মাংসপিণ্ডের হাহুতাশ

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জুন ২৪ ২০১৯, ১৬:১৬

মাংসপিণ্ডের হাহুতাশ
– বনশ্রী বড়ুয়া

আজ তিনদিন ধরে বালতিতে পড়ে আছি।না-এটা ঠিক, বালতি নয়,পুরানো ময়লার ঝুড়ি কিংবা গামলা জাতীয় কিছু একটা হবে।সাধারণত প্রতিদিন আমার মতন যারা এখানে আসে, তাদেরকে সন্ধ্যা হলেই আয়া মাসি ওই দূরের ডোবার পাড়ে রেখে আসে,,,,
আজ মাসির খুব তাড়াহুড়ো ছিল,বাড়ি যেতে হবে।অনেকদিন বাড়ি যায় না,আজ ছুটি মিলতেই তাড়াহুড়ো করে বেড়িয়ে গেল।
দু’দিন পরেই দুর্গাপূজা।মায়ের আগমনে চারিদিকে সাজ সাজ রব,ঢাক ডোল বাজছে।মায়ের বোধন হবে,,সিঁদুর খেলবে,,নতুন জামা… লাল পেড়ে সাদা শাড়ি।আহারে কি সুন্দর লাগবে সবাইকে!!
আমার অবশ্য দু’দিন আগেই মরে যাবার কথা।সবার ক্ষেত্রে এমনই হয়।যখন রক্তের জড়াজড়িতে মাংসপিণ্ডটাকে নাড়ী কেটে আলাদা করে ময়লার ঝুঁড়িতে এনে রাখা হয় ফেলে দেবার জন্যে তখনও ডিবডিব করতে থাকে ওই মাংসপিণ্ডটার প্রাণ..
সাধারণত দু’এক ঘন্টা,মাঝেসাঝে তিন চার ঘন্টা পর্যন্ত প্রাণটা ছটফট করতে থাকে,ভাবে এই বুঝি আবার মায়ের কাছে চলে যাবে।আহা!! মা!!
যাওয়া হয়না।শেষতক ওই ডিবডিব টুকুন থেমে যায়।
কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার আমি এখনো মারা যায়নি।কই মাছের প্রাণ বলা যায় হয়ত!!আয়া মাসি ডোবার পাড়ে রেখে এলে হয়ত এতক্ষণে শিয়াল-কুকুরের পেটে চলে যেতাম।এই গামলাটাই পড়ে আছি,,কেউ দেখছে না।একটা মেয়ে এদিক ওদিক হাঁটছে..আমার খুব ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে ভয় দেখাতে।অবশ্য এটার একটা কারণ আছে।
আমাকে যখন আমার মায়ের কাছ থেকে আলাদা করা হচ্ছিল,তখন মায়ের সেকি চিৎকার!!পূর্ণতা পাবার আগে নাড়ী কেটে বুকের মানিককে আলাদা করার কি কষ্ট কেউ বুঝতে পারবে না…
ব্যথায় মা মরেই যাচ্ছিল।আর ওই মেয়েটা তখন বলছিল, ওই মাগী, রঙ করার সময় মনে আছিল না?
এহন ছিক্কুর পারছ ক্যা?
এই পাজি মেয়েটা জানে না আমার মায়ের কি কষ্ট, কি যন্ত্রনা…
মা আর চিৎকার করেনি।একদম চুপ হয়েছিল।
আমি তো জানি আমার মা চায়নি আমাকে আলাদা করতে।আচ্ছা তোমরাই বলো, কোন মা কি তার সন্তানকে নিজের থেকে আলাদা করতে পারে?
আমার মা তো আমাকে রোজ পেটে হাত দিয়ে আদর করতো,,কত কথা বলতো!!
এইতা সেদিন মা আমাকে বলছিল,,,জানিস, তোর বাবার ক’দিন পরেই রেজাল্ট হবে,তারপর একটা চাকুরী।এরপর তুই, আমি আর তোর বাবা…কি মজাই না হবে রে সোনা।আমরা সারাদিন দৌড়ঝাঁপ করে বেড়াবো।তোর জন্য লাল সোয়েটার বুনেছি,,,কি সুন্দর লাগবে তোকে!!
আমি চুপ করে মায়ের কথা গুলো শুনতাম।আমি আর আমার মা কত গল্পই না হতো আমাদের..মাঝেমধ্যে বাবা ফোন করলে মা লুকিয়ে ছাদে চলে যেত,ফোনটা পেটের কাছে রেখে বলতো,,তোমার বাবু কি বলছে শোন,,,বাবার সে কি খুশি!!আমরা তিনজনে গল্প করতাম।মা ছাদে,বাবা ফোনের ওপাশে আর আমি??মায়ের পেটে গুটিসুটি মেরে থাকতাম।
অপেক্ষায় থাকতাম কখন বাবা আসবে…
আমার মা’কে নিয়ে যাওয়া হয়েছে গতকাল।
ইসস…যদি যাওয়ার সময় মা’কে দেখতে পেতাম!!
মায়ের সেই লাবণ্য প্রভা মুখটা নিশ্চয়ই শুকিয়ে গেছে।
অবশ্য যাওয়ারই কথা..
সেদিন দাদু খুব রাগারাগি করেছিল মায়ের সাথে।কেন মা কাউকে না জানিয়ে বাবাকে বিয়ে করেছিল। চালচুলোহীন ওই মানুষটাকে ছেড়ে আসার জন্য আমার মাকে অনেক জোর করেছিল।মা রাজি হয়নি।
সে রাতেই বাবা মাকে ফোন করে বলল, দাদুর সাথে দেখা করবে,মাকে নিয়ে যাবে বাবার কাছে।
সকালের ট্রেনেই আসছে…
সে রাতে মা একটুও ঘুমায়নি।সারারাত আমার সাথে কথা বলেছে।কত স্বপ্ন মায়ের..
আমার মনে হচ্ছিল, পৃথিবীতে এমন মায়ের গর্ভে আসা সত্যি পরম ভাগ্যের…নিজেকে বড্ড সৌভাগ্যশালী মনে হচ্ছিল।
সারারাত না ঘুমিয়ে শেষ রাতের দিকে মা ঘুমিয়ে পড়ল।
যখন ঘুম ভাঙলো তখন অনেক বেলা হয়ে গেছে।দাদুবাড়ির চারদিকে চিৎকার … চেঁচামেচি…. হইহুল্লোড়!!
দিদিমার কান্নার শব্দ কেউ থামতে পারছে না।মায়ের ঘরটা ছিল দোতলায়।কোনমতে উঠে গেলেন বারান্দায়….।নীচে কি হচ্ছে তা দেখতে চাইছিল।
একটা এম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে।মা কিছুই বুঝতে পারছে না, দৌড়ে নেমে এলো নীচের ঘরে।সারাঘর ভর্তি লোকজন। বাবার আজকে আসার কথা মনে পড়তেই
দাদু’কে খুঁজতে লাগল।দাদু দাঁড়িয়ে ছিলেন সিঁড়ি ঘরের কোণায়…
বাবা,আজ তো অনির্বাণের আসার কথা,ও কোথায়??
আসেনি এখনো??
হঠাৎই দাদুই চিৎকারে কেঁপে উঠল পুরো বাড়ি।না চিৎকার নয় এ যে বাঁধভাঙা কান্নার জোয়ার।মাকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না!!
মা তখনো বলেই চলছে, অনির্বাণ কই বাবা…অনির্বাণ কই…
হ্যাঁ, আমার বাবা ট্রেন থেকে নেমে বাড়ি ফেরার পথেই রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়…এম্বুলেন্সে বাবারই লাশ।
মা দেখেনি বাবাকে..দৌড়ে এম্বুলেন্সের কাছে যেতে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গিয়েছিল।তাতে করেই মায়ের ব্লিডিং শুরু হয়ে গেছে..
হাসপাতালে নিয়া আসা হয় মাকে।দাদু জামাইয়ের সৎকার না করেই ছুটেছেন মেয়ের পিছুপিছু। ডাক্তার অবশ্য বলে দিয়েছে মাকে বাঁচাতে হলে এই মূহুর্তেই এবরশন করাতে হবে…অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে মা আর বাচ্চা দু’টিকে বাঁচানো সম্ভব নয়।
দাদু তার নিজের সন্তানকে বাঁচাতে আমাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অবশ্য এতে দাদুর দোষ ছিল না।প্রত্যেকেই তার নিজের সন্তানকে বাঁচাতে চায়…
কিন্তু আমার মা!! স্বামী, সন্তান দুজনকে হারিয়ে কি করে বাঁচবে?মা,তোমাদের ঈশ্বর এত পঁচা কেন?কেন এমন করলেন?
আজ নাকি দেবী বোধন হবে, সবাই কত আনন্দ করছে।আর আমি, তুমি, বাবা কত দূরে….কেন এমন শাস্তি পেলাম মা…
মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।নিশ্চয়ই মা খুব কাঁদছে।আচ্ছা,আমি মরে যাচ্ছি না কেন?মরে গেলে আমি আত্মা হয়ে মায়ের কাছে চলে যেতাম…।ইচ্ছে করছে মায়ের কোলে গিয়ে বসতে।বাবার গায়ের গন্ধ নিতে ইচ্ছে করছে….
ইসস!বাবাকে যদি একবার দেখতাম!
মরে গেলে হয়ত বাবার সাথে আমার দেখা হয়ে যেতো অন্য এক জগতে… সেখানে আমি লাল সোয়েটারটা পড়ে বাবার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম মায়ের জন্য…
আমার ডিবডিব কমে আসছে ধীরে ধীরে…. যেকোনো মূহুর্তে আমি হয়ত বাবার কাছে চলে যাবো।অবশ্য যাবার আগে একটা কাজ করে যেতে হবে।মেয়েটাকে একটা শিক্ষা দিয়ে যেতে হবে।
ওই তো আসছে মেয়েটা!পূজোর ছুটিতে প্রায় অনেকেই বাড়ি চলে গেছে।মেয়েটা একা….এবার ওকে ভয় দেখানোর পালা,কঠিন ভয়!!
এ জীবনে যেন আর কোন মাকে বাজে কথা না বলে..
মাংসপিন্ডটা হঠাৎ কথা বলছে…আঁয়, কাঁছে আঁয়…
আঁমি….তোঁকে নিঁয়ে যাঁবো…আঁয়…. আঁয়….আঁয়….
হি হি হি…..হা হা হা…..হি হি হি…..