মিহনা: গুম জেল রিমান্ডের ৬৪১ দিন

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মে ২৮ ২০২১, ১৩:৪২

আবদুল্লাহ মায়মূন: ৫ মার্চ ২০১৯ সাল। সন্ধ্যা ৭টা হবে হয়তো। সিলেটের গহরপুর থেকে বের হয়েছি। ভাড়া করা প্রাইভেটকারে। সঙ্গে আমার প্রিয়তমা শরীফা নুসরাত তায়্যিবা। আর গাড়ীর ড্রাইভার আব্দুর রহীম। গহরপুর থেকে আমাদের উদ্দেশ্য মৌলভীবাজার জেলার সদর উপজেলার দুর্লভপুর ইউনিয়নের মামরকপুর গ্রাম। আমাদের নানাবাড়ি। আমাদের গন্তব্যস্থল।

আমার নানা হচ্ছেন শায়খ হাবীবুর রহমান রায়পুরি রাহ:, শায়খুল ইসলাম হোসাইন আহমদ মাদানি রহ. ‘র অন্যতম খলীফা। মামরকপুরের পাশের গ্রাম হচ্ছে রায়পুর, নানা দীর্ঘদিন ওই গ্রামে মসজিদের ইমাম হিসেবে থাকেন, বিয়ে-শাদীর পর সংসার এখানেই গড়েন। নানার মূল বাড়ী হচ্ছে নোয়াখালী জেলার নরোত্তমপুর এলাকায়। যৌবনে ভাগ্যান্বেষণে তিনি বাড়ী থেকে বের হন। এরপর বিভিন্ন চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে রায়পুর গ্রামে বসতি গড়েন। স্থানীয় মসজিদের ইমাম হিসেবে তিনি প্রথমে রায়পুর গ্রামে আসেন। এরপর সেখানকার একটি ঘরে বিয়ে করেন। বিয়ের পর একটি মেয়ে সন্তান হয়। ওই মেয়ে অর্থাৎ আমাদের খালা বর্তমানে আশির উপরে বয়স নিয়ে সন্তানাদিসহ ব্রিটেন আছেন। কিছুদিন পর নানাজির প্রথম স্ত্রী মারা যান। এরপর প্রথম স্ত্রীর পরিবারের ইচ্ছায় এবং তাদের অভিভাবকত্বে আরেকটি বিয়ে করেন। এভাবে নানা জীবন-যৌবনের বিরাট একটি অংশ রায়পুর গ্রামে অতিবাহিত করেন, ব্যস, শায়খে রায়পুরি বিশেষণে তিনি পরিচিতি পান। এই হলো শায়খে রায়পুরি বিশেষণের নেপথ্য কারণ।

এরপর নানা পরিবার-পরিজনসহ রায়পুরের পাশের গ্রাম মামরকপুরে চলে আসেন। সেখানে ঘর-বাড়ি করেন। কিছুদিন পর রাস্তাঘাটের অসুবিধার দরুণ মামরকপুর গ্রামের আরেকটি বাড়ি কিনেন। সেখানেই নানার বর্তমান সন্তানাদি বসবাস করছেন। নানাজি জীবনের শেষ অংশ এখানেই কাটান। রায়পুর থেকে মামরকপুর গ্রামে স্থানান্তরিত হলেও রায়পুরির বদলে মামরকপুরি বিশেষণ লাগানো হয়নি।

আমাদের তৃতীয় মামা মাওলানা নু’মান হোসাইন রহ. রায়পুর গ্রামেই বিয়ে করেন। তিনি ছিলেন ফেদায়ে মিল্লাত সায়্যিদ আসআদ মাদানি রহ. ‘র খলীফা। প্রথমে তাঁর একটি মেয়ে সন্তান হয়েছিলো, তবে সে ছিলো প্রতিবন্ধী, জন্মের দুই/আড়াই বছর পর সে মারা যায়। এরপর মামার চার ছেলে সন্তান হয়। বড় ছেলের বয়স যখন সাত বছর তখন মামা ১৯৯৮ সালের ১৬ই নভেম্বর নশ্বর দুনিয়া ত্যাগ করে মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে চলে যান। এরপর এই চার সন্তানকে মামী আগলে রেখে অত্যন্ত যতনে হাড়খাটুনি কষ্ট করে মানুষ করেন। মামী আমাকে খু-ব-ই স্নেহ করেন, উনার কোনো মেয়ে নেই। তাই আমি যখন ২০১৮ সালের ২রা এপ্রিলে বিয়ে করি তখন মামী সানন্দে আমার ওয়ালিমাতে আসেন, ওয়ালিমার আগের দিন তাঁর একমাত্র বড় ভাই মারা যান, আপন ভাইয়ের মৃত্যু তাকে আমার ওয়ালিমায় উপস্থিত হওয়ায় বাঁধার কারণ হয়নি। বিয়ের পর তিনি আমাকে, আমার প্রিয়তমা শরীফা নুসরাত তায়্যিবা, শ্বশুর ও সম্বন্ধীকে তার ঘরে দাওয়াত করেন। এদিকে মামীর কোনো মেয়ে নেই, অন্যদিকে আমার প্রিয়তমা নুসরাতের চালচলন তার অত্যন্ত ভালো লাগে৷ সে হিসেবে তিনি নুসরাতকে তার মেয়ে বানিয়ে নেন। এই ভালোবাসার স্মৃতিস্বরূপ তিনি রমজানে একদিন নুসরাতের জন্যে ইফতারি নিয়েও হাজির হন।

বিয়ের কিছুদিন পর নুসরাত ব্রিটেন চলে যায়। এর সাত মাস পর ২০১৯ সালের ১৮ই জানুয়ারি সে এবং আমার শ্বশুর আবার দেশে আসেন। আমার শ্বাশুড়ি এবং একমাত্র সম্বন্ধী ব্রিটেনেই থাকেন। প্রায় এক মাস সে দেশে থাকে, তখন মামী তার মেয়েকে আবার তার বাড়ীতে দাওয়াত করেন। সে দাওয়াতেই আমরা ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখে নানাবাড়ী যাই। মামীর ঘরেই উঠি। মামীও নুসরাতকে মেয়ের মতো এবং আমাকে জামাইর মতো আদর করে রাখেন৷ এরই মধ্যে আসে একটি প্রয়োজন, নুসরাত এবং আমার শ্বশুরকে একদিন ইংল্যান্ড ফোন করতে হবে। ওই দেশের বিভিন্ন প্রয়োজন রেন্টে ফোন করতে হবে, মোবাইলে এগুলো সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। এজন্যে আমাদেরকে সিলেটে যেতে হবে। মৌলভিবাজার থেকে সিলেট।

সিদ্ধান্ত হলো ৫ মার্চ রোজ মঙ্গলবার আমি আর নুসরাত মৌলভীবাজার জেলা থেকে সিলেটের উদ্দেশে রওয়ানা হবো। পথিমধ্যে আমার শ্বশুরআব্বাকে তাঁর গহরপুরের এক আত্মীয় বাড়ি থেকে তুলে একসাথে সিলেট যাবো। এ উদ্দেশ্যেই আমরা মামরকপুর গ্রামেরই একজন ড্রাইভারকে নির্বাচন করি, তার নাম আব্দুর রহিম। সে অন্যের গাড়ী চালায়, এটা তার চাকুরি। তো নির্ধারিত দিনে আমি আর নুসরাত সকাল আটটার দিকে মামীর হাতে রান্না করা সিলেটি আখনী খেয়ে সিলেটের উদ্দেশ্যে আব্দুর রহিমের গাড়ীতে উঠি। মধ্যখানে গহরপুর থেকে আমার শ্বশুর সাহেবকে উঠিয়ে এক সাথে সিলেট যাই। সিলেট শহরে আমাদের লন্ডনে ফোন, শপিং করাসহ বিভিন্ন কাজ সম্পন্ন করতে করতে মাগরিব হয়ে যায়, ছোট দিন হ‌ওয়ায় খুব দ্রুত দিন চলে যায়। মাগরিবের নামায সিলেটেই আদায় করি, নুসরাতকে নিয়ে আল-হামরা শপিং মহলে যাই, সেখানে সে মহিলাদের নির্ধারিত নামাযের জায়গায় সালাত আদায় করে। মাগরিবের পর আমরা সিলেট থেকে আবার মৌলভীবাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই, গহরপুর এসে শ্বশুর সাহেবকে নামিয়ে দিই। তখন ড্রাইভার আব্দুর রহিম বলে গাড়ীতে গ্যাস কম, এ গ্যাস নিয়ে মৌলভীবাজার যাওয়া যাবে না। রাস্তা থেকে গ্যাস নিতে হবে। তখন রাত বাজে সাতটা, এদিকে এ সময়ে গ্যাস পাম্প বন্ধ থাকে। রাত নয়টার আগে ফিলিং স্টেশন খুলবে না। তাই মনে মনে ভাবলাম এ সময়টা কোথাও কাটিয়ে নেই৷ এভাবে আমরা সিলেট হাইওয়ের গোয়ালাবাজারে চলে আসি৷ একটি অভিজাত রেষ্টুরেন্টে রাতের খাবারের জন্যে উঠি। সেখানে ফ্রেশ হয়ে খাবারের অর্ডার দেই। অন্যদিকে মামীকে ফোন দিয়ে জানাই যে, আমরা রাতের খাবার খাবো না। কেনো খাবো না বিস্তারিত বলিনি। মাঝেমধ্যে আমি আর নুসরাত বাহিরে খাবার খাই৷ এতে সময়টা ভালো কাটে এবং মন ফুরফুরা থাকে। তো রেষ্টুরেন্টে খাবার খেয়ে রাত নয়টার দিকে গোয়ালা বাজার ত্যাগ করি, গ্যাসের জন্যে শেরপুর গিয়ে সরাসরি মৌলভীবাজার না গিয়ে ঢাকার হাইওয়ে হয়ে আউশকান্দি যাই, কারণ আশপাশে আর কোনো গ্যাস পাম্প নেই। পাম্পে পৌঁছে গাড়ীতে গ্যাস নেওয়া হল, মামী আমাদেরকে ফোন দেন, আমাদের অবস্থা জিজ্ঞেস করেন, কখন বাড়ী ফিরবো তাও জানতে চান।

মিহনা: গুম জেল রিমান্ডের ৬৪১ দিন। দ্বিতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এর‌ই মধ্যে গ্যাস নিয়ে গাড়ী ঘুরিয়ে পাম্প ছেড়ে আইল্যান্ডে আসতেই কিছু যুবক দৌড়ে এসে ড্রাইভারকে বললো, ‘গাড়ী থামা আর গাড়ীর চাবি দে’, রাত তখন সাড়ে দশটা হবে, ঘুটঘুটে ভীতিকর অন্ধকার পরিবেশ, এ জায়গায় আবার ডাকাতিও বেশি হয়। ড্রাইভার এদেরকে ডাকাতই মনে করে। নুসরাত এদেরকে দেখে ভয় পেয়ে যায়, আমার হাত চেপে ধরে আর বলে ‘এরা মনে হয় ডাকাত’। তখন গাড়ীর পিছনের দুনো গ্লাস নামানো ছিলো। আমরা সাথে সাথে গ্লাস উঠিয়ে নেই। ইতোমধ্যে আমার শ্বশুরও ফোন করেন, অস্থির পরিস্থিতির কারণে ফোন উঠাতে পারিনি। যাইহোক, ড্রাইভার গাড়ী থামায়নি, সে গাড়ী স্পীডে টান দেয়, কিছুক্ষণ সামনে যেতেই পিছন থেকে মাইক্রো বাস দ্রুত আমাদের গাড়ীকে ব্যারিকেড দেয়, ড্রাইভার চেষ্টা করে এ ব্যারিকেডের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে যেতে, কিন্তু রাস্তার বাম পাশে বিদ্যুতের খুঁটি থাকায় এটা ভাঙতে পারেনি। একদিকে বিদ্যুতের খুঁটি, অন্যদিকে মাইক্রো বাস, এতেই গাড়ী আটকে গেলো। এদিকে ওই হামলাকারীরা চোখের পলকেই মাইক্রো থেকে লাঠি বের করে, গাড়ীর গ্লাস বন্ধ থাকায় তারা অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়ে লাঠির উপর্যুপরি আঘাতে গ্লাস ভাঙ্গতে থাকে। আমি তখন কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যাই, নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করি, নুসরাত কান্না শুরু করে, এর‌ই মধ্যে আমার শ্বশুর আবার ফোন করেন, আমি ফোন উঠিয়ে বলি, ‘আমরা আউশকান্দিতে আছি, ডাকাতরা আমাদের গাড়ীতে হামলা করেছে’। এই বলেই ফোন কেটে দেই। শ্বশুর আমাদেরকে বার বার ফোন দেওয়ার কারণ হচ্ছে, আমরা তাকে গহরপুর নামিয়ে দেওয়ার অনেকক্ষণ হয়ে গেলো, অথচ আমাদের মৌলভীবাজারে পৌঁছার কোনো সংবাদই তিনি পাননি। গহরপুর থেকে মৌলভীবাজার পৌঁছতে সর্বোচ্চ ৪০-৪৫ থেকে মিনিট লাগার কথা, এদিকে আমাদের প্রায় আড়াই ঘন্টা হয়ে গেলো তিনি কোনো খবরই পাচ্ছেন না।

শ্বশুরের সাথে ফোনালাপের পর আমার মনটা অনেক হালকা হলো, মনে মনে ভাবলাম, বাড়ির লোককে জানানো গেছে, কিছু হলে তারা জানতে পারবেন। এদিকে ইতোমধ্যে তারা পিছনের দুটি গ্লাসই ভেঙ্গে ফেলে। তাই আমি জানালার গ্লাস দিয়ে মাথা বের করি, যাতে হামলাকারীদের সাথে আলাপ করে বুঝতে পারি তারা আসলে কী চায়? তখন শীতকাল, আমার মাথায় ছিলো টুপি আর লম্বা চুল, পরনে বিয়ের হাদিয়া ফুলহাতা কোট, গলায় মাফলারের মতো নুসরাতের দেওয়া কাফলীন। মাথা বের করতেই তারা আমার টুপি ফেলে চুলে ধরে টেনে গাড়ি থেকে বের করে নেয়। আমি কোনো শক্তি করিনি, কেননা শক্তি করার ইতিবাচক ফলাফল আসবে না, উলটো ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা। আমার ধারণা হলো, তারা আমাকে ধরতেই এসেছে, আমাকে ধরে ফেললে তাদের কাজ শেষ হয়ে যাবে। এতে করে নুসরাত আর ড্রাইভারের জীবনটা বেঁচে যাবে। যেহেতু আমার গায়ে শক্ত কোট ছিলো এজন্য টেনে বের করার সময় গাড়ীর গ্লাসের কাচ শরীরে বিদ্ধ হয় নি, তবে কোটের অনেকটা রঙ মুছে যায়। যাইহোক তারা আমাকে গাড়িতে উঠিয়ে হাতে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে দেয়, চোখ গামছা দিয়ে বেঁধে নেয়। কিছুক্ষণ পরে শুনতে পাই তারা ড্রাইভারকে গাড়ীতে উঠিয়েছে। এরপর গাড়ি দ্রুত ছুটে চলে অজানা গন্তব্যে।

চলবে…