মাওলানাদের কথা শতবার এসেছে বঙ্গবন্ধুর লেখায়

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

এপ্রিল ১৯ ২০১৮, ১১:৫১

সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ:
বঙ্গবন্ধু শেখ মমুজিবুর রহমানের লেখা অসামাপ্ত আত্মজীবনী কতবার যে পাঠ করেছি এর হিসাব রাখা দায়। তবে এবার এক অন্যরকম চোখে পাঠ করলাম। খোঁজে নিলাম বঙ্গবন্ধুর লেখাতে মাওলানারা কতবার এসেছেন। বঙ্গবন্ধু তার নিজ হাতে কতবার আলেমদের নাম উল্লেখ করেছেন। কার কার নাম এসেছে। আমি অবাক ও বিস্মৃতি হলাম বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়ে।

২৮৮পৃষ্টার মূল গ্রন্থে মাওলানাদের নাম এসেছে ১০০বার। শতবার মাওলানাদের কথা বঙ্গবন্ধুর কলামে এটা চাট্টিখানি কথা নয়। এই নামগুলো কি প্রমাণ করে? যে মাওলানারা এদেশের রাজনীতি ও গণ মানুষের মুক্তির সংগ্রামে সব সময়ই অনিবার্য ছিলেন। ছিলেন চালকের আসনে। নেতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে।

মাওলানা আব্দুল হামিদ ভাসানী থেকে শুরু করে মাওলানা আকরাম খাঁ আর মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ এর নাম এসেছে অর্ধশতবার। এসেছে মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী, মাওলানা রাগিব আহসান, মাওলানা আযাদ সোবহানী, আর মাওলানা আমিন পীর মানকী রহ এর কথা। এভাবে মাওলানা মুহাম্মদ আলী, মাওলানা আবুল কালাম আযাদ, হাফিজ ইসহাক, পীর সালহ উদ্দীন, পীর সাহেব খরকী, মাওলানা ইয়াসিন, মাওলানা ওয়াহেদসহ অসংখ্য আলেমদের কথা ও রাজনৈতিক ইতিহাস। এসেছে মাওলানা শহীদ তিতুমীর আর মাওলানা হাজী শরীয়ত উল্লাহ কিভাবে প্রেরণা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সে কথা। পাশাপাশি অসংখ্যবার এসেছে মাওলানা আকরাম খাঁর সম্পাদিত দৈনিক আযাদের কথা। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন ইসলামি সংগঠন ফরায়েজি আন্দোলন, নেযামে ইসলাম, তমদ্দুন মজলিস,ওয়াহাবী আন্দোলনের কথা। লিখেছেন খলিফাতুল মুসলিমিন হযরত উমর রা., নিযামুদ্দীন আউলিয়ার কথা।

গ্রন্থের পরতে পরতে যেন মাওলানাদের রাজনৈতিক কথা বারবার নিখুতভাবে ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধুর সাথে আলেম উলামাদেে কি পরিমান আত্মিক সম্পর্ক ছিল তার প্রমান বহন করে এই অসমাপ্ত আত্মজীবনী পাশাপাশি এদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক অবস্থান এবং জাতীয় নেতৃত্বে উলামায়ে কেরাম যে সর্বযুগেই অনিবার্য ছিলেন সেই দেশপ্রেমের চিত্র বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে ফুটিয়ে তুলেছেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দীক্ষা নিয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি হুসেন শহীদ সরওয়ার্দীর। তাঁর কথা গ্রন্থে লিখেছেন ৫৪বার। তাছাড়া মাওলানা ভাসানী ও মাওলানা তর্কাবাগিশের মতো বরেণ্য দুই রাজনৈতিক আলেম সরাসরি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু ছিলেন। ফলে তাদের কথা গ্রন্থে অর্ধশতবারের বেশি এসেছে। এই গ্রন্থটি পাঠ করলে নিসংকোচে বঙ্গবন্ধুকে মাওলানা প্রিয় বলা যেতে পারে।

বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ শ্বরণ শক্তি ছিল, তিনি জানতেন সিপাহি বিদ্রোহ সহ ওহাবি আন্দোলনের ইতিহাস এবং সব সময় বন্ধুদের সাথে আলাপ করতেন, কেমন করে বৃটিশরা মুসলমানদের কাছথেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে রাতারাতি মুসলমানদের সর্বস্বান্ত করে হিন্দুদের সাহায্য করেছিল। বঙ্গবন্ধু তাঁর ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি কেত্রে রাজনৈতিক আলোচনা আর ঐতিহাসিক বিষয় নিয়েই ব্যাস্ত থাকতেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের আন্দোলন, ওহাবি আন্দোলন কি করে শুরু করেছিল তখনকার হাজার হাজার বাঙ্গালী মুজাহিদরা। তিতুমীরের জেহাদ, হাজী শরীয়ত উল্লাহ্‌র ফারাজি আন্দোলন তিনি তাঁর বন্ধুদের সাথে সব সময় আলোচনা করতেন। বঙ্গবন্ধুর জীবনের তারুণ্যে পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাকে সব চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদে পরিণত করেছিল। যে সকল নেতাদের সান্নিধ্যে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন গড়ে উঠে এরা হচ্ছেন হোসেন শহীদ সোহওয়ারদী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ও মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী মাওলানা আকরাম খাঁ আর মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ, মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী, মাওলানা রাগিব আহসান, মাওলানা আযাদ সোবহানী, মাওলানা আমিন পীর মানকী, মাওলানা মুহাম্মদ আলী, মাওলানা আবুল কালাম আযাদ, হাফিজ ইসহাক, পীর সালহ উদ্দীন, পীর সাহেব খরকী, মাওলানা ইয়াসিন, মাওলানা ওয়াহেদসহ অসংখ্য আলেমদের কথা ।

বঙ্গবন্ধুর এই বর্ণাট্য রাজনৈতিক জীবনের (অসমাপ্ত আত্মজীবনী) অসাধারণ লেখায় আর অনেক নাম উঠে এসেছে যেমন, তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, মোঃ জিল্লুর রহমান, জহুর আহমদ চৌধুরী, ফণীভূষণ মজুমদার, শাহ আজিজুর রাহমান, শওকত আলী (মোগলটুলী পার্টি হাউজের স্বত্বাধিকারী), শাহ আজিজুর রাহমান, শেখ আব্দুল আজিজ, অধ্যক্ষ কামরুজ্জামান, অলি আহাদ, আনোয়ারা খাতুন, আতাউর রহমান খান, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, আবু সাঈদ চৌধুরী, আবুল হাসিম, উসমান আলী, কাজী গোলাম মাহাবুব, কোরবান আলী, আবুল মনসুর আহমদ, মহিউদ্দিন আহমেদ, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া (রাজনৈতিক বিশ্লেষক), শামসুল হক (আওয়ামী মুসলিমলীগের প্রতিষ্টাতা সাধারণ সম্পাদক), খালেক নওয়াজ খান (ছাত্রলীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক ৪৯-৫৩), দবিরুল ইসলাম (ছাত্রলীগের প্রথম সভাপতি ৪৯-৫৩), নঈমউদ্দিন আহমদ (ছাত্রলীগের আহবায়ক), ইয়ার মোহাম্মদ খান (আওয়ামীলীগের প্রতিষ্টাতা কোষাধ্যক্ষ), আব্দুল ওয়াসেক সহ শত শত নাম। যে সকল রাজনীতিবিদ ও সুশীল ব্যাক্তিবর্গের নাম উঠে এসেছে, আমরা কোন দিনও এদের নাম শুনি নাই। ইতিহাসও একদিন হয়ত তাঁদের নাম ভুলে যেত, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর এই অসমাপ্ত আত্মজীবনীর মাধ্যমে ইতিহাসে তাঁরা অমর হয়ে থাকবেন।

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়লাম। বইটা বারবার পড়তে গিয়ে অসংখ্যবার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছে। কি সহজ, সাবলীল ভাবে আমাদের ইতিহাসের অসাধারন সব ঘটনাগুলো তিনি লিখেছেন। এই প্রথম মনে হয় অনেক কাছ থেকে দেখলাম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী আর মাওলানা আকরাম খাঁকে। বঙ্গবন্ধুর কি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা, ভালবাসা আর বিস্ময় ছিল তাঁর প্রিয় নেতাদের প্রতি। তেমনি ভাবে মওলানা ভাসানী, শামসুল হকের সাথে একই সেলে মাসের পর মাস বন্দী জীবনের গল্প, সকল নির্যাতন সহ্য করে আপোষহীন এই তিন নেতার মুসলীম লীগের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ গঠনের গল্প। যে মানুষটি পাকিস্তান গঠনের নেশায় তার যৌবন কাটিয়েছেন, পাকিস্তান হবার পর সেই মানুষটিই স্বাধীন পাকিস্তানে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দী।

এই বইটা পড়ার পর থেকে একটা অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছে। এই মানুষগুলোর জীবনের পুরোটাই সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের । পরিবারের সাথে থাকতে পারেন নি, অর্থবিত্ত কিছুই ছিল না, তারপরও তিনি দেশের জন্য, মানুষের জন্য সব উজার করে দিয়েছেন। আর আমরা আজকে সামান্য ত্যাগ স্বীকার করতেও প্রস্তুত না।

যারা বাংলাদেশে রাজনীতি করেন, বাংলাদেশকে নিয়ে ভাবেন, আমার একান্ত নিবেদন আপনারা বইটা পড়বেন।আমার বিশ্বাস এই একটি বই আমাদের দেশের রাজনীতি পাল্টে দিতে পারে, আমাদের দেশকে বদলে দিতে পারে! আলেমদের নিয়ে এদেশের জাতীয় ইতিহাস রচনায় অসমাপ্ত আত্মজীবনী যুগে যুগে মাইল ফলক হিসাবে অমর হয়ে থাকবে।

লেখক:
কেন্দ্রিয় সদস্য সচিব
আলেম মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম ফোরাম