসাহে তাকে কায়েদা পড়ানো শুরু করি। এক্ষেত্রে আমার দুর্বলতা ছিলো দু’টি: ১- আব্দুর রহীমের মেধা সম্পর্কে কোনো স্বচ্ছ ধারণা না থাকা, ২- বাচ্চাদেরকে পড়ানোর ক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞতা না থাকা।

আমি মাদরাসায় পড়াই ঠিকই। কিন্তু আমার পড়ানোর ক্ষেত্র ছিলো ৬ষ্ঠ/৭ম শ্রেণীর উপরের ছাত্রদেরকে। তাই বাচ্চাদের পড়ানো হয় নি। এদিকে আব্দুর রহীমকে বাচ্চাদের বই এবং মক্তবের পাঠই পড়াতে হচ্ছে। তার নিজের সম্পর্কে সে আমাকে যা বললো তা হচ্ছে, সে ক্লাস টু পর্যন্ত স্কুলে পড়েছে; কী পড়েছে ভুলে গেছে। শুধু নিজের নামটা লিখতে জানে, তাও ভালোভাবে নয়। ‘আব্দু’ লিখতে গিয়ে ‘ব’ আর ‘দ’কে এক সাথে মিশিয়ে আবু বানিয়ে ফেলে, তখন ‘আব্দুর রহীম’ আবুর রহীম হয়ে যায়। বাংলা অক্ষরের পরিচয় কোনোভাবে জানলেও বাংলা পড়তে পারে না। আর আরবি! আরবির ব্যাপারে তার বক্তব্য হচ্ছে সে আরবি অক্ষরও চিনে না! এই হলো আব্দুর রহীমের শিক্ষাগত যোগ্যতা। আহ!

তার পেছনে তাই আমার প্রচুর মেহনত প্রয়োজন। এই লক্ষ্যেই তাকে প্রথমে আরবি অক্ষরের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকি। ‘আলিফ’ ‘বা’ ‘তা’ সহজে শিখলেও পরবর্তী অক্ষরগুলো তার জন্যে কঠিন হয়ে যায়। আমার ইচ্ছা ছিলো, তাকে কয়েকটি অক্ষরের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব, দু/তিন বার মশক করিয়ে দেব, তখন সে জপা শুরু করবে। অন্যদিকে আমি তিলাওয়াতে মশগুল হয়ে যাবো। কিন্তু কয়েকবার পড়ানোর পর বুঝলাম তার স্মৃতি অনেক দুর্বল। কোনো বিষয় খুব দ্রুত শিখতে পারে না। শিখলেও বেশি সময় ধরে রাখতে পারে না। তার সাথে বাচ্চাদের মতো লেগে থাকতে হয় আর তাকে মশক করাতে হয়। তার স্মৃতি দুর্বল হওয়ার অন্যতম কারণ হলো, সে দু’বার মাথায় প্রচণ্ড রকমের আঘাত পায়। মাথায় তখন কয়েকটি সেলাইও লাগে।

দুপুরের আগে আমাদের দুজনের খাট দুটি পাশাপাশি করে দেওয়া হয়েছিলো। দুপুর, আছর পেরিয়ে মাগরিব পর্যন্ত আমাদের মশক চলতে থাকে। মাগরিবের পর আসে এক সিনিয়র নেতা। সে এসে আমাদের দুনোজনকে পাশাপাশি দেখেই ভ্রুকুঞ্চন করে। কিছু কথাবার্তা বলে চলে যায়। এরপরেই এক পাতি নেতা এসে আমাদের দুজনের খাটকে আবার বিচ্ছিন্ন করে দেয়। রুমের দুই পাশে দুজনের দুই খাট থাকে।

তীব্র কষ্টের মধ্যে আমাদের সামান্য আনন্দ মুহূর্তেই বিষাদে পরিণত হয়। আমি এই পাতি নেতাকে জিজ্ঞেস করলাম, কারণ কী? তখন সে জবাব দেয়, প্রথমে আমি নিজ ক্ষমতাবলে তোমাদের প্রতি স্নেহাপরায়ণ হয়ে এই সুযোগ করে দিই। এখন লিডারের নির্দেশে আবার পৃথক করে দিচ্ছি।’

খাট পাশাপাশি করে দেওয়ার সময় আব্দুর রহীম অনেক খুশি হয়েছিলো। মনে মনে ভেবেছিলো, অবসর এই সময়কে কুরআন শিক্ষার সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করবে। প্রচণ্ড আগ্রহ আর উদ্যমতা নিয়ে পড়তে বসে। কিন্তু খাট পৃথক করে দেওয়ায় সে প্রচণ্ড আঘাত পায়। অনেক টেনশনে পড়ে যায়। দুশ্চিন্তা তাকে গ্রাস করে ফেলে। অত্যধিক টেনশনে আক্রান্ত হওয়ার কারণে যে রোগ তার লেগেই থাকে, ওইটা দেখা দেয়। তার কথা বন্ধ হয়ে যায়। প্রচন্ড হেচকি দেওয়া শুরু করে। চোখ বন্ধ করে বেহুঁশ হয়ে একেবারে চিৎ হয়ে পড়ে থাকে।

তখন দায়িত্বরত লোকেরা তাদের সিনিয়রদেরকে ডেকে আনতে থাকে। তারা একজন ফার্মাসিস্টকে নিয়ে আসে। সে তার প্রেশার মাপে, গ্যাসের ঔষধসহ কিছু ওষুধ দেয়। স্যালাইনের পানি খাওয়ায়, বিভিন্ন ধরনের কলাকৌশলে প্রায় ২০ মিনিট পর সে সুস্থ হয়৷ সুস্থ হওয়ার পর তারা বুঝতে পারে যে প্রকৃত রোগ হচ্ছে অত্যধিক টেনশন। ওই সময় তাদের আরেক সিনিয়র নেতা আসে। তার সিদ্ধান্তে পরে তারা কিছুটা দয়ালু হয়ে তার খাট আমার খাটের পাশে নিয়ে আসে।‌ আগে ছিলো তার আর আমার খাট পুর্ব-দক্ষিণ পাশে। আর এখন আমার খাটের পাশে তথা পশ্চিম দিকে রুমের মাঝামাঝি আমার উত্তর দিকে নিয়ে আসে। তখন তাকে আবার আমি পড়ানো শুরু করি।

আমার ইচ্ছা ছিলো তাকে অক্ষরের পরিচয় দিয়েই আমি তেলাওয়াতে ব্যস্ত হবো, কিন্তু তার সাথে সর্বদা লেগে থাকায় আমার তেলাওয়াতের মাত্রা কিছুটা কমে যায়। কিন্তু সময় ভালোভাবেই যাওয়া শুরু হয়।

এখন আমার সময় পার হচ্ছে- কিছু সময় আব্দুর রহীমকে পড়িয়ে, কিছু সময় নেতা-পাতিনেতাদের সাথে গল্প করে, বাকী সময় আমার নিজস্ব আমলে। এখন আর আব্দুর রহীমের সাথে কথা বলার জন্যে আওয়াজ উঁচু করতে হয় না,। সে পাশে থাকায় তার সাথে সহজে গল্প করা যায়। ওই সময় দায়িত্বে যে পাতি নেতা ছিলো, সে পুর্বের মতন আসা-যাওয়া এবং জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রাখে।

তার সাথে আমাদের প্রায় এক সপ্তাহ কেটে যায়। এরমধ্যে সেই বেশি কথা বলতো, আর আমরা শ্রোতা হয়ে থাকতাম। একদিন সে চলে গেলো, আসলো নতুন আরেক পাতি নেতা। ওকে দেখে কিছুটা হাবাগোবা টাইপেরই মনে হলো। মনে মনে ভাবলাম তার ভেতর হয়তো অনেক সজাগ হবে। কারণ যারা হাবাগোবা ভাব দেখায় তাদের ভেতর অনেক সজাগ হয়। কিন্তু তার কথায় তেমন মনে হলো না, কারণ তার সাথে কথা শুরু হলে সে শুধু বলতেই থাকে আর যদি তার প্রশংসা করা হয় তখন সে আরো উৎসাহী হয়ে বলতে থাকে। তার এই ভাবটা আমি সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতাম। তাকে শুধু কথা বলতে দিতাম আর বিষয় তুলে দিতাম যে, আপনার প্রেমের কাহিনী বলেন, বিয়ের কাহিনী বলেন ইত্যাদি। তখন সে প্রাণভরে উদার বুকে বউয়ের প্রশংসা করা শুরু করে। তার বউ নাকি অনেক সরল, বিশ্বস্ত, স্বামীভক্ত। তার বউয়ের আনুগত্যের কাহিনী বলা শুরু করতো। আমিও কথা বলার বিভিন্ন পয়েন্ট বের করে দিতাম। এগুলো দেখে আব্দুর রহীম মিটিমিটি হাসতো। ওই ব্যক্তি চলে যাওয়ার পর আমি আব্দুর রহীমকে হাসির কারণ জিজ্ঞেস করি, তখন সে আবার হাসতে হাসতে বলে, ‘এদের মধ্যে যদি চালাক-চতুর ব্যক্তি আসে তখন আপনাকে জিজ্ঞেস করতে থাকে, আর যদি হাবাগোবা টাইপের হয় তাহলে আপনিই তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন।’

এতদিনে নেতা-পাতি নেতা ছাড়াও দায়িত্বরত আর‌ও অনেকের সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠতা শুরু হয়। পাহারায় সর্বদা একজন নেতাসহ ছয়জন থাকতো। তারা ছয়জন করে ছয় ঘন্টা পর পর ডিউটি করতো। এতে করে তাদের চব্বিশ ঘন্টায় বারো ঘন্টা ডিউটি পড়তো। এরা ছাড়াও রাতে আরো একজন পাতি নেতা আসতো, সব মিলিয়ে সাতজন হতো। আমাদের সাথে তাদের কথাবার্তা বলা নিষেধ। প্রথমে তাই তেমন কথাবার্তা হত না, আস্তে আস্তে পরে কথাবার্তা শুরু হয়। আমিও তখন তাদেরকে স্বাভাবিকভাবে নামাযসহ দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে দাওয়াত দিতাম। কেউ কেউ গ্রহণ করতো আবার কেউ কেউ গ্রহণ করতো না। কিন্তু বিরক্ত হত না। আমাদের এই দাওয়াত বিফলে যায় নি। আস্তে আস্তে তাদের মধ্যে বেশ কিছু নামাযী তৈরি হয়ে যায়। তারাও আমাদের সাথে আমাদের জায়নামাযে আমাদের রুমেই নামায পড়তো।

তাদের তিনগ্রুপে তিনজন পাতি নেতা ছিলো। তাদের একজনের মুখে দাড়ি ছিলো এবং নিয়মিত নামায পড়তো। আমাদের প্রতি তার আচরণ অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ। আমি অনেকটা অবাক হয়ে যাই, যখন আমি জিজ্ঞেস করি আপনি কীভাবে দ্বীন পেলেন? তখন সে সোৎসাহে জবাব দেয়, তার একটি ছেলে হাটহাজারীতে পড়ে আলেম হয়েছে। এরপরে তাবলীগে সময় লাগিয়ে এক ফার্মেসীতে সময় দেয়। তাবলীগে সে উলামায়ে কেরামের সাথেই আছে। তারও ইচ্ছা কিছুদিন পর এসব চাকরী বাদ দিয়ে হজ্ব করে পুত্রের সাথে ফার্মেসীতে সময় দিবেন।’

আমি এরকম অনেক দাড়িওয়ালা ব্যক্তিকে পেয়েছি, কিন্তু কারো আচরণ এই ব্যক্তির মতন নয়। কারণ এদের কেউ কেউ দ্বীন পেয়েছে তাবলীগের মাধ্যমে, কেউ কেউ পেয়েছে পীরের মাধ্যমে, কেউ অডিও-ভিডিও দেখে, কেউ শুধু বই পড়ে। কিন্তু কেউ এই ব্যক্তির মতন নয়। এসব দাড়িওয়ালারা তাদের কাজকে ফরজ মনে করে, এই জুলুমকে তাদের উপর কর্তব্য মনে করে, তাই তাদের মনে নেই কোনো অনুশোচনা। তো চাকরি বাদ দিবে কীভাবে?

এছাড়াও আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে, যারা আলেমের সোহবতে থেকে দ্বীন শিখে, তাদের দ্বীনের বুঝ ও আচরণ আর যারা বিভিন্ন বই-পুস্তক, অডিও-ভিডিও, পীরের মুরীদ এবং শুধু তাবলীগ থেকে দ্বীন শিখে তাদের মধ্যে অনেক পার্থক্য। এই ব্যক্তি তাদের একজন যার দ্বীনের বুঝ ও আচরণ অনেক ব্যতিক্রম।

চলবে ইনশাআল্লাহ…

মিহনা’র অন্যান্য পর্বের লিঙ্ক নিচে দেয়া হল—

  1. মিহনা: গুম জেল রিমান্ডের ৬৪১ দিন
  2. ড্রাইভারকেও অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে ওরা আসে আমার স্ত্রীর কাছে
  3. চোখ বেঁধে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে ওরা আমাকে গাড়ির ফ্লোরে শুইয়ে রাখে
  4. আলো বাতাসহীন অন্ধকার রুমে
  5. ক্রসফায়ার থেকে বেঁচে যাওয়া, মুক্তিপণ চেয়ে ফোন কল
  6. ওরা আমাকে যেসব বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে
  7. লন্ডনী কন্যা, পুলিশ ও এক অদ্ভুত কাহিনী
  8. নতুন ঠিকানায় স্থানান্তর, আশা উৎকণ্ঠার দীর্ঘ রাত
  9. জঙ্গী দমনে সবচে কার্যকরী পন্থা শরীয়া শাসন প্রতিষ্ঠা
  10. ফকিন্নির পোলার কোটিপতি ভাব আর অন্যায় কাজে আনুগত্য করা মুসুল্লি
  11. দয়ালু জালিম ও হ্যান্ডকাপের জীবন