মহিমান্বিত শবে কদর ও এতেকাফ

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মে ০৪ ২০২১, ১৩:২৩

মুহাম্মদ ইমদাদুল হক ফয়েজী: মুমিন জীবনে অত্যন্ত তাৎপর্যমন্ডিত ও ফজিলতপূর্ণ মাস রমজান। বিশেষত এ মাসের শেষ দশকটি অসীম ফজিলতময়। হাদিসের বর্ণনা মতে, শেষ দশকের যে কোনও বেজোড় রাতে রয়েছে মহিমান্বিত লাইলাতুলকদর। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান কর।’ (বোখারী : ২০১৭)

কোরআন হাদিসে সুস্পষ্টভাবে এ রাতের মহিমা ও ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় আমি কোরআন নাযিল করেছি লাইলাতুল ক্বদরে।’ (সূরা কদর : ১) মুফাসসিরগণ বলেন, লাওহে মাহফুজ থেকে দুনিয়ার আকাশে পূর্ণ কোরআন একত্রে নাজিল করা হয়েছে কদরের রাতে। অতঃপর সেখান থেকে সুদীর্ঘ ২৩ বছরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে মানবজীবনের প্রয়োজনের আলোকে ওহি আকারে প্রেরণ করা হয়েছে। কোরআন কারিমে এরাতকে এক হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হাজার মাস থেকেও শ্রেষ্ঠ রজনী লাইলাতুল কদর।’ (সূরা কদর : ৩)

ক্যালকুলেসন করলে দেখা যায়, এক হাজার মাসে ‘তিরাশি বছর চার মাস’ হয়। আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয়, ওই একটি মাত্র রাত ইবাদতে ব্যয় করতে পারলে তিরাশি বছর চারমাসেরও অধিক সময় ইবাদতের পুণ্য লাভ হবে।

রমজান ইবাদতের বসন্তকাল। অবারিত পুণ্যে চাষের উর্বর মওসুম। এমাসে প্রতিটি নেক আমলের প্রতিদান অন্যান্য মাসের তুলনায় অত্যধিক। রমজানে একটি নফল ইবাদত অন্য মাসের ফরজ ইবাদত এবং একটি ফরজ ইবাদত অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ ইবাদতের পুণ্য সমমান বলে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। ইবাদত-বন্দেগিতে অধিক মনোযোগী হয়ে মহান প্রভুর কাছে নিজেদের সঁপে দেয়ার, কাকুতি-মিনতি করে যাবতীয় অপরাধ-দুর্বলতা স্বীকার করে করে তার ক্ষমা, ভালবাসা ও নৈকট্য লাভের মাহেন্দ্রক্ষণ রমজান। তাই আমরা রবের ইবাদতে আত্মনিয়োগ করব, পুণ্যকাজ করব, মানবতার কল্যাণে এগিয়ে যাব। যাবতীয় পাপাচার-অনাচার থেকে বিরত থাকব। প্রতিটি রাতে সাধ্যানুযায়ী কিছু দান করার চেষ্টা করব। বিশেষত শেষ দশকের একটি রাতও যাতে বাদ না পড়ে। কোনো কারণে প্রতিদিন দানগ্রহীতা না পাওয়া গেলে বিকল্প হিসেবে আমরা একটি পাত্রে প্রতি রাত দানের কড়ি রেখে দেব এবং পরবর্তীতে উপযুক্ত এক বা অধিক দানগ্রহীতার হাতে পৌঁছে দেব। এতে করে আশা করা যায়, আমাদের কোনও একটি রাতের দান শবে কদরে হয়ে যাবে এবং এরাতে দান করার অসীম পুণ্য আমাদের আমলনামায় জমা হয়ে যাবে ইনশা-আল্লাহ।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসে ঈমানের সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পুণ্য লাভের উদ্দেশ্যে সিয়াম পালন করবে তার পূর্বের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। আর যে ব্যক্তি কদরের রাতে ঈমানসহ আল্লাহর সন্তষ্টি ও পুণ্য লাভের লক্ষ্যে ইবাদত করবে তার পূর্বের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ (বোখারী : ১৬৬৬)

আমরা অনেকেই মনে করি লাইলাতুল কদর সাতাশ রমজানের রাতে হয়ে থাকে। এধারণাটি আমাদের দেশে অধিক প্রচলিত। অথচ তা নির্দিষ্ট নয়। সুনানু আবু দাউদের একটি হাদিসে ২৭ রমজানের কথা উল্লেখ থাকলেও অধিকাংশ হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী শবে কদর রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতসমূহের কোনও এক রাতে হয়ে থাকে।

রমজানের শেষ দশকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর গুরুত্বপূর্ণ আরও একটি আমল হচ্ছে এতেকাফ। যা হিজরতের পর কোনও রমজানে তিনি বাদ দেননি। উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় হিজরতের পর ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত প্রতি রমজানে শেষ দশক এতেকাফ করেছেন এবং তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর পত্মীগণ এতেকাফ করেছেন।’ (বোখারী, মুসলিম) অপর বর্ণনায় এসেছে তিনি প্রতি বছর ১০ দিন এতেকাফ করতেন এবং ইন্তেকালের বছর ২০ দিন এতেকাফ করছেন।

পুরুষ এতেকাফ করবে যে কোনও জামে মসজিদে। মহিলা স্বীয় গৃহের নির্জন স্থানে এতেকাফ করতে পারবে। হাদিসের ভাষ্যমতে, এতেকাফকারী ব্যক্তি যেহেতু পার্থিব সকল বিষয় থেকে বিমুখ হয়ে সর্বদা মসজিদে, মহান প্রভুর দরবারে অবস্থান করেন, ফলে তার প্রতিটি মূহুর্ত ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়। পাশাপাশি যে কোনও ইবাদত-বন্দেগি সম্পাদন করার পথ সুগম হয়। বিশেষত লাইলাতুল কদর লাভ করার সৌভাগ্য অনায়াসে অর্জন হয়ে যায়।

এতেকাফের ফজিলত সম্পর্কে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘রমজানের শেষ দশক এতেকাফের সওয়াব হচ্ছে, দুটি হজ্জ ও উমরাহ সমপরিমাণ।’ (বায়হাকি) নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একদিন ইতিকাফ করল, আল্লাহ পাক তার ও দোজখের মধ্যখানে এমন তিনটি পরিখা তৈরি করে দেবেন, যার একটি থেকে অপরটির দূরত্ব হবে পূর্ব ও পশ্চিমের দূরত্ব থেকেও বেশি।’ (তিরমিজি)।

আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, ‘এতেকাফের মাহাত্ম্য হলো, আল্লাহর সঙ্গে রুহ ও অন্তরের সম্পর্ক স্থাপন করা। এতেকাফকারীর দৃষ্টান্ত ওই ব্যক্তির মতো, যে কারো দরবারে হাজির হয়ে এ কথা বলে যে, আমার দরখাস্ত কবুল না করা পর্যন্ত আমি ফিরবো না।’ এতেকাফ মহান প্রভুর ভালোবাসা ও সান্নিধ্য লাভের সোপান। নিজেকে পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে পবিত্র জীবন গঠনের অবারিত সুযোগ রয়েছে এতেকাফে। যাবতীয় পাপকাজ থেকে মুক্ত থেকে একনিষ্ঠভাবে খোদাভীরু-মুত্তাকি হিসেবে যে কেউ নিজেকে গড়ে তুলার ব্যতিক্রমধর্মী অনুশীলন হচ্ছে এতেকাফ। দরবারে এলাহিতে নিজের ত্রুটি-বিচ্যুতি, অন্যায়-অপরাধের স্বীকারোক্তি দিয়ে, নিরবিচ্ছিন্নভাবে ইবাদত-বন্দেগি করে প্রভুর প্রিয়জন হওয়ার অবারিত সুযোগ রয়েছে এতেকাফে।

অশেষ ফজিলতপূর্ণ লাইলাতুল কদর এবং এতেকাফের জন্য আমাদের এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। আল্লাহ তায়াল বলেন, ‘যারা আমার পথে, সাধনায় আত্মনিয়োগ করবে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথে রয়েছেন।’ (সুরা আনকাবুত : ৬৯)।

আসুন, পার্থিব সকল কাজকর্ম আমরা দ্বিতীয় দশকে শেষ করে নিই। শেষ দশকটি প্রভুর সাথে একান্তে, কিছু ভাব বিনিময় এবং ইবাদত করে তাঁর প্রেম আর নৈকট্য অর্জনে মনোনিবেশ করি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন।