বিজ্ঞানবাদ-এর লক্ষণ: পশ্চিমা অ্যাকাডেমিকের চোখে

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

মার্চ ১০ ২০২১, ০১:২১

অনেকেই আমার কাছে জানতে চান, কেউ বিজ্ঞানবাদে আক্রান্ত কি-না কীভাবে বুঝবো? কীভাবে বিজ্ঞানের ক্ষতি করা থেকে তাদের রুখবো? এই প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী। তাই এর উত্তরটাও জানা থাকা দরকার। এই উত্তরের খোঁজে চলুন যাওয়া যাক পশ্চিমা অ্যাকাডেমিয়ায়।

শুরুতেই বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানবাদের বুনিয়াদি তফাৎ বুঝে নিই। বিজ্ঞান হলো বস্তুজগত সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের একটি সীমিত মাধ্যম। যেখানে কিছু পূর্বানুমান (presuppositions) এর উপর দাঁড়িয়ে বস্তুজগত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং (সচরাচর) আরোহ যুক্তি কাজে লাগিয়ে একটি আনুমানিক (tentative/provisional) সিদ্ধান্ত দেয়া হয়।

অন্যদিকে বিজ্ঞানবাদ হলো একটি স্ববিরোধী জ্ঞানতাত্ত্বিক (দার্শনিক) মতাদর্শ। এটি মোটেই বৈজ্ঞানিক নয়, বরং অনেকটা ছদ্মধর্মগত অবস্থান। এতে দীক্ষিতরা বিশ্বাস করে সত্য জানার একমাত্র নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হলো বিজ্ঞান। অথচ এই বিশ্বাস নিজেই বিজ্ঞানের বাইরে অবস্থিত, যা বিজ্ঞান দিয়ে যাচাই করা সম্ভব না। তাই অ্যাকাডেমিকরা বলেন-বিজ্ঞানবাদ একটি কুযুক্তিপ্রসূত মতাদর্শ, যা বিজ্ঞানের জন্য ক্ষতিকর। পদার্থবিদ আয়ান হাচিসন আমাদেরকে সতর্ক করে বলেন:

❝বিজ্ঞানবাদী চেতনা বিজ্ঞানের কোনো উপকারে তো আসেই না, বরং বিজ্ঞানের ক্ষতি করে বসে। বিজ্ঞানবাদের ছোবলে অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তিক মহল থেকে প্রতিরোধমূলক ও আক্রমণাত্মক প্রতিক্রিয়ার জন্ম নেয়। বিজ্ঞানবাদের স্বীয় অজ্ঞতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎপীড়নের ফসল এটা। বিজ্ঞানকে কলঙ্কিত করে তোলে এই বিজ্ঞানবাদ।❞ (মনোপলাইজিং নলেজ)

বিজ্ঞানবাদ সংক্রান্ত আলোচনায় বিভিন্ন জার্নাল ও বইপত্রে পুরস্কার বিজয়ী (নিধর্মী) অধ্যাপিকা ড. সুজান হ্যাক এর নাম প্রায়ই আসে। তিনি অক্সফোর্ডের স্নাতক, আর ক্যামব্রিজে পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন। সম্ভবত তিনিই প্রথম প্রায়োগিক ক্ষেত্রে বিজ্ঞানবাদের লক্ষণগুলো একাট্টা করেছেন। আমি প্রথম তার কাজ সম্পর্কে জানতে পারি (নিধর্মী) অধ্যাপক ও দার্শনিক মাসিমো পিগলিউশির প্রবন্ধে।

তারপর ড. সুজানের কাজগুলো ঘেঁটে বুঝতে পারি তিনি আসলেই চমৎকার একটি প্রায়োগিক কাঠামো দাঁড় করিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে দেয়া তার লেকচার নিয়ে সাজানো বই Sceintism and It’s Discontents এবং লোগস অ্যান্ড এপিস্টেম জার্নালে প্রকাশিত তার পিয়ার রিভিউড পেপার দুইটি মিলিয়ে বিজ্ঞানবাদের লক্ষণগুলো সাজানো হয়েছে। তাত্ত্বিক নয়, বরং আমজনতার মাঝে কীভাবে বিজ্ঞানবাদ ছড়িয়ে আছে তা বুঝার জন্য এই লক্ষণগুলো আমাদের কাজে লাগাতে হবে।

লক্ষনসমূহ:

১. কোনো কিছুর সাথে ‘বিজ্ঞানসম্মত’, ‘বৈজ্ঞানিক’ শব্দ শুনলেই বিনাবাক্যব্যয়ে গ্রহণ করা। বিজ্ঞানীরা যাই বলুক না কেন, সেটাকেই চোখ বুঝে মেনে নেয়া।

২. ‘বিজ্ঞান’, ‘বৈজ্ঞানিক’ ইত্যাদি শব্দগুলোকে ভক্তির সাথে ব্যবহার করা। জ্ঞানের সার্বজনীন উৎস মনে করে প্রশংসামুখর হওয়া। ভেবে বসা বিজ্ঞান মানেই পোক্ত, নির্ভরযোগ্য ও ভালো জিনিস।

৩. নিখাদ বিজ্ঞান আর আপাত/ছদ্মবিজ্ঞানের মাঝে স্পষ্ট বিভাজন রেখা আছে বলে জোর দেয়া।

৪. এটা মনে করা যে বিজ্ঞানের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হলো এর অভিনব কর্মপদ্ধতি। ভেবে বসা জগত অনুসন্ধানের একেবারে ইউনিক পন্থা আছে বিজ্ঞানের হাতের মুঠোয়।

৫. বিজ্ঞান দিয়ে এমন কিছুর উত্তর খুঁজার চেষ্টা করা যা বিজ্ঞানের আওতার বাইরে৷

৬. বিজ্ঞানের ফলাফল ও ছাতার আড়ালে থেকে ভান করা যে তারা বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানকে উৎসাহিত করতে চাচ্ছে, আদতে তারা গুরুত্বের সাথে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে অপারগ।

৭. প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বাইরে জ্ঞানের যে শাখাগুলো রয়েছে সেগুলোকে গুরুত্ব না দেয়া। এমনকি কেউ কেউ সেগুলোকে জ্ঞানের শাখা হিসেবে স্বীকারই করতে চায় না। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বাইরে থাকা জ্ঞানের শাখাগুলোতে হামলে পড়ে সেগুলোকে বৈজ্ঞানিক কিছু দ্বারা প্রতিস্থাপিত করে ফেলতে চায়।

এসব লক্ষণ কারো মাঝে দেখলে তাকে সহানুভূতির সাথে বিজ্ঞানের সঠিক অনুধাবনের পথে আসার দাওয়াত দিতে হবে। বিজ্ঞানবাদ নির্মূল করে বিজ্ঞানমনস্কতা ও বিজ্ঞানচেতনার প্রসারে দেশকে এগিয়ে নিতে আমাদের কাজ করতে হবে একসাথে।

লেখক: ডা. রাফান আহমেদ