মানব জীবনে তাকওয়ার গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুন ১১ ২০২০, ১৮:১৯

মুফতি আহমদ যাকারিয়া

আল্লাহ পাক মানুষ ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তারই ইবাদত করার জন্য। ইবাদতের মাধ্যমে বান্দাহ শুধুমাত্র বাহ্যিক দৃষ্টিতে কয়েকটি আনুষ্ঠানিকতা পালন করে না; বরং ইবাদত একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর নিমিত্তে হওয়ার জন্যে চাই খালেস নিয়ত ও একাগ্রচিত্ততা, যা বান্দাহ ক্রমাগতভাবে করতে থাকলে অর্জন করে এক মহামূল্যবান নিয়ামত, যাকে শরীয়তে ‘তাকওয়া’ নামে আখ্যায়িত করা হয়।

তাকওয়া অর্থ: তাকওয়া আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো; বিরত থাকা, পরহেজ করা, বেঁচে থাকা ইত্যাদি।

শরীয়তের পরিভাষায় তাকওয়া হলো; একমাত্র আল্লাহর ভয়ে যাবতীয় অন্যায় কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখা। যে ব্যক্তির মধ্যে তাকওয়া থাকে, তাকে মুক্তাকি বলা হয়। সৎ গুণাবলির মধ্যে তাকওয়া হচ্ছে অন্যতম। যার মধ্যে তাকওয়া থাকে, সে পার্থিব জীবনের লোভে কোনো খারাপ কাজ করে না। সে পরকালীন জীবনের কল্যাণ ও মঙ্গলের কাজে সবসময় নিজেকে নিয়োজিত রাখে।

তাকওয়া হলো জীবনের প্রতিটি কাজকর্মের অগ্র-পশ্চাতে দিবা-নিশিতে আল্লাহর ভয়কে অন্তরে জাগরুক রাখা। আল্লাহর ভয়কে অন্তরে জাগরুক রেখে আমলের প্রতিটি স্তর পার হতে পারলেই সে তাকওয়া অবলম্বনকারী মুমিন মুত্তাকি হবে।

তাকওয়াকে যদি ভিন্নভাবে উপস্থাপন করি, তাহলে বলবো যে, সকল প্রকার অনিষ্ট কাজ থেকে আল্লাহর ভয়ে নিজেকে বাঁচানোর অন্য নামই হলো তাকওয়া। এই তাকওয়ার মধ্য দিয়েই একজন মুমিন পরিশুদ্ধতা লাভ করে। ঈমানশুদ্ধতার আত্মিক সুখ-শান্তি লাভ করে। তৌহিদের উপস্থিত প্রফুল্লতায় ভরে উঠে জীবনের চারিধার। তাই একজন মানুষকে মানুষ হতে হলে সর্বাগ্রে তাকে তাকওয়া অবলম্বন করতে হবে। তাকওয়াহীন মানুষ হওয়া অসম্ভব। তাকওয়া তথা আল্লাহর ভয়ে সমাজের কল্যাণকামিতা যদি সদা অন্তরে জাগ্রত না থাকে, তাহলে তার দ্বারা ভালো কাজের আশা করা যায় না। সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে দুর্নীতি করা যায়, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা যায়, দায়িত্বে অবহেলা করা যায়, আমানতের খিয়ানত করা যায় কিন্তু আল্লাহর চোখকে ফাঁকি দেয়া যায় না, একারণে তাকওয়াহীন মানুষ মানুষই হতে পারে না।

তাকওয়া কীভাবে অবলম্বন করতে হয়, এর একটি উদাহরণ আমরা নিতে পারি সাহাবিদের থেকে।

একদা হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. হজরত উবাই ইবনে কাব রা.-কে তাকওয়ার সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। হে উবাই ইবনে কাব! তাকওয়া কী? এর উত্তরে হজরত উবাই ইবনে কাব রা. বললেন; হে আমাদের খলিফা! আপনি কী কখনো কাঁটাযুক্ত পথে হেঁটেছেন?

হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. বললেন, হ্যাঁ; হেঁটেছি

: কীভাবে হেঁটেছেন?

: অতি সতর্কতার সঙ্গে।

: কীভাবে ওই রাস্তা পার হয়েছেন?

: জামার হাতা গুছিয়ে সাবধানতা অবলম্বন করে বহু পরিশ্রমের সঙ্গে সেই রাস্তা পার হয়েছি।

তখন উবাই ইবনে কাব রা. বললেন, এটাই হচ্ছে ‘তাকওয়া’।

সকল প্রকার গোনাহ থেকে সর্বদা নিজেকে গুটিয়ে শরীর ও মনকে পাপ থেকে অক্ষত রেখে দুনিয়ার জীবন পাড়ি দেয়ার নামই হলো তাকওয়া। এজন্য তাকওয়া অবলম্বন করতে বর্তমান সমাজে সুদ, ঘুস ও দূর্নীতির কাঁটা থেকে একজন মুমিনকে আত্মরক্ষা করে খুব সতর্কতার সঙ্গে জীবনপথ পাড়ি দিতে হবে।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি নিজেকে শিরক, কবিরা গুনাহ্ ও অশ্লীল কাজকর্ম ও কথাবার্তা থেকে বিরত রাখে, তাকে মুত্তাকি বলা হয়।’ মুত্তাকি ব্যক্তি সততা, আমানতদারি, ধৈর্য, শোকর, আদল-ইনসাফ ইত্যাদি সব ধরনের গুণে গুণান্বিত হয়ে থাকে।

তাকওয়ার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে পবিত্র কোরআন ও হাদিসে সুস্পষ্ট করে বয়ান করা হয়েছে। নীচে এর কিছু নমুনা পেশ করা হলো:

“এই সেই কিতাব; এতে কোনো সন্দেহ নেই, মুত্তাকিদের জন্য তা পথনির্দেশ, যারা অদৃশ্যে ঈমান আনে, নামায কায়েম করে এবং তাদেরকে যে জীবনোপকরণ দান করেছি তা থেকেই ব্যয় করে, এবং তোমার প্রতি যা নাযিল হয়েছে ও তোমার পূর্বে যা নাযিল হয়েছে তাতে যারা ঈমান আনে ও আখেরাতে যারা নিশ্চিত বিশ্বাসী, তারাই তাদের প্রতিপালক-নির্দেশিত পথে রয়েছে এবং তারাই সফলকাম।” (বাকারা:২)

“হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে, পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো। তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাসম্পন্ন; যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকী। নিশ্চয় আল্লাহ সকল কিছু জানেন, সমস্ত খবর রাখেন” (হুজুরাত:১৩)

“হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হও।” (তাওবা:১১৯)

“পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোতে কোনো পুণ্য নেই; কিন্তু পুণ্য আছে কেউ আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতাগণ, সমস্ত কিতাব এবং নবীগণের ওপর ঈমান আনলে এবং আল্লাহপ্রেমে আত্মীয়স্বজন, পিতৃহীন, অভাবগ্রস্ত, মুসাফির, সাহায্যপ্রার্থীদেরকে এবং দাসমুক্তির জন্য অর্থ দান করলে, নামায কায়েম করলে, যাকাত প্রদান করলে এবং প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পূর্ণ করলে। অর্থ-সঙ্কটে, দুঃখ-কষ্টে ও যুদ্ধ-সঙ্কটে ধৈর্য ধারণ করলে। এরাই তারা; যারা সত্যপরায়ণ এবং এরাই মুত্তাকী।” (বাকারা: ১৭৭)

“তোমরা ধাবমান হও তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমার দিকে এবং সেই জান্নাতের দিকে, যার বিস্তৃতি আসমান ও জমিনের মতো, যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে মুত্তাকীদের জন্য, যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় দান করে এবং যারা ক্রোধ সংবরণকারী এবং মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল; আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদেরকে ভালোবাসেন; এবং যারা কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে অথবা নিজেদের প্রতি জুলুম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ব্যতীত কে পাপ ক্ষমা করবে? এবং তারা যা করে ফেলে, জেনে-শুনে তারই পুনরাবৃত্তি করে না। এরাই তারা, যাদের পুরস্কার তাদের প্রতিপালকের ক্ষমা এবং জান্নাত, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত; সেখানে তারা স্থায়ী হবে এবং সৎকর্মশীলদের পুরস্কার কত উত্তম।” (আলে ইমরান: ১৩৩-১৩৬)

“আমি তো মুসা ও হারুনকে দিয়েছিলাম ‘ফুরকান’, জ্যোতি ও উপদেশ মুত্তাকীদের জন্য, যারা না দেখেও তাদের প্রতিপালককে ভয় করে এবং তারা কিয়ামত সম্পর্কে ভীতসন্ত্রস্ত।” (আম্বিয়া:৪৮-৪৯)

“সেদিন নিশ্চয় মুত্তাকীরা থাকবে প্রসবণবিশিষ্ট জান্নাতে, উপভোগ করবে যা তাদের প্রতিপালক তাদেরকে দেবেন; কারণ, পার্থিব জীবনে তারা ছিলো সৎকর্মপরায়ণ, তারা রাতের সামান্য অংশই অতিবাহিত করতো নিদ্রায়, রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করতো এবং তাদের ধন-সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদেরহ হক।” (যারিয়াত:১৫-১৯)

“নিশ্চয় আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর নিকট মাস গণনায় মাস বারোটি, তার মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস, এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করো না এবং তোমরা মুশরিকদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করবে, যেমন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করে থাকে। এবং জেনে রেখো, আল্লাহ তো মুত্তাকীদের সঙ্গে আছেন।” (তাওবা: ৩৬)

“হে মুমিনগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদানে তোমরা অবিচল থাকবে; কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদেরকে যেন কখনো সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। সুবিচার করবে, এটা তাকওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় করবে, তোমরা যা করো নিশ্চয় আল্লাহ তার সম্যক খবর রাখেন। যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে, আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাদের জন্য ক্ষমা ও মহাপুরস্কার আছে।” (মায়িদা:৮-৯)

“হে মুমিনগণ! তোমরা সুদ খেয়ো না ক্রমবর্ধমান এবং আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।” (আলে ইমরান:১৩০)

“হে ইমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় কর।” (আলে ইমরান:১০২)

“এবং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আর মনে রেখ, নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকিদের সঙ্গে আছেন।” (বাকারা:১৯৪)

তাকওয়া আল্লাহর নৈকট্য ও ভালোবাসা লাভ করার একমাত্র উপায়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন;

কোরআন মাজিদে এরশাদ হয়েছে- “নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকিদের ভালোবাসেন।” (তাওবা:৪)

আল্লাহ অপর আয়াতে এরশাদ করেন- “মুত্তাকিরা থাকবে নিরাপদ স্থানে।” (দুখান:৫১)

মুত্তাকিরা আল্লাহর কাছে অধিক সম্মানিত।

এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বলেন;”তোমাদের মাঝে সে ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে অধিক সম্মানিত; যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকি।” (হুজুরাত-১৩)

তাকওয়া শুধু মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয় না, বরং তা জান্নাতে প্রবেশ করতেও সাহায্য করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন; “আর যে ব্যক্তি তার রবের সামনে উপস্থিত হওয়ার ভয় রাখে এবং নিজেকে কুপ্রবৃত্তি থেকে ফিরিয়ে রাখে, নিশ্চয় জান্নাত হবে তার আবাসস্থল। (নাযি’আত:৪০-৪১)

তাকওয়া প্রসঙ্গে রসুল সা. থেকে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে

হজরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, রসুল সা. কে প্রশ্ন করা হলো, ইয়া রসুলুল্লাহ! মানুষের মধ্যে অধিক সম্মানিত কে? তিনি বললেন, তাদের মধ্যে যে অধিক মুত্তাকি বা পরহেজগার। (বুখারি ও মুসলিম)

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত আছে যে, রসুল সা. আল্লাহর কাছে এভাবে দোয়া করতেন, হে আল্লাহ! আমাকে হিদায়াত, তাকওয়া, পবিত্রতা ও অমুখাপেক্ষিতা এসব গুণ দান করুন। (মুসলিম)

হজরত আদী ইবনে হাতিম তাঈ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন; আমি রসুল সা. কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি কোনো বিষয়ে শপথ করে, অতঃপর সে অন্য কিছু এর চেয়ে বেশি তাকওয়াপূর্ণ মনে করে, তবে সে যেন তাকওয়াপূর্ণ বিষয়কেই অবলম্বন করে। (মুসলিম)

রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, দু’টি চোখকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করতে পারবে না:

. এমন চোখ, যা আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করে, ২. আর অপর চোখ হলো, যা আল্লাহর রাস্তায় পাহারারত অবস্থায় রাত্রি যাপন করে। (তিরমিজি)

তাকওয়া অর্জনে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকওয়ার গুরুত্ব কত বেশি হাদীসে তা তুলে ধরেছেন। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন; ‘আল্লাহ পাক কিয়ামতের দিন তোমাদের বংশ ও আভিজাত্য সম্পর্কে জানতে চাইবেন না। বরং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আল্লাহকে বেশি ভয় করে; সে-ই হবে আল্লাহর কাছে সর্বাধিক সম্মানের অধিকারী।’

অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক জীবন যাপন করবে। কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে এগিয়ে আসবে। গঠন করবে পরকালের জবাবদিহিমূলক জীবন।

অন্য হাদিসে বলেন; ‘আল্লাহ পাক তোমাদের মুখাকৃতি ও সম্পদের দিকে দৃষ্টি দেন না বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও কাজ কর্ম দেখেন।’

এ জন্যই আল্লাহ পাক আমাদেরকে প্রবৃত্তির খাহেশাত থেকে মুক্ত রাখুন। দুনিয়ার যাবতীয় অন্যায় ও অনাচারসহ নৈতিকতা বিবর্জিত কাজ থেকে হেফাজত করুন। দুনিয়ার প্রতিটি কর্মের জন্যে পরকালের জবাবদিহিতার মানসিকতা তৈরির মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন এবং পরকালের সফলতা লাভের তাওফিক দান করুন।

যারা তাকওয়া অবলম্বন করে তাদেরকে শরীয়তের পরিভাষায় বলা হয় মুত্তাকী। মুত্তাকিদের পরিচয় প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘যারা অদৃশ্যের প্রতি ঈমান রাখে, নামাজ আদায় করে এবং আমি তাদের যে রিজিক দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে। আর যারা আপনার উপর যা নাজিল করা হয়েছে (কুরআন) এবং আপনার আগে যা নাজিল করা হয়েছে (আসমানী কিতাব) তার প্রতি ঈমান রাখে, আর তারা আখেরাতের প্রতি ইয়াকিন রাখে।’ (বাকারা, ৩-৪)

উপরিউক্ত আয়াতে আল্লাহ পাক মুত্তাকিদের গুণ ও বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন।

. গায়েব বা অদৃশ্য যেমন: আল্লাহ, ফেরেশতা, জান্নাত-জাহান্নাম, আখেরাত ইত্যাদি যা মানবীয় জ্ঞানে বোধগম্য নয়- এরূপ বিষয়গুলোতে ঈমান রাখা।

. নামাজ কায়েম করা, অর্থাৎ যথাযথ শর্ত পালন করে নিষ্ঠার সাথে নামাজ কায়েম করা।

. আল্লাহর পথে ব্যয় করা, অর্থাৎ আল্লাহ্ প্রদত্ত জীবিকা ও ধনসম্পদ থেকে তাঁরই নির্দেশিত পথে ব্যয় করা।

৪. রাসূলুল্লাহ্ সা. এর প্রতি অবতীর্ণ কুরআন এবং তাঁর পূর্ববর্তী আসমানি কিতাবের উপর ঈমান রাখা।

৫. মুত্তাকিরা পরকাল সম্পর্কে দৃঢ়বিশ্বাসী। তারা দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবন এবং আখেরাতের চিরস্থায়ী জীবনের প্রতি ইয়াকিন রাখে।

তাকওয়ার অবস্থান:

তাকওয়া দৃশ্যমান কোন বস্তু নয়। এটা মূলত মানুষের আভ্যন্তরীন গুণ বিশেষ। তাকওয়ার স্থান সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, তাকওয়া বা আল্লাহ ভীতি এখানে থাকে, এ কথা বলে তিনি তিনবার নিজের বুকের দিকে ইশারা করলেন। তাকওয়া যেহেতু অন্তরে থাকে, তাই আল্লাহর রাসূল সা. অন্তর পরিষ্কার করার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, মনে রেখ, নিশ্চয়ই মানুষের শরীরে একটি গোশত পিন্ড আছে, যা ঠিক থাকলে সমস্ত দেহই ঠিক থাকে। আর তার বিকৃতি ঘটলে সমস্ত দেহেরই বিকৃতি ঘটে। সে গোশতের টুকরাটি হলো “অন্তর”। (বুখরী, মুসলিম)

পবিত্র কুরআনে মানুষের তিনটি ইচ্ছে শক্তির বর্ণনা পাওয়া যায়।

। নফসে আম্মারা। কুপ্রবৃত্তি (দাস) (ইউসুফ:৫৩)

। নফসে মুতমাইন্না। সুপ্রবৃত্তি (নিয়ন্ত্রিত) (ফযর:২৭)

। নফসে লাওয়ামা। অনুশোচনার প্রবৃত্তি (কিয়ামাহ:০২)

এই নফসে আম্মারাকে দমন করতে পারলেই তাকওয়া অবলম্বনের পথ আবিষ্কার হয়। উপরোক্ত বক্তব্যে প্রতীয়মান হয় যে, তাকওয়ার অবস্থান অন্তর, যা অদৃশ্য। তবে মানুষের কর্মে ও আচরণে তা বহিঃপ্রকাশ হয়।

তাকওয়ার স্থর:

ইমাম গাযযালী রহ. তাকওয়ার চারটি স্তরের কথা বর্ণনা করেছেন; যা নিম্নরূপ:

। শরীয়াতে যে সকল বস্তু হারাম করা হয়েছে, আল্লাহর ভয়ে সে সকল বস্তু হতে বিরত থাকা। যেমন: মদ, জুয়া, ব্যভিচার ও সুদ খাওয়া ইত্যাদি হারাম হতে আত্মরক্ষা করা। এ পর্যায়ের মুত্তাকীকে বলা হয় “মু’মিন”।

২। হারাম বস্তু হতে বিরত থাকার পরে সন্দেহযুক্ত হালাল বস্তুসমূহ হতেও দূরে থাকা। এ পর্যায়ের মুত্তাকীকে বলা হয় “সালিহ”।

৩। সকল হারাম বস্তু ও সন্দেহযুক্ত হালাল বস্তু সমূহ হতে দূরে থাকার পরে আল্লাহর ভয়ে অনেক সন্দেহবিহীন হালাল বস্তুও পরিত্যাগ করা। এ পর্যায়ের মুত্তাকীকে বলা হয় “মুত্তাকী”।

৪। উপরোক্ত তিন শ্রেণীর তাকওয়া আয়ত্ব করার পর এমন সব হালাল বস্তু পরিত্যাগ করা, যা ইবাদাতে কোন সহায়তা করে না। এ পর্যায়ের মুত্তাকীকে বলা হয় “সিদ্দীক”।

আল্লামা বায়যাবী রহ. তাঁর তাফসীরগ্রন্থে তাকওয়ার তিনটি স্তরের কথা বর্ণনা করেছেন, তা নিম্নরুপ:

। চিরস্থায়ী আযাব তথা জাহান্নামের ভয়ে সকল প্রকার শিরক হতে বেঁচে থাকা। এটা হলো “খালিস তাওহীদ”।

২। সকল প্রকার গুনাহের কাজ হতে এমনকি (কারো মতে) সগীরা গুনাহ হতেও বেঁচে থাকা। শরীয়াতের পরিভাষায় ইহাকে “তাকওয়া” বলা হয়।

৩। আত্মা বা নফসকে হক (সত্য) হতে গাফেল রাখে এমন সকল বস্তু হতে সম্পর্কচ্ছেদ করা এবং জাহির ও বাতিন (দেহ ও মন) কে সত্যের আলোকে উদ্ভাসিত করা। এরূপ তাকওয়ার কথাই কুরআনে বলা হয়েছে।

তবে প্রকৃত সত্য হলো যে, তাকওয়ার দু’টি স্থর রয়েছে। ‘মুত্তাকী’ বা ‘পরহেযগা’র কাকে বলে? কী কী বৈশিষ্ট্যের দ্বারা মানুষ আল্লাহর কাছে মুত্তাকী বলে গণ্য হয়? মুত্তাকী হলেন আল্লাহর ঐ সকল বান্দাহ, যাদের অন্তরে আল্লাহ পাকের ভয় আছে এবং যারা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকেন।

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাক সূরা আ‘রাফের ২০১-২০২ নম্বর আয়াতে বলেন;

إِنَّ الَّذِينَ اتَّقَوْا إِذَا مَسَّهُمْ طَائِفٌ مِنَ الشَّيْطَانِ تَذَكَّرُوا فَإِذَا هُمْ مُبْصِرُونَ . وَإِخْوَانُهُمْ يَمُدُّونَهُمْ فِي الْغَيِّ ثُمَّ لَا يُقْصِرُونَ

“নিশ্চয়ই যারা আল্লাহকে ভয় করে যখন তাদেরকে স্পর্শ করে শয়তানের পক্ষ থেকে কোনো কিছু; কুমন্ত্রণা বা ওয়াসওয়াসা, তখন তারা আল্লাহকে স্মরণ করে। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ স্মরণ করে। ফলে তাদের চোখ খুলে যায়, করণীয় স্পষ্ট হয়ে যায়। এ হচ্ছে মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য।

আর দ্বিতীয় আয়াতের অর্থ হচ্ছে, “শয়তান তাদেরকে গোমরাহীর পথে মদদ দিতে থাকে এবং এগিয়ে নিতে থাকে। আর এ বিষয়ে কোন ত্রুটি করে না। ফলে ওরা চূড়ান্ত গোমরাহীতে গিয়ে নিপতিত হয়। এরপর সে অবস্থায়ই তাদের মৃত্যু হয়। আর আল্লাহ তাআলার সামনে তারা শয়তানের ভাই হিসাবেই উপস্থিত হয়।”

একজন খাঁটি মানুষ হতে হলে সর্বপ্রকার শয়তানী থেকে নিজেকে বাঁচাতে হবে। আর শয়তানের শয়তানী থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হলে অবশ্যই তাকওয়া অবলম্বন করতে হবে। যে তাকওয়া অবলম্বন করবে সেই শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাবে। তাই সুন্দর চরিত্রের মূল আকর্ষণে থাকতে হবে তাকওয়া এবং তাকওয়া। তাকওয়া ছাড়া সচ্চরিত্রকে কল্পনা করা যাবে না।

আল্লাহ পাক এ দুই আয়াতে মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য ও ‘ইখওয়ানুশ শায়াতীন’-এর বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন। এ দুই আয়াত মানুষের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের মতো গোনাহগার, যারা শয়তানের ধোঁকায় পড়ে যাই, গোনাহে লিপ্ত হয়ে যাই, এ সকল মানুষের জন্য এ দুই আয়াতে যেমন আছে গভীর সান্ত্বনা, তেমনি আছে অতি প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা।

আল্লাহকে স্মরণ করার এক পর্যায় হল, গুনাহের পরিস্থিতি তৈরি হলে আল্লাহকে স্মরণ করা এবং গুনাহে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকা। কুরআন মাজীদে আল্লাহ পাক বলেন;

وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى

‘পক্ষান্তরে যে স্বীয় প্রতিপালকের সম্মুখে উপস্থিত হওয়ার ভয় করে এবং প্রবৃত্তি থেকে নিজেকে বিরত রাখে, জান্নাতই হবে তার আবাস।’ (নাযিআত ৭৯ : ৪০-৪১)

গুনাহের পরিস্থিতি অনেক রকম হতে পারে। যেমন ক্রোধের পরিস্থিতি। কারো প্রতি ক্রোধ জাগ্রত হয়েছে, এ অবস্থায় আল্লাহর ভয়ে সীমালঙ্ঘন থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর কাছে মুত্তাকী হিসেবে গণ্য হয়।

বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম মুজাহিদ রাহ. আলোচিত আয়াতের طَائِفٌ مِنَ الشَّيْطَانِ ‘শয়তানের পক্ষ হতে কুমন্ত্রণাকে’ ‘ক্রোধ’ শব্দের দ্বারা ব্যাখ্যা করেছেন। এটি একটি ক্ষেত্র। এ রকম আরো অনেক ক্ষেত্র হতে পারে। অন্যান্য গুনাহের পরিস্থিতিতেও আল্লাহর ভয়ে নিজকে নিয়ন্ত্রণ করার দ্বারা ‘তাকওয়ার’ পরিচয় পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. এর শব্দটি ব্যাপক। তিনি طائف من الشيطان -এর ব্যাখ্যা করেছেন اللمة من الشيطان অর্থাৎ ‘শয়তানের প্ররোচনা’।

তাকওয়া অবলম্বন করলে কী হবে?

তাকওয়া অবলম্বনকারীকে আল্লাহ পরিমিত রিযিক দান করেন;

﴿وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ﴾

‘যে কেউ আল্লাহর ব্যাপারে তাকওয়া অবলম্বন করবে, আল্লাহ তার জন্য সঙ্কট থেকে উত্তোরণের কোনো পথ তৈরি করে দিবেন। এবং তাকে এমন স্থান থেকে রিযিক দিবেন যা তার ধারণারও বাইরে। (তালাক: ২)

কেউ তাকওয়া সম্ভলিত সুন্দর চরিত্র নির্মাণ করতে পারলে তার রিযিকের অভাব হবে না। এই আয়াত থেকে এটাই প্রতীয়মান হয়।

তাকওয়া অবলম্বনকারীর জন্য রয়েছে আল্লাহর অফুরন্ত ভালোবাসা ও ভালোলাগা। একজন মানুষের জন্য এর থেকে সুন্দর আর উত্তম কোনো প্রতিদান কি হতে পারে যে, আল্লাহ তায়ালা তাকে ভালোবাসেন? কখনোই তার থেকে উত্তম কোনো প্রতিদান হতে পারেনা। আর এই প্রতিদানটা পাওয়া যাবে চরিত্রের মধ্যে তাকওয়া সম্ভলিত চরিত্র নির্মাণ করলে। আল্লাহ্ বলেন;

﴿فَإِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ﴾

‘নিশ্চয় আল্লাহ তাকওয়া অবলম্বনকারী মুত্তাকিনদের ভালোবাসেন। (আলে ইমরান:৭৬)

অপর আয়াতে আল্লাহ্ বলেন;

وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ

‘আল্লাহর ব্যাপারে তাকওয়া অবলম্বন করো। জেনে রাখ, আল্লাহ তাকওয়া অবলম্বনকারী মুত্তাকিনদের সঙ্গে আছেন’। (বাকারাহ:১৯৪)

তাকওয়া অবলম্বনকারীর ভাগ্যে আল্লাহর নাজাত মিলে; এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেন;

وَنَجَّيْنَا الَّذِينَ آمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُون

‘(আগেও) যারা ঈমান গ্রহণ করেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে তাদেরকে আমি রক্ষা করেছি (নাজাত দিয়েছি)’। ( হা-মীম: ১৮)

তাকওয়া অবলম্বনকারী বান্দার আমল কবুল হয়;

إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللَّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ

‘আল্লাহ শুধুমাত্র মুত্তাকীদের ইবাদত কবুল করেন’। (মায়িদাহ: ২৭)

তাকওয়া অবলম্বনকারী বান্দার কোন ভয় থাকবে না; এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেন;

فَمَنِ اتَّقَى وَأَصْلَحَ فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ

‘যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে এবং নিজেকে সংশোধন করেছে কিয়ামতের দিন তার কোনো ভয় নেই এবং কোনো দুশ্চিন্তায়ও তাকে গ্রাস করবে না’। (আ’রাফ:৩৫)

তাকওয়া অবলম্বনকারী বান্দার পুরস্কার বড় করে দেয়া হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন;

وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يُكَفِّرْ عَنْهُ سَيِّئَاتِهِ وَيُعْظِمْ لَهُ أَجْرًا

‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ ওই ব্যক্তির গুনাহ (তার আমলনামা থেকে) মুছে ফেলেন এবং তার পুরস্কারকে বড় করে দেন’। (তালাক:৫

তাকওয়া অবলম্বনকারী বান্দার কাজ আল্লাহ সহজ করে দেবেন; এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেন;

وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مِنْ أَمْرِهِ يُسْرًا

‘যে তাকওয়া অবলম্বন করলো, আল্লাহ তার জন্যে কাজগুলোকে সহজ করে দেবেন। ( তালাক:৪)

তাকওয়া অবলম্বনকারী বান্দার জন্যে জমিন ও আসমানের বরকতের দরজা খুলে দেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন;

وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ وَلَكِنْ كَذَّبُوا فَأَخَذْنَاهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ

‘যদি এলাকার লোকজন ঈমান আনয়ন করতো এবং সঙ্গে সঙ্গে তাকওয়া অবলম্বন করতো, তাহলে আমি আল্লাহ তাদের আসমান ও জমিনে বরকতের দরজাসমূহ খোলে দিতাম। কিন্তু তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে (আমার আয়াতকে) তাদেরকে আমি পাকড়াও করবো তাদের অর্জিত পাপের কারণে। (আ’রাফ:৯৬)

তাকওয়া অবলম্বনকারী বান্দার ভেতরে হক-বাতিল বুঝার ও পার্থক্য করার বিবেক সৃষ্টি হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন;

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ تَتَّقُوا اللَّهَ يَجْعَلْ لَكُمْ فُرْقَانًا وَيُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ

‘হে ঈমানদারগণ! যদি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করো, তোমাদের জন্যে আল্লাহ সত্য-মিথ্যা, হক- বাতিল অনুধাবন করার বুঝ দিবেন, তোমাদের থেকে মন্দগুলো দূর করবেন এবং গুনাহসমূহকে ক্ষমা করে দেবেন। মহান আল্লাহ বড় দয়ালু ও রহমওয়ালা। (আনআ’ম: ২৯)

তাকওয়া অবলম্বনকারী বান্দারা দুনিয়া ও আখেরাতে সু-সংবাদ লাভ করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন;

الَّذِينَ آمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ لَهُمُ الْبُشْرَى فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ لَا تَبْدِيلَ لِكَلِمَاتِ اللَّهِ ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ

‘যারা ঈমান এনেছে ও তাকওয়া অবলম্বন করেছে; তাদের জন্যে পার্থিব ও আখেরাতের সুসংবাদ রয়েছে। আল্লাহর কথা কখনো পরিবর্তন হবে না। এগুলো মহাসাফল্য। (ইউনুস: ৬৩-৬৭)

মোটকথা; গুনাহের পরিস্থিতি তৈরি হলে আল্লাহকে স্মরণ করা এবং গুনাহ ত্যাগ করা তাকওয়ার একটি প্রকার। এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যক্তি আল্লাহর কাছে মুত্তাকী হিসেবে গণ্য।

আল্লাহকে স্মরণ করার দ্বিতীয় পর্যায় হলো; গুনাহ হয়ে যাওয়ার পর আল্লাহকে স্মরণ করা। মুত্তাকী বান্দার কখনো কোনো গোনাহ হয় না, তা নয়। স্খলন হতে পারে, ভুল হতে পারে, কিন্তু তার বৈশিষ্ট্য হলো, গুনাহ হয়ে গেলে মনে অনুতাপ জাগে, আল্লাহর ভয় জাগে এবং এই উপলব্ধি জাগে যে, আমি আমার পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছি। আর তখন সে তার করণীয় স্পষ্ট দেখতে পায় যে, আমাকে এই অবস্থা থেকে ফিরতে হবেই। সে ব্যাকুল হয়ে আল্লাহর দিকে ফিরে যায়। এটিও তাকওয়ার একটি স্তর এবং মুত্তাকীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এদের সম্পর্কেও আছে জান্নাতের সু-সংবাদ। সূরা আলে ইমরানে, যেখানে আল্লাহ তাআলা মুত্তাকীদের গুণাবলী বর্ণনা করেছেন, সেখানে আছে-

اَلَّذِيْنَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللَّهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ وَمَنْ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا اللَّهُ وَلَمْ يُصِرُّوا عَلَى مَا فَعَلُوا وَهُمْ يَعْلَمُونَ

‘এবং যারা কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে অথবা নিজেদের প্রতি জুলুম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া কে পাপ ক্ষমা করবে? আর তারা যা করে ফেলে জেনে বুঝে তাতে অটল থাকে না।’ (আলে ইমরান:১৩৫)

তো এ আয়াতে তাকওয়ার এ পর্যায়টির কথা পাওয়া যায়। আমাদের আলোচ্য আয়াত এ পর্যায়কেও শামিল করে। ইমাম সুদ্দী রাহ. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি ঐ আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন, إذا زلوا تابوا অর্থাৎ যখন তাদের পদস্খলন ঘটে তখন তাওবা করে।

জামে তিরমিযীতে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,

– سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: ما من رجل يذنب ذنبا , ثم يقوم فيتطهر ثم يصلي ثم يستغفر الله إلا غفر الله له ثم قرأ هذه الآية: والذين إذا فعلوا فاحشة… وهم يعلمون …

আমি আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, কেউ যখন কোনো গুনাহ করে ফেলে এরপর (তার বোধোদয় হয় এবং সে ) উত্তমরূপে পবিত্রতা অর্জন করে, এরপর নামায পড়ে, এরপর আল্লাহর কাছে মাফ চায়, আল্লাহ তাকে মাফ করে দেন। এরপর তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করেন।(তিরমিযী, হাদীস ৪০৬)

তো মুত্তাকী ও পরহেযগার বান্দা তারাই; যাদের অন্তরে শয়তান যখন কোনো কুমন্ত্রণা দেয় তখন তারা আল্লাহকে স্মরণ করে এবং গোনাহ থেকে বিরত থাকে। কিংবা কখনো গুনাহ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে অনুতপ্ত হয়ে তাওবা করে।

পক্ষান্তরে যারা শয়তানের ভাই, তাদের অবস্থা কী? তাদের অবস্থা হলো;

وَإِخْوَانُهُمْ يَمُدُّونَهُمْ فِي الْغَيِّ ثُمَّ لَا يُقْصِرُونَ

শয়তান তাদেরকে গোমরাহীর পথে মদদ দিতে থাকে এবং এগিয়ে নিতে থাকে। আর এ বিষয়ে কোন ত্রুটি করে না। ফলে ওরা চূড়ান্ত গোমরাহীতে গিয়ে নিপতিত হয়। এরপর সে অবস্থায়ই তাদের মৃত্যু হয়। আর আল্লাহর সামনে তারা শয়তানের ভাই হিসেবেই উপস্থিত হয়। তো আল্লাহ পাকের কোনো বান্দা যদি তাঁর সামনে তাঁর সবচে’ বড় অবাধ্য-শয়তানের দোসর হিসেবে উপস্থিত হয়, তাহলে তার পরিণাম কী হবে? তার পরিণাম তো অত্যন্ত ভয়াবহ। এ জন্যই গোনাহর চিন্তা মনে এলেই আল্লাহর আশ্রয় নেয়া উচিত। আর কখনো গোনাহ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তাওবা করা উচিত। সঙ্গে সঙ্গে ভাবা উচিত যে, আমি ভুল পথে আছি। এই পথ আমাকে দুনিয়াতে লাঞ্ছিত করবে। এই পথ আমাকে আখেরাতে ধ্বংস করবে। এই পথ আমার সুনাম-সুখ্যাতি মান-মর্যাদা সব ধুলোয় মিশিয়ে দেবে। এইভাবে চিন্তা করা উচিত। যখন মানুষ এইভাবে চিন্তা করে তখন তার ফিরে আসা সহজ হয়ে যায়।

তাকওয়ার পরিধি: 

তাকওয়ার ক্ষেত্র সীমাহীন বিস্তৃত। এটি যেকোন ধরনের পদস্খলন থেকে মানুষকে রক্ষা করে; সব মন্দ ও অশ্লীল কথা, কাজ ও পরিবেশ থেকে ফিরিয়ে রাখে। খাহেশাতে নাফসানি তথা প্রবৃত্তির খেয়ালখুশি বা অভিলাষ ও দুষ্টচক্রের ফাঁদে পড়ে নিজের ক্ষতি করা থেকে এবং পরিবার, সমাজ ও দেশের ক্ষতি করা থেকে রক্ষা করে। তাকওয়া জীবনকে এমন এক সুদৃঢ ভিত্তির উপর স্থাপন করে, যা সব ধরনের ভীতি, লোভ-লালসা, প্ররোচনা-প্রতারণা, প্রলোভন-পদস্খলন থেকে মানুষকে নিরাপদ রাখে। অন্ধাকারাচ্ছন্ন গভীর সমুদ্রে কম্পাস বা দিগদর্শন যন্ত্র যেমন সমুদ্রাভিযাত্রীকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে, সমস্যাসংকুল জীবনপথে তাকওয়াও তেমনি মানুষকে নির্ভুল পথের সন্ধান দেয়। ভালোকে গ্রহণ করার তীব্র আগ্রহ এবং মন্দকে পরিহার করে চলার দৃঢ় মনোবলই হচ্ছে তাকওয়া। তাকওয়া মানুষের মধ্যে পরকালের ভাবনা অধিক পরিমাণে জাগিয়ে তোলে।

তাকওয়ার একটি দৃষ্টান্ত:

হযরত ওমর রা. তাঁর খেলাফতকালে লোকজনের খোঁজখবর নেওয়ার জন্যে রাতের বেলা মদীনায় টহল দিতেন। এক রাতে তাহাজ্জুদের পর টহল দিচ্ছিলেন। হঠাৎ লক্ষ করলেন যে, একটি ঘর থেকে কথাবার্তার শব্দ শোনা যাচ্ছে। সাধারণ অবস্থায় কারো ব্যক্তিগত কথা আড়ি পেতে শোনা জায়েয নয়। কিন্তু দায়িত্বশীল ব্যক্তির জন্য প্রয়োজনের ক্ষেত্রে অনুমতি আছে। তো কথাবার্তার ধরন শুনে তাঁর কৌতূহল হলো। তিনি ঘরের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালেন এবং শুনতে পেলেন যে, এক বৃদ্ধা তার মেয়েকে বলছে, ‘বেটি! আজ তো উটের দুধ কম হয়েছে। এত অল্প দুধ বিক্রি করে জীবন চালানো কষ্ট হবে। তাই দুধের সাথে একটু পানি মিশিয়ে দাও।’

মেয়ে উত্তরে বললো, ‘মা! আমীরুল মুমিনীন তো দুধের সাথে পানি মেশাতে নিষেধ করেছেন?’ বৃদ্ধা বললেন, ‘আমীরুল মুমিনীন কি আমাদের দেখছেন? তিনি হয়তো নিজ ঘরে ঘুমিয়ে আছেন। তুমি নিশ্চিন্তে পানি মেশাতে পার।’

এবার মেয়ে বলল, ‘মা, আমীরুল মুমিনীন এখানে নেই এবং তার কোনো লোকও নেই। কিন্তু আল্লাহ তো আছেন! তিনি তো দেখছেন! তাঁর কাছে আমরা কী জবাব দেব?’

ওমর রা. দেয়ালের ওপাশ থেকে সব কথা শুনতে পাচ্ছিলেন। এতটুকু শুনেই তিনি চলে এলেন এবং পরদিন লোক পাঠিয়ে সে ঘরের খোঁজখবর নিলেন। তারপর বৃদ্ধার কাছে পয়গাম পাঠালেন যে, ‘আপনি সম্মত হলে আপনার মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ে দিতে চাই।’

এভাবে তাকওয়ার বদৌলতে মেয়েটি আমীরুল মুমিনীনের পুত্রবধু হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করলো। এই বরকতময় ঘরের তৃতীয় পুরুষে জন্মগ্রহণ করলেন খলীফা ওমর বিন আবদুল আযীয রাহ.। যাকে পঞ্চম খলীফায়ে রাশেদা বলা হয়।

তো মানুষের অন্তরে সর্বক্ষণ এই ধ্যান জাগরুক থাকা যে, ‘আল্লাহ পাক আমাকে দেখছেন’ এর নামই হলো প্রকৃত তাকওয়া।

শেষ কথা; 

পবিত্র কোরআনের বিশেষ রীতি হলো, যেকোন গুরুত্বপূর্ণ বিধান নাজিলের পরই তাকওয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়। এর কারণ হলো শত আইনকানুন, কলাকৌশল, পুলিশি পাহারা এবং চৌকিদার দিয়েও অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব নয়, যতক্ষণ না অপরাধী মানসিকভাবে সেই অপরাধ বর্জনে অঙ্গীকারবদ্ধ ও দৃঢপ্রতিজ্ঞ হয়। বর্তমান সমাজের দিকে তাকালে এর সত্যতার স্বপক্ষে অসংখ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। তাই ইসলাম অপরাধ দমনে সদিচ্ছা নিয়ে মানুষকে প্রথমে অপরাধ পরিত্যাগ করতে বলা হয়েছে, তারপর অপরাধের পার্থিব-অপার্থিব শাস্তি ঘোষণা করেছে। এর সঙ্গেই মানুষকে আল্লাহর ভয় ও তাকওয়া অর্জন করতে বলেছে। এটাই মূলত অপরাধ ও পাপাচার ত্যাগের মূলমন্ত্র। কেননা অদৃশ্যের ভয় যখন ব্যক্তির মাঝে কাজ করে, পরকালের চিন্তা যখন তাকে তাড়িত করে। তখন সে ভেতরে-বাইরে, প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে সর্বত্রই পাপাচার বর্জন করতে সক্ষম হয়। আল্লাহ্ পাক আমাদের সবাইকে ব্যক্তি জীবনে তাকওয়া অবলম্বন করে জীবন পরিচালনা করার তাওফীক দান করুন। আমীন